জলবায়ু পরিবর্তন রোধে তুমি যা করতে পারো
জলবায়ু পরিবর্তন রোধে একজন কিশোরের ভূমিকা কী? কেউ বলেন, বেশি করে গাছ লাগাও। একজন কিশোর হিসেবে তোমার হয়তো গাছ লাগানোর জন্য কোনো জায়গাই নেই। কারো পরামর্শ, যেখানে-সেখানে ময়লা ফেলো না। তুমি এক বোতল পানি খেয়ে বোতলটা ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দিতে পারো। বোতল ফেলে দিলে সেটা রিসাইকেল হতে পারে। কিন্তু গাছ লাগানো বা বোতল রিসাইকেল করার বিষয়টি তুমি বুঝতে পারো না, তোমার এসব কাজ জলবায়ু পরিবর্তন রোধে কোনো ভূমিকা রাখছে কি না। কিংবা ভবিষ্যতের বাসযোগ্য পৃথিবী গড়তে তুমি কী করতে পারো। জানতে হলে পড়তে পারো এই লেখা।
জলবায়ু পরিবর্তনের পেছনের কথা
জলবায়ু পরিবর্তনের নিয়ে আলাপের শুরুতেই কথা ওঠে কয়লা, তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস নিয়ে। গল্পটা এ রকম, কয়েক লাখ বছর আগের কোনো এক সময় কিছু গাছপালা বা শেওলা মারা যায়। ক্ষয়প্রাপ্ত হওয়ার পরিবর্তে এই কার্বনসমৃদ্ধ গাছ ও শেওলা পলিমাটির নিচে আটকে পড়ে। একসময় পাথরে পরিণত হয়। তারপর লাখ লাখ বছর ধরে শিলাগুলো চাপা পড়ে থাকে ও ভূতাত্ত্বিক প্রক্রিয়ায় উত্তপ্ত হয়। এই গাছপালা এবং শৈবালের অবশিষ্টাংশগুলো কার্বনসমৃদ্ধ উপাদানের বিশাল খনিতে পরিণত হয়।
রান্নার কাজে গ্যাসের চুলা জ্বালালে এই প্রাগৈতিহাসিক উপাদানগুলোর কিছু অংশ মুহূর্তেই পুড়ে যায়। এভাবে প্রতিদিন মানুষ ডাইনোসরের চেয়ে পুরোনো বস্তুর ব্যবহার করে! বর্তমানে জীবিত মানুষকে এক প্রজন্ম ধরলে, খনি থেকে তোলা তেল, গ্যাস, কয়লার শেষতম ব্যবহারকারী এই প্রজন্মকে বলা যায়। মানুষের লাইফস্টাইল এবং নিজের জন্য বেছে নেওয়া কর্মকাণ্ডে পৃথিবীপৃষ্ঠ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে।
জ্বালানি পোড়ালে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গত হয়। গ্রিনহাউসের প্রভাবে পৃথিবীপৃষ্ঠ ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। বর্তমানে জলবায়ু দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কমাতে চাইলে কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ কমাতে হবে। এই প্রক্রিয়া আবার সহজ নয়। কারণ, সভ্যতা গড়ে উঠেছে এই প্রক্রিয়াকে কেন্দ্র করে। বর্তমানে মানুষ যা কিছু করে, তা-ই বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড এবং অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন করে। পৃথিবীকে বাঁচাতে কার্বন নির্গমনের অভ্যাস বদলে ফেলতে হবে।
ইস্পাত, কংক্রিট এবং প্লাস্টিকের মতো শিল্প বিশ্বব্যাপী বার্ষিক গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের প্রায় ৩০ শতাংশের জন্য দায়ী। ২৬ শতাংশ দায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের। মানুষ খাদ্যের প্রয়োজনে গাছপালা লাগায়। প্রাণী লালন-পালন করে। এ থেকে আসে গ্রিনহাউস গ্যাস। এই গাছপালা এবং প্রাণী যা খায়, তার সঙ্গে কাপড় এবং কাগজের মতো উপকরণ তৈরির জন্য যে কৃষিকাজ করা লাগে, সেগুলো ২১ শতাংশ নির্গমনে দায়ী। এ ছাড়া পরিবহনশিল্প বিশ্বব্যাপী নির্গমনের প্রায় ১৬ শতাংশের জন্য দায়ী। এর মধ্যে রয়েছে এক বিলিয়ন যাত্রীবাহী গাড়ি। এ ছাড়া বাণিজ্য ও পরিবহন নেটওয়ার্কের প্লেন, ট্রাক, ট্রেন ও জাহাজ। বাকি ৭ শতাংশ নির্গমন ঘরবাড়ি গরম ও ঠান্ডা করার মাধ্যমে আসে। তাই জলবায়ু সমস্যা শুধু কয়েকটি দেশের নয়, বরং পুরো মানবজাতির জন্যই ঝুঁকি।
প্রতিদিনের খাবার নিয়ে সচেতন হও
বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য ও পানীয় দরকার। তবে কারও কারও জন্য খাবার ও পানি শুধু বেঁচে থাকার জন্য নয়, লাইফস্টাইল ও ভোগের বিষয়। এর প্রভাবগুলো কী কী? খাবার ও পানীয়ের বিষয়ে মানুষের যা পছন্দ, তার কি কোনো বিকল্প আছে?
