রাজকন্যা রাপুনজেলের কথা তোমাদের মনে আছে নিশ্চয়ই? যার লম্বা চুল বেয়ে টাওয়ারের চূড়ায় উঠে পড়ে গল্পের নায়ক, এরপর তাকে উদ্ধার করে বন্দিদশা থেকে? সেই রাপুনজেলের ভীষণ প্রিয় ছিল তার লম্বা চুলগুলো। সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে যেত কেবল চুলের যত্নেই। তোমাদেরও তো নিজেদের চুল খুব প্রিয়, তাই না? সকাল থেকে দুপুর না হোক, সারা দিনে একটুখানি সময় ব্যয় করতেই পারো চুলের যত্নে। আর এখন তো শীতকাল। শীতে ত্বকের সঙ্গে সঙ্গে চুলও হয়ে যায় রুক্ষ, হারায় উজ্জ্বলতা। তাই শীত পুরোপুরি জাঁকিয়ে বসার আগেই জেনে নিতে পারো চুলের যত্নের খুঁটিনাটি।
প্রথমেই তোমাদের এক ভুল ধারণা দূর করে দিই। আমাদের প্রচলিত ধারণা রয়েছে যে শীতকালে চুল পড়ার প্রবণতা অন্য মৌসুমের তুলনায় বেশি। আসলেই কি তাই? চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আফজালুল করিম বলেন, ‘শীতকালে চুল বেশি পড়ে এমন ধারণা ভুল। সব ঋতুতেই গড়ে প্রতিদিন পঞ্চাশ থেকে শখানেক চুল ঝরে যায়। একটি চুল পড়লে তার বদলে আরেকটি চুল গজায়, এটিই নিয়ম। শীতে বেশি চুল পড়লে তো শীতের দেশের মানুষের মাথায় চুলই থাকত না!’
তবে আবহাওয়াগত কারণে আমাদের দেশে শীতে স্বাভাবিকভাবেই চুলে দেখা দেয়া রুক্ষতা। এই রুক্ষতা দূর করার জন্য দেওয়া চাই তেল। তেল পেলে কে না খুশি হয় বলো? চুলকে আয়ত্বে রাখতেও তাই ‘তৈলমর্দন’ জরুরী। শুধু মেয়েদের বলছি না কিন্তু, যত্নের প্রয়োজন আছে ছেলেদের চুলেরও। তেলের কথা শুনে আবার তেলে বেগুনে জ্বলে উঠো না যেন! গোসলের আগে চুলে তেল ম্যাসাজ করলে খুব ভালো হয়। কিংবা রাতে তেল দিয়ে ঘুমিয়ে শ্যাম্পু করে ফেলতে পারো সকালবেলা। তবে শ্যাম্পুও কিন্তু করতে হবে নিয়ম মেনে। তোমরা অনেকে ভাবো যে বেশি বেশি শ্যাম্পু ঢাললেই বুঝি কাজ হয়। ‘জ্বালো আগুন জ্বালো’ চেতনায় তোমরা ‘ঢালো শ্যাম্পু ঢালো’। মোটেই তা নয়। অল্প শ্যাম্পুর সঙ্গে অল্প পানি মেশালে দেখবে প্রচুর ফেনা তৈরি হচ্ছে তাতে বেরিয়ে আসবে তোমার চুলে জমে থাকা ময়লাগুলো। যারা শ্যাম্পুর সঙ্গে কন্ডিশনার ব্যবহার করো, এটি অবশ্যই শ্যাম্পুর পরে ব্যবহার করা উচিত, আগে নয়। আর কন্ডিশনার যতটা সম্ভব চুলের আগার দিকে ব্যবহার করতে হবে, চুলের গোড়ায় বা মাথার ত্বকে লাগালে বরং তা আরও ক্ষতিকর।
শীতকালে গরম পানি দিয়ে চুল ধোওয়ার অভ্যাস রয়েছে অনেকের। এটিও চুলকে দুর্বল করে দেয়। এ সময় ভেজা চুলে বেশিক্ষণ থাকলে খুব দ্রুত ঠান্ডা লেগে যায়। তাই গোসলের পরই মাথা ভালোভাবে মুছে ফেলতে হবে, আর ফ্যানের বাতাসে জলদি শুকিয়ে নিতে হবে চুল। ফ্যানের বাতাসে চুল শুকাতে আপত্তি থাকলে ব্যবহার করতে পারো হেয়ারড্রায়ার। তবে ড্রায়ারে সপ্তাহে দু-এক দিনের বেশি চুল শুকানো উচিত নয়। বুঝতেই পারছ, গরম পানির মতো গরম বাতাসও চুলের জন্য ক্ষতিকর।
