‘তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা,
এ সমুদ্রে আর কভু হব নাকো পথহারা।
যেথা আমি যাই নাকো, তুমি প্রকাশিত থাকো,
আকুল নয়নজলে ঢালো গো কিরণধারা।’
‘৮ অক্টোবর ২০২৩, রোববার’, দিনটি আমার জীবনে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। কারণ, সেদিন একজন নটরডেমিয়ান হিসেবে আমার কলেজজীবনের শুভারম্ভ হয়েছে। নটর ডেম কলেজে পড়ার অনেক স্বপ্ন দেখেছি আমি। সেদিন আমার সেই সাধ পূরণ হয়েছে। গায়ে ঘিয়ে রঙের কলেজ ইউনিফর্ম আর কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে যখন নটর ডেম কলেজের প্রাঙ্গণে পদার্পণ করলাম, তখন এক লহমায় মনের মধ্যে কেমন যেন করে উঠল।
সে অনুভূতি আনন্দ আর বেদনার মাঝামাঝি। কখনো মনে হচ্ছিল, আমি খুব খুশি। আবার কখনোবা এই পেরে ওঠার জন্য আমার দুই আঁখি ঝাপসা হয়ে উঠেছিল অশ্রুকণায়। নতুনকে অনুভব করার অভিজ্ঞতায় যেমন বিপুল আনন্দ আছে, তেমনি আশার মধ্যে কিছুটা ভীতিও থাকে। আমারও তেমন হয়েছিল। অসংখ্য নটরডেমিয়ানের ভিড়ে দিশাহারা মনে হচ্ছিল। তবে নটর ডেম কলেজের সবুজ-শ্যামল প্রাঙ্গণ দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখতে দেখতে এগিয়ে যাচ্ছিলাম ফাদার হ্যারিংটন ভবনের তিনতলায়। কাঠগোলাপ, শিমুল, বকুল, শিউলি, কামিনী, জামরুল, শতবর্ষী শিরীষ, আম, লিচুসহ আরও নাম না জানা গাছেরা আগলে ধরে আছে আমার নটর ডেম কলেজকে। শারদপ্রাতে তাদের শীতল স্পর্শ পেয়ে আমি হয়ে গেলাম অভিভূত।
ধীরে ধীরে আমি ৩০৪ নম্বর কক্ষে পৌঁছে গেলাম। স্মৃতিতে মনে পড়ে গেল ১৮ আগস্টের লিখিত ও ২৫ আগস্টের মৌখিক পরীক্ষার কথা। তারপর মনে পড়ল ২৯ সেপ্টেম্বরের কথা, যেদিন আমাদের নবীনবরণ হয়েছিল। সেটা আরেক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। সেদিন একজন নটরডেমিয়ান হিসেবে আমার অভিষেক ঘটেছিল, শপথ করেছিলাম শুভ ও কল্যাণকর উদ্দেশ্য পূরণে সর্বদা নিবেদিত ও আত্মপ্রত্যয়ী থাকব। আগে থেকেই আমার কয়েকজন সহপাঠীদের সঙ্গে পরিচয় ছিল। যদিও ১২৮ জন ছাত্রের ভিড়ে অধিকাংশকেই আমি চিনি না। একটা মজার ব্যাপার হলো যে আমি যেমন খুলনা থেকে এসেছি; আমাদের ক্লাসে সমগ্র বাংলাদেশের নানা অঞ্চল থেকেও অনেকে এসেছে। এখানে সেই টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া কথাটি বেশ মানানসই।
প্রথম পিরিয়ড থেকে শুরু করে ষষ্ঠ পিরিয়ড পর্যন্ত ক্লাস হলো বটে, তবে শিক্ষকেরা পরিচিতি এবং পড়াশোনা করার গুরুত্ব, কৌশল, প্রয়োগ, জীবনদর্শন প্রভৃতি নিয়ে অনুপ্রেরণা দিয়ে সময় কাটিয়ে দিলেন। তাঁদের আশিষবাণী আমার খুব ভালো লেগেছে। এ ছাড়া তাঁদের আন্তরিকতা আর কর্মস্পৃহা আমাকে আশান্বিত করেছে। পরদিন থেকে আমাদের প্রতিটি ক্লাস পুরোদমে শুরু হবে। আর কিছুদিনের মধ্যেই আমাদের কুইজ পরীক্ষা আর ল্যাব ক্লাস আরম্ভ হতে যাচ্ছে।
বাড়ি ছেড়ে ঢাকায় হোস্টেলে থাকতে প্রথম প্রথম আমার খুব কষ্ট লাগত এবং এখনো লাগে। তবু সবকিছুর সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি। আমার বেশ কয়েকজন নতুন বন্ধুও হয়েছে। কলেজের আবৃত্তি দল, গণিত ক্লাব ও লেখককুঞ্জ ক্লাবে যুক্ত হয়েছি। ধীরে ধীরে সবকিছু ভালো লাগতে শুরু করেছে। আজ আমার জীবনের ধ্রুবতারা নটর ডেম কলেজ, আমি তার দেখানো পথেই জীবনের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যের পথে অগ্রসরমাণ। আমার আছে সাদা অ্যাপ্রোন পরার আজন্মলালিত স্বপ্ন। নিরলস পরিশ্রমের মাধ্যমে উচ্চমাধ্যমিকে অধ্যয়নের পুরো সময়টুকুর সম্পূর্ণ সদ্ব্যবহার করার জন্য আমি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আমি জানি, আমি ঠিকই পারব। নিরন্তর প্রার্থনা করি, কল্যাণময় বিশ্ববিধাতা আমার জীবনের লক্ষ্য পূরণে আমাকে পথ দেখাবেন। বিপদে আমাকে অভয়দান করবেন, আমার পাশে থাকবেন।
লেখক: শিক্ষার্থী, একাদশ শ্রেণি, নটর ডেম কলেজ, ঢাকা