বাঙালি ছাড়াও এ দেশে বসবাস করে আরও অনেক জাতি। যারা ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী নামেই অধিক পরিচিত। ‘কড়া’ তেমনই একটি জাতির নাম। যারা এ দেশে টিকে আছে সবচেয়ে কমসংখ্যক মানুষ নিয়ে। এদের একমাত্র গ্রামটি দিনাজপুরে, বিরল উপজেলার ঝিনাইকুড়িতে। সেখানে বাস করে মাত্র ১৮টি পরিবার।
বাংলাদেশে টিকে থাকা এ ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর একমাত্র গোত্রপ্রধানের নাম জগেন কড়া। তিনি জানান, ‘কড়া’ মানে মাটি খোঁড়া। কোনো এক সময় এ ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী দিঘি খোঁড়ার কাজে যুক্ত ছিল। তখন থেকেই এদের নামকরণ হয়েছে ‘কড়া’। ইংরেজ আমলে ভারতজুড়ে বিভিন্ন জায়গায় বসেছে রেললাইন। পাহাড় কেটে, মাটি খুঁড়ে সেই রেললাইন বসানোর কাজে ঘাম ঝরিয়েছে এ ক্ষুদ্র জাতিসত্তাও। মূলত ভারতের ঝাড়খন্ড থেকে এদের আগমন ঘটে এ অঞ্চলে। এখনো ভারতের ঝাড়খন্ড প্রদেশের দুমকা, গোড্ডা, পাকুর, শাহিবগঞ্জ, হাজারিবাগ প্রভৃতি অঞ্চলে কড়ারা বসবাস করছে।
এই ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর প্রধান উৎসব কারমা। ভাদ্র মাসের পূর্ণিমায় এ উৎসব উদ্যাপন করে তারা। তাদের বিশ্বাস, এটি তাদের অভাবমুক্তি ও সৌভাগ্যলাভের উৎসব। বিরল প্রজাতির ‘খিল কদম’ গাছের ডাল কেটে এনে এ উৎসবে বিশেষ আচার পালন করে কড়ারা। গাছটি তাদের কাছে অতি পবিত্র। গাছের ডাল কেটে আনার কাজটি করে যুবকেরা। আর রাতভর উৎসবের মূল আচারে অংশ নেয় শুধু মেয়ে বা নারীরা।
কেন এবং কোন সময় থেকে কড়া জাতিগোষ্ঠীরা কারমা উৎসব উদ্যাপন করে থাকে? এটি জানা যায় উৎসবে তাদের বলা লোকগাথা থেকে। গোত্রপ্রধান জগেন কড়ার মুখে শোনা সেই লোকগাথাটির ভাবার্থ:
কারাম আর ধারাম দুই ভাই। কারাম বড়। ধারাম ছোট। পারাবেতী তাদের একমাত্র বোন। ভাদ্র মাসে একবার গ্রামের এক ধনী ব্যক্তি ঢোল পিটিয়ে তার জমিতে ‘হাউলি’র (ধান গাড়ার) ডাক দেয়। অন্যদের সঙ্গে কারাম-ধারামও যায় সেখানে।
কাজ শুরু হয় খুব ভোরে। কিছু চারা লাগানোর পরেই সকালের নাশতা বা পান্তার ডাক পড়ে। দুই ভাই তখন কলাপাতা বিছিয়ে বসে যায় লাইনে। কিন্তু তাদের কাছে এসেই তা শেষ হয় যায়। পান্তা না পেয়ে বড়ই দুঃখ পায় তারা। নিজেকে সামলে নিয়ে দুপুরে খাবারের আশায় তারা আবার কাজে ফেরে। কিন্তু এবারও ঘটে একই ঘটনা। তাদের কাছাকাছি এসেই খাবার শেষ! ব্যথিত হয় দুই ভাই-ই। রাগে-কষ্টে তারা তাদের হাতে লাগানো রোয়া তুলে ফেলতে রওনা দেয়।
পথেই ছিল একটি বড় বটগাছ। হঠাৎ সে কথা বলে ওঠে। তাদের রাগ ও দুঃখের কারণ জানতে চাইলে, দুই ভাই বটগাছকে সব খুলে বলে।
সব শুনে বটগাছ বলে, ‘তোদের কারমা কপাল জেড় গেলে’, অর্থাৎ ‘তোদের কর্মভাগ্য পুড়ে গেছে।’
এখন উপায়?
