আচ্ছা বলো তো, এই পৃথিবীতে সবচেয়ে কঠিন কাজ কোনটি?
কী ভাবছ, এভারেস্ট জয় করা? অঙ্কে এক শতে এক শ পাওয়া? ক্লাসরুমে কাউকে কলম ধার দিয়ে সেটি আবার ফেরত চাওয়া?
উঁহু, এগুলো প্রতিটিই অত্যন্ত কষ্টসাধ্য কাজ বটে, কিন্তু পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ মোটেই নয়। সবচেয়ে কঠিন কাজ হলো, কারও কাছে আন্তরিকভাবে ক্ষমা চাওয়া। জানো বোধ হয়, এলটন জনের একটি গানই আছে, ‘সরি সিমস টু বি দ্য হার্ডেস্ট ওয়ার্ড’। সত্যিই তা-ই। কারও মনে আঘাত দেওয়ার পর শুধু বলার জন্য বলা না, একদম মন থেকে অনুভব করে তাকে ‘দুঃখিত’ বা ‘সরি’ বলে ক্ষমা চাওয়ার মতো কঠিন কাজ আর দ্বিতীয়টি হয় না।
এখনো বিশ্বাস না হলে তুমি তোমার নিজের জীবনের দিকেই তাকিয়ে দেখো। এমনকি কখনো হয়নি যে তুমি ঝোঁকের মাথায়, উত্তেজিত হয়ে কাউকে এমন কোনো কটু কথা বলে বসেছ যে তার চোখে জল চলে এসেছে? কথাটি বলার পরপর তোমারও বড্ড খারাপ লেগেছে। তবু তুমি সংকোচে তাকে ‘সরি’ বলতে পারোনি। তোমার মনে হয়েছে, তাকে ‘সরি’ বলা মানে সবার সামনে নিজেই ছোট হয়ে যাওয়া, নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করে ফেলা। অনেকে আবার মনে করে, ‘বন্ধুত্বে আবার সরি কিসের? নো সরি, নো থ্যাংক ইউ!’
তাই তুমি মনে মনে অনুতপ্ত হলেও সরাসরি কখনোই ক্ষমা চাওনি বন্ধুর কাছে। কদিন বাদে অবশ্য ঠিকই তার সঙ্গে মিলে গেছ। এমন ভাব করেছ যেন তোমাদের মধ্যে কখনো কোনো ঝামেলাই হয়নি! অথবা হয়তো এমন হয়েছে যে ওই একটি ঘটনার সূত্র ধরে চিরতরেই তোমাদের বন্ধুত্ব ছিন্ন হয়ে গেছে।
এ রকম উদাহরণ আসলে আমাদের সবার জীবনেই কমবেশি আছে। আমরা ভাবি, কাউকে ‘সরি’ বলা হলো নিজের দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ। কিংবা আমাদের সম্পর্ক এতটাই গাঢ় যে ‘সরি’ বলার দরকারই নেই কোনো! তাই আমরা মনে মনে ‘সরি’ হলেও অনেক ক্ষেত্রেই মুখ ফুটে সেটি উচ্চারণ করি না। ফলে অনেকের সঙ্গেই আমাদের সহজ-সরল সম্পর্কে চিড় ধরে যায়।
বাস্তবতা হলো, কারও সঙ্গে সম্পর্ক যতই ঘনিষ্ঠ হোক না কেন, তাকে ‘সরি’ বা ‘থ্যাংক ইউ’ বলা যেতেই পারে। মাঝেমধ্যে এগুলো বলা দরকারও বটে। তা ছাড়া নিজের ভুল বুঝতে পেরে কারও কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করা কখনোই দুর্বলতার পরিচায়ক নয়। যারা এমনটি ভেবে থাকে, তাদের মনটাই আসলে অনেক বেশি দুর্বল, ঠুনকো। অপর দিকে যারা নিজেদের ভুলত্রুটি স্বীকার করতে ভয় পায় না, তারাই প্রকৃতপক্ষে শক্তিশালী মনের অধিকারী। তারাই জানে, কারও মনে কষ্ট দেওয়ার পর আবার তার মন ভালো করে দেওয়ার মধ্যে নিহিত রয়েছে প্রকৃত মনুষ্যত্ব।
তো, এতক্ষণে তো বুঝতে পারলেই যে কেন কাউকে ‘সরি’ বলা পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কিন্তু একই সঙ্গে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও অত্যাবশ্যক একটি কাজ।
তবে এমনটি মনে করার কোনো কারণ নেই যে কাউকে শুধু ‘সরি’ বললেই হয়ে গেল। সেই ‘সরি’ বলায় কতটা আন্তরিকতার ছাপ রয়েছে, সেটিও কিন্তু মাথায় রাখতে হবে। তাই চলো, জেনে নেওয়া যাক, কীভাবে আন্তরিকতার সঙ্গে কারও কাছে ক্ষমা চাওয়া যেতে পারে, যাতে সত্যিই মনে কষ্ট পাওয়া মানুষটির আঘাত প্রশমিত হবে।
সরাসরি বলো তোমার ভুলটি আসলে কী ছিল
