সাক্ষাৎকার
বড় ভাই হুমায়ূন আহমেদ পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছিলেন, এটা আমার কাছে পুরস্কার পাওয়ার চেয়েও আনন্দময় — আহসান হাবীব
ব্রিটিশ কমিকবুক আঁকিয়ে ডেভ গিবনসের ভাষায় আহসান হাবীব হলেন বাংলাদেশের ‘কার্টুন ড্যাডি’। অবশ্য এ দেশে তিনি সবার কাছে পরিচিত ‘বস’ নামেই! বাবার বদলি চাকরির সুবাদে ছেলেবেলা কাটিয়েছেন বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায়, পড়েছেন দেশের বিভিন্ন স্কুলে। ছোটবেলায়ই গণকণ্ঠ পত্রিকায় মেজো ভাই মুহম্মদ জাফর ইকবালের কার্টুন আঁকা দেখে উৎসাহী হয়ে নিজেই বানিয়ে ফেলতেন কমিকস, আঁকতেন ছোটদের পাতার জন্য কার্টুন। স্কুল ও কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ভূগোল নিয়ে। সে সময়ই ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত হলো দেশের ‘একমাত্র বানান ভুলসর্বস্ব’ রম্য ম্যাগাজিন উন্মাদ। যোগ দিলেন সেখানে। এরপর ব্যাংকিং পেশা ছেড়ে হয়ে গেলেন উন্মাদ প্রকাশক ও পুরোদস্তুর কার্টুনিস্ট। বাংলাদেশের সিংহভাগ কার্টুনিস্টের কার্টুন আঁকার শুরুটা তাঁর হাত ধরেই। বাংলাদেশের কার্টুন আন্দোলনের অন্যতম এই পুরোধা পেয়েছেন তুরস্কের ‘নাসিরুদ্দীন হোজ্জা কনটেস্ট’, ‘হাভানা কনটেস্ট’সহ আরও অসংখ্য পুরস্কার। তিনি বাংলাদেশ কার্টুন অ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টা। সদা হাস্যোজ্জ্বল এই মানুষটি মুখোমুখি হয়েছিলেন কিশোর আলোর সাক্ষাত্কার দলের। সেই দলে ছিল উদয়ন উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মাহাতাব রশীদ, ওয়াইডব্লিউসিএ উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের রাজকন্যা রাজ্জাক, আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজের ইশরাত জাহান, নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আসাদুজ্জামান ও আশা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের সৈয়দা নাহার বিনতে আল রাজি। ছবি তুলেছেন কবীর শাহরীয়ার।
আপনি কি উন্মাদ?
হ্যাঁ, যেহেতু দুই যুগ ধরে উন্মাদ বের করছি, তাই সেটা বলাই যায়। কেউ আমাকে উন্মাদ বললে আমি কিছু মনে করি না।
উন্মাদ-এর সঙ্গে জড়িত হলেন কীভাবে?
আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে এটা শুরু করেছিলাম। কাজী খালেদ আশরাফ আর ইশতিয়াকহোসেন প্রথমে শুরু করেছিলেন। এঁদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ শুরু করি ১৯৭৮ সালে।
আঁকাআঁকির শুরুটা কীভাবে?
আমার মেজো ভাই মুহম্মদ জাফর ইকবাল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় গণকণ্ঠ পত্রিকায় নিয়মিত কার্টুন আঁকতেন। তাঁর একটা বই আছে মহাকাশে মহাত্রাস; সেটার স্ট্রিপ কমিকস আঁকতেন। আমি তখন এইট-নাইনে পড়ি, খুবই ভাল্লাগত এই আঁকাআঁকি দেখতে। সেই উৎসাহ থেকে আঁকাটা শুরু। তখন ডেইলি অবজারভার নামের একটা পত্রিকায় ছোটদের পাতা ছিল, সেখানে কার্টুন আঁকতাম।
আপনার নাম কুদরাত-এ-খুদা রাখা হয়েছিল। পরে ‘আহসান হাবীব’ হওয়ার কারণ—
আমার বাবার একটা অদ্ভুত শখ ছিল—ছেলেমেয়েদের নাম পরিবর্তন করা। বাংলাদেশের বিখ্যাত বিজ্ঞানী কুদরাত-এ-খুদার নাম অনুসারে আমার নাম কুদরাত-এ-খুদা রাখা হয়। কিন্তু আমার কাজকর্মের সঙ্গে বিজ্ঞানের কোনো মিল পাওয়া যাচ্ছিল না বলে নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় মাসুদ আহমেদ। পরে আবার নাম বদলে আহসান হাবীব রাখা হয়। এটি রেখেছিলেন বড় ভাই হুমায়ূন আহমেদ, তাঁর ক্লাসের ফার্স্টবয়ের নাম থেকে।
ছোটবেলায় অনেকবার স্কুল বদল করেছেন, মানিয়ে নিতেন কীভাবে?
