গুগল যেন আমাদের প্রথম ডাক্তার হয়ে উঠেছে। অসুখ হলেই রোগের লক্ষণগুলো গুগল করার প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই রোগের লক্ষণ গুগল করা হয়ে উঠতে পারে বিপদের কারণ। এ রকম ঘটেছিল ইংরেজ লেখক জেরোম কে জেরোমের বিখ্যাত বই ‘থ্রি মেন ইন আ বোট’-এ। যদিও বইটি লেখা হয়েছে ১৮৮৯ সালে। তখন তো ইন্টারনেট ছিল না। ছিল বইপত্র। মনে কোনো প্রশ্ন এলে সোজা লাইব্রেরিতে চলে যেত মানুষ। বই ঘেঁটে বের করত উত্তর। এখন আমরা রোগের লক্ষণ গুগল করে মিলিয়ে দেখি। কিন্তু আগে মানুষ লাইব্রেরিতে গিয়ে ডাক্তারি বই বের করে মিলিয়ে দেখত তার কী রোগ হয়েছে। রম্যলেখক জেরোম কে জেরোমও ছিলেন সেই দলে।
জেরোম কে জেরোম ‘থ্রি মেন ইন আ বোট’ বইটি মূলত জর্জ, উইলিয়াম স্যামুয়েল হ্যারিস, লেখক এবং মন্টমরেন্সি—এই চারজনের ভ্রমণকাহিনি। আড্ডা চলছিল লেখকের ঘরে। তিনজন মিলে আলাপ করছিলেন (কারণ, মন্টমরেন্সি লেখকের কুকুরের নাম) কার শরীরে অবস্থা কতটা খারাপ। কে কতটা কঠিন রোগে আক্রান্ত। রোগের গল্প করতে করতে তাদের খুব খারাপ আর নার্ভাস লাগছিল। হ্যারিসের অস্থিরতা কাজ করছিল। জর্জের খুব মাথা ঘুরছিল। আর জেরোম ভাবছিলেন, তাঁর যকৃত কাজ করছে না। কারণ, আড্ডার আগ দিয়ে যকৃত রোগের ওষুধের বিজ্ঞাপনে বিস্তারিত লক্ষণগুলো পড়েছিলেন তিনি। একদিন ব্রিটিশ মিউজিয়মে চলে গেলেন লেখক, চিকিৎসাবিষয়ক বই পড়ার জন্য। এ সময় তাঁর সামান্য জ্বর ছিল। রোগের পূর্বলক্ষণবিষয়ক একটা বই নামিয়ে বিবরণ পড়া শুরু করলেন। বিরাট ধাক্কা খেলেন শুরুতেই। জেরোম দেখলেন, বইয়ে যত রোগের বর্ণনা আছে, সব রোগের প্রাথমিক লক্ষণই আছে তাঁর মধ্যে।
কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকলেন তিনি। পরে হতাশ হয়ে পাতা উল্টে টাইফয়েডের উপসর্গ পড়লেন। আবিষ্কার করলেন, মাসখানেক আগে তাঁর টাইফয়েড জ্বরও ছিল! এরপর পড়তে পড়তে জেরোম নিশ্চিত হয়ে গেলেন, নেফ্রাইটিস, কলেরা, ডিপথেরিয়া সব রোগই জীবনের কোনো না কোনো সময় তাঁর ছিল। এভাবে বই ঘেঁটে ঘেঁটে তিনি টের পেলেন, ২৬ বছর বয়সের মধ্যে একটি রোগ ছাড়া সব রোগেই আক্রান্ত হয়েছেন তিনি। সেই রোগটি হলো ‘চাকরানির হাঁটুফোলা রোগ’! মোটামুটি সুস্থ অবস্থায় লাইব্রেরিতে আসা জোরোম কে জেরোম যখন বই পড়ে বের হলেন, তখন তিনি বেশ অসুস্থ বোধ করছিলেন। এত রোগ নিয়ে তিনি বেঁচে আছেন কীভাবে? দ্রুত চলে গেলেন হাসপাতালে।
