গরমে কলিজা ঠান্ডা করা খাবার
—বড় মামা?
—উঁ?
—তোমরাও কি ছোটবেলায় এ রকম চিড়া দিয়ে দই-কলা মাখিয়ে খেতে?
—না না, ছি ছি! তা খাব কেন? ছোটবেলায় আমরা চিড়ার সাথে স্ট্রবেরি আইসক্রিম মাখিয়ে খেতাম। প্রশ্নের কী ছিরি!
—না মানে, আমি জিজ্ঞেস করতে চাইছিলাম, গরম বেশি পড়ছে দেখে মা প্রায়ই চিড়া ভিজিয়ে দই-কলা আর আম মাখিয়ে ইদানীং সকালের নাশতা দিচ্ছে। তোমাদের ছোটবেলায়ও গরমের দিনে এমন নাশতা হতো?
—তা হতো মাঝে মাঝে। কথা বলিস না তো বাপু। দইটা আজকে চিড়ার সাথে একেবারে মাখো মাখো হয়েছে। এর সাথে পাকা কলাটাও লাগছে যেন ক্ষীর! তোর কথায় খাওয়ার তাল কেটে যাচ্ছে।
—দই তো ভালো লাগবেই। তুমি আসবে শুনে বাবা বগুড়া থেকে দই আনিয়ে রেখেছে।
—তাই? সেটা বলবি তো! ঢাকায় বসে বগুড়ার দইয়ের নামে এটা-সেটা খেয়ে আমরা মুখ বাঁকাই। আসল বগুড়ার দই যদি গিয়ে খেতে পারিস, কোনো তুলনা চলে না!
—মামা, বললে না তো গরমের দিনে তোমরা কী খেতে ছোটবেলায়?
—আমরা? অনেক সময় পান্তা খেতাম। পান্তা খেলে সারা দিন শরীরটা ঠান্ডা ঠান্ডা থাকে। পান্তা কপকপিয়ে খেয়ে নিতাম পেঁয়াজ-মরিচ আর শুঁটকি ভর্তার সঙ্গে। অনেক সময় আবার পানিভাতের সঙ্গে কাঁঠাল চটকে খেয়ে নিতাম। ওটারও একটা মজার টেস্ট ছিল।
—পান্তা তো মজার খাবার। আমরা পয়লা বৈশাখে খাই।
—পয়লা বৈশাখে খাওয়ায় দোষ নেই ছোটন সোনা। তবে অন্য সময়েও মাঝেমধ্যে খেয়ো। উহ্, ফ্যানের স্পিডটা আরেকটু বাড়িয়ে দে না!
ছোটন ফ্যানের স্পিডটা পাঁচে তুলে দিল। বড় মামা এ রকমই। হুটহাট আমেরিকা থেকে দেশে চলে আসেন। গত শীতেও এসেছিলেন। এবার এই কাঁঠালপাকা গরমেও। ছোটন জিজ্ঞেস করাতে একগাল হেসে বললেন, ‘আম-কাঁঠালের ছুটি পেয়ে বেড়াতে এসেছি।’
ছোটন অবাক। তাদের আম-কাঁঠালের ছুটি হয়। তাই বলে আমেরিকার ইউনিভার্সিটির প্রফেসরদেরও আম-কাঁঠালের ছুটি হবে নাকি?
—আরেকটা খাবারও মাঝেমধ্যে খেতাম আমরা গরমে। বড় মামা বললেন। খই। সঙ্গে সরওয়ালা দুধ ঢেলে দিতাম। মাঝেমধ্যে পাটালি গুড় থাকত। আহা!
কথাবার্তা শুনে মনে হতে পারে ডাইনিং টেবিলে বসে খুব কেতাদুরস্তভাবে খাওয়াদাওয়া চলছে। আসলে খাওয়া চলছে বারান্দার দোলনার মধ্যে দোল খেতে খেতে। দুজনের হাতে ঢাউস দুটি বাটি। বাড়ির আর সবাই ব্যস্ত। কেবল ছোটনের আম-কাঁঠালের ছুটি চলছে বলে হাতে অঢেল সময়। বড় মামাও ছুটি নিয়ে দেশে এসেছেন বলে অঢেল সময়। অনেক বেলা করে ঘুম থেকে উঠে চোখ-মুখ ফুলিয়ে দুজন চিড়া মাখানো খাচ্ছে।
বড় মামার লুঙ্গি পরা আদুল গা এলিয়ে দেওয়া দেখে কে তাকে স্যুটেড-বুটেড জাঁদরেল প্রফেসরের সাথে মেলাতে পারবে?