বাবার বদলির চাকরি থাকায় দেশের বিভিন্ন জায়গায় একেক স্কুলে পড়তে হয়েছে। পুরোনো বন্ধুদের ছেড়ে যাওয়াটা যেমন কষ্টের ব্যাপার, আবার নতুন বন্ধু তৈরি করাটাও সময়ের ব্যাপার। একটু অসুবিধা হতো, তবে বড় কোনো সমস্যা হয়নি।
ছোটবেলায় কী হতে চাইতেন?
ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ির ড্রাইভার। আমাদের বাসার সামনে দিয়ে যখন ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি পোঁ পোঁ করে যেত, তখন এটা হতে খুব ইচ্ছে করত।
শুনেছি ছোটবেলায় আপনার গানের গলা নাকি অসাধারণ ছিল। গায়ক হননি কেন?
ছোটবেলায় আমি ভালো গান গাইতাম। আমার দুই বোনও ভালো গান গাইত। বাবা মারা যাওয়ার পর তারা আর গায়নি। আমি তাদের কাছ থেকে শিখে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাইতাম। দুইটা গান খুব ভালো পারতাম—একটা ‘মন মোর মেঘেরও সঙ্গী’, আরেকটা ‘সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে’। আমার একটা গিটারও ছিল।
ক্যারিয়ারের শুরুতে ব্যাংকার ছিলেন। পরে তা ছেড়ে হলেন কার্টুনিস্ট। আপনাকে দেখে দেশের সব ব্যাংকার যদি কার্টুনিস্ট হয়ে যান, তাহলে কী হবে?
হলে তো ভালোই! আমাদের কার্টুনিস্টের দরকার আছে। আমি ছিলাম ভূগোলের ছাত্র, সেখানে আঁকাআঁকি করতেই হতো। ভূগোলের মানচিত্র আঁকাকে বলে কার্টোগ্রাফ। কার্টুনে আবার এটা নিয়ে একটা বিভাগ আছে ‘কার্টোগ্রাফটুন’ নামে। ভারতের বিখ্যাত কার্টুনিস্ট সুধীর ধরও ভূগোলের ছাত্র। এ দিক থেকে তাঁর সঙ্গে আমার মিলটা ভালো লাগে।
কার্টুন আঁকার সহজ কৌশল কী কী?
কার্টুন আঁকা খুব সহজ একটা কাজ। ফুল স্কেচ কাগজ, সংবাদপত্র, কলম—এই তিনটা বিষয়ই দরকার হয় কার্টুন আঁকার জন্য। যে কেউ সংবাদপত্র থেকে ধারণা নিয়ে কার্টুনের চরিত্রের মাধ্যমে তার মতামত প্রকাশ করতে পারেন।
আঁকাআঁকি এখন দুভাবে হয়—হাতে কলম-কালি-রং দিয়ে আর গ্রাফিকস প্যাডে। কোনটাকে সমর্থন করেন?
