ফিলিস্তিনি শিশুর প্রতি লেখা চিঠি
ফিলিস্তিনের শিশুদেরকে উৎসর্গ করা চিঠি, কবিতা ও চিত্রকর্মের একটি অনলাইন প্রদর্শনী করে লেটারস ফর প্যালেস্টিনিয়ান চাইলহুডস (এলফরপিসি)। যার লক্ষ্য হলো ফিলিস্তিনি জনগণকে ঘিরে যেসব অমানবিক বর্ণনা ছড়ানো হয়, সেগুলোর প্রতিক্রিয়া জানানো এবং ফিলিস্তিনিদের মানবিক কাহিনিগুলো তুলে ধরা। এর মাধ্যমে ফিলিস্তিনি শিশুদের নাম, গল্প, অভিজ্ঞতা, স্বপ্ন এবং সংগ্রামের প্রতি মনোযোগ দেয়। ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে এই প্ল্যাটফর্মটি সংহতি জানায়। এটি একই সঙ্গে তুলে ধরে, কীভাবে পশ্চিমা সমর্থিত ইসরায়েলি রাষ্ট্রের সহিংস নীতি ও কর্মকাণ্ড ফিলিস্তিনি শিশুদের জীবনে গভীর প্রভাব ফেলছে। এই কবিতাটি ইংরেজিতে লিখেছেন ড. এলসা তালাত খওয়াজা। কিআ পাঠকের জন্য কবিতাটির ভাবানুবাদ করেছেন আহমাদ মুদ্দাসসের।
তোমাকে ভুলে যাইনি।
আমার প্রিয়, অমূল্য, স্নেহময় গাজার শিশু,
আমি জানি, কোনো কথাই যথেষ্ট না। তোমরা যা সহ্য করেছো, এখনো যা সহ্য করতে হচ্ছে, এই কঠিন সময়ে আমি কলম ধরেছি।
আমি তোমার কাছে এসেছি।
কারণ, এই মুহূর্তে আমি জানি না আর কোথায় যাব।
আমি আটকে আছি এক নিরাপদ ‘কারাগারে’, যেখানে নেই কোনো বোমা, রক্তপাত, মৃত্যু কিংবা ধ্বংস। আর তুমি আছো অসহনীয় এক নিষ্ঠুর বাস্তবতায় বন্দি, যেখানে তোমার কোনো দোষ নেই।
তুমি জেনে রাখো, তোমাকে আমরা দেখছি, শুনছি তোমার কথা, তোমাকে অনুভব করছি।
আমি স্বপ্নে দেখি তোমার আর্তচিৎকার, শুনতে পাই ধসে পড়া কংক্রিটের নিচে চাপা পড়া তোমার কান্না।
তোমার চোখ জলে ভেজা, মুখভর্তি ধুলো আর রক্ত। তোমার মুখে ভয় আর শোকের ছায়া।
তোমার কোমল, ছোট্ট হৃদয়টা হঠাৎই ভরে গেছে কত দুশ্চিন্তা, কষ্ট, ভয় আর বোমার শব্দে।
তোমার শান্ত শিশুসুলভ মনটা হঠাৎ করেই যন্ত্রণা, বেদনা, ভয় ও বোমাবর্ষণের ভারে চাপা পড়ে গেছে।
যে হৃদয় একসময় তারুণ্যের স্বপ্ন, আশা ও ভাবনায় আনন্দিত ছিল, আজ সেখানে ভর করেছে সশব্দ বিস্ফোরণের ক্ষত।
তোমার নিষ্পাপ মুখ আজ বদলে গেছে, প্রজন্মান্তরের ঘৃণার ছাপ পড়েছে মুখে, মৃত্যুর ছায়া ঢেকে দিয়েছে তোমার কোমল ও আলোকিত মুখ।
তোমার কষ্টের সীমা দূর থেকে কল্পনাও করা যায় না, তবুও আমি শুধু বলতে চাই, অনেক মানুষ তোমাকে দেখে, ভালোবাসে। তোমাকে ভুলে যায়নি কেউ, সবসময় তোমার জন্য দোয়া করছে।
তোমার কখনোই এমন যন্ত্রণা আর কষ্ট পাওয়ার কথা ছিল না।
