আজকে বাসায় সবকিছুতেই খুব খুশি খুশি ভাব।
এই যে বিকেলবেলায় ছোটন দুধ খাওয়ার কথা বলে ঘরে নিয়ে আস্তে করে বেসিনে ফেলে দিল, মা কীভাবে কীভাবে যেন সেটাও দেখে ফেললেন। অন্য দিন এ নিয়ে তুলকালাম হতো, আজকে শুধু ছোটনকে একটু চোখরাঙানি দিয়েই শেষ। ছোট্ট একটু হুমকিও ছিল অবশ্যই—মামা যাওয়ার পর তোমার হবে!
ছোটন অবশ্য জানে, মামার কানে টুক করে এই ‘হবে’ কথাটা চলে গেলে আর কিছুই হবে না। কেন জানি বড় মামাকে সবাই বাঘের মতো ভয় পায়। এই যেমন মা কিছুক্ষণ আগে যখন জিজ্ঞেস করলেন—ভাইজান, সকালে কি পিঠা খাবেন? নাকি বিন্নিচালের ভাত?
মামা কী একটা বই পড়ছিলেন। বই থেকে মুখ না সরিয়েই বললেন—এটা কী ধরনের প্রশ্ন হলো?
মায়ের মুখটা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেল। ছোটনের হাসি পেয়ে গেল মায়ের অবস্থা দেখে। স্কুলের রিপোর্ট কার্ড দেখানোর সময় মায়ের সামনে তার এই অবস্থাই হয়।
মা আমতা আমতা করে বললেন, না মানে আপনি বারো বছর পরে এলেন তো দেশে, সকালে নাশতায় আগের মতোই কি বাসি ভাত মাখানো খান? না হলে নলি দিয়ে নানরুটি? সে জন্যই জিজ্ঞেস করছিলাম। নাকি দুটো স্যান্ডউইচ বানিয়ে দেব ভাইজান?
মামা এবার বই থেকে মুখ সরালেন—তোর মাথা খারাপ হয়েছে বিন্তি? কেক-স্যান্ডউইচ খাওয়ার জন্য দেশে এসেছি নাকি? দুই রকমের খাবারের কথা একসঙ্গে বলেছিস, তোর শাস্তি হলো দুটোই করবি। পিঠা আর বিন্নিভাত। শীতের দিনে জমবে ভালো।
মা খুশি খুশি মুখে বাবাকে গিয়ে বললেন, এক্ষন নিউমার্কেটে যাও। শোল মাছ আনতে হবে। ভাইজানকে কালকে বিন্নিভাতের সঙ্গে শোল মাছের কুটি বিরান খাওয়াব।
বাবা ইউটিউবে কী এক পুরোনো দিনের সিনেমা দেখছিলেন। আস্তে করে বললেন, এই ছুটির দিনে শোল মাছ আনার জন্য বাইরে যাওয়ার যন্ত্রণার কী দরকার? সকাল সকাল স্টার থেকে ঝালফ্রাই নিয়ে আসব নাহয়।
ও-ঘর থেকে এ-ঘরে আসতে আসতেই মায়ের চেহারার কাচুমাচু ভাব পাল্টে গেছে—ঝালফ্রাই মানে? ভাইজানকে আমি ঝালফ্রাই দিয়ে বিন্নিভাত খাওয়াব? এক্ষন যাবে তুমি, এক্ষন! সকালে কিন্তু পিঠাও থাকবে সঙ্গে। নাকি ভাপা পিঠা খেতে চাও না তুমি?
‘ওরে বাবা, পিঠাও হবে? পিঠা খাওয়ার জন্য তো এইটুকু কষ্ট করাই যায়!’ বাবা পাঞ্জাবিটা গায়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। পিঠার পাগল বাবাটা! মা একেবারে মোক্ষম দাওয়াই দিয়েছেন!
ছোটন আবার গুটিগুটি পায়ে মামার ঘরে চলে এল। সবাই মামাকে ভয় ভয় করে কথা বললেও ছোটনের ভয় লাগে না তেমন। আমেরিকার কোনো এক ইউনিভার্সিটিতে পড়ান মামা। কিন্তু চেহারার মধ্যে একটুও মাস্টার মাস্টার ভাব নেই। এর থেকে ছোটনের প্রাইভেট টিচার আলম স্যারকেই বরং স্যার স্যার মনে হয়। আলম স্যারের কথা মনে হতেই কালকের হোমওয়ার্কের কথা মনে হয়ে গেল। ঠিকমতো পড়া দিতে না পারলে তার খবরই আছে!
পড়াশোনাবিষয়ক দুশ্চিন্তা মাথা থেকে ঝাড়তে সে মামার দিকে মনোযোগ দিল।
—মামা?
—উঁ?
—গল্প বলো না একটা?
—কিসের গল্প শুনতে চাস?
—তোমার জীবনের একটা আনন্দের ঘটনা বলো।
—কী রকম আনন্দ?
—এই ধরো তোমরা নায়াগ্রা ফলস দেখতে গেছো বা ডিজনিল্যান্ড দেখতে গেছো—এই রকম কোনো আনন্দের ঘটনা?
—তার থেকেও আনন্দের একটা ঘটনা শুনবি?
—কী ঘটনা?
—ওসব আম্রিকা-টিকা না। দেশের ঘটনা বলি। তোর জন্মেরও আগের ঘটনা। আমার তখন বিয়ে হয়েছে মাত্র। নতুন বউ নিয়ে প্রথম গিয়েছি শ্বশুরবাড়ি। সিলেটের গ্রামাঞ্চল। শীত নেমেছে কেবল দেশে, এই এখনকারই মতো।
সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি এত্তগুলো বাঁশ নিয়ে আসা হয়েছে। কী ব্যাপার? শুনলাম ওগুলোই নাকি আজকে আমার খাবার!
জামাই মানুষের সঙ্গে একটু ঠাট্টা-রসিকতা দোষের কিছু না। আমি চুপ করে হাসলাম। একটু পরে দেখি বাঁশগুলো এক হাত সমান লম্বা করে কাটা হচ্ছে। তাতে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে ভরা হলো কলাগাছের পাতা। এবার এতে দেওয়া হলো আগেই ভিজিয়ে রাখা বিন্নিচাল। বাঁশগুলো যখন আমার শাশুড়ি আগুনে পোড়াতে দিলেন, তখন সত্যি সত্যিই বিশ্বাস করলাম যে এই বাঁশই হতে যাচ্ছে আমার খাদ্য!
—বলো কী? পোড়া বাঁশ খেতে দিল তোমাকে?
—হা হা হা...আরে না না। পোড়ানোর পর দা দিয়ে বাঁশগুলো ফাঁড়া হলো। বেরিয়ে এল ঠিক মোমের মতো একটা চোঙা! ওইটাই খাদ্য। চোঙার মতো দেখতে বলেই এর নাম চোঙা পিঠা।
—খেতে কেমন?
—সেইটাই তো সবচেয়ে আনন্দের ব্যাপার। আমার সামনে নানা রকমের পিঠাপুলি, ফলপাকুড়। মিষ্টি মনে হয় এলাকার বাজার খালি করে নিয়ে আসা হয়েছে। কিন্তু শ্বশুর সাহেব আস্তে করে বললেন, বাবাজি প্রথমে চোঙাপিঠা একটু মুখে দাও।
আমি চোঙাপিঠা ভেঙে অল্প একটু মুখে দিলাম। বিশ্বাস কর, থতমত খেয়ে গেছি! সামান্য চালেরই তো পিঠা, কিন্তু এতেই আমি পেয়ে গেলাম বিন্নিভাতের স্বাদ, পোড়া পোড়া একটা ফ্লেবার, আর ওই বাঁশের একটা অদ্ভুত সুগন্ধ। এই জিনিস খাওয়ার জন্য সামনে রাখা ছিল খেজুরের গুড়, মধু, মাছ ভাজা, হাঁসের ভুনা। শ্বশুর আবার বললেন, মাছ ভাজা দিয়েই শুরু করো বাবাজি। আমি খেলাম।
নতুন জামাই শ্বশুরবাড়িতে গেছি, সবকিছুতেই না না করা নিয়ম। আমি উল্টো আরও চোঙাপিঠার থাল প্রায় খালি করে ফেললাম। মাথা নষ্ট স্বাদ, বুঝলি? পুরোই মাথা নষ্ট!
মামার হাতে বইটা আলগোছে ধরা। ছোটন তাকিয়ে দেখল মামার চোখ যেন চলে গেছে বহু বছর আগে সিলেটের এক গ্রামে। সেই আনন্দ মামাকে যেন আবার ঘিরে ধরেছে। ছোটন আস্তে আস্তে বের হয়ে গেল ঘর থেকে। হোমওয়ার্কটা রাতের মধ্যেই সেরে ফেলতে হবে।
সেই রাতে ছোটন স্বপ্নে দেখল চোঙাপিঠা খেতে বসেছে। স্বপ্নের মধ্যেই সে চিৎকার করছে—মামা আমার মাছভাজাটা কে নিল? মামা?
...