পুলিৎজার পুরস্কারপ্রাপ্ত কার্টুনিস্ট ম্যাট উয়েরকার যখন উন্মাদ-এ এলেন, তিনি আমাকে প্রথমেই জিজ্ঞেস করেছিলেন তুমি আঁকার জন্য কোনো প্রযুক্তি ব্যবহার করো? আমি হাতে আঁকি জানালে তিনি খুশি হয়ে বললেন যে তিনিও হাতে আঁকেন। এখন তো ড্রয়িংয়ে প্রযুক্তি এসে পড়েছে; সমস্ত ক্রিয়েটিভিটির মধ্যেই মেকানিজম তৈরি হয়েছে। যাঁরা গান করেন, তাঁরা যেমন ভয়েস সিন্থেসাইজার ব্যবহার করেন, তেমনি যাঁরা আঁকেন, তাঁরা গ্রাফিকস প্যাড ব্যবহার করেন। ডিজিটালি আঁকাতে কোনো সমস্যা নেই, তাতে আরও দ্রুত ভালোভাবে কাজ করা যায়। কমিকস তৈরির ক্ষেত্রে সেটা সুবিধার। তবে এটা অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে যে একজন শিল্পী যেমন গ্রাফিকস প্যাডে আঁকছেন, সে রকম যেন হাতেও আঁকতে পারেন।
এখন যাঁরা কমিকস করছেন, তাঁদের কমিকসের গল্প বা আঁকাটা একটু বিদেশি ধাঁচের—এমন অভিযোগের সঙ্গে আপনি কি একমত?
এ বিষয়ে আমি একমত না। বাংলাদেশ কার্টুন অ্যাসোসিয়েশন থেকে আমাদের সব সময় বলা হয় যেন কার্টুন আঁকতে গিয়ে আমাদের উপমহাদেশীয় স্টাইলটা বজায় থাকে। তোমরা লক্ষ করলে দেখবে যে বাংলাদেশের বেশির ভাগ কার্টুন বা কমিকগুলোর ব্যাকগ্রাউন্ড দেখে আমাদের দেশ বলে চেনা যায়।
কখনো নিজের কার্টুন নিজে এঁকেছেন?
আমি তো প্রায়ই নিজের কার্টুন আঁকি। বইমেলায় ভক্তদের অটোগ্রাফ দেওয়ার সময় নিজের কার্টুন এঁকে দিই।
নিজেকে নিয়ে কমিকস আঁকতে বললে সেই কমিকসে নিজের কোন দিকটা ফোকাস করবেন?
খুবই কঠিন প্রশ্ন (হাসি)। আমাদের উন্মাদের কার্টুনিস্ট শান্ত যখন নিজেকে নিয়ে কোনো কমিক আঁকত তখন সে নিজেকে সব সময় সুপারম্যান বা অতিমানবীয় কোনো চরিত্র হিসেবে প্রকাশ করত। আমিও নিজেকে সে রকম কোনো অতিমানব চরিত্রে প্রকাশ করব, যে সব অসম্ভবকেই সম্ভব করতে পারে।
আপনার চোখে পৃথিবীর সেরা কার্টুনিস্ট কে?
মেক্সিকান কার্টুনিস্ট সার্জিও অ্যারাগনস। তিনি ‘ম্যাড’-এ আঁকতেন। তাঁর কার্টুনগুলো সংলাপ ছাড়া। তাঁর কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পেয়ে আমিও মাঝেমধ্যে সংলাপ ছাড়া কার্টুন আঁকার চেষ্টা করি।
আপনার চোখে বাংলাদেশের সেরা কার্টুনিস্ট কে?
মেহেদী হক। সৈয়দ রাশাদ ইমাম তন্ময়ও ভালো আঁকে।
বাংলাদেশের কার্টুন এখন যে পর্যায়ে আছে, সেটাকে কি সম্ভাবনাময় বলা যায়?
অবশ্যই। বাংলাদেশের ভবিষ্যত্ খুব ভালো। কার্টুন আঁকাকে আগে পেশা হিসেবে নেওয়া হতো না। এখন হয়। উন্মাদ-এর অনেক কার্টুনিস্ট ভালো ভালো জায়গায় কাজ করছেন। কমিকসের ক্ষেত্রেও ভবিষ্যৎ দারুণ সম্ভাবনাময়।
আমাদের কার্টুন আঁকার ক্ষেত্রটায় মেয়েদের ভূমিকা কেমন?
আমাদের বেশ কয়েকজন মেয়ে কার্টুনিস্ট খুবই ভালো আঁকছে। শিখা, মিতু, বুশরা, জয়িতা—এরা অনেক এগিয়ে গেছে। তারপরও ছেলেদের চেয়ে সংখ্যাটা কম, তাই মেয়েদের সংখ্যাটা আরও বাড়তে হবে।
আপনার জীবনে কি এমন কেউ আছে, যাকে আপনি প্রতিটি মুহূর্তে অনুসরণ করতে চেষ্টা করেন?
