আমাদের দেশে কিশোরদের বয়সোপযোগী জ্ঞানার্জনের জন্য প্রকাশনার সংখ্যা বিরল। শিশু বা কিশোরসাহিত্য নামে প্রচুর বই প্রতিবছর প্রকাশিত হয়, কিন্তু সেগুলো শিশু বা কিশোরচিত্ত হরণ করতে পারে না। অল্প বয়সী পাঠকদের গ্রন্থের জগতের প্রতি আকৃষ্ট করতে না পারার একটা আক্ষেপ আমাদের আছে বটে, কিন্তু এর বড় কারণ যে আকর্ষণীয় মানসম্মত বইয়ের অভাব, সেটি সব সময় স্বীকার করতে চাই না আমরা। হাতে পাওয়া মুঠোফোন, কম্পিউটার কিংবা ট্যাবের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে শিশু-কিশোরদের বইয়ের প্রতি আকর্ষিত করার কাজটি বর্তমানে আরও দুরূহ হয়ে পড়েছে। সুতরাং এই অসম প্রতিযোগিতা এবং মানসম্মত শিশু-কিশোর গ্রন্থের অপ্রতুলতা – দুই বিপরীতমুখী শক্তি আমাদের গ্রন্থজগতের শাখাটিকে আরও নিষ্প্রভ ও দুর্বল করে নিয়েছে।
এ রকম পরিস্থিতিতে একটি বই হাতে আসার পর কিঞ্চিৎ আশার সঞ্চার হয়েছে বলে এই লেখাটির অবতারণা। বইটির নাম, টাকা এলো কেমন করে। লিখেছেন দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার সাংবাদিক সিরাজুল ইসলাম কাদির।
মানবসভ্যতার বিবর্তনের সঙ্গে সমাজে ও বাজারে পণ্য বিনিময় ব্যবস্থার ক্রমপরিবর্তনের প্রক্রিয়া হিসেবে টাকা বা মুদ্রা প্রচলনের বিষয়টি অন্য বিভিন্ন জিনিসের মতো কিশোরমনের মধ্যে তেমনভাবে জাগ্রত হয় না, কিন্তু লেখক কিশোরসুলভ সরলতায় বিষয়টির মূল থেকে ধীরে ধীরে উঠে এসে পুরো প্রক্রিয়াটা সহজভাবে তুলে ধরেছেন। কিশোরবাসী পাঠকদের অভিমান্য বিষয়টিকে তাদের মধ্যে জাগিয়ে দিতে পেরেছেন, এটিই তাঁর সাফল্য। তাঁর বইটিকে কেবল কিশোর পাঠকদের জন্য নির্ধারিত করে ফেললে অবিচার করা হবে। কারণ, এটি মূলত সব বয়সী পাঠকের পাঠ্যও হতে পারে।
লেখক দেখিয়েছেন, সভ্যতার আদি যুগে পণ্য লেনদেনের জন্য বার্তার ব্যবস্থার পরিবর্তে বিভিন্ন মূল্যবান বস্তু, তিমি কিংবা হাতির দাঁত, ঝিনুকের কড়ি, পাথরের চাকতি, মানুষের মাথার খুলি, পেরেক, তাস, চা-পাতার আঁটি, বিভিন্ন আকৃতির ধাতব খণ্ড—এসব বিচিত্র ধরনের বস্তু টাকা বা বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হতো। তারপর আসে ধাতব মুদ্রার নানা ধরন এবং পরিশেষে কাগজের মুদ্রা বা টাকা। এসব ইতিহাস খুব চমকপ্রদভাবে গল্প বলার মতো করে বর্ণনা করেছেন লেখক, যাতে একজন কিশোর নিজের অজান্তেই ঢুকে পড়তে পারে টাকা বা মুদ্রা আবিষ্কারের ইতিহাসের মতো একটা প্রায় আকর্ষণহীন বিষয়ের মধ্যে।
মুদ্রার ক্রমবিবর্তন এবং আধুনিক ব্যবস্থা সম্পর্কে বিশদ বর্ণনার পর লেখক কিশোর পাঠকদের নিয়ে যান ব্যাংকিংয়ের জগতে। এই বিষয় নিয়েও শিশু-কিশোরদের মধ্যে বিশেষ উৎসাহ দেখা যায় না বলে প্রতিষ্ঠানটির উদ্ভব, ইতিহাস ও ভূমিকা, ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রবর্তনে বিভিন্ন শ্রেণি ও মহলের ভূমিকা ইত্যাদির একটা সংক্ষিপ্ত ও মনোগ্রাহী বর্ণনা উপহার দেন লেখক খুদে পাঠকদের। প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক যুগের ব্যাংকিং সম্পর্কে বইটিতে রয়েছে সংক্ষিপ্ত তথ্যবহুল ইতিহাস। আধুনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থায় স্বর্ণকার, মহাজন ও ব্যবসায়ীদের ভূমিকা যুক্ত করার ফলে অধ্যায়টি একটা পূর্ণাঙ্গ রূপ লাভ করেছে।