ছোটন হঠাৎ চোখ বড় বড় করে বলল, ‘মামা, মেলায় যাবে?’
—কিসের মেলা আবার?
—আম-কাঁঠালের মেলা।
—না না, ঢাকা শহরের এই মেলার মতোন একটু জায়গা ঘিরে আম-লিচু-কাঁঠাল বেচার এই সব জায়গা আমার ভালো লাগে না। গেলে সত্যিকারের মেলাতেই যাব।
—মামা, তোমাকে আমি ওই রকম সত্যিকারের মেলার কথাই বলছি। আমার বন্ধু রাতুল গিয়েছিল ওর বাবার সাথে। ফেসবুকে ছবি দেখেছি। টঙ্গীর ওই দিকে কোথায় যেন। আমি ফোন করে জেনে নিই?
—আচ্ছা দ্যাখ ফোন করে। দুপুরে খাওয়ার পরপর রওনা দিলাম। বিকেলে মেলা দেখা যাবে। তোর মা আবার আমভর্তা বানাবে একটু পরে। মরিচপোড়া দিয়ে। একটু মনে হয় চিনি আর হালকা কাসুন্দিও দেবে। এইবেলা মেলায় গিয়ে মিস করা ঠিক হবে না মনে হয়, কী বলিস?
২
মেলায় ঢুকে বড় মামা আর ছোটন দুজনেই থতমত খেয়ে গেছে। ওরা ভেবেছিল ছোটখাটো কোনো মেলা, কিন্তু ইয়া বড় গেট দেখেই চমকে গেছে। বিশাল বড় মাঠ ঘিরে আয়োজন, তারপরও লোকজনে যেন গিজগিজ করছে। আকাশে আগুনের হলকা এখনো আছে। একটু হাঁটাচলা করলেই লোকজন হাঁপিয়ে উঠছে।
তেষ্টা মেটাতে তাই শরবতের আয়োজনও অনেক রকমের।
তেঁতুলের শরবতের গ্লাস হাতে নিয়ে অনেকের জিবে টাকরার টক্করের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। তেঁতুলের টকটা ভালোই ধাক্কা দিচ্ছে বোঝা যাচ্ছে। পাশেই পাওয়া যাচ্ছে কাঁচা আমের জুস। দুপুরের আগে আগে বাসায় মজা করে কাঁচা আমের ভর্তা খাওয়া হয়েছিল। তারপরও ছোটন আর বড় মামা কাঁচা আমের জুসের অর্ডারই দিল।
এল লম্বা সরু গ্লাসে করে। সাথে স্ট্র বসানো।
চুমুক দিয়েই প্রথমে টের পাওয়া গেল বরফশীতল ঠান্ডা। তারপর একসাথে টের পাওয়া গেল কাঁচা আমের সুগন্ধ, কাঁচা মরিচের হালকা ঝাল, বিট লবণের স্বাদ, কোথায় যেন একটু পুদিনা পাতার ঘ্রাণ। আবার একটু মিষ্টি-মিষ্টিও! বড় মামা বললেন, ‘বাহ্, বেশ মেলা তো! আমের জুস খেয়ে মন ভরে গেল।
ওদিকে বাঁদরনাচের আসর বসেছে। ডুগডুগির তালে তালে বাঁদর নাচছে। কেউ কেউ সাহসী হয়ে এগিয়ে এলে তার ঘাড়ে উঠে মাথা চুলকেও দিচ্ছে।
পপকর্ন যেমন মুভিস্ন্যাক্স, এই সব মেলার তেমন অনুষঙ্গ হলো মুরালি। লোকে কচরমচর করে মুরালি খেতে খেতে বাঁদরের নাচ দেখছে। বড় মামা আর ছোটন কিছুক্ষণ মুরালির প্যাকেট হাতে নিয়ে বাঁদরের খেলা দেখল। তারপর টিয়া পাখি নিয়ে গম্ভীর মুখে বসে থাকা জ্যোতিষীর ভাগ্য গণনা দেখল।
ওই দিকে তখন ধুম পড়েছে বাক্সে করে আইসক্রিমের। কাঠির মাথায় নারকেলি আইসক্রিম। সাথে আছে স্যাকারিন দেওয়া পাইপ আইসক্রিম। ছোটনের খুব খেতে ইচ্ছে করছিল, মামার কথা ভেবে সুড়ুৎ করে লালা আটকাল।
