অমর্ত্য সেনের জন্ম ১৯৩৩ সালে বাংলাদেশের মানিকগঞ্জ জেলায়। শিক্ষাজীবন শুরু ঢাকার সেন্ট গ্রেগরি উচ্চবিদ্যালয়ে। দেশভাগের সময় ভারতে চলে গেলে ভর্তি হন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় স্কুলে। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অর্থনীতিতে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে বিএ ডিগ্রি অর্জন করে ওই বছরই কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রিনিটি কলেজে পড়তে যান। ১৯৫৬ সালে প্রথম শ্রেণিতে বিএ (সম্মান) ডিগ্রি অর্জন করেন। মাত্র ২৩ বছর বয়সে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। হয়ে যান ভারতের ইতিহাসের সবচেয়ে কম বয়সী অধ্যাপক। যুক্তরাষ্ট্রের ট্রিনিটি কলেজে তিনি ফেলোশিপ লাভ করেন, যা তাঁকে পরবর্তী চার বছর তাঁর ইচ্ছামতো যেকোনো কাজ করার সুযোগ এনে দেয়। তিনি দর্শনশাস্ত্রে অধ্যয়ন করার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৫৯ সালে তিনি ট্রিনিটি থেকে পিএইচডি সম্পন্ন করেন।
বিভিন্ন সময়ে অমর্ত্য সেন অধ্যাপনা করেছেন ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি, স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া অ্যাট বার্কলে, লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি বর্তমানে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। তাঁর লেখা গ্রন্থাবলি ৩০টিরও বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
অমর্ত্য সেন দুর্ভিক্ষ, মানব উন্নয়নতত্ত্ব, জনকল্যাণ অর্থনীতি ও গণদারিদ্র্যের অন্তর্নিহিত কার্যকারণ বিষয়ে গবেষণা এবং উদারনৈতিক রাজনীতিতে অবদান রাখার জন্য ১৯৯৮ সালে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। তিনি জাতিসংঘের বিভিন্ন দেশের শিক্ষা ও মানবসম্পদ উন্নয়ন সম্পর্কে ধারণা পাওয়ার জন্য মানব উন্নয়ন সূচক আবিষ্কার করেন।
গুণী এই ব্যক্তিত্ব ১৯৯৯ সালে ভারতরত্ন উপাধি লাভ করেন। ২০১১ সালে বাংলা ভাষার ধারক ও বাহক হিসেবে বাংলা একাডেমি তাদের বার্ষিক সাধারণ সভায় তাঁকে সম্মানসূচক ফেলোশিপ প্রদান করে।
২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশে এসেছিলেন তিনি। নিজের অতি ব্যস্ত কর্মসূচির মধ্যেই কিশোর আলোর সাক্ষাৎকার দলকে কিছুটা সময় দেন। সেই দলে ছিল ভিকারুননিসা নূন স্কুলের অহর্নিশ অহনা, বিয়াম মডেল স্কুলের মাশায়েখ হাসান, কামরুন্নেসা সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের সুপ্রীতি মালাকার, বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ পাবলিক কলেজের বিভা মোশাররফ ও নটর ডেম কলেজের অংকন ঘোষ দস্তিদার।
প্রশ্ন :
প্রবাদ আছে, ‘অর্থই সকল অনর্থের মূল’। সে ক্ষেত্রে অর্থনীতি কী হিসেবে বিবেচিত হবে?
অর্থনীতির কুপ্রভাবে যে খারাপ জিনিসগুলো ঘটতে পারে, সেগুলো যাতে না ঘটে, সেটা নিশ্চয়ই অর্থনীতিচর্চার একটা প্রধান উদ্দেশ্য। লোকে দারিদ্র্য থেকে খাওয়া-দাওয়া করতে পারে না, অল্প বয়সে মারা যায়, চিকিৎসার অভাব হয়, শিক্ষার সুযোগ হয় না। অকারণে যে ব্যাধি হয়, সেগুলো তারা নিরাময় করতে পারে না। সেগুলো কীভাবে বদলানো যায়, সেটা তো নিশ্চয়ই অর্থনীতির একটা উদ্দেশ্য। আসলে অর্থই সব অনর্থের মূল তা বলা যায় না। অর্থ কিছু অনর্থের মূল। আর অর্থাভাব আরও অনেক বেশি অনর্থের মূল। অর্থ রোজগার করা আর ব্যবহার করা। আর এই যে বাক্যটা, এই যে প্রবাদটা বলা হলো, প্রবাদটা ভুল না। কিন্তু এর অর্থ এত অপরিষ্কার যে সেটা প্রথমে দেখতে হবে কী বলা হলো। তারপর দেখতে হবে, যা বলা হলো তা ঠিক বলা হলো কি না।
প্রশ্ন :
ঘুম থেকে উঠে যদি দেখেন খাটের পাশে একটি চেয়ার নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বসে আছেন, তাঁকে কী বলবেন?