যার খাবারের অভাব, তার জন্য খাবার বাছাবাছির সুযোগ নেই। খেতে পেলেই সে খুশি। কিন্তু যারা খাবার বাছাবাছির সুযোগ পায়, তার জন্য পরিবেশের জন্য উপকারী খাবার বাছার সুযোগ রয়েছে। এখন শিশুদের দেখতে পাওয়া যায়, যারা সবকিছু খেতে চায় না। মাছে কাঁটা থাকে, তাই মাছ খায় না। বাছাবাছির সুযোগ আছে কি নেই, এটা ধরে সামনে এগোনো যাক।
বিশ্ব জনসংখ্যা হিসাবে কখনো এমন ছিল না যে সবার জন্যই অনেক খাবার আছে। বর্তমানে সবাইকে খাওয়ানোর জন্য পৃথিবীতে পর্যাপ্ত খাদ্য উৎপাদিত হয়। কৃষিতে উন্নতি এবং সারা বিশ্বে খাদ্য পরিবহন সহজ হওয়ার কারণে এমন হয়েছে। কিন্তু সব জায়গায় একই চিত্র দেখা যায় না। প্রতি রাতে বিশ্বব্যাপী প্রায় এক বিলিয়ন মানুষ ক্ষুধার্ত পেটে ঘুমাতে যায়। তাদের অধিকাংশই এশিয়া আর আফ্রিকায় বসবাস করে। তাদের জন্য পছন্দ এবং বেছে নেওয়ার সুযোগ এখনো নেই। শুধু প্রয়োজন বা ক্ষুধার কারণেই তাদের খাদ্য প্রয়োজন হয়। বিশ্বের অন্যান্য অংশে, বিশেষ করে উন্নত দেশগুলোতে এক বিলিয়নের বেশি মানুষ রয়েছে, যাদের ওজন বেশি। তাদের মধ্যে ৩০০ মিলিয়ন মানুষ স্থূল। তাদের অধিকাংশ দরিদ্র মানুষ। বিশ্বব্যাপী স্থূলতা প্রায় তিন গুণ বেড়েছে ১৯৮০ সালের পর থেকে। মূলত খাবারে বেশি চর্বি এবং বেশি চিনি যুক্ত হওয়ার কারণে।
ক্যালরি গ্রহণ বেড়ে যাওয়ার হার লক্ষ করো
যাচাই করো তোমার খাদ্যাভ্যাস
নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও। লক্ষ করো, কোন জায়গায় ইতিবাচক পরিবর্তন করা যায়।
• খাবার কীভাবে বাছাই করো? কোন খাবারটি খেতে চাও?
• তোমার প্লেটের খাবারের ফুড মাইল (কত দূরত্ব পাড়ি দিয়ে তোমার প্লেটে খাবারটি এসেছে) কত?
• তোমার কি পছন্দ করার সুযোগ আছে? কোন খাবার কিনবে বা তোমার খাবার কোথা থেকে আসবে? তুমি হয়তো কাউকে চেনো, যে নিজের জন্য আম নিয়ে আসে রাজশাহী থেকে। দই আনায় বগুড়া থেকে। তোমার খাবার যদি পাশের দোকান থেকে আসে, তাহলে এই দোকানে পণ্য আসে কোথা থেকে?
• খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করতে তোমার কী করার আছে?