চুলের একটি বড় সমস্যা হলো খুশকি, যা শীতকালে আরও প্রকট আকারে দেখা দেয়। যাদের খুশকির সমস্যা আছে, তারা তো জানোই এটি কতটা বিব্রতকর। কালো সোয়েটার বা জ্যাকেট পরলে তো কথাই নেই, একটু পর আবিষ্কার করবে ঘাড়ের কাছে তুষারপাত হয়ে গেছে! চুলে দূর্গন্ধ ও চুল পড়ার প্রবণতাও দেখা দেয় খুশকির কারণে। খুশকি হওয়ার সঠিক কারণ আজও জানা যায়নি, তবে ফাঙ্গাস বা অধিক ঘামের কারণে এর বৃদ্ধি ঘটে। তাই বলে জটিল রহস্য নিয়ে মাথা ঘামানো বন্ধ করে দিও না আবার। প্রয়োজন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা।
বাজারে খুশকিনাশক নানা রকম শ্যাম্পু পাওয়া যায়, যা সপ্তাহে দু-তিনবার ব্যবহার করে খুশকি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। এ ছাড়া ঘরোয়া পদ্ধতিতেও চুলে ব্যবহার করতে পারো খুশকি দূর করার বিশেষ প্যাক(সিক্স প্যাক না কিন্তু)। রূপ বিশেষজ্ঞ তানজিমা শারমিন বাতলে দিলেন সেই উপায়, ‘টক দই ও ডিমের সাদা অংশের সঙ্গে মেথি ও হালকা লেবুর রস মিশিয়ে ঘরেই খুশকি দূর করার প্যাক তৈরি সম্ভব। এই প্যাক সপ্তাহে দুই দিন চুলে লাগিয়ে আধা ঘণ্টা পর চুল শ্যাম্পু করে ধুয়ে ফেলতে হবে। এতে খুশকি দূর হওয়ার পাশাপাশি চুল সতেজ ও উজ্জ্বল হবে।’ আর খুশকি না থাকলেও তোমরা ব্যবহার করতে পারো আরেক ধরনের ঘরোয়া প্যাক। এ ব্যাপারে তানজিমা শারমিন বলেন, ‘শীতে চুল স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি শুষ্ক হয়ে যায়, ময়েশ্চার হারায়। এ জন্য পাকা কলা, ডিমের সাদা অংশ, টক দই ও অল্প পেঁয়াজের রস দিয়ে প্যাক বানিয়ে ব্যবহার করা যেতে পারে। এ ছাড়া মেহেদি পাতা চুলের জন্য খুব উপকারী। তবে চুলে বেশি সমস্যা দেখা দিলে বিশেষজ্ঞদের সাহায্য নেওয়া উচিত।’ বুঝেছ, ‘ডিম খাবি না তো কি মাথায় দিবি?’ কথাটা কেউ বললে অবাক হবার ইমো দিও না যেন।
এ ছাড়া যারা বেশি হেয়ার স্প্রে বা জেল ব্যবহার করো, তাদেরও উচিত অতিরিক্ত সাবধান হওয়া। তবে হ্যাঁ, কোনো কিছু নিয়ে বেশি দুশ্চিন্তা করলে কিন্তু চুল পড়বে যেকোনো ঋতুতেই। তাই থাকতে হবে হাসিখুশি। আর তোমরা যারা ক্রাশ ডায়েট করতে চাচ্ছ বা করে ফেলেছ, এটিও কিন্তু চুলের জন্য ক্ষতিকর। শীতকালে প্রচুর তরতাজা ফলমূল ও শাকসবজি পাওয়া যায়, যা তোমার চুলকে আরও মজবুত ও সতেজ করে তুলবে। সেই সঙ্গে নিয়মিত পানি পানের কথা ভুলে গেলে চলবে না কিন্তু! মনে রাখবে, ভেতর থেকে সুস্থ হলে তবেই তোমার বাহ্যিক সুস্থতা বজায় থাকবে। কী, এই শীতে তুমি তৈরি তো?