নিজের মুখে নিজের ভুল স্বীকার করা অত্যন্ত সাহসী একটি কাজ। এবং এটিই মনে কষ্ট পাওয়া মানুষটিকে বোঝানোর জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে তুমি তোমার ভুলটি বুঝতে পেরেছ। তাই কাউকে স্রেফ ‘আচ্ছা যাও, আমি সরি!’ বলেই দায়িত্ব সেরে ফেলো না। এতে ক্ষমাপ্রার্থনার ব্যাপারটি অনেক খেলো হয়ে যায়। বরং স্পষ্টভাবে, সাজিয়ে-গুছিয়ে বলো, তোমার ভুলটি আসলে কোথায় ছিল।
হতে পারে তুমি কারও উচ্চতা নিয়ে উপহাস করেছ। তাহলে ক্ষমা চাওয়ার প্রথম ধাপে তাকে বলতে পারো, ‘আমি তোমার হাইট নিয়ে মজা করেছি। বলেছি তুমি অনেক খাটো। এতে তুমি মনে আঘাত পেয়েছ। কাজটি আমার একদমই করা উচিত হয়নি। এ জন্য আমি সরি।’
সহমর্মী হও
empathy শব্দটির অর্থ জানো তো? বাংলায় একে বলে সহমর্মিতা। তবে অনেকেই কাছাকাছি আরেকটি শব্দের সঙ্গে একে গুলিয়ে ফেলে। সেটি হলো sympathy । কিন্তু sympathy ও empathy পুরোপুরি এক নয়। যখন তুমি অন্যের অনুভূতি বুঝতে পারো, তখন সেটিকে বলে sympathy। আর যখন তুমি অন্যের অনুভূতি নিজেও মন থেকে অনুভব করতে পারো, তখন সেটিকে বলে empathy। কারও মনে কষ্ট দিয়ে ফেলার পর শুধু sympathy দেখানোই যথেষ্ট নয়। দরকার empathy প্রদর্শনও। তাই তোমাকে যা করতে হবে তা হলো, অন্যের জুতোয় পা গলিয়ে অনুভব করতে হবে, তার আসলে কেমন লাগছে। ধরো, কেউ পরীক্ষায় বাজে ফল করেছে বলে তুমি তাকে কটাক্ষ করেছিলে। তাহলে ক্ষমা চাওয়ার সময় তুমি তাকে বলতে পারো, ‘তোমার মার্কস নিয়ে মশকরা করা আমার উচিত হয়নি। আমি নিজেই বুঝতে পারছি তোমার এই মুহূর্তে কেমন লাগছে। একবার জানো তো, আমিও পরীক্ষায় বাজে ফল করার পর বন্ধুরা আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করেছিল। তখন কী যে খারাপ আমার লেগেছিল!’
নিজের কৃতকর্মের দায় নিজেই পুরোটা নাও
কথায় আছে, এক হাতে তালি বাজে না। যদিও এ কথা সব ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য নয়, তবে অনেক সময় তা সত্যি হলেও হতে পারে।
তুমি যাকে মনে কষ্ট দিয়েছ, হতে পারে সে-ই প্রথম তোমাকে কোনো উসকানিমূলক কথা বলেছিল। হতে পারে সে-ই প্রথম ঝগড়ার সূত্রপাত ঘটিয়েছিল।
কিন্তু মনে রেখো, কোনো ধরনের উসকানির পরিপ্রেক্ষিতেই তোমার করা খারাপ কাজটা গ্রহণযোগ্য হয়ে যায় না। তুমি যদি কোনো ভুল করে থাকো, সেটি সব সময়ই ভুল। তা ছাড়া তোমার আচরণে বা কাজে আরেকজন কষ্ট পেয়েছে, সেটিও তো অস্বীকার করার জো নেই। তাই ক্ষমা চাওয়ার সময় আকারে-ইঙ্গিতেও তাকে দোষারোপ করাটা কোনো কাজের কথা নয়।
তুমি বরং ক্ষমাপ্রার্থনার পুরোটা সময় নিজের কৃতকর্মের ওপরই ফোকাস করো। বলে যাও যে তোমার তরফ থেকে কী কী ভুল হয়েছে, কীভাবে কীভাবে তুমি তার মনে কষ্ট দিয়েছ, কিংবা তার ক্ষতি করেছ। ভুলেও এমন কিছু বলে বোসো না, যাতে তোমার ভুলটাকে যুক্তি দিয়ে ঠিক প্রমাণের চেষ্টা করা হয়। কারণ, সে ক্ষেত্রে তোমার ক্ষমাপ্রার্থনা গুরুত্ব হারাবে।
তবে হ্যাঁ, আরেকটি কথাও প্রচলিত আছে যে বুদ্ধিমানের জন্য ইশারাই যথেষ্ট। তুমি যার কাছে ক্ষমা চাইছ, তার ঘটে যদি একটুখানিও বুদ্ধি থাকে, তাহলে তোমার কথা শুনতে শুনতে সে-ও বুঝে যাবে যে তার নিজেরও কোথায় ভুল ছিল। আশা করা যায়, নিজের ভুল বুঝতে পেরে সে-ও তখন ক্ষমা চাইবে।
আর যদি না চায়? বেশ, তাহলেও তোমার কোনো ক্ষতি হচ্ছে না। তুমি তোমার করণীয়টা ঠিকভাবে সম্পন্ন করেছ, এটাই সবচেয়ে বড় কথা। পাশাপাশি এই মানুষটির প্রকৃত রূপও তো তোমার চেনা হয়ে গেল। ভবিষ্যতে এই মানুষটির সংস্পর্শ যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলাটাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ!