‘সাত সমুদ্র লঙ্কা পার হয়ে আনতে হবে কর্মভাগ্যকে’।
বটগাছের কথামতো কারাম-ধারামও রওনা হয় কর্মভাগ্য ফিরিয়ে আনতে।
পথে তাদের সঙ্গে দেখা একটি কুলগাছের। দুই ভাইয়ের ঘটনা শুনে সে-ও জানায় তার দুঃখের কথাটি। তার ফল পেকে মাটিতে পড়ে থাকে কিন্তু কেউ সে ফল খায় না। তার ভাগ্যটিও জেনে আসতে তাদের সে অনুরোধ করে।
যেতে যেতেই কারাম-ধারামের দেখা হয় একটি ডুমুরগাছের সঙ্গে। তাদের লঙ্কা পার হওয়ার কথা শুনে সে আফসোস করে বলে, ‘আমার এমন সুদৃশ্য ফল পেকে থাকে। কিন্তু মানুষ ও পাখি সেদিকে ফিরেও তাকায় না।’ সে অনুরোধ করে তার ভাগ্যটিও জেনে আসার।
কিছু দূর যেতেই কারাম আর ধারামের সামনে পড়ে একটি নদী। নদীতীরে দুটি হাতি নিজেদের মধ্যে মারামারি করছিল। তাদের পুরো শরীর কাদায় ঢাকা। কারাম-ধারামের কথা শুনে তারা দুঃখ করে বলে, ‘আমরা নিজেদের মধ্যে মারামারি করে আর কতকাল কাদায় ঢাকা থাকব? আমাদের কি কেউ গোসল করিয়ে পরিষ্কার করে রাখবে না? তোমরা আমাদের ভাগ্যটিও জেনে এসো।’
নদী পার হয়ে কিছুদূর যেতেই পড়ে লঙ্কা সমুদ্র। কিন্তু বিশাল এ সমুদ্র দুই ভাই কীভাবে পার হবে?
সমুদ্রে ছিল বড় একটি কুমির। সাত দিন আগে তার গলায় বিঁধেছে আইড় মাছের কাঁটা। যন্ত্রণায় তার ঘুম হারাম। সে কারাম-ধারামের সাহায্য চাইল। সমুদ্র পার করা ও নিয়ে আসার শর্তে দুই ভাই কুমিরের গলার কাঁটা বের করে দিল। অতঃপর কুমিরের পিঠে চড়ে লঙ্কা সমুদ্র পার হতেই তারা দেখা পায় তাদের কর্মভাগ্যের।
সারা শরীর তার পোকায় খাচ্ছিল। কারাম-ধারাম স্পর্শ করতেই সেটি গাছ হয়ে গেল। দুই ভাইয়ের মনে তখন অন্য রকম শক্তির সঞ্চার হয়। তখন তারা সেই গাছ ঘাড়ে নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিল।
ফেরার পথে হাতি দুটো তাদের ভাগ্যের কথা জানতে চাইলে কারাম-ধারাম বলে, এমন একজন লাগবে যে তোমাদের শরীর পরিষ্কার করে দেবে। হাতি দুটি মিনতি করে তাদের সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার। দুই ভাই তখন দুই হাতির পিঠে চড়ে বসে।
এরপর ডুমুরগাছ তার ভাগ্যের কথা জানতে চাইলে তারা বলে, তোমার গোড়ার মাটির নিচে সাত কলসি সম্পদ আছে। সেটি সরালেই তোমার ফল সবাই খাবে। ডুমুরগাছ কারাম-ধারামকে তা তুলে নেওয়ার অনুরোধ করে। তারা তখন সাত কলস সম্পদ হাতির পিঠে তুলে নেয়।
কুলগাছের সঙ্গে দেখা হতেই দুই ভাই তাকেও একই কথা বলে। সে-ও মাটির নিচের সাত কলস সম্পদ তুলে নেওয়ার মিনতি করে।
এভাবে দুই ভাই কর্মভাগ্যকে নিয়ে আসে ওই বটগাছটির কাছে। বটগাছ কর্মভাগ্যরূপী ওই গাছটিকে মাটিতে গেড়ে তাদের বোন পারাবেতীকে দিয়ে পূজা করার নির্দেশ দেন। তারা তা-ই করে। কড়া জাতিগোষ্ঠীর বিশ্বাস, সে সময় থেকেই পৃথিবীতে কারমা উৎসবের আয়োজন হয়ে আসছে।
কড়ারা এটিকে কারমা উৎসব বললেও সমতলের অন্য ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর কাছে এটি কারাম উৎসব। কড়াসহ এ অঞ্চলের জাতিগোষ্ঠীরা চরম দারিদ্র্যের মধ্যে জীবন যাপন করছে। তবু প্রতি ভাদ্রে তারা ধুমধামের সঙ্গে উদ্যাপন করে উৎসবটি। তাদের বিশ্বাস, গাছরূপী দেবতা কারাম গোঁসাই একদিন ঠিক ঠিক তাদের ঘরে আসবেন। তাদের দুঃখে ভরা জীবনে লাগবে তখন সৌভাগ্যের সুবাতাস।