টেবিলে রাখা একটা কফির কাপ। সামনে একটা খোলা বই, পেছনে আধখোলা জানালা। বাতাসে জানালার পর্দা উড়ছে।
দৃশ্যটা খুব পরিচিত মনে হচ্ছে, তাই না? অনেকের ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম পোস্ট বা স্টোরিতে দেখা যায় এমন ছবি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘এস্থেটিজম’ বা সৌন্দর্যচর্চার অন্যতম একটি মাধ্যম হয়ে উঠেছে কফির কাপ। চা না কফি—এই প্রশ্ন এলে প্রাপ্তবয়স্করা যেকোনো একটি বেছে নিতেই পারেন। কিন্তু ছোটরা কোনটা বেছে নেবে? কারণ, অতিরিক্ত চা বা কফির কারণে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে কিশোর-কিশোরীরা।
বড় একটা সময় ধরে মানুষ শুধু চা পান করত। সকালে ঘুম থেকে উঠে, বিকেলের নাশতা বা আড্ডায় চলত শুধু চা। এখনো বেশ ভালোভাবেই চলছে চা। তবে চায়ের জনপ্রিয়তায় ভাগ বসিয়েছে কফিও। শহরের বিভিন্ন আনাচকানাচে গড়ে ওঠা কফিশপগুলো মানুষকে দিচ্ছে একটু ভিন্নতার ছোঁয়া। চা আছে আগের মতোই, কিন্তু কফিশপগুলোর কারণে কফির জায়গা হয়েছে একটু আলাদা স্থানে। অনেকের আড্ডার জায়গা এখন কফিশপ। ফলে অনেক কিশোর-কিশোরী এখন আকৃষ্ট হচ্ছে কফির দিকে।
চা হোক কিংবা কফি, সব সময় এগুলোকে ধরে নেওয়া হয় একটু বড়দের পানীয়। একসময় বাসায় মা–বাবা ঠিক করে দিতেন, বাচ্চারা ঠিক কোন বয়স থেকে চা-কফি পান করতে পারবে, কতটুকু পারবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে কিশোর-কিশোরীদের অনেকেই এখন ট্রেন্ড সম্পর্কে সচেতন। অনেকের কাছেই কফি হয়ে উঠেছে নিত্যদিনকার পানীয়। মা-বাবা হয়তো খেয়ালই করছেন না কফির অপকারিতা সম্পর্কে।
শিশুরোগ বিশেষজ্ঞরা বারবার বিভিন্নভাবে অভিভাবকদের সতর্ক করেছেন, যেন শিশু-কিশোরদের ক্যাফেইন গ্রহণের পরিমাণের প্রতি নজর রাখেন তাঁরা। শিশুস্বাস্থ্য নিয়ে নিয়মিত কাজ করা যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘আমেরিকান একাডেমি অব পেডিয়াট্রিক্স’-এর মতে, ১২ বছরের নিচের কোনো শিশুকে ক্যাফেইনযুক্ত চা, কফি, সোডা বা কোনো ধরনের এনার্জি ড্রিংকস দেওয়া যাবে না। ১২ থেকে ১৮ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরীদের দৈনিক সর্বোচ্চ ১০০ মিলিগ্রাম ক্যাফেইনযুক্ত পানীয় দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু যেকোনো সাধারণ কফিশপের এক কাপ কফিতে থাকে প্রায় ৩০০ থেকে ৩৫০ মিলিগ্রাম ক্যাফেইন, যা বিপৎসীমার অনেক ওপরে!
প্রাপ্তবয়স্কদের সঙ্গে শিশু-কিশোরদের মূল পার্থক্য শারীরিক গঠনে। সাধারণত তাদের শরীর ছোট হয়ে থাকে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই, অল্প পরিমাণে ক্যাফেইনেই শিশু-কিশোরদের চাহিদা পূরণ হয়ে যায়। প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত ক্যাফেইন শরীরে গেলে নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে। যেমন হৃৎকম্পন বেড়ে যাওয়া, সময়মতো ঘুম না হওয়া, উচ্চরক্তচাপ, বুক জ্বালাপোড়া ইত্যাদি। নিয়মিত অতিরিক্ত কফি সেবনের ফলে কিশোর-কিশোরীরা অনেক সময় কফির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। তখন কফি খাওয়া বন্ধ করে দিলে তাদের মাথাব্যথা, দুর্বল লাগা, অযথাই বিরক্ত হওয়া ইত্যাদি সমস্যা দেখা দিতে পারে।
বয়সের চেয়ে মূলত শরীরের গঠনের ওপর ভিত্তি করে ঠিক করা হয় ক্যাফেইনের পরিমাণ। অর্থাৎ কোনো শিশু বা কিশোর যদি বয়সের তুলনায় শারীরিকভাবে বেশি লম্বা বা ভালো গঠনের হয়, সে ক্ষেত্রে হয়তো তার ক্যাফেইনের পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে। আবার বয়সের তুলনায় যাদের শরীরের গঠন স্বাভাবিকের চেয়ে একটু ছোট, তাদের ক্ষেত্রে আবার কমিয়ে দিতে হবে।
শুধু ক্যাফেইন ছাড়াও কফির আরও কিছু বাজে দিক রয়েছে। সুস্বাদু করার জন্য বেশির ভাগ সময়েই কফিতে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি চিনি ব্যবহার করা হয়, যার প্রভাব আরও মারাত্মক। অতিরিক্ত চিনি খাওয়ার ফলে অল্প বয়সেই স্থূলতা, হৃদ্রোগ আর দাঁতের রোগে আক্রান্ত হতে পারে শিশু-কিশোরেরা, যা পরবর্তী সময়ে অনেক দিন ভোগাতে পারে তাদের।
ফলে অভিভাবকদের উচিত শিশু-কিশোরেরা দৈনিক ঠিক কতটুকু ক্যাফেইন গ্রহণ করছে, তার দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা। চা-কফি খাওয়া একেবারে বন্ধ করে দেওয়া কিন্তু কোনো সমাধান নয়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক জার্নাল ফ্রন্টিয়ার্স ইন পাবলিক হেলথ-এর ২০২১ সালের এক গবেষণায় উঠে আসে, অভিভাবকেরা যখন বাচ্চাদের জন্য কোনো কিছু নিষিদ্ধ করেন, সে জিনিসের প্রতি বাচ্চাদের আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। এমনকি পরবর্তী সময়ে এ নিয়ে অভিভাবকদের সঙ্গে বাচ্চাদের মনোমালিন্যের পাশাপাশি দূরত্বেরও সৃষ্টি হতে পারে। তাই কফি খাওয়া একদমই নিষিদ্ধ না করে এর ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে বাচ্চাদের বুঝিয়ে বলতে হবে। পাশাপাশি এখন বাজারে ‘ডিক্যাফ’ও পাওয়া যায়। এটিও একধরনের কফি, কিন্তু এতে ক্যাফেইনের পরিমাণ খুব কম। ফলে অভিভাবকেরা ডিক্যাফের ব্যবহারও করতে পারেন।
বিশ্বজুড়ে কফি খুব জনপ্রিয় একটি পানীয়। অন্য সবকিছুর মতো খারাপ দিক রয়েছে কফিরও। কিন্তু তাই বলে শিশু-কিশোরদের কফি খাওয়া বন্ধ করে দিতে হবে, এমনটাও নয়। এর ক্ষতিকর দিকগুলো জেনে মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণ গ্রহণ না করাটাই এর মূল সমাধান।