যাঁর হাত ধরে আজও টিকে আছে রিকশা পেইন্ট
‘হঠাৎ সিদ্ধান্ত’ হলে যা হয়, বন্ধু সাবা আর সুমাইয়ার সঙ্গে পুরান ঢাকার মাটিতে পা দিয়েই বিহ্বল হয়ে গেলাম। আজ কলেজ ছুটির দিন, সকালে ঘুম থেকে উঠে আমরা ভাবলাম, হুট করে পুরান ঢাকা ঘুরে এলে কেমন হয়? প্রথমে কিছু সমস্যা দেখা দিলেও আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল বিশাল চমক। হোটেলে বসে চা খেতে খেতে গুগল ম্যাপ দেখে তালিকা করার চেষ্টা করলাম। দূরত্ব অনুযায়ী কোথায় কোথায় যাওয়া যায়। একে তো পুরান ঢাকার চিরন্তন কোলাহল, আরেক দিকে সাবানের সেই বিজ্ঞাপনের সাবানের মতো ধীরগতির ইন্টারনেট। ঘামতে ঘামতে সাবা আর সুমাইয়াকে বললাম, ‘চিন্তা করিস না, বের করে ফেলব কোথায় কোথায় যাওয়া যায়।’ ওরা প্রায় একসঙ্গে বলল, ‘চিন্তা আমরা করছি না, তুই একা করছিস। আমরা শুধু ঘুরে বেড়াব।’
কিছুক্ষণ ওদের দিকে চোখ গরম করে তাকালাম। গুগলের সাহায্যে লিস্ট বানাতে গিয়ে মনে হলো, স্থানীয় মানুষের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। হোটেল বয়কে ডেকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ভাই, বিউটি বোর্ডিং কোন দিকে?’ সে মাথা চুলকে বলল, ‘বিউটি পারলার তো এখনো খুলে নাই।’ আমি হতাশ হয়ে ঠান্ডা চায়ের কাপে ঘন ঘন চুমুক দিতে থাকলাম।
জীবনে চলার পথে যত বাধাই আসুক, কোনো না কোনো সমাধান পাওয়াই যায়। ম্যাপে দেখলাম, যেখানে আছি, সেখান থেকে ১৫ মিনিটের হাঁটা পথে হোসনি দালান নামের এক দর্শনীয় স্থান আছে। আমরা রওনা হলাম। ১৫ মিনিট না, আধা ঘণ্টা হেঁটে হোসনি দালানের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ইতিউতি উঁকি দিচ্ছিলাম। একজন এসে বললেন, ‘কোথায় যাবেন?’ আমি বললাম, ‘এটা হোসনি দালান না?’ লোকটি বলল, ‘হ্যাঁ। তবে এই গেট বন্ধ। আপনাদের বকশীবাজার হয়ে আরেকটু সামনে হেঁটে আরেক গেট দিয়ে যেতে হবে।’
সাবা গজগজ করে বলল, ‘ঠিকমতো রাস্তা বের করতে পারিস না?’ আমি রেগেমেগে বললাম, ‘ঠিক রাস্তায়ই আসছি। আমি কীভাবে জানব এই গেট বন্ধ?’ আমি আর সাবা মিলে প্রায় তর্ক শুরু করছিলাম, সুমাইয়া দুজনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বলল, ‘বাচ্চারা, থামো। আমরা এখানে ঘুরতে এসেছি, ঘুরতে বেরোলে অনেক বাধাবিপত্তি পেরিয়ে গন্তব্যে পৌঁছতে হয়।’ তা-ই হবে, সাবা আর আমি থামলাম।
আমরা তিনজন প্রাচীন এই শহরের সরু গলিপথ ধরে হাঁটা ধরলাম। দেখতে দেখতে বকশীবাজার লেনে পৌঁছালাম। হঠাৎ এক দোকানে চোখ পড়ল। পুরান ঢাকার প্রাচীন ধূসর ধুলোবালুমাখা সরু রাস্তার পাশে এক ছোট্ট দোকান। এক ছোটখাটো মধ্যবয়স্ক লোক বাইরে দাঁড়িয়ে গম্ভীর মুখে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছেন। ভেতরে চেয়ারে বসা এক তরুণ দোকানি। পলকেই বুঝলাম, এটা রিকশাচিত্র বা রিকশা পেইন্টের দোকান। বিলুপ্তপ্রায় এই শিল্পের ধারা, সকালের ঝকঝকে রোদ্দুর দোকানের ভেতর সাজিয়ে রাখা রঙিন চিত্রগুলো দ্যুতি ছড়াচ্ছে। কিসের ছবি নেই এই দোকানে? করোনার জন্য লকডাউনকে থিম হিসেবে নেওয়া চিত্র, প্রাকৃতিক দৃশ্য, জবা ফুল, পাখি-ময়ূরের চিত্র, বিভিন্ন পেশার মানুষ, এমনকি চায়ের কেটলি আর চায়ের কাপও আঁকা আছে। এক তাকে একগাদা রঙিন কাচের বোতল আর সানগ্লাসের ফ্রেম রাঙিয়ে সারি সারি করে রাখা। উজ্জ্বল সব রং। কে এই শিল্পের কারিগর?
একটু এগিয়ে গিয়ে চেয়ারে বসা সেই দোকানিকেই জিজ্ঞাসা করে বসলাম, ‘এই ছবিগুলো কি আপনি এঁকেছেন?’ হো হো করে হেসে বললেন, ‘আমি কেন আঁকতে যাব? ওস্তাদ এঁকেছেন সব।’ সুমাইয়ার প্রশ্ন, ‘কোন ওস্তাদ?’ দোকানের সামনে দাঁড়ানো মধ্যবয়স্ক লোকটাকে দেখিয়ে বললেন, ‘উনি, হানিফ পাপ্পু।’
আগেকার দিনে সিনেমার ব্যানার ডিজিটালি প্রিন্ট করা হতো না। তিনি আর তাঁর শিল্পীবন্ধুরা মিলে হাতে ব্যানার আঁকতেন। ‘বেদের মেয়ে জোস্না’র ব্যানারও তাঁর আঁকা। সাবা বলল, ‘এ তো এলাহি ব্যাপার।’ দোকানি চালিয়ে গেলেন, ‘আশি আর নব্বইয়ের দশকে কোনো সিনেমা বের হলে ওনার ওপর দায়িত্ব পড়ত ব্যানার আঁকার। নাওয়া-খাওয়া ভুলে সারা দিন আঁকতেন, এমনকি দিনে ১০টার মতো ব্যানারও এঁকেছেন!’
এক দৌড়ে শিল্পী হানিফ পাপ্পুর কাছে গিয়ে বললাম, ‘আপনি কত বছর ধরে আঁকছেন?’ তিনি হেসে বললেন, ‘শুনলে তো হার্টফেল করবে।’ আমি বললাম, ‘তা-ও বলেন।’ তিনি রহস্য করে বললেন, ‘৫৫ বছর।’ আমরা তিনজন অবাক হলাম। বললেন, ‘এখন তো সব ডিজিটাল হয়ে গেছে, কেউ আর হাতে আঁকা ব্যানার চায় না। আমার বন্ধুরা সব জীবিকার জন্য অন্য কাজে চলে গেছে। রিকশা পেইন্টের ধারা একদম শেষ না হয়ে যায়, তাই এই দোকান আঁকড়ে রেখেছি যত কষ্টই হোক না কেন।’ একটু বিরতি নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, 'আমি মরে গেলে তো এসব না–ও থাকতে পারে!’
ইউনেসকো রিকশাচিত্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার পর বকশীবাজারে ‘রিকশা আর্ট গ্যালারি’ দোকানটি তিনি চালু করেন। বৈচিত্র্যময় ক্যানভাসে বৈচিত্র্যময় ছবি আঁকেন। রাজনীতি থেকে শুরু করে সামাজিক সমস্যা নিয়ে সচেতনতা তৈরির জন্য তিনি অবিরাম এঁকে চলেছেন। জহির রায়হান আর সত্যজিৎ রায়ের সিনেমার পোস্টারও এঁকেছেন। দেশের আনাচকানাচে যে রিকশাগুলো পেছনে সিনেমার চরিত্র আঁকা নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, সেগুলোর শুরু শিল্পী হানিফ পাপ্পুর হাত ধরে। সম্ভবত হেন কিছু নেই, যেটা নিয়ে তিনি আঁকেননি। কোনো খালি ফ্রেম দেখলেই পাপ্পু ছবি আঁকার কথা ভাবেন। তুলি নিয়ে পটু হাতে ক্যানভাস রং দিয়ে আঁকিবুঁকি করেন।
বিদায়কালে হানিফ পাপ্পু বললেন, ‘আবার এসো।’ বললাম, ‘অবশ্যই আসব।’
রঙে উজ্জ্বল হয়ে থাকা দোকানে শেষবারের মতো চোখ বুলিয়ে ভাবলাম, ‘ভাগ্যিস, ভুল করে এদিকে চলে এসেছিলাম, না হলে এমন অসাধারণ এক শিল্পীর দেখা পেতাম?’