আমার বাবাই আমার জীবনের অনুপ্রেরণা। বাবার কাছ থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি। একজন পুলিশ অফিসার হওয়া সত্ত্বেও তিনি একাধারে ছবি আঁকতেন, কবিতা লিখতেন, নাটক করতেন। তিনি একটা টেপরেকর্ডার দিয়ে পরিবারের সবাইকে নিয়ে নাটক করতেন। আমার মনে হয়, বাবা হতে চাইলে তাঁর মতো বাবাই হওয়া উচিত।
আপনি কি সেই অর্থে আদর্শ বাবা?
না, আমি তেমন একটা ভালো বাবা নই। আমি মেয়েকে সময় দিতে পারি না। আমি থাকি আমার জগতে, মেয়ে থাকে তার জগতে।
অনেকেরই ধারণা, যাঁরা মজার সব কার্টুন আঁকেন, তাঁরা রিয়েল লাইফেও সে রকমই মজার—সেটা কি সত্যি?
হ্যাঁ, সত্যি। আমি নিজেও কার্টুন এঁকে মজা করি। তবে আমরা বাঙালি সবাই হাসতে পছন্দ করি। একবার বাংলাদেশে ব্রিটিশ কার্টুনিস্ট জেরমি ট্রেইনার এসেছিলেন। তিনি উন্মাদ-এর হয়ে বিভিন্ন কাজও করেছেন। তিনি আমাকে বলেছিলেন, আমাদের দেশের পথশিশুরা যখন খালি গায়ে রাস্তায় থাকে, তখনো তাদের মুখে হাসি লেগে থাকে। কিন্তু আমেরিকায় একটা শিশুকে প্রতিদিন একটা করে খেলনা কিনে দিলেও এতটা খুশি হয় না। বাঙালিরা স্বভাবতই বাস্তবজীবনেও অনেক রসিক। আমরা খুব অল্পতেই খুশি হই।
প্রতিবাদের মাধ্যম হিসেবে কার্টুন ব্যবহার করেছেন?
হ্যাঁ। গাজায় যুদ্ধ হলো, তখন আমরা সব কার্টুনিস্ট কার্টুন এঁকে প্রেসক্লাবে প্রদর্শনী করেছিলাম। আমরা এ ব্যাপারে ব্যাপক সোচ্চার। কার্টুন অ্যাসোসিয়েশন হওয়ায় জিনিসগুলোতে আরও জোর দেওয়া সম্ভব হয়েছে।
অনেক ক্ষেত্রে কার্টুন কি মানুষের মধ্যে বিভেদ-বিদ্বেষ সৃষ্টি করে?
কার্টুনে আসলে কোনো বিষয়কে অতিরঞ্জন করে আঁকা হয়। কিন্তু অতিরঞ্জনের মাত্রাটা এমন হবে যে যাকে নিয়ে আঁকা হচ্ছে, সে নিজেও মজা পাবে, আবার খোঁচাটাও হজম করবে।
এক গভীর রাতে দেখলেন আপনার আঁকা সব চরিত্র জীবন্ত হয়ে গেছে। তখন কী করবেন?
তখন আর কী করব! ভালো লাগবে। নিজের আঁকা চরিত্র জীবন্ত হয়ে গেলে তো ভালো লাগারই কথা।
আপনি নাকি প্রচুর হাঁটতে পছন্দ করেন?
হ্যাঁ, আমি প্রচুর হাঁটি। অনেকে আছে বাস-রিকশা না পেলে যেন তাদের মাথায় বাজ পড়ে। আমি হাঁটা শুরু করে দিই। যেমন, যখন বইমেলা থেকে বের হই, তখন সঙ্গে অনেক তরুণ ছেলে থাকে, সবাই আমার সঙ্গে হাঁটে, শাহবাগে এসে সবাই বাসে উঠে পড়ে। বাসে প্রচণ্ড ভিড় দেখে আমি হাঁটা শুরু করি। এতই জ্যাম যে আমি ফার্মগেট পর্যন্ত হেঁটে আসার পর দেখি ওরা বাস থেকে আমায় হাত নাড়াচ্ছে! এর জন্যই হাঁটার অভ্যাস করা ভালো। এদিকে আবার ব্যায়ামও হলো।
উন্মাদ-এর নাম ‘উন্মাদ’ কেন?
