নতুন বছরে শিখি নতুন কিছু

নতুন বছরে শিখতে পারো নতুন কিছুমডেল: মাহরিন, ছবি: সুমন ইউসুফ

‘মনের মতন’ কবিতায় সুকুমার রায় কহেন—

‘কান্না হাসির পোঁটলা বেঁধে, বর্ষভরা পুঁজি,

বৃদ্ধ বছর উধাও হ’ল ভূতের মুলুক খুঁজি।

নূতন বছর এগিয়ে এসে হাত পাতে ঐ দ্বারে,

বল্ দেখি মন, মনের মতন কি দিবি তুই তারে?’

তুমি কী ঠিক করলে? নতুন বছর নিয়ে পরিকল্পনা কী? নতুন কী করবে? শিখবে কিছু? শেখা তো স্কুল-কলেজেও হচ্ছে। ও রকম নয়। এমন কিছুর কথা বলছি, যার প্রতিধ্বনি শোনা যায় এই কবিতার বাকি অংশেও—

‘আর কি দিব?—মুখের হাসি, ভরসাভরা প্রাণ,

সুখের মাঝে, দুখের মাঝে আনন্দময় গান।’

‘টু-ডু লিস্টে’ নিশ্চয়ই অনেক কিছুই রেখেছ। কয়েকটি আইডিয়া থাকল এখানেও।

ফার্স্ট এইড

ইউরো ২০২০-এর কথা মনে আছে? ডেনমার্ক-ফিনল্যান্ডের ম্যাচ। খেলা চলাকালে আচমকাই মাঠে লুটিয়ে পড়লেন ফুটবলার এরিকসেন। অ্যাম্বুলেন্সে নেওয়ার আগপর্যন্ত সিপিআর দেওয়া হলো তাঁকে। বুকে চাপ দিয়ে কৃত্রিমভাবে শ্বাসপ্রশ্বাস চালু রাখার পদ্ধতি এটি। হাসপাতালে নেওয়ার পর জানা গেল, কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়েছিল তাঁর। সিপিআর দেওয়া না হলে এরিকসনের মৃত্যু ছিল অবশ্যসম্ভাবী। এই সিপিআর কিন্তু ফার্স্ট এইডের একটি অংশ।

বিদ্যুৎস্পৃষ্ট বা আগুনে দগ্ধ হওয়া, শরীরের কোনো অংশে আঘাত লাগা, সাপে কাটা—জরুরি পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে যেকোনো সময়। হাসপাতালে নেওয়ার আগপর্যন্ত তাৎক্ষণিক সেবা দিলে শঙ্কামুক্ত হওয়া যায় অনেকটাই। তাই নতুন কিছু শেখার অগ্রাধিকারে থাকতে পারে ফার্স্ট এইডের প্রশিক্ষণ।

বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি এ রকম কর্মশালার আয়োজন করে থাকে। তাদের ওয়েবসাইট (https://bdrcs.org/first-aid-training/) ও ফেসবুক পেজে চোখ রেখো। ১০ থেকে ১২ জানুয়ারির প্রশিক্ষণে অংশ নিতে চাইলে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে ৬ জানুয়ারির মধ্যে। এ ছাড়া যুক্ত হতে পারো স্কাউটিংয়েও। ফার্স্ট এইডের ওপর বাড়তি জোর দেওয়া হয় সেখানে। পারদর্শিতা অর্জন করলে প্রদান করা হয় ব্যাজ।

আরও পড়ুন

থিয়েটার

টেনেসি উইলিয়ামসের মতে, থিয়েটার এমন একটি মাধ্যম, যেখানে আমাদের জীবনের নানা দিক, আবেগ, অনুভূতি অন্য যেকোনো শিল্পমাধ্যমের চেয়ে তীব্রভাবে ফুটে ওঠে। এই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে পারো তুমিও। ঢাকা থিয়েটার, নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়সহ বিভিন্ন নাট্যদলের সঙ্গে যোগাযোগের নম্বর পাওয়া যাবে এখানে— www.grouptheatre.org.bd/তালিকাভুক্ত-নাট্যদল