ব্যাংকিং ব্যবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে লেখক এটিএম, অনলাইন ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মতো বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করা সেবাগুলোর বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। এই বিষয়গুলো যুক্ত না করলে ব্যাংকিং ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনাটা অসমাপ্ত থেকে যেত। সর্বশেষ অধ্যায়ে ক্রিপ্টোকারেন্সির মতো বিতর্কিত ও বিমূর্ত বিষয়টির অবতারণা করে প্রশংসনীয় কাজ করেছেন লেখক সিরাজুল ইসলাম কাদির। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এটি চালু হলেও অনেক দেশেই এখনো স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি নবতম মাধ্যমটিকে, যার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশও। অর্থব্যবস্থার সর্বশেষ এই সংযোজনটি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা বইটির পাঠকশ্রেণি বিবেচনায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এটির মূল পাঠক কিশোরশ্রেণি যখন আর্থিক জগতে প্রবেশ করবে, তত দিনে ক্রিপ্টোকারেন্সি সম্বন্ধে একটা ফয়সালায় পৌঁছাবে আরও বেশি দেশ এবং হয়তো বাংলাদেশও। বিষয়টি সম্পর্কে এখনই কিছু ধারণা থাকলে পরিণত বয়সে বর্তমান পাঠকদের এ বিষয়ে বুঝতে ও সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হবে।
এ পর্যায়ে একটি পরামর্শ দেওয়া যেতে পারে। টাকা যেমন বিনিময়ের মাধ্যম, চেকও তেমনি নগদ টাকার বিকল্প একটা মাধ্যম, যার মাধ্যমে লেনদেন ভবিষ্যতে আরও বাড়বে। কারণ, চেক, তথা ব্যাংকিং ব্যবস্থার মাধ্যমে লেনদেন একদিকে যেমন নিরাপদ, তেমনি স্বচ্ছ ও বৈধ লেনদেনের সহায়ক একটা মাধ্যম। এটি কর ফাঁকি যেমন বন্ধ করতে পারে, তেমনি রোধ করতে পারে মানি লন্ডারিং। সুতরাং চেক এবং বিভিন্ন ধরনের চেকের বিবরণ ও তাৎপর্য নিয়ে একটা অধ্যায় সংযোজন করা যেত। বইটি যেহেতু টাকা-সম্পর্কিত, তাই একই সঙ্গে মানি লন্ডারিং বিষয়েও কিছুটা আলোকপাত করা যেত। পরবর্তী সংস্করণে এই দুটি বিষয় সংযোজনের কথা ভাবতে পারেন লেখক।
কিশোর পাঠকদের আগ্রহ তৈরি করার জন্য পাতায় পাতায় সচিত্রকরণ বইটির আকর্ষণ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ এবং আকবর আলী খানের মতো দুজন ব্যক্তিত্বের মুখবন্ধ ও ভূমিকা বইটিকে দিয়েছে বাড়তি মর্যাদা।
টাকা এলো কেমন করে | সিরাজুল ইসলাম কাদির
প্রকাশক: ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড
পৃষ্ঠাসংখ্যা: ১৯৭
মূল্য: ৪০০ টাকা