প্রিয়, স্নেহময় গাজার শিশু,
আমরা জানি তুমি পৃথিবীর সবচেয়ে সাহসী, সহনশীল, নির্ভীক এবং অদম্য শিশুদের একজন।
তোমাকে গভীরভাবে ভালোবাসি এবং কখনোই ভুলে যাই না।
তুমি যে কষ্ট সহ্য করেছ, এখনো করছ, তা বলা জন্য কোনো ভাষা যথেষ্ট না।
যখন থেকে খোদা তোমাকে আমাদের মধ্যে আশীর্বাদ হিসেবে পাঠিয়েছেন, তখন থেকেই তুমি সংগ্রামের পথ ধরে চলছো।
তুমি জেনে রেখো, সোনা বাবা… তুমি কোনো ভুল করোনি। এটা তোমার দোষ নয়।
তোমার রক্ত সবচেয়ে পবিত্র।
জেনে রেখো, আমাদের হৃদয় তোমার সঙ্গে কাঁদে। প্রতিদিন আমরা তোমার জন্য দোয়া করি, যেন তোমার হৃদয় মৃত্যু আর ধ্বংসের মধ্যেও টিকে থাকে।
আমরা প্রার্থনা করি, তুমি বেঁচে থাকো, যেন তুমি তোমার গল্পটা বিশ্বকে বলতে পারো, যেন তোমার নিষ্পাপ কণ্ঠস্বর জগৎ শুনতে পায়।
তোমার স্বপ্নগুলো কখনোই যুদ্ধ ও সংঘাতের বাধা পাওয়ার কথা ছিল না। তোমার কখনোই এত রক্তপাত আর হত্যা দেখার কথা ছিল না।
তোমার মনের আশা আকাঙ্ক্ষা আমাদের অন্তরে প্রতিধ্বনিত হবে। তোমার এত আগে চলে যাওয়া নিয়ে আমরা কাঁদি, তুমি নেই, তোমার সহ্য করা কষ্টের কথা ভেবে আমরা কান্না করি।
এ এমন এক গভীর বেদনা, পৃথিবীর নানা প্রান্তে অসংখ্য মানুষ তোমাকে অনুভব করে।
আমি কামনা করি, আমরা এমন এক পৃথিবীতে বাস করব, যেখানে শান্তি, ন্যায়বিচার, ভালোবাসা ও স্বাধীনতা থাকবে সবার জন্য।
যেখানে শিশুর সরলতা, জাতি-ধর্ম-বর্ণ-ভাষা-অর্থনীতি, সব টিকে থাকবে, যুদ্ধ আর সংঘাত থেকে দূরে থাকবে।
কিন্তু, দুঃখজনকভাবে, আমরা এখনো সেই নিষ্ঠুর পৃথিবীতেই বাস করি।
তোমার স্মৃতিই বলবে, কেন শান্তি, কেন চুক্তি আর ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষার প্রতিজ্ঞা করা কেন জরুরি।
তোমার নিঃশ্বাসে এই জগতে আলো ছড়িয়েছ, রেখে গেছ এক অমূল্য উত্তরাধিকার।
আমি দোয়া করি, এই উত্তরাধিকার একদিন এমন এক পৃথিবী গড়বে, যেখানে সব জাতির শিশু একসঙ্গে বেড়ে উঠবে, হাসবে, খেলবে, চিৎকার করবে আনন্দে, স্বপ্ন দেখবে আর সমানভাবে এগিয়ে যাবে।
আমি দোয়া করি, তুমিসহ গাজার প্রতিটি শিশু পাবে বেঁচে থাকা, পড়াশোনা করা, বিশ্ব ঘুরে দেখা, কোনো ভয় ছাড়া, কোনো বাধা ছাড়া নিজের মতো করে বড় হয়ে ওঠার সুযোগ।
আমার প্রিয়তম গাজার শিশু।
তোমাকে ভুলে যাইনি।
আমি জানি, তুমি এখন ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছো।