সকাল সকাল ছোটন পড়তে বসেছে। তার মুখ গম্ভীর। মা দুধের বড় গ্লাসটা টেবিলে রেখে গেছে। ওটা শেষ করতে হবে।
দুধের গ্লাসটার দিকে তাকালেই ছোটনের মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। কাল বেসিনে ঢেলে দেওয়ার ব্যাপারটা মা দেখে ফেলেছেন। এ জন্য আজকে ছোটনের রুমেই পেপারটা নিয়ে বসেছেন। খেতেই হবে এই জিনিস, নিস্তার নেই! কিন্তু পড়ার ফাঁকে দুধের গ্লাসটা হাতে নিয়েই ছোটন অবাক হয়ে গেল। এটা কী? লালচে রঙের দুধ! ওপরে আবার সরও ভাসছে! ছোটন মায়ের দিকে তাকাল। মা মিটিমিটি হাসছেন। ছোটন ভয়ে ভয়ে চুমুক দিল।
এ কী! এ তো ভাতের মাড়! একটু নোনতা নোনতা খেতে। দুধের চেয়ে হাজার গুণে ভালো। ছোটন মায়ের দিকে তাকাল। মা হাসতে হাসতে বললেন, তোর মামার বুদ্ধি। দুধ খেতে তোর যে ভালো লাগে না, সেটা মামা জেনে গিয়েছেন। সে জন্যই বললেন আজকে দুধের বদলে লাল রঙের বিরোই চালের মাড় দিতে, একটু লবণ মিশিয়ে।
ছোটন স্যুপের মতো গরম গরম চুমুক দিতে লাগল। মামার আসলে তুলনা হয় না। কী একটা চমৎকার জিনিস দিতে বলেছে! বিরোই চালের মাড়! ছোটন প্রশ্ন করল, আচ্ছা মা, মাড় যদি এত মজার হয়, তাহলে আমরা শুধু শুধু গরুকে খাইয়ে দিই কেন?
ছোটনের প্রশ্ন শুনে মা হাসতে হাসতেই গড়িয়ে পড়লেন।
মামা নাশতায় বসেছেন। বাবাও বসেছেন। মা ব্যস্ত রান্নাঘরে। চুলায় ছ্যাঁতছোঁত শব্দ হচ্ছে। একটু পরেই টেবিলে এল ছিটেরুটি। চালের গুঁড়ির তরল কাই হাতে ছিটিয়ে গরম প্যানে এই পিঠা বানিয়েছেন মা। সঙ্গে আছে ডিম ভাজা, ফালি করে কাটা পনির, মুরগির মাংস।
এপাশে রাখা ছোট ছোট চিতই পিঠা। পিঠার পিঠে গাঁথা আছে ইলিশ মাছ। ফ্রিজের কল্যাণে ইলিশ এখন বারোমেসে খাদ্য।
হয়তো মামা মুখের স্বাদ বদলাতে পাতে তুলে নেবেন একটুখানি বিন্নিভাত। এই ভাত পেটে গেলে জায়গা দখল করে খুব, কাজেই হিসাব করে খেতে হয়। সঙ্গে হয়তো মামা নেবেন শোল মাছের ভুনা। একেবারে কুটি কুটি করে কাটা, স্টুয়ের সাইজে। ওপরে ধনেপাতার সবুজ। বা হয়তো মামা দুধ আর খেজুর গুড়েও চটকে নিতে পারেন।
ওই দেখো আসা শুরু হয়েছে ধোঁয়া ওঠা ভাপা পিঠার ঝাঁক! একেবারে নতুন চালের গুঁড়ি দিয়ে। মুখে দিলে দাঁতের নিচে পড়বে কচকচে নারকেল, মিষ্টি মিষ্টি গুড়। একটু কি লবণের ছোঁয়াও? আরেক রকমের ভাপাও বানানো হয়েছে; ধনেপাতা, নুন আর হালকা কাঁচা মরিচের ঘ্রাণে। এটা অবশ্য মূল স্বাদের ভাপা না, মিষ্টি খেতে খেতে গলা ধরে এলে এই জিনিস খেতে হয়। কে জানে, মামা হয়তো এটাই বেশি পছন্দ করবেন বা করবেন না! পিঠার মাহাত্ম্যে কী আসে-যায় তাতে!
শেষ পাতে অপেক্ষা করে আছে দুধে ভেজানো দুধপুলি। সারারাত রস খেয়ে পিঠাগুলো একেবারে ফুলেফেঁপে আছে। চামচের ছোঁয়া লাগানো মাত্র একেবারে গলে গলে পড়বে। কুয়াশা এখনো পুরোপুরি কাটেনি। এক কাপ চা নিয়ে মামা চলে এলেন বারান্দায়। ছোটন স্পষ্ট শুনতে পেল—চায়ে চুমুক দিয়ে মামা বিড়বিড় করে বললেন, আহা! আমার শীতকাল!
...
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বড় মামারা চলে যান, ছোটনরাও বুড়িয়ে যায়। শীতকাল কিন্তু বছর বছরই আসে। হয়তো নতুন কোনো ছোটন মুগ্ধ চোখে শুনে যাবে তার বড় মামার শীতের খানাখাদ্যের গল্প। হয়তো অন্য কোনো মা তাঁর ভাইজানের জন্য পরম মমতায় গরম গরম ভাপা পিঠা নামাবেন।
বেঁচে থাকুক শীতকাল, বেঁচে থাকুক শীতের সকালের নাশতাগুলো।