উন্মাদ-এর জন্য যখন কাজ শুরু করি, তখন আমি কলেজে পড়ি। সে সময় খুব বিখ্যাত ছিল ম্যাড পত্রিকা। ‘ম্যাড’-এর বাংলা করে ‘উন্মাদ’ নামটি রাখা হয়। কিন্তু আমরা যদি আরেকটু বড় হয়ে পত্রিকাটি বের করতাম, তাহলে নাম অন্য কিছুও হতে পারত।
উন্মাদ অফিসে একসঙ্গে দুটি ঘড়ি আছে, যেখানে ভিন্ন ভিন্ন সময় দেখায়। এই ঘড়ির রহস্য কী?
উন্মাদ-এর অফিসের দুটি ঘড়ির একটা ঠিক, আরেকটা উল্টো। উন্মাদ পত্রিকার ‘ন্মা’-র মতো ঘড়িটাও উল্টো সময় দেখায়। এ ঘড়ির মেকানিজম ব্যাংকক থেকে উল্টো করে আনা হয়েছে।
আপনি সবার কাছে ‘বস’ নামে পরিচিত। এই বসের ওপরেও কি কোনো বিগবস আছে?
আমাকে ‘বস’ বলার কারণটা আসলে জানা নেই। হয়তো বয়সের কারণে ‘বস’ বলতে পারে, আর সেই অর্থে জীবনে ‘বিগবস’ নেই। তবে একটা কথা আছে ‘রাজা চালায় রাজ্য, রানি চালায় রাজা!’ আমার ক্ষেত্রেও তা-ই হয়। আমি আমার স্ত্রীর ওপর অনেক নির্ভরশীল।
উন্মাদ-এর অফিসে প্রতিনিয়ত অনেক মজার মজার ঘটনা ঘটেছে। এ রকম একটা ঘটনা শুনতে চাই।
একবার এক ছেলের বেশ কিছু লেখা ছাপার অযোগ্য বলে আমি ডাস্টবিনে ফেলে দিই। পরদিন সেই ছেলে এসে দেখে তার লেখা ডাস্টবিনে। তখন আমি বিব্রত হয়ে গেলাম। তাই তাকে বললাম, উন্মাদ-এর অফিসে সবকিছুই উল্টাপাল্টা হয়। যে লেখাগুলো ছাপানোর জন্য নির্বাচিত, সেগুলোই এই ডাস্টবিনে রাখা হয়। এটা শুনে পাশের রুম থেকে ছড়াকার অনিক খান এসে ডাস্টবিনটা তুলে নিয়ে বলল, ‘বস, এগুলো ছাপতে দিয়ে দিলাম!’
উন্মাদ-এর পাশাপাশি আপনি ট্রাভেল অ্যান্ড ফ্যাশন নামে একটা ভ্রমণ ম্যাগাজিন বের করেন; ভ্রমণ আর ফ্যাশন কি আপনার অনেক প্রিয়?
আসলে ফ্যাশন আমার প্রিয় নয়। আমার কয়েকজন বন্ধুর ফ্যাশন হাউস আছে। ওরা একদিন এসে আমাকে জানাল যে তারা একটা ফ্যাশন ম্যাগাজিন প্রকাশ করবে, সেখানে আমাকে সম্পাদক হতে হবে। তখন আমি জানালাম যে ফ্যাশনের সঙ্গে ভ্রমণ যুক্ত করলে আমি রাজি আছি। আর এই ম্যাগাজিনে শুধু পোশাক নিয়ে ফ্যাশন ছাপানো হয় না; মহাজগৎ, আমাদের চারপাশের জগৎ, মানুষের ভাবনা, উদ্ভিদ, প্রকৃতি—সবকিছুরই ফ্যাশন থাকে।
‘সুখ নাইরে পাগল’—সুখ কি আসলে নাই? সুখ আসবে কীভাবে?