ঘণ্টা তিনেকের কর্মশালার সন্ধান চাইলে ঢুঁ মারতে পারো ওপেন স্পেস থিয়েটারেও— https://openspacetheatre.com/

অলিম্পিয়াড

আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় আগ্রহের বিষয় অন্বেষণের ব্যবস্থা রাখা হয়নি সেভাবে। অলিম্পিয়াডে অংশ নেওয়া এ ক্ষেত্রে অনেকটা ‘আপনাকে আমি খুঁজিয়া বেড়াই’ ধরনের ব্যাপারস্যাপার।

গণিত আর পদার্থবিজ্ঞান তো বটেই; আইকিউ, দর্শন, অর্থনীতি, ইনফরমেটিকস, নিউট্রিশন, রোবটসহ বিভিন্ন বিষয়ে রয়েছে অলিম্পিয়াড। অংশ নিতে পারো সেসবেও। বিস্তারিত তথ্য পাবে আয়োজকদের ওয়েবসাইট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। (https://www.facebook.com/share/p/1FYy5aVZ3v/)। জাতীয় পর্যায়ে সম্মাননা পাওয়ার পাশাপাশি সুযোগ থাকে এসব অলিম্পিয়াডের আন্তর্জাতিক আসরে অংশ নেওয়ারও। তাও আবার ‘টিম বাংলাদেশ’ হিসেবে!

আরও পড়ুন

চ্যাটজিপিটি, জেমিনি, কো-পাইলট

জেনারেটিভ এআইগুলোর মধ্যে এই তিনটি বেশ জনপ্রিয়। শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশই অবশ্য নিজেদের অ্যাসাইনমেন্ট, হোমওয়ার্কের প্রশ্ন এখানে তুলে দেয়। তারপর সমাধান হুবহু নকল করে। এগুলো এআইয়ের সক্ষমতার স্রেফ অপচয়। এক চ্যাটজিপিটি দিয়েই যে কত কিছু করা যায়!

একটু আগে বলা অলিম্পিয়াডের প্রস্তুতি নিতেই এআইয়ের শরণাপন্ন হতে পারো। ধরা যাক, বিজ্ঞান বিভাগে দশম শ্রেণিতে পড়ছ তুমি। অর্থনীতি নিয়ে একটু–আধটু কৌতূহল বোধ করছ ইদানীং। ঠিক করলে ইকোনমিকস অলিম্পিয়াডে অংশ নেবে। তাদের ফেসবুক পেজ ঘাঁটাঘাঁটি করে জানতে পারলে, সিলেবাসে রয়েছে প্রিন্সিপাল অব ইকোনমিকস নামের একটি বই। এই পর্যায়ে এসো কল্পনা করি, সেটি পড়তে গিয়ে কিছু কিছু বিষয় অস্পষ্ট লাগছে তোমার। চ্যাটজিপিটিকে বললে, ওই অংশগুলো সহজ করে ব্যাখ্যা করতে। এআইও ঠিক তা-ই করল। ব্যস, অস্পষ্টতা দূর হলো নিমেষেই।

চ্যাটজিপিটির মতো এআইকে নির্দেশনা দেওয়ার ব্যাপারটির নাম প্রম্পট। একটু কৌশলী হয়ে প্রম্পট দিলে এআইয়ের প্রত্যুত্তরও হয় বেশ কার্যকর। প্রম্পট দেওয়া শিখতে পারো কোর্সেরা, ডেটাক্যাম্প থেকে।

ভাষা

পড়ালেখা, ক্যারিয়ার, বিদেশের দারুণ সব গল্প-উপন্যাস পড়া থেকে শুরু করে একটু আগে বলা অলিম্পিয়াডের প্রস্তুতি, এআইয়ের ব্যবহারসহ সব কিছুতেই বাড়তি সুবিধা পাবে যদি ইংরেজি জানা থাকে তোমার।

ইংরেজিতে লেখা এমনকি কথা বলা চর্চার ক্ষেত্রেও চ্যাটজিপিটির সাহায্য নিতে পারো।

ইংরেজি বাদে স্প্যানিশ, জার্মান, ফ্রেঞ্চ বা অন্য কোনো তৃতীয় ভাষা শেখা রাখতে পারো নতুন বছরের টু-ডু লিস্টে। ডুয়োলিঙ্গো অ্যাপ এ ক্ষেত্রে সেরা।