নিজের খাদ্য বাছাই করতে হবে
খাদ্য পছন্দ করা খুব জটিল। কারণ, খাদ্য বাছাই দিয়ে পুরো গল্পটা বোঝা সব সময় সহজ নয়। মানুষ যে খাবারগুলো খায়, সেগুলো কীভাবে জলবায়ু পরিবর্তনে অবদান রাখে, তা সহজে বোঝা যায় না। অনেক রকম ধারণা আর উদ্যোগ আছে, যা দিয়ে খাদ্য বেছে নেওয়া সহজ হয়। এখানে মূল কয়েকটি ধারণার কথা আছে।
স্থানীয় খাবার খাও
সারা পৃথিবীতে লাখো মানুষ নিজের খাবার নিজেরা উৎপাদন করে। ফলে ফুডমাইল বিষয়টি তাদের জন্য দরকার হয় না। নিজে উৎপাদন না করেও ফুডমাইল এড়ানো যায়। চারপাশে যেসব খাবার উৎপাদিত হয়, সেগুলো থেকেই নিজের খাবার বেছে নেওয়া ভালো। তবে এটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য সব সময় কাজে লাগে না। এসব দেশের ক্ষেত্রে স্থানীয়ভাবে পর্যাপ্ত ও সব ধরনের খাবার উৎপাদন করা সম্ভব হয় না। তাই দেশগুলো ব্যাপকভাবে অন্য অঞ্চলের খাবারের ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হয়।
মাংস ছাড়া খাবার
ভেগানিজম সারা পৃথিবীতেই জনপ্রিয়। যারা প্রাণিজ আমিষ এবং প্রাণী থেকে পাওয়া যায় এমন খাবার খায় না, তাদেরকে বলে ভেগান। গ্রেটা থুনবার্গ একজন ভেগান। কারণ, সে মনে করে, মাংস উৎপাদনের জন্য প্রচুর গ্রিনহাউস গ্যাস তৈরি হয়। বাংলাদেশের মানুষ পৃথিবীতে সবচেয়ে কম মাংস খায়। বড় অংশ অতি দরিদ্র। তবে যার খাবারই নেই বা যে খুব অল্পই মাংস খেতে পায়, তাকে মাংস খেতে নিষেধ করার অর্থ হয় না। বাংলাদেশের একজন মানুষ গড়ে সারা বছর ৪ দশমিক ৩ কেজি মাংস খায়। গড় বলতে ওপরের তলার মানুষেরা নিশ্চয়ই সোয়া চার কেজি মাংস খায় না। অনেক বেশি খায়। তাই পিরামিডের নিচের দিকের মানুষেরা একদমই মাংস খেতে পায় না ধরে নেওয়া যায়। তাই মাংস বাদ দিয়ে ভেজিটেরিয়ান হওয়া তখনই সঠিক, যখন শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টির জোগান মাংস বাদ দিয়েই পাওয়া যায়। জোগাড় করার সক্ষমতা থাকে।
২০২২ সালের জুলাই মাসে একটা কনফারেন্স আয়োজিত হয় ঢাকার ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকে। সেখানে ভারত থেকে ছয়জন অতিথি আসেন, যাঁরা ভেগান। তাঁদেরকে আপ্যায়নের দায়িত্ব পড়ে লেখকের ওপর। তাঁদের সকাল আর দুপুরের খাবার খাওয়াতে গিয়ে দেখা যায়, ইউরোপিয়ান অতিথিদের খাবারে যে খরচ হয়, ঢাকায় সমমানের ভেজ খাবার জোগাড় করতে সাড়ে তিন গুণ দাম দিতে হয়। আসলে বাংলাদেশে ভেগান হওয়া সহজ নয়। তারপরও যদি কেউ জলবায়ুর স্বার্থে হতে চায়, মন্দ কী?
খাদ্যাভ্যাস পরীক্ষার জন্য পরিকল্পনা করো
আগামী এক সপ্তাহের কেনাকাটার সময় নোট করো, কত দূর থেকে তোমার খাবার আসে? সব সময় এই তথ্য জানা জরুরি না। অবশ্য বাংলাদেশে কোরবানির ঈদের সময় লোকে হাটে গিয়ে সবার আগে জিজ্ঞেস করে, গরু কোন জায়গার? গরু কেনার ক্ষেত্রে গরুর বেড়ে ওঠা এলাকা একদম অপ্রয়োজনীয় তথ্য। তারপরও মানুষ এটি জিজ্ঞেস করে বিক্রেতাকে। আর ইলিশ মাছ কেনার সময় জিজ্ঞেস করে কোথাকার ইলিশ? বিক্রেতারা সব সময়ই বলে পদ্মার তাজা ইলিশ! তাহলে বঙ্গোপসাগরে এত ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ ধরা পড়ে, সেগুলো কোথায় যায়?