আমাদের এমন দুটো উক্তি আছে, ‘সুখ নাইরে পাগল’ আর ‘কী আছে দুনিয়ায়’। মানুষ যত ভালো কাজই করুক, মানুষের মধ্যে অতৃপ্তি থাকবে। এই অতৃপ্তি মানুষকে পরবর্তী কাজ করতে উৎসাহ জোগায়। আর তাই মানুষ সম্পূর্ণ সুখী হতে পারে না।
উন্মাদ-এর একটি অংশ আছে, যেখানে নিজেদেরই প্র্যাকটিক্যাল জোক ছাপা হয়। আপনার জীবনের একটি প্র্যাকটিক্যাল জোক শুনতে চাই।
রিয়েল লাইফ জোক আর প্র্যাকটিক্যাল জোকের মধ্যে পার্থক্য আছে। রিয়েল লাইফ জোক হচ্ছে যেটা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজে থেকে ঘটে। আর প্র্যাকটিক্যাল জোক হচ্ছে যেটা ইচ্ছাকৃতভাবে ঘটানো হয়। আমার জীবনে প্র্যাকটিক্যাল জোকের অভাব নেই। যেমন—একদিন অফিসে বসে আমি কালো কালি দিয়ে কাজ করছিলাম। এমন সময় ছড়াকার ওবায়দুল গণি চন্দন হন্তদন্ত হয়ে এসে হাজির। চোখে ঝাপসা দেখছেন, তাই সানগ্লাসটা খুলে টেবিলে রেখে চোখে পানি দিতে গেলেন। আমি তখন সানগ্লাসটার কাচ কালো কালি দিয়ে ভরিয়ে দিলাম। গণি এসে চোখে সানগ্লাস দিতেই চিত্কার করে উঠল, ‘ও আল্লাহ! কিছুু দেখি না...’ (হাসি)।
উন্মাদ পড়ে কি কেউ এখন পর্যন্ত উন্মাদ হয়েছে?
এখন পর্যন্ত আমি উন্মাদ পড়ে কাউকে হাসতে দেখিনি, তবে অনেককেই উন্মাদ হতে দেখেছি। আমার অফিসে একবার উদ্ভট একটা ঘটনা ঘটে। এক ছেলে এসে বলল যে সে উন্মাদ-এ কাজ করতে চায়। আমি বললাম, তুমি কি কার্টুন আঁকতে পারো? সে বলল, না। রম্য গল্প লিখতে পারো? সে বলল, না। কম্পিউটার চালাতে পারো? সে তা-ও পারে না। আমি বললাম, তুমি কিছুই পারো না, উন্মাদে কী কাজ করবে? তখন সে বলল, সে আসলে অনেক রাত করে বাড়ি ফেরে। রাত একটা, দুইটা। তাই তার বাবা তাকে বলেছে, ‘তুমি একটা উন্মাদ, বদ্ধ উন্মাদ!’ এ জন্য সে উন্মাদ-এ কাজ করতে এসেছে। তখন আমি তাকে সময়মতো বাড়ি ফেরার উপদেশ দিলাম।
অনেকেই আপনার ভক্ত, আপনি কার ভক্ত?
যারা আমার লেখা পড়ে, যারা টাকা দিয়ে উন্মাদ কিনে পড়ে, আমি তাদের ভক্ত।
আপনার পরিবারে ছোটদের যখনই জিজ্ঞাসা করা হয়, কোন মামা বেশি মজার, তারা নাকি উত্তর দেয় ‘শাহীন মামা’ (আহসান হাবীবের ডাকনাম)। এটা কি আপনি ছোটদের সঙ্গে মিশতে পছন্দ করেন বলে?
ছোটদের সঙ্গে মিশতে অবশ্যই পছন্দ করি। আমার বড় বোনের তিন মেয়ে। ওদের সকালে তিন গ্লাস দুধ খেতে দেওয়া হতো। তারা সেটি আমার কাছে নিয়ে আসত। আমি তিন গ্লাস দুধ খেয়ে ফেলতাম। ওরা খালি গ্লাস দেখিয়ে বলত ওরা খেয়েছে। আসলে তো খেয়েছি আমি (হাসি)। এ ধরনের আরও অনেক মজার কাহিনি আছে। তাই ওরা আমাকে খুব পছন্দ করত।
মানুষের কোন গুণটা আপনাকে বেশি মুগ্ধ করে?
