সাকিবের বয়স চার। মা আর দাদা-দাদির সঙ্গে সে থাকে সিলেটের বিয়ানীবাজারে। ছোটবেলা থেকে সমবয়সী অন্য শিশুদের তুলনায় খুব কম কথা বলত সাকিব। কথা কম বলত বললে ভুল হবে, কথাই বলতে পারত না সে। শুরুতে এ নিয়ে মাথা ঘামায়নি বাসার কেউ। সবাই ভেবেছিল আস্তে আস্তে কথা বলা শিখে যাবে সাকিব। অনেক শিশুই দেরিতে কথা বলতে শেখে। কিন্তু চার বছর পার হওয়ার পরও ‘মা’ ছাড়া আর কিছুই স্পষ্টভাবে বলা শিখতে পারল না সাকিব। চিন্তায় পড়ে গেল বাসার সবাই। সাকিবকে নিয়ে যাওয়া হলো চিকিৎসকের কাছে। একজন চিকিৎসক সন্দেহ করলেন, ছেলেটার শ্রবণশক্তি হয়তো একটু কম। ফলে কথা শুনতে পারছে না। পারছে না শিখতেও। কিন্তু পরীক্ষা করে দেখা গেল, শ্রবণে কোনো সমস্যা নেই সাকিবের। একের পর এক চিকিৎসক এবং ওষুধ বদলের পরও কোনো উন্নতি হলো না। সাকিবকে নিয়ে ঢাকায় এলেন তার মা। শরণাপন্ন হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিশুবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. আফিকুল ইসলামের।
সব রিপোর্ট দেখে অভিজ্ঞ এই চিকিৎসক এককথায় বলে দিলেন, শারীরিক কোনো সমস্যা নেই সাকিবের। সারা দিন নিজে নিজে একমনে মুঠোফোন আর টিভির স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকার জন্য কথা বলা শিখতে এত সময় লাগছে তার। তিনি জানান, মুঠোফোন, টেলিভিশনের মাধ্যমে হয় ‘ওয়ানওয়ে কমিউনিকেশন’ বা একমুখী যোগাযোগ। অর্থাৎ এখান থেকে শিশুরা শুধু কথা শোনে। নিজের কিছু বলতে হয় না। তাই কথা বলা শেখা হয় বাধাগ্রস্ত। স্ক্রিন–আসক্তি কমিয়ে নিয়মিত মানুষের সঙ্গে সময় কাটালে স্বাভাবিকভাবে কথা বলা শিখবে সাকিব। অধ্যাপক আফিকুল ইসলামের কথামতো এক মাস মুঠোফোন এবং টেলিভিশন থেকে দূরে রাখা হলো সাকিবকে। কাজ হলো ম্যাজিকের মতো। এই এক মাসে সাকিব যত কথা বলা শিখেছে, গত চার বছরেও তা শিখতে পারেনি।
স্ক্রিন–আসক্তি আজকাল শিশুদের অন্যতম একটি সমস্যা। প্রযুক্তির এই সহজলভ্যতার যুগে স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে রাখা মুশকিল। বিশেষ করে শিশুরা সারা দিনে ঠিক কত সময় ধরে মুঠোফোন, কম্পিউটার, ট্যাবলেট বা টেলিভিশনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে, তা বোঝা খুব কঠিন। পাশাপাশি কোভিড-১৯ মহামারির জন্য দীর্ঘদিন বাসায় বসে থাকায় শিশু-কিশোরদের মধ্যে এ আসক্তি আরও বেড়েছে। এ ধরনের সমস্যা আমাদের দেশে নতুন হওয়ায় বেশির ভাগ মানুষ এখনো স্ক্রিন–আসক্তির ভয়াবহতা সম্পর্কে অসচেতন। ফলে নীরবে আমাদের মারাত্মক শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি করে যাচ্ছে স্ক্রিন–আসক্তি।
শুরুতে উল্লেখ করেছি, স্ক্রিন–আসক্তির কারণে শিশুদের কথা বলা শুরু করতে স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি সময় প্রয়োজন হয়। বেশিক্ষণ স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকার আরও বেশ কিছু ক্ষতিকর দিক রয়েছে। দীর্ঘক্ষণ স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকার ফলে কমে যায় মানুষের সঙ্গে মেশার প্রবণতা। আমরা অনেক সময় দীর্ঘক্ষণ স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকি। কিন্তু তাকিয়ে থাকলেও আসলে মনোযোগ দিয়ে দেখি না। স্ক্রল করে যাই কেবল। তাই নির্দিষ্ট কোনোকিছুর প্রতি মনোযোগ দিতে পারার ক্ষমতা কমে যায়। পাশাপাশি ঘুম কম হওয়া, শারীরিক পরিশ্রমে অনাগ্রহী হওয়া এবং বিষণ্ন হয়ে যাওয়াও স্ক্রিন–আসক্তির অন্যতম ক্ষতিকর দিক।
আমরা যেন স্ক্রিন–আসক্ত হয়ে না যাই, সে জন্য সচেতন হতে হবে সবাইকে। তবে স্ক্রিন–আসক্তি কমানো মানে এই নয় যে মুঠোফোন বা টেলিভিশন একেবারে দেখা যাবে না। সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারলে এগুলো মেধা বিকাশের গুরুত্বপূর্ণ একটি মাধ্যম। মুঠোফোন, ল্যাপটপ ইত্যাদির ব্যবহার না কমিয়েও আমরা স্ক্রিন–আসক্তি থেকে রক্ষা পেতে পারি। বিশেষ করে ছোট ভাইবোনেরা মুঠোফোন বা টিভিতে কার্টুন দেখবেই। মাঝেমধ্যে তাদের সঙ্গে আমরাও কিছু সময় দেখতে পারি। স্ক্রিনে দেখানো অনুষ্ঠান নিয়ে তাদের সঙ্গে আলোচনা করতে পারলে খুব ভালো হয়। যোগাযোগ বাড়ে।
একই সঙ্গে কোন জিনিস কতক্ষণ দেখব, কখন দেখব আর কখন দেখব না, তা ঠিক করে নিতে হবে নিজেদের। প্রয়োজনে অভিভাবকদের সাহায্য নিতে পারি আমরা। রাতে যেন পর্যাপ্ত ঘুম হয়, সে জন্য ঘুমানোর অন্তত দুই ঘণ্টা আগে মুঠোফোন, টেলিভিশন, অর্থাৎ যেকোনো স্ক্রিন থেকে দূরে থাকা ভালো। আরও ভালো বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা। বই আমাদের কল্পনাশক্তি বাড়ায়। এভাবে ছোট ছোট বিষয়ের প্রতি যদি আমরা লক্ষ রাখতে পারি, তাহলে স্ক্রিন–আসক্তি থেকে মুক্ত রাখা কঠিন কোনো ব্যাপার হবে না।
আমরা যে সময়ে দাঁড়িয়ে আছি, সেখানে আসলে আমাদের পক্ষে স্ক্রিন এড়িয়ে চলা সত্যিই খুব কঠিন। তাই স্ক্রিন–আসক্তির ভয়াবহতা সম্পর্কে আমাদের সবার সচেতন হওয়া দরকার। জানা দরকার এর ক্ষতিকর দিকগুলো। স্ক্রিন আমরা নিয়ন্ত্রণ করব। আমাদের যেন স্ক্রিন নিয়ন্ত্রণ না করে।