কিন্তু কত দূর থেকে তোমার প্লেটে খাবার আসে, তোমার জানা প্রয়োজন। খাদ্যতালিকা করে অনুসন্ধান করতে পারো। তোমার খাবারের ধরন লক্ষ করো। ভাবো, কী পরিমাণ শক্তি খরচ হয় এবং কী পরিমাণ গ্রিনহাউস গ্যাসের নিসঃরণ ঘটে? তোমার অনুসন্ধান হয়তো বলতে পারবে, খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করতে হবে কি না? লাইফস্টাইল বদলে ফেলতে হবে কি না? কোন জায়গাটা পরিবর্তন করা সবচেয়ে কঠিন? জলবায়ু পরিবর্তনের কথা ভেবে খাদ্যতালিকা আরও উন্নত করতে কী কী তথ্য তোমার প্রয়োজন?
একটি নতুন টি–শার্ট কিনলে কী হয়?
এখন অনলাইনে জামাকাপড় কেনা খুব সহজ। ওয়েবসাইটে যাও। পছন্দ করো। কার্টে যোগ করো। অর্ডার করে দাও। তোমার বাসার দরজার সামনে টি–শার্টটি হাজির হয়ে যাবে। কিন্তু একটু চিন্তা করলেই বোঝা যায়, এই টি–শার্টটি অনেকগুলো ধাপ পেরিয়ে তোমার ঘরের দরজায় এসেছে। চলো, ধাপে ধাপে চিন্তা করি।
অনলাইনে অর্ডার করার জন্য ইন্টারনেট ও বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে হয়েছে। তোমার কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট বিদ্যুৎ ব্যবহার করে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত হয়। অন্যদিকে টি–শার্টের কাপড় তৈরি হয়েছে সুতা বুনে। সুতা তৈরি হয় তুলা থেকে। প্রাকৃতিক গাছপালা পরিষ্কার করে জমিতে তুলা চাষ করা হয়। এর জন্য তুলা বীজ রোপণ, সার দেওয়া, যত্ন নেওয়া এবং ফসল তোলার মতো কাজ করতে হয়েছে।
যেকোনো ফসল লাগানো, সার দেওয়া এবং ফসল কাটার জন্য প্রতিটি ধাপেই সরঞ্জাম প্রয়োজন হয়। এগুলো তৈরিতে এককালীন গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত হয়েছে। কারখানায় টি–শার্টটি তৈরির সময় স্টিলের যন্ত্রপাতি এবং প্লাস্টিকের সামগ্রী ব্যবহার করে সুতা থেকে কাপড় তৈরি করা হয়েছে। কাটা, সেলাই, রঙের ছাপ, ইস্তিরি এবং প্যাকেজিং করতে হয়েছে।
একটি সুতির টি–শার্ট বানাতে দরকার হয় প্রায় ২ হাজার ৭০০ লিটার পানি! পৃথিবীর ৯৭ শতাংশ পানি লবণাক্ত। ২ শতাংশ পানি বরফ হিসেবে জমাট হয়ে আছে। আর মাত্র ১ শতাংশ ব্যবহারযোগ্য। এর মধ্যে ৭০ ভাগ খরচ হয় কৃষিকাজে। একটি টি–শার্ট কম বানালে বেঁচে যাবে একজন মানুষের ৯০০ দিনের খাবার পানি!