মানুষের ভান না করার গুণটা ভালো লাগে। অনেকে আছে যারা ভান করে থাকে, নিজের সত্যিটা প্রকাশ করে না। যারা ভান না করে মনে যা আছে প্রকাশ করে, তাদের ভালো লাগে।
আমাদের পাঠ্যবইয়ের সঙ্গে শিক্ষামূলক কমিকস থাকলে আমাদের পড়াশোনা কি আরও আনন্দের হতো?
সেটা তো অবশ্যই আনন্দময় হতো। আমাদের দেশের শিক্ষাবিদেরা এটা নিয়ে চিন্তাভাবনা করছেন। বিদেশের ও লেভেল, এ লেভেলের বইগুলোতে কার্টুন যুক্ত করায় বইয়ের বিষয়গুলো অনেক সহজেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আমাদের দেশেও যদি তা করা হয়, তাহলে শিক্ষাপদ্ধতি অনেক সহজ হয়ে যাবে। আর তাতে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করেও মজা পাবে।
শহর এবং গ্রামের মধ্যে কোনটা বেশি ভালো লাগে?
নিঃসন্দেহে গ্রাম। গ্রামে থাকতে সব সময়ই ভালো লাগে। বড় ভাইয়ের নুহাশপল্লীতে যেতেও ভালো লাগে।
তুরস্কের ‘নাসিরুদ্দিন হোজ্জা কনটেস্ট’, ‘হাভানা কনটেস্ট’সহ অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন! সেই মুহূর্তগুলো কেমন ছিল?
(হেসে) অসংখ্য বলাটা ঠিক হবে না। এগুলোই পেয়েছি। আমার পুরস্কারপ্রাপ্তিতে খুশি হয়ে বড় ভাই হুমায়ূন আহমেদ আমাকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। এটা আমার কাছে পুরস্কার পাওয়ার চেয়েও আনন্দময় মুহূর্ত ছিল।
যারা কার্টুনিস্ট হতে চায়, তাদের উদ্দেশে আপনার পরামর্শ কী?
এই ১৬ কোটি মানুষের দেশে ‘বাংলাদেশ কার্টুন অ্যাসোসিয়েশন’-এ কার্টুনিস্ট আছে মাত্র ৫০ জন। আমি তো মনে করি, এখন অনেক কার্টুনিস্ট দরকার। যারা আঁকতে চায়, তাদের মোস্ট ওয়েলকাম। এখনই সময় উন্নতি করার। কোনো যন্ত্রপাতি ছাড়াই শুধু কাগজ আর কলম থাকলেই কার্টুন আঁকা যায়। সেদিক দিয়ে এর থেকে সহজ সৃজনশীল মাধ্যম তো আর নেই।
আপনি নাকি যেকোনো পরিস্থিতি থেকেই আইডিয়া পান। আজকের এই সক্ষাৎকারে মাথায় নতুন কী আইডিয়া এল?
আমি সব সময় বিভিন্ন জায়গা থেকে আইডিয়া নিই। যখন হেঁটে যাই তখন চারদিক খেয়াল করি। কার্টুনিস্টদের পর্যবেক্ষণটা শক্তিশালী হওয়া উচিত। আমি একদিন হেঁটে যাচ্ছি, দুই বন্ধু রাস্তার পাশে বসে খাচ্ছে। একজন আরেকজনকে বলছে, ‘বুঝলি, মানুষের খিদা আসলে চোখে। তারপরে মুখে।’ তখন অন্য বন্ধু বলছে, ‘তাইলে পেটে কী?’ আমি হেঁটে চলে যাচ্ছি বলে এই পর্যন্তই শুনলাম। পরে আমার মাথায় ঘুরছিল ‘পেটে তাহলে কী?’ পরে ভাবলাম পেটে তাহলে গ্যাস। ব্যাপারটা কি আমি বাইরে থেকে নিলাম না? তুমি যদি কার্টুনিস্ট হতে চাও তাহলে চোখ-কান খোলা রাখতে হবে।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
তোমাদেরও অনেক ধন্যবাদ।