আরও পড়ুন

নোশন

নোট নেওয়া, জার্নাল লেখা, কোডিং ছাড়াই ওয়েবসাইট নির্মাণ, ডেটাবেজ তৈরি, আর্কাইভ সাজানো—বরং খোঁজা উচিত নোশনে ঠিক কী করা যায় না।

যাহোক, ওয়েব সংস্করণের জন্যে ব্রাউজারে লেখো notion.so। স্মার্টফোনের জন্য অ্যাপই রয়েছে। নোশন ব্যবহার করা মোটেও কঠিন কিছু নয়। তবু দিকনির্দেশনার দরকার পড়লে ভরসা হতে পারে notion.com-এর ব্লগ, টেম্পলেট লাইব্রেরি। ওদের ইউটিউব চ্যানেলে রয়েছে ভিডিও টিউটোরিয়াল।

যবনিকা টানার আগে

‘নতুন বছরে নতুন আমি’ ঘরানার সংকল্প করা সহজ। কী কী শিখব বা কী কী করব, তা নির্ধারণ করাও কঠিন কিছু নয়। দেখা যায় জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে লক্ষ্য পূরণে মহাসমারোহে কাজ করি আমরা। কিন্তু ঝামেলাটা বাধে সেই উদ্যম ধরে রাখার বেলায়। তা ছাড়া অনেকগুলো লক্ষ্য নির্ধারণের পর সব কটা নিয়ে একসঙ্গে কাজ শুরু করলে ভর করে ক্লান্তি। ইংরেজিতে যাকে বলে, ‘বার্ন আউট’। তাহলে সমাধান কী?

এ ক্ষেত্রে মেনে চলা যেতে পারে প্রোডাক্টিভিটি স্পেশালিস্ট আলী আবদালের কিছু পরামর্শ। তাঁর মতে, লক্ষ্যগুলো মনের মধ্যে না রেখে প্রথমেই কাগজে লিখে ফেলতে হবে। তারপর সেগুলো ভাগ করে নেওয়া যেতে পারে ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে। মানে, বছরের প্রথমার্ধের মধ্যেই তোমাকে সবকিছু শিখে ফেলতে হবে, এমন কোনো তাড়া নেই।

আরও পড়ুন

যাহোক, ত্রৈমাসিক বা কয়েক মাস মেয়াদের পরিকল্পনা সাজানো গেল। এরপরের পরামর্শটি হলো, প্রতি সপ্তাহের একটা দিন নিজের সঙ্গে রিভিউ সেশনে বসা। মানে লক্ষ্যগুলো নিয়ে তোমার পরিকল্পনামাফিক অগ্রগতি হচ্ছে কি না, তা পর্যালোচনা করা। এ ক্ষেত্রে কাজে দিতে পারে নোশনের হ্যাবিট ট্র্যাকার টেমপ্লেট।

নতুন কিছু শেখার এই পথচলায় তোমাকে স্বাগত! শেখা শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই ফলাফল পাওয়ার আশা অযথা অস্থিরতা বাড়াবে। তাই, শেখো মনের আনন্দে। থাকো ধারাবাহিক। দেখা যাবে, একটা বিষয় শিখতে গিয়ে সেটা নিয়ে জানাশোনা তো হচ্ছেই, অজান্তেই দক্ষ হবে ভিন্ন আরেকটা বিষয়ে। সামগ্রিকভাবেই হয়ে উঠছ বিকশিত। খুঁজে পাচ্ছ আগ্রহের জায়গা। পরীক্ষার খাতায় তখন ‘এইম ইন লাইফ’ রচনা লেখার বিষয়বস্তু গাইড বই থেকে নয়, সত্যিকার অর্থেই হয়ে উঠবে ‘জীবন থেকে নেওয়া’।

২০২৫ সালে তোমার জীবনে কল্যাণ নেমে আসুক। গাইতে থাকো ‘সুখের মাঝে, দুখের মাঝে আনন্দময় গান’। শুভকামনা!

আরও পড়ুন