প্রকৃত বাস্তবতা সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করো
জগতের কোনো কিছুই পুরোপুরি সাদা বা কালো নয়। মাঝখানে অনেক ধূসর জায়গাও থাকে। সুতরাং একটি ঘটনা খুব সোজাসাপটাও না-ও হতে পারে। এমনও হতেই পারে যে তুমি যার কাছে ক্ষমা চাইছ, তার নিজের প্রয়োজনেই ঘটনার অন্তরালের কিছু কিছু বিষয় তার জানা প্রয়োজন। না হলে ভবিষ্যতে ভুল-বোঝাবুঝির অবকাশ তো থেকে যাবেই, সেই সঙ্গে তারও ছোট বা বড় কোনো ক্ষতির আশঙ্কা থাকবে।
যেমন ধরো, তুমি যে কারও মনে আঘাত দিয়েছ, সেখানে তৃতীয় কোনো ব্যক্তির উসকানি ছিল। সেই তৃতীয় ব্যক্তিটি চায় তোমাদের দুজনের সম্পর্ক নষ্ট করতে।
এখন ব্যাপারটা হলো, তৃতীয় ব্যক্তি যতই প্রভাব ফেলুক না কেন, তোমার তরফ থেকে হওয়া ভুলের জন্য তোমাকে আগে ক্ষমা চাইতেই হবে। সেটি ঠিকভাবে করা শেষ হলে, তুমি খুবই সংক্ষেপে তাকে ওই তৃতীয় ব্যক্তির ব্যাপারে সাবধান করে দিতে পারো। সে জন্য প্রয়োজনে খানিকটা প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যাও করতে পারো। কিন্তু সেটি যথাসম্ভব সংক্ষিপ্ত রাখলেই ভালো হবে।
মনে রাখবে, তোমার উদ্দেশ্য কেবলই তোমার বন্ধুর ভালো করা। সেটি যেন কোনোভাবেই পরনিন্দা বা পরচর্চায় রূপ না নেয়!
জোরাজুরি কোরো না
তুমি কারও মনে কষ্ট দেওয়ার পর তার কাছে ক্ষমা চেয়েছ, এখানেই তোমার কাজ শেষ। টা টা, বাই বাই। তোমার ক্ষমাপ্রার্থনা শুনে ওই মানুষটির যে মন গলবে, সঙ্গে সঙ্গে সে তোমাকে ক্ষমা করে দেবে, আবার তোমার সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক ফিরিয়ে আনবে, তেমনটি না-ও হতে পারে।
মনে রেখো, আমাদের সবার মন কিন্তু এক রকম নয়। তুমি-আমি হয়তো শুধু ‘সরি’ শুনেই কাউকে মাফ করে দিই। আবার অনেক সময় ‘সরি’ শোনা পর্যন্তও অপেক্ষা করি না। কিন্তু সবাই যে তোমার-আমার মতোই হবে, সেটি কি আশা করা ঠিক? একদমই না। এই পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষেরই নিজস্বতা আছে, স্বকীয়তা আছে, সেটিকে আমাদের সম্মান করতেই হবে।
সুতরাং তুমি ক্ষমা চাওয়ার পরও যদি কেউ তোমার ওপর নারাজ থাকে, মুখ গোমড়া করে থাকে, তাহলে অহেতুক তাকে জোরাজুরি কোরো না। তাকে সময় দাও নিজের মনে গোটা ঘটনাটা ভালোভাবে বুঝে নিতে। কিছুটা সময় পেলে সে হয়তো সত্যিই আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে যাবে। তোমরা আবারও তোমাদের আগেকার সহজ-সুন্দর সম্পর্কে ফিরে যাবে।
কিন্তু যদি সে স্বাভাবিক না হয়? তোমার সঙ্গে আর সম্পর্ক কন্টিনিউ করতে না চায়? এমনটিও হতেই পারে। তোমার ক্ষমাপ্রার্থনায় সর্বোচ্চ আন্তরিকতা থাকা সত্ত্বেও সে এমনটি করতেই পারে। এতে কষ্ট পেয়ো না। ভেবো না তোমার আন্তরিকতায় কোনো ঘাটতি আছে।
ইংরেজিতে বলে না, ‘Let it go,’ তুমিও সেটিই করো। খামাখা আর তাকে ব্যতিব্যস্ত কোরো না। তার থেকে দূরে সরে গিয়েও তুমি তার মঙ্গল কামনা করে যেয়ো সব সময়, সেটিই হবে তোমাদের অতীতের সম্পর্কের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন।