তোমার যা ভালো লাগে, তা–ই করতে থাকো। তোমার ছবি আঁকতে ভালো লাগে, ছবি আঁকো। তোমার গান গাইতে ভালো লাগে, গান করো। তোমার গল্পের বই পড়তে ভালো লাগে, গল্পের বই পড়ো। তোমার লেখালেখি করতে ভালো লাগে, লেখো। তোমার গণিত করতে ভালো লাগে, গণিত করো। তোমার বেড়াতে যেতে ভালো লাগে, ঘুরে বেড়াও।
তোমার যা ভালো লাগে, তা–ই করবে, কিন্তু সেটা কোনো উদ্দেশ্য বা মতলব থেকে করার দরকার নেই। মানে তোমার ক্রিকেট খেলতে ভালো লাগে, কাজেই তোমাকে ক্রিকেটারই হতে হবে—এমন নয়। জীবনের শুরুতেই এত বেশি ক্যারিয়ারিস্ট হয়ো না। উপভোগ করো। এনজয়। খেলতে ভালো লাগে, খেলো। পড়তে ভালো লাগে, পড়ো। তোমার পাহাড়ে উঠতে ভালো লাগে, তাই তোমাকে পর্বতারোহীই হতে হবে, এ রকম আগেভাগে ভাবার দরকার নেই।
সাকিব আল হাসানের বাবা নিজেও খেলোয়াড় ছিলেন। তাঁরা ছেলেকে খেলাধুলায় উৎসাহই দিতেন। কিন্তু সাকিব বেশি বেশি ক্রিকেট খেলতেন। সারাক্ষণ ক্রিকেট নিয়ে পড়ে থাকতেন। এই জন্য সাকিব আল হাসানের বাবা ছেলের ক্রিকেট ব্যাট কেটে ফেলেছিলেন। শোনা যায়, তিনি তিন-চারটা ক্রিকেট ব্যাট কেটে ফেলেছিলেন। আর সব মা–বাবার মতো নিশ্চয়ই সাকিব আল হাসানের বাবা-মা চেয়েছিলেন, ছেলে বড় হয়ে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হোক। কিন্তু ছেলে ক্রিকেট ভালোবাসে। সে মাগুরা থেকে নড়াইলে গিয়ে ক্রিকেট ক্যাম্পে যোগ দিল। সেখানে সে নির্বাচকদের নজরে পড়ে গেল। তাকে আনা হলো ঢাকার কাছে বিকেএসপিতে। বিকেএসপির হোস্টেলে থেকে সাকিব লেখাপড়া আর খেলাধুলা চালিয়ে যেতে লাগলেন। আমরা পেলাম পৃথিবীর এক নম্বর অলরাউন্ডারকে।
আমাদের ক্রিকেটার মোস্তাফিজ ছিলেন সাতক্ষীরা থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরের এক গ্রামে। তিনিও খুব ক্রিকেট খেলতেন। তাঁর বাবাও ছেলের জন্য তিনটা টিউটর রেখে দিয়েছিলেন। তবুও ছেলে শুধু ক্রিকেট খেলে। মোস্তাফিজের মেজ ভাই তখন তাঁকে মোটরসাইকেলের পেছনে করে সাতক্ষীরায় রোজ ৪০ কিলোমিটার নিয়ে যেতেন। সেখানে সুন্দরবন ক্রিকেট একাডেমিতে মোস্তাফিজ ক্রিকেট শিখতেন। এর মধ্য দিয়েই আমরা পেলাম ক্রিকেটার মোস্তাফিজকে।
শচীন টেন্ডুলকার যখন ছোট, তখন তাঁদের বাড়িতে মিটিং বসল। শচীনের বাবা ভালো কবি। তাঁদের মিটিংয়ের বিষয়, ছোট্ট শচীনকে কি ক্রিকেট শিখতে দূরে হোস্টেলে পাঠানো হবে? মিটিং শেষে সিদ্ধান্ত হলো, হ্যাঁ, পাঠানো হবে। ছোট শচীন পরিবার ছেড়ে হোস্টেলে গিয়ে উঠলেন।
এই সব ঘটনা থেকে আমরা বুঝতে পারি, যার যা ভালো লাগে, তাকে তা–ই করতে দেওয়া উচিত। আর এই ভালো লাগার পেছনে ছুটতে গেলে জীবনে কিছু ত্যাগও করতে হয়। কষ্টও স্বীকার করতে হয়।
তোমার চামচ থেকে যেন তেল না পড়ে যায়
এই গল্পটা অনেকবার বলেছি। আবারও বলি। পাওলো কোয়েলহোর লেখা আল কেমিস্ট বইয়ে গল্পটা আমি পেয়েছি।
এক ছেলেকে তার বাবা পাঠালেন পৃথিবীর সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তির বাড়িতে উপদেশ নেওয়ার জন্য। ছেলেটা পাহাড় ডিঙিয়ে, মরুভূমি পাড়ি দিয়ে সেই জ্ঞানী ব্যক্তির প্রাসাদে গিয়ে হাজির হলো। জ্ঞানী ব্যক্তি তখন আরও কয়েকজন মানুষের সঙ্গে বসে গল্প করছিলেন।
ছেলেটা বাবার দেওয়া চিঠি তুলে দিল জ্ঞানী ব্যক্তির হাতে—বলল, আমার বাবা আমাকে পাঠিয়েছেন উপদেশের জন্য। আপনি আমাকে উপদেশ দিন।
জ্ঞানী ব্যক্তি বললেন, তোমাকে আমি উপদেশ দেব। তার আগে তোমাকে একটা চামচ দিচ্ছি। এই চামচে তেল ভরে দিচ্ছি। তুমি পুরো বাড়িটা ঘুরে দেখো। তবে শর্ত আছে—তোমার চামচ থেকে যেন তেল পড়ে না যায়। ছেলেটা পুরো বাড়ি ঘুরল। ফিরে এসে বলল, এবার আমাকে উপদেশ দিন।
জ্ঞানী ব্যক্তি বললেন, বলো তো পাশের ঘরে কী আছে?
আমি বলতে পারব না।
তার পাশের ঘরে?
বলতে পারব না।
কেন পারবে না?
কারণ আমি সারাক্ষণ চামচের দিকে তাকিয়ে ছিলাম, যেন চামচ থেকে তেল পড়ে না যায়। কাজেই আশপাশে কী আছে, সেদিকে আমি তাকাতে পারিনি।
জ্ঞানী ব্যক্তি বললেন, তুমি আবার যাও। তোমার হাতে চামচ থাকবে, চামচে তেলও থাকবে, সেই তেল তুমি ফেলতেও পারবে না; কিন্তু তোমাকে বলতে পারতে হবে, কোন ঘরে কী আছে!
ছেলেটা চামচ হাতে পুরো বাড়ি ঘুরে দেখল। বলল, এবার আমি বলতে পারব কোন ঘরে কী আছে। পাশের ঘরে আছে সুন্দর সুন্দর ছবি, তার পাশের ঘরে আছে সুন্দর কার্পেট। আরেকটা ঘরে আছে ফুলগাছ।
জ্ঞানী ব্যক্তি বললেন, তোমার চামচের তেল কোথায়?
ছেলেটি তাকিয়ে দেখল, চামচ থেকে তেল পড়ে গেছে।
জ্ঞানী ব্যক্তি বললেন, এটাই তোমার প্রতি আমার উপদেশ। আমাদের চামচ থেকে তেল পড়তে পারবে না। কিন্তু আমাদের চারপাশে যা কিছু ঘটছে, তা দেখতে হবে। যা কিছু আনন্দের, উপভোগের, তাতে অংশ নিতে হবে, উপভোগ করতে হবে, উদ্যাপন করতে হবে। করতে হবে, কিন্তু চামচ থেকে যেন তেল পড়ে না যায়।
আমরাও আমাদের যা ভালো লাগে, তা করব। তাতে অংশ নেব। আমরা প্রচুর বই পড়ব, প্রচুর খেলব, প্রচুর বেড়াব, ছোটাছুটি করব। আমরা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দেব, গান করব, নাচ করব, আবৃত্তি করব, ক্লাব করব, বিজ্ঞান ক্লাব, ফটোগ্রাফি ক্লাব, বুক ক্লাব, অ্যাডভেঞ্চার ক্লাব—সব। কিন্তু আমাদের পরীক্ষার পড়াও আমরা পড়ব। আমাদের ফল যেন বেশি খারাপ না হয়ে যায়।