একটি ভালো কারখানায় শ্রমিকদের জন্য তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। স্টোরেজের জন্য গুদাম ঠান্ডা বা গরম করা লাগে। এটি তৈরি হয়ে গেলে টি–শার্টটি হোলসেলার বা কারখানা থেকে খুচরা বিক্রেতার কাছে পাঠাতে হয়। এ জন্য পণ্যবাহী জাহাজ, বিমান বা ট্রাক, গাড়ি, মোটরসাইকেল ইত্যাদি ব্যবহার করে ঘরের দরজা পর্যন্ত পৌঁছাতে হয়। প্রতি পদক্ষেপেই গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত হয়। যদি ক্রেতা টি–শার্টে কোনো অসুবিধা খুঁজে পান বা পণ্যটি পছন্দ না হয়, তখন বাধে নতুন বিপত্তি। বিক্রেতার কাছে শার্টটি ফেরত পাঠানো হয়। ভুল সাইজ বা কাপড়ের মান বা রঙের দুর্বলতার কারণে টি–শার্টটি বাতিল হতে পারে। এই রিভার্স প্রক্রিয়ায় আরও কার্বন ডাই–অক্সাইড গ্যাস নির্গত হয়। এখানেই শেষ নয়। বছরখানেকের মধ্যে শার্ট ব্যবহার শেষ হয়ে গেলে ফেলে দেওয়া হয়। শার্টটি ময়লার গাড়ি ঘুরে মাটিতে চলে যাবে। ধীরে ধীরে পচে যাবে। এই টি–শার্টের কথা ভুলে যাওয়ার অনেক অনেক পরে এটি গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ করবে।
সব মিলিয়ে ফ্যাশনশিল্প প্রতিবছর প্রায় এক বিলিয়ন মেট্রিক টন কার্বন ডাই–অক্সাইডের সমতুল্য গ্যাস নির্গত করে। এ রকম ধাপে ধাপে চিন্তা করলে একধরনের অপরাধবোধ কাজ করতে পারে। প্রয়োজন না থাকার পরও একটি টি–শার্ট পছন্দ হলো আর অর্ডার দিয়ে দিলাম, এ রকম করতে অস্বস্তি লাগতে পারে।
সারা বিশ্বের শিল্প থেকে নির্গমনের উত্স হিসাব করলে প্রতিবছর ৫১ বিলিয়ন টন গ্রিনহাউস গ্যাস কীভাবে তৈরি হচ্ছে, তা দেখানো সম্ভব। এগুলোর মধ্যে জীবনযাপনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে, এমন অনেক কিছুই আছে। শিল্পবিপ্লব শুরু হয়ে পৃথিবীকে বদলে দেওয়া শুরু করেছে অনেক দিন হলো। একইভাবে আরেকটি শিল্পবিপ্লব আনা প্রয়োজন। যেটি হবে সবুজ শিল্পবিপ্লব। পৃথিবীকে বাঁচাতে এর প্রয়োজন হবে। সৌরবিদ্যুৎ, বায়ুবিদ্যুৎ ইত্যাদি সবুজ শিল্পবিপ্লবের চালিকা শক্তি হবে।
টি–শার্ট কেনার এই ধাপগুলো দেখায়, জলবায়ু পরিবর্তনে মানুষ ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে পরস্পরের সহযোগিতার প্রয়োজন হয়। অপ্রয়োজনীয় পোশাকের ব্যাপারে নতুন করে ভাবলে জলবায়ু পরিবর্তন রোধে ভূমিকা রাখা যাবে।
পছন্দের লাইফস্টাইল বেছে নাও
সবাই একটি সুখী জীবন চায়। কিন্তু এর মানে কী? সবারই নিজস্ব জীবনধারা আছে। ভোগের প্রবণতা জানা যায় কার কত সম্পদ আর কে কত খরচ করে? কোন ধরনের পণ্য তুমি পছন্দ করো?
লাইফস্টাইল শব্দটা এখন প্রায়ই ম্যাগাজিনে দেখতে পাবে। কোন বস্তুটি কিনবে, টিভিতে বিজ্ঞাপন দেখে তুমি পছন্দ করতে পারো। এটা খুব সহজ ধারণা। তুমি কোথায় আর কীভাবে বসবাস করো বা জীবনযাপনের মাধ্যমসহ সবকিছুই এর অন্তর্ভুক্ত। যেমন, সকালে ঘুম থেকে জেগে ওঠা থেকে ঘুমাতে যাওয়া, খাবার থেকে শুরু করে যোগাযোগ পদ্ধতি, পরিচয়, মূল্যবোধ, আশা, ভয়, রাজনীতি ও সামাজিক অবস্থান—সবকিছুই। সবারই নিজস্ব জীবনধারা আছে। কেমন খাবার খাবে, তা নির্ধারিত হয় কত টাকা আছে আর কত খরচ করতে ইচ্ছুক, তার ওপর।
ধরা যাক, তোমার কাছে পর্যাপ্ত টাকা আছে। সবকিছুই খেতে পারবে। কিন্তু তুমি কি সবই খাবে? যদি রেস্টুরেন্টে নিয়মিত খেতে হয়, তাহলে সম্ভাবনা আছে তুমি খাবার বেছে নেবে। মাছ আর মাংসের মধ্যে শুধু মাংস নিতে পারো। সঙ্গে একটা সবজি, একটা ডাল নিতে পারো। বলতে চাইছি, তুমি নিজের মতো করে খাবার বেছে নিতে পারো। বাসায়ও একই রকম। তোমার বাসায় কেউ যদি কচু না খায়, তবে বাসায় কচু রান্না হওয়ার সম্ভাবনাও কম। কচু খেলে কারও যদি গলা ধরে, তাহলে কচু কেনই–বা খাবে?
লাইফস্টাইল যদি জলবায়ুবান্ধব না হয়, তবে তোমাকে হয়তো অভ্যাস পরিবর্তন করতে হবে।
বেছে নেওয়ার জগৎ
সব মানুষ ক্রমাগত বাছাই করে। ব্যক্তি হিসেবে পছন্দ নির্ভর করে একজন কোথায় কীভাবে বাস করে? মানুষটি কতটা ধনী? একা নাকি অন্যদের সঙ্গে বাস করে? ব্যক্তিগত প্রবণতা দিয়েও বেছে নেওয়া প্রভাবিত হয়। বন্ধু ও পরিবার, শিক্ষা ও কাজ, সংস্কৃতি ও স্বার্থ, মনোভাব ও বিশ্বাসের কারণে মানুষ বেছে নেয়।
কিছু মানুষ পার্টি করতে পছন্দ করে। বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটাতে পছন্দ করে। কেউ শান্ত এবং একাকী জীবন খোঁজে। পরিবারের সঙ্গে বাড়িতে থাকা উপভোগ করে কেউ। অবশ্য দরিদ্র মানুষ জীবনধারা বেছে নেওয়ার সুযোগ তেমন পায় না। দীর্ঘ সময় কাজ করে শুধু খাবার জোগাড় করতে। স্বল্প আয় দিয়ে তেমনভাবে বেছে নিতে পারে না। অবস্থা যেমনই হোক, কিছু ক্ষেত্রে তাদেরও বেছে নেওয়ার সুযোগ আছে।
তালিকা তৈরি করতে হবে
বেঁচে থাকার উপায় বের করতে কয়েক শব্দে একটি তালিকা তৈরি করো। এই তালিকা তোমার লাইফস্টাইল বর্ণনা করবে।
তুমি কী কী খাও? কোন ধরনের পোশাক পরো?
তোমার ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য কী কী আছে?
তোমার বন্ধু কারা?
বিনোদনের জন্য তুমি কী করো?
তোমার ভালো ও মন্দ অভ্যাস কোনগুলো?
কোন জিনিসগুলো পরিবর্তন করলে তোমার লাইফস্টাইল আরও টেকসই হবে?
টেকসই জীবন মানে আমাদের জীবনধারণের উপায় পুনর্বিবেচনা করা। একজন কী ভোগ করে এবং কীভাবে প্রতিদিনের জীবনধারণ করে? কীভাবে সামাজিকভাবে অন্যদের সঙ্গে সম্পর্ক করে? অন্যদের সঙ্গে কেমন করে ভাব বিনিময় করে? পড়াশোনা ও নিজের পরিচয় তৈরির মাধ্যমে টেকসই লাইফস্টাইল অর্জন করা যায়। শক্তির ব্যবহার, যাতায়াতের জন্য পরিবহন, খাদ্য, বর্জ্য, যোগাযোগের উপায় দিয়ে টেকসই জীবন তৈরিতে অবদান রাখা যায়।
আরও প্রশ্ন আছে
তোমার সামাজিক কাজ আর বসবাসের ধরন প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না?
সুনাগরিক হিসেবে বাসা, স্কুল কিংবা কর্মক্ষেত্রে যে শক্তি ব্যবহার করো, তা নিয়ে তুমি সচেতন কি না?
বিশ্বের বিভিন্ন অংশের জন্য গ্লোবাল ফুটপ্রিন্ট নেটওয়ার্ক একটি ক্যালকুলেটর তৈরি করছে। যা দিয়ে ওই এলাকার মানুষের লাইফস্টাইল ধারণা করা যায়। বিশ্বব্যাপী 'কার্বন ফুটপ্রিন্ট'-এর অবস্থানও বোঝা যায়। দেখা যায়, বিশ্বব্যাপী মানুষের জীবনধারা টেকসই না। শুধু ২০১০ সালে গড়ে প্রত্যেকে ২.৭ গ্লোবাল হেক্টর জায়গা ব্যবহার করছে। সে সময় কি তোমার জন্ম হয়েছিল?
এটি বিশ্বব্যাপী গড়। সব দেশের জন্য এক না। সবখানে জীবনযাপনের বৈষম্য আছে। তোমার কী মনে হয়?
কম কম গাড়ি ব্যবহার করো
কম পরিমাণে গাড়িতে চলা মানে কম কার্বন নির্গমন করা। যখনই সম্ভব হাঁটা বা সাইকেল চালানো ভালো। গাড়ির বদলে রিকশাও ব্যবহার করা যায়। ঢাকায় স্বল্প দূরত্বে যাতায়াতে প্রায়ই দেখা যায়, গাড়িতে ও রিকশায় একই সময় লাগে। ক্যাম্পাস এলাকায় বাইসাইকেল শেয়ারিং থাকলে সেগুলোও ব্যবহার করা যায়। এর থেকে বেশি দূরত্বে যাতায়াতে পাবলিক পরিবহন ব্যবহার করো। স্কুলে বা কাজে যেতে একা গাড়ি ব্যবহারের পরিবর্তে বন্ধু বা সহকর্মীর সঙ্গে গাড়ি শেয়ার করা যেতে পারে। নিজে গাড়ি ব্যবহারের চেয়ে রাইড শেয়ারিং সেবা ব্যবহার করা যায়।
কোনো একজন লোক অফিস শেষে শেয়ারিং সার্ভিসের মাধ্যমে নিজের এলাকায় ফিরে যাওয়ার সময় আরেকজনকে নিয়ে যেতে পারে। এভাবেও নির্গমন কমে। আগে থেকে যাতায়াত পরিকল্পনাও একটি ভালো পদ্ধতি। দূরের যাত্রায় ট্রেন ব্যবহার করা যায়। যদি সম্ভব হয়, ওয়ার্ক ফ্রম হোম বা বাড়ি থেকে কাজ করাও কম নির্গমনে সহায়ক। আরেকটি বিষয় হলো, গাড়ি বন্ধ ও চালু করতে যে পরিমাণ জ্বালানি খরচ হয়, তার তুলনায় জ্যামে বসে থাকলে কম খরচ হয়, এমন ধারণা ঠিক নয়। আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে গাড়ির সক্ষমতা এত বেড়েছে, এখন ৩০ সেকেন্ডের জন্য গাড়ি নিয়ে কোথাও বসে থাকতে হলে গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করে ফেলা উচিত।
কাজ শুরু করে দাও
প্রতিদিন মানুষ যা দেখে, তাই তার লাইফস্টাইল প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। নিচের কথাগুলো টেকসই লাইফস্টাইল গ্রহণ করতে সাহায্য করতে পারে এবং অন্যদের ওপর প্রভাবও ফেলতে পারে।
কেনাকাটা করা বা একটি ম্যাগাজিনে বিজ্ঞাপন খেয়াল করো। কোন বিজ্ঞাপনগুলো লাইফস্টাইলের ধরন ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা করছে? কোন বিজ্ঞাপন আচরণকে জলবায়ুর জন্য টেকসই ব্যবস্থা নিতে উত্সাহিত করে? আর কোনগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের হার কমাতে খারাপ প্রভাব রাখছে?
পরেরবার টিভি দেখার সময় ভাবো, কোনগুলো ইতিবাচক এবং কোনগুলো নেতিবাচক? তোমার জন্য দেখানো রোল মডেল এবং কী বলছে তারা?
টেকসই জলবায়ুর জন্য ভেবেচিন্তে কেনাকাটা করো। কাজ, পরিবার ও বন্ধুদেরকে টেকসই আচরণ করতে উৎসাহ দাও। চিন্তা করে বের করো, কোন কাজগুলো করতে বলবে তাদেরকে? কোন কাজগুলো করতে নিষেধ করবে?
এগুলো ছিল ব্যক্তিগত পর্যায়ে জলবায়ু পরিবর্তন রোধে ভূমিকা রাখার উপায়। এই বিষয়গুলোতে সচেতন থাকলে নিজের জীবন ও কমিউনিটিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখা সম্ভব। পৃথিবীকে তো রক্ষা করতে হবে। নিজের দেশ আর পরবর্তী প্রজন্মের কথাও ভাবতে হবে আমাদের।