জানো, তোমার ধৈর্য আর সাহস পুরো বিশ্বকে অনুপ্রাণিত করেছে।
তুমি জন্ম নিয়ে কোনো অপরাধ করোনি।
তোমার জন্ম কোনো ঘৃণার চিহ্ন না।
তোমাকে অন্যায়ভাবে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। কারণ, তুমি জন্মেছো এক অনন্য সুন্দর ফিলিস্তিনে।
আমরা এখন তোমার স্মৃতির পোষাক পরি, তোমাকে আঁকি, তোমার পতাকাকে সম্মান করি, লাল, সাদা, সবুজ ও কালো রঙের পতাকা।
যদি খোদা এখনই তোমাকে আমাদের কাছ থেকে নিয়ে যান, তবে তিনি যেন তোমাকে দেন চিরকালের জান্নাত।
আমি আন্তরিকভাবে ক্ষমা চাই, এই বিশ্ব তোমাকে রক্ষা করতে পারেনি। আমি ক্ষমা চাই, আমাদের আরও কিছু করার ছিল তোমার জন্য, করতে পারিনি।
কিন্তু জেনে রেখো, আমরা এই যুদ্ধে জিততে চলেছি, বিশ্বের কোটি মানুষের হৃদয় ও বিবেক দিয়ে তোমার পাশে আছে। তোমার মৃত্যু, কষ্ট আর যন্ত্রণা বিফলে যাবে না।
প্রিয়তম গাজার শিশু, আমরা কখনো আশা হারাব না। আমরা জানি, তুমি লড়ছো এক অকল্পনীয় পরিস্থিতির সঙ্গে।
আমাদের ক্ষোভ, দুঃখ আর তোমার মুক্তির জন্য আমাদের সংগ্রাম, চিরকাল চলবে।
লড়াই করে বাঁচতে তোমাকে চাই, তোমার চারপাশের মানুষদের পাশে থাকার জন্যও তোমাকে চাই, আগামীর দিনগুলোতে তোমাকে চাই।
তুমি জন্মেছো খাঁচায়, ধ্বংসস্তূপের মধ্যে তোমার জন্ম। তবে জীবনের মধ্য দিয়ে তুমি এই শৃঙ্খল ভেঙে ফেলবে, মুক্ত হয়ে উঠবে।
এই দুনিয়া তোমার স্বাধীনতাকে উদ্যাপন করতে এক হবে।
তুমি তোমার পূর্বপুরুষের মাতৃভূমিতে শান্তিতে বাঁচবে।
আর আমরা লড়ব তোমার হারানো স্বজনের ন্যায়বিচারের জন্য।
এত কষ্টের মধ্যেও তোমার অটুট মনোবল, অকল্পনীয় বিপদের মুখে তোমার সাহস দেখে আমার মন ভরে যায়, শান্তির ভবিষ্যতের আশা পাই।
দূর থেকে তোমাকে ভালোবাসা ও সহানুভূতি জানাই, আমরা তোমার পাশে আছি।
খোদার ওপর বিশ্বাস রেখে, তোমার শক্তি ও ধৈর্য দেখে আশা জাগে, একদিন নতুন ভোর আসবে, যেদিন তোমাদের কান্না ও ভয়ের বদলে থাকবে কেবল হাসি ও আনন্দ।
এই তপ্ত সময়ে তোমার জন্য শান্তি ও শক্তি কামনা করছি। দোয়া করছি, তোমার সাহস, দৃঢ়তা, বীরত্ব এবং বেঁচে থাকার শক্তি যেন অটুট থাকে।
আজ হেরেছি, কিন্তু কাল লড়াই চালিয়ে যাব।
কারণ, নদী থেকে সাগর পর্যন্ত, ফিলিস্তিন হবে স্বাধীন।
তোমার জন্য দোয়া করি।
তোমাকে দিলাম শান্তি, উষ্ণতা ও আশীর্বাদ।
আমার হৃদয়ের সবটুকু দিয়ে তোমার খালা আর বোন,
ড. এলসা তালাত খওয়াজা (ওয়াশিংটন ডিসি, যুক্তরাষ্ট্র)