আমরা হাঁচি দিই কেন, চোখ খোলা রেখে হাঁচি দিলে কী বিপদ হবে
আমরা সবাই জীবনে অনেকবার হাঁচি দিয়েছি। কখনো কি মাথায় এই প্রশ্নটি এসেছে, কেন আমরা হাঁচি দিই? কিংবা হাঁচি দিলে কেন চোখ বন্ধ হয়ে আসে? ঠান্ডা লাগলে কিংবা ধুলাবালুর মধ্যে গেলে অনেকেরই হাঁচি আসে। কিন্তু এই ছোট্ট কাজটির পেছনের কারণ আসলে কী? হাঁচি দেওয়া কি শুধুই একটি বিরক্তিকর অভ্যাস, নাকি এর পেছনে কোনো গুরুত্বপূর্ণ কারণ আছে? হাঁচি দেওয়ার কি কোনো উপকারিতা আছে, নাকি ক্ষতিকর। এ সব প্রশ্নের উত্তর ও হাঁচি নিয়ে আরও কিছু মজার তথ্য নিয়ে এই লেখা।
হাঁচি হলো শরীরের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে নাক পরিষ্কার হয়। যখন আমরা নিশ্বাস নিই, তখন বাতাসের সঙ্গে ধুলাবালু, পরাগরেণু বা অন্যান্য ক্ষতিকর কণা আমাদের নাকের ভেতরে প্রবেশ করে। আমাদের নাকের ভেতরে অসংখ্য সূক্ষ্ম লোম এবং সংবেদনশীল ত্বক থাকে। যা এই ক্ষতিকর কণিকাকে আটকে রাখার চেষ্টা করে। এগুলো প্রাথমিক প্রতিরক্ষা হিসেবে কাজ করে। কিন্তু যখন এই কণা অতিরিক্ত বেড়ে যায়, তখন আমাদের নাকের স্নায়ু উদ্দীপিত হয়। এই উদ্দীপনা মস্তিষ্কে পৌঁছালে, মস্তিষ্ক একটি স্বয়ংক্রিয় প্রতিক্রিয়া হিসেবে শ্বাসতন্ত্রে হাঁচির নির্দেশনা পাঠায়।
হাঁচির সময় আমাদের ফুসফুস থেকে প্রচণ্ড বেগে বাতাস বের হয়ে আসে। যার ফলে নাকের ভেতরের সব ক্ষতিকর পদার্থ বের হয়ে যায়। ব্যাপারটা কিছুটা এমন, গায়ে কোনো পোকা বসলে আমাদের ত্বকের সংবেদনশীল কোষগুলো সেটা টের পায়। যা আমাদের মস্তিষ্ককে একটি সংকেত পাঠায়। এই সংকেতে আমরা বুঝি শরীরের এখানে কিছু একটা আছে। আমাদের শরীরের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হলো সেই পোকাকে দূরে ঠেলে দেওয়া। তাই আমরা হাত দিয়ে পোকাকে ফেলে দেই নিজেদের সুরক্ষার জন্য। এভাবে হাঁচি আমাদের শরীরের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করে।
হাঁচি শরীরে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ২০১২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভেনিয়ার গবেষকরা আবিষ্কার করেছিলেন, হাঁচি নাকের কার্যক্রম নতুন করে শুরু তথা রিসেট করার প্রাকৃতিক উপায়। গবেষণায় দেখা গেছে, নাকের ভিতরে টিস্যুতে আস্তরণ তৈরি করে সিলিয়া নামের কোষ। হাঁচি দিলে এই আস্তরণ বেরিয়ে যায়, নতুন আস্তরণ তৈরির কাজ আবার শুরু হয়। গবেষকেরা আরও দেখেছেন, যাঁর সাইনোসাইটিসের মতো দীর্ঘস্থায়ী নাকের সমস্যা রয়েছে, তাঁদের ওপর হাঁচি সাধারণভাবে কাজ করে না। অন্যদের ক্ষেত্রে হাঁচি নতুন করে নাকের আস্তরণ তৈরির প্রক্রিয়া শুরু করলেও সাইনোসাইটিস আক্রান্তদের ক্ষেত্রে প্রক্রিয়াটি বাধাগ্রস্ত হয়।
এখন আসি চোখ বন্ধ হওয়ার প্রসঙ্গে। হাঁচির সময় চোখ বন্ধ হয়ে যাওয়া একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। অনেকে ভাবেন হাঁচির সময় চোখ খোলা রাখলে চোখ বের হয়ে যাবে। কিন্তু এটি ভুল ধারণা। হাঁচি বের হওয়ার বাতাস প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ১০০ মাইল বেগে ছুটতে পারে। তুলনা করলে দেখা যায়, কাশির বেগ সাধারণত প্রতি ঘণ্টায় ৫০ মাইলের কম হয়। অনেকে একদিনে অনেকবার হাঁচি দেন। কিন্তু দিনে সাধারণত চারবার হাঁচি দেওয়া স্বাভাবিক। কখনো কখনো আলোতে আসার সঙ্গে সঙ্গে হাঁচি আসে। এই ঘটনাকে ফোটিক স্নিজ রিফ্লেক্স বলে। অর্থাৎ, আলোর সংস্পর্শে এলে অনেক মানুষের হাঁচি আসে। তবে সবার ক্ষেত্রে এমন হয় না। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথের তথ্য মতে, বিশ্বের প্রায় ৩৫ শতাংশ মানুষের এই ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়। যাদের অতিরিক্ত হাঁচি আসে, তারা এটি পরীক্ষা করে দেখতে পারো। জিহ্বাকে তালুতে চেপে ধরলে হাঁচি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তবে এটি কতটা কার্যকরী, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। অনেকে মনে করেন, এটি চাপের কারণে হয়। কিন্তু আসলে এটি মস্তিষ্কের একটি প্রতিক্রিয়া। একবার চেষ্টা করে দেখতে পারো।
মানুষের মতো অন্যান্য প্রাণীও হাঁচি দেয়। তবে ইগুয়ানা এবং অন্যান্য কিছু সরীসৃপের হাঁচি অনেক বেশি হয়। এটি এদের খাবারে থাকা অতিরিক্ত লবণের কারণে। হাঁচির মাধ্যমে এরা এই অতিরিক্ত লবণ শরীর থেকে বের করে দেয়।
হাঁচি নিয়ে বিশ্বরেকর্ড রয়েছে। ডোনা গ্রিফিথস নামে একজন ব্রিটিশ নারীর দীর্ঘতম হাঁচির বিশ্ব রেকর্ড রয়েছে। তিনি ধারাবাহিকভাবে ৯৭৬ দিন, অর্থাৎ প্রায় দুই বছর ধরে হাঁচি দিয়েছিলেন। ১৯৮১ সালের ১৩ জানুয়ারি শুরু হওয়া এই হাঁচি ১৯৮৩ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর হঠাৎ থেমে যায়। কেন তিনি এতদিন হাঁচি দিয়েছিলেন, তার সঠিক কারণ জানা যায়নি। শুধু জানা যায়, প্রথম এক বছরে তিনি প্রায় এক মিলিয়নবার হাঁচি দিয়েছিলেন। চীনের ই ইয়াং নামের এক ব্যক্তি বিশ্বের সবচেয়ে জোরে হাঁচি দেওয়ার রেকর্ড গড়েছেন। তাঁর হাঁচির শব্দ ১৭৬ ডেসিবেল পর্যন্ত উঠেছিল। তুলনা করলে বোঝা যায়, একটি এয়ারহর্নের শব্দ ১২৯ ডেসিবেল। অর্থাৎ, ই ইয়াংয়ের হাঁচি এত জোরে যে তাতে কাচও ভেঙে যেতে পারে।
হাঁচির সময় আমাদের নাক থেকে পানি এবং বাতাস জোরে বের হয়ে আসে। এই বাতাসের সঙ্গে ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়ার মতো জীবাণু থাকতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে এই কণাগুলোর আকার সাধারণত ০.৫ থেকে ৫ মাইক্রোমিটারের মধ্যে হয়। একটি হাঁচি ৪০ হাজার পর্যন্ত এমন কণা বের করতে পারে। যা অন্যকে সর্দি বা ফ্লু সংক্রমিত করতে পারে। ২০২০ সালে করা একটি গবেষণায় দেখা গেছে, হাঁচির ফলে উৎপন্ন কণাগুলো আট মিটার পর্যন্ত দূরত্বে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এ জন্য হাঁচি দেওয়ার সময় শিষ্টাচার মেনে চলা উচিত। যেমন, হাঁচির সময় মুখ বা নাক টিস্যু বা কাপড় দিয়ে ঢেকে নেওয়া, শব্দ যতটা সম্ভব কম করার চেষ্টা করা, হাঁচির পর হাত ধোয়া; হাঁচির পর অন্যদের কাছে ক্ষমা চাওয়া। হাতের তালু দিয়ে মুখ ঢাকা ঠিক নয়, কারণ, হাতের মাধ্যমে জীবাণু অন্যের শরীরে বা বস্তুতে সহজেই ছড়িয়ে পড়তে পারে। তাই এর বদলে হাতের কনুই ব্যবহার করে হাঁচি সামলাতে হবে।
সূত্র: হেলথ লাইন, হেলথ ডটকম