প্রাণ হাতে নিয়ে কোনোক্রমে গেলেন হাসপাতালের ডাক্তার বন্ধুর কাছে। সব দেখেশুনে ডাক্তার তাঁকে দিলেন একটা প্রেসক্রিপশন। সেটা না দেখেই ফার্মেসিতে চলে গেলেন জেরোম। ফার্মেসির লোক জানালেন, তাঁর কাছে এই রোগের কোনো ওষুধ নেই। কারণ, জেরোমের আসলে কোনো রোগই নেই। সে জন্য বলছি, সামান্য কিছুতেই নিজের রোগের লক্ষণ গুগলকে জিজ্ঞেস করে চিন্তিত হওয়া যাবে না। লক্ষণগুলো গুগল করতেই পারো, কিন্তু সেটা বিশ্বাস করে মানসিকভাবে ভেঙে পড়া কোনো কাজের কথা না। সবার আগে নিতে হবে চিকিৎসকের পরামর্শ।
‘থ্রি মেন ইন আ বোট’ বইটি ‘ত্রিরত্নের নৌবিহার’ নামে বাংলায় অনুবাদ করেছেন এ টি এম শামসুদ্দীন। অনেক আগে সেবা প্রকাশনী থেকে বইটি বেরিয়েছে। বাংলা সংস্করণটিও দারুণ জনপ্রিয়। আজই পড়ে ফেলতে পারো।
‘থ্রি মেন ইন আ বোট’ পড়েছেন কি না জানি না, তবে সুইডিশ ডাক্তার হেনরিক ওয়াইডগ্রিনের মতো একই রোগের লক্ষণ গুগল কোরো না। ডাক্তারির পাশাপাশি গানও করেন হেনরিক ওয়াইডগ্রিন। গায়ক হিসেবে সুইডেনে তিনি জনপ্রিয়। এ ছাড়া করেন টিভি শো। মিডিয়া ব্যক্তিত্ব হিসেবে ভালোভাবেই পরিচিত তিনি। ‘লাস্ট কল’ নামে একটা গানের দলও আছে তাঁর। সুইডিশ ও ইংরেজি ভাষায় গান করে লাস্ট কল।। মজার মজার লিরিকের জন্য তাঁদের গান বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়। ২০১৯ সালে মজার একটি অ্যালবাম বের করেছেন তাঁরা। নাম ‘মেডিকেল মেলোডিস অ্যান্ড সার্জিক্যাল সং’। এই অ্যালবামেরই একটি গান ‘নেভার গুগল ইয়োর সিম্পটমস’।
গানের কথাগুলো অনেকটা এ রকম—গায়কের বাবা মৃত্যুপথযাত্রী। একদিন সন্ধ্যায় তিনি তাঁর সন্তানকে শেষবারের মতো উপদেশ দিচ্ছেন। বাবা বললেন, ‘আমি শিগগিরই মারা যাব। শেষযাত্রার আগে তোমাকে একটা উপদেশ দিয়ে যাই। “কখনো তোমার রোগের লক্ষণগুলো গুগল কোরো না’। যদি করো, তাহলে তোমার ভয়ংকর সব রোগ ধরা পড়বে।’ এই গানে আছে, যদি গুগল করো ‘কাশি আর রোগনির্ণয়’, তবে আবিষ্কার তোমার যক্ষ্মা হয়েছে। যদি গুগল করো “জ্বর এবং লালচে” তবে তোমার ইবোলা হবে। যদি গুগল করো ‘আমার নাক দিয়ে পানি পড়ছে’, গুগল হয়তো বলবে, এই নাকের পানি সেরিব্রো স্পাইনাল ফ্লুইড, তোমার মস্তিষ্ক গলে বেরোচ্ছে! যদি তুমি “চুলকানি এবং কী হতে পারে’ লিখে গুগল করো, তবে তোমার অ্যানাফিল্যাকটিক শক বা সাইকোসিস হবে। মোটকথা, গুগলে দেখা রোগের উপসর্গ মিলে গেলেই ভেবো না ওই রোগটাই বাসা বেঁধেছে তোমার শরীরে। আর গুগলে পাওয়া পরামর্শ মেনে ভুলেও চিকিৎসা করতে যেয়ো না। বিপদে পড়ে যেতে পারো। অসুখ হলে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের পরামর্শ নেবে।
মজার গানটির মিউজিক ভিডিও ইউটিউবে দেখা যাবে।