গ্রামীণ আইসক্রিমের বাক্সের পাশেই শহুরে আইসক্রিমের ভ্যানগাড়ি। তাতে চকোলেট মিল্ক আছে, চকবার আছে, নানা ফ্লেবারের কোন আছে।
আহা! ওই পাশে দেখো ফলের বাহার। বাজারে ইন্ডিয়ান আম কিছু কেনাবেচা শুরু হয়েছে। টক-টক আম। হলুদ রং দেখলে মানুষ তো আর কাঁচা আমের মতো হিসাব করে মুখে দেয় না, খপ করে মুখ পোরে! আর শিরশিরে টকে দাঁতে স্পার্ক করলে নাকমুখ বাঁকিয়ে লাফিয়ে ওঠে! জ্যৈষ্ঠ মাস আসি আসি করছে। কিছুদিনের মধ্যেই বাজারে আসবে সুমিষ্ট আঁশের দেশি পাকা আম। ছোট বাচ্চাদের খালি গায়ে ও রকম একটা আম হাতে ধরিয়ে বসিয়ে দেওয়া হবে। দু-এক গাল মুখে দেবে, বাকিটা রসে ওরা গোসল করবে!
লিচুকে দেখলে এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে স্ট্রবেরির খালাতো ভাই। কয়েক দিনেই অবশ্য তোবড়ানো গালে মাংস লাগবে। সবুজ রং হয়ে যাবে একেবারে মেমসাহেবের গালের মতো টুকটুকে লাল! কাঁঠালের এঁচোড় খাওয়া শুরু হয়ে গেছে আগেই। ছোটনের বাবাও কসাইয়ের কাছে কচি বাছুরের জন্য ধরনা দিচ্ছেন। ওই জিনিস দিয়ে কাঁঠালের তরকারির তুলনা নেই! ছোটনের বড় মামাকে এবার খাওয়াতেই হবে।
কলা এই মুহূর্তে আর কলা নেই, খোসায় পোরা ফিরনি! এক ডজন কিনলে বিক্রেতা আবার একটা ফ্রি দেয়! পেকে একেবারে ফেটে পড়া বাঙ্গির সুগন্ধে ম-ম করছে মেলা। তরমুজের লালে রক্তলাল মানুষের ওষ্ঠ, গাল, গলা। উৎসাহ নিয়ে দা হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে তাল বিক্রেতার দল! ভটভট শব্দ তুলে বরফঠান্ডা আখের শরবত বানিয়েই যাচ্ছে কারিগর।
একধারে দাঁড়িয়ে থাকা জামগাছে বাতাস এলেই টুপটাপ ঝরে পড়ছে কাঁচা-পাকা জাম! কয়েক দিন পরেই ফেরিওয়ালারা বসাবে কাঁচামরিচ-শর্ষের তেলে মাখা মাখা জামভর্তার পসরা। আনারস ছুটিয়ে দিচ্ছে রসের ফোয়ারা। ওদিকে দেশিয়াল ভাই লটকন, জাম্বুরা, সফেদা, আতা ফলেরা তো আছেই!
কোণের দিকে এক লোক ডুগডুগির মতোন বাজাচ্ছে। কাছে গেলে বোঝা গেল তার আকর্ষণ হলো কুলফি মালাই। অর্ডার দিলেই টিনের চাকতি খুলে খুলে কলাপাতায় তুলে দিচ্ছে। ছোটন আর বড় মামা একটা করে খেল, তারপর আরেকটা, তারপর আরেকটা। তাদের চোখমুখ বন্ধ, মুখে ভাবালুতা, জিবে স্বর্গসুখ।
নাগরদোলার ক্যাঁচকোঁচ আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। ছোটন আর বড় মামা ওই দিকে হাঁটা দিল। আম-কাঁঠালের মেলায় এসে নাগরদোলায় চড়া হবে না, এ হয় নাকি?