প্রথমে বলব, আপনি তো মারা গেছেন বলে শুনেছি। আপনি যদি রবীন্দ্রনাথের ভূত হন, তাহলে আমার যে বিশ্বাস, যে অলৌকিক কিছু পৃথিবীতে হয় না, সেটায় একটা পরিবর্তন আমাকে করতে হবে। সেটা যদি এমন হয়ে থাকে যে আপনি রবীন্দ্রনাথ নন, তাঁর ছায়া এবং আমার চিন্তাতে আপনি কীভাবে আসনশীল, সেটা দেখার জন্য কিংবা আমার মনে লালন করার জন্য পাশের খালি চেয়ারে আপনাকে দেখছি। সে ক্ষেত্রে আমাকে ভাবতে হবে যে এই সমস্যাটির কারণ কী! একটা কারণ হতে পারে এই যে রবীন্দ্রনাথের চিন্তাভাবনাকে আমরা যথেষ্ট মর্যাদা দিচ্ছি না, অতএব কীভাবে মর্যাদা দেওয়া যায় সেটা ভাবা। অথবা হতে পারে যে রবীন্দ্রনাথের চিন্তাধারাকে আমরা মর্যাদা দিচ্ছি, কিন্তু এই মর্যাদাটা যে নানাভাবে ব্যবহৃত হতে পারে, সে ব্যবহারগুলো পরিচ্ছন্ন হচ্ছে কি না তা ভাবা। কিন্তু প্রথমে দেখতে হবে রবীন্দ্রনাথ ভূত না অভূত!
প্রশ্ন :
শান্তিনিকেতনে নাকি আপনার ‘সারেগামা’ শুনেই বাসায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এরপর আপনি কি আর গান শেখার চেষ্টা করেছিলেন?
একেবারেই না! কারণ, গানটা ঠিক আসে না আমার। আমার পুত্র, কবির তার নাম, সে শুধু গাইয়ে তা না, গাইয়ে হিসেবে তার নামও আছে। এবং তার কাজও ঠিক কাব্যিক। সে এটা কোথা থেকে পেল, সেটা একটি চিন্তা করার কারণ। আমার থেকে পায়নি এটা তো নিশ্চয়ই বোঝা যাচ্ছে। তার মা, মানে আমার স্ত্রীর দিক থেকে পেয়েছে। তার মা ইতালিয়ান ছিলেন, ইভা কলোর্নি। তিনি খুব ভালো গান করতেন। পশ্চিমা, ক্লাসিক্যাল ইত্যাদি। আমার ধারণা, কবির সেখান থেকেই পেয়েছে এটা। কিন্তু আমার নিজের এ প্রশ্নে যাওয়াটা অত্যন্ত সহজ। কারণ, গান চর্চাটা আমার হবে না, কোনো ব্যাপারে কোনো সম্ভাবনা আমি দেখিনি।
প্রশ্ন :
নিজেকে কখনো বাহবা দিয়েছেন?
এটা ভীষণ কঠিন প্রশ্ন। অনেক সময় মনে হয়েছে যে এর থেকে অনেক খারাপ হতে পারত, কিন্তু তাকে বাহবা বলা যাচ্ছে না। আর আমি যেটা বলার চেষ্টা করছি, আমার মনে হয়েছে চেষ্টাগুলো ঠিকভাবে বলতে পারলাম না। এখন, তখন মাথায় একটা কিছু ঘুরছে সেটা পরিষ্কারভাবে বলতে পারলে একটা খুশি হওয়ার কারণ আছে। সেটাকে বাহবা বলা যায় না, কিন্তু এটি সন্তোষের কারণ। ঠিক যে দিকগুলো বলছি সেটাকে খুব একটা মহান জিনিস মনে করা অত্যন্ত খারাপ। যা বললাম, যা বলতে চাচ্ছিলাম, তা-ই কি বললাম? দ্বিতীয়ত, যা বলতে চাইছিলাম, সেটা কি এই ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এবং এই মুহূর্তে বলার প্রয়োজন আছে? এই দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাব দেওয়া কঠিন। তাই এখনো নিজেকে বাহবা দেওয়ার কোনো সুযোগ হয়নি। কিন্তু অনেক সময় মনে হয়েছে যে, যা বলতে চাচ্ছিলাম বলেছি। ঠিক হোক, ভুল হোক, তবু বলা হলো।
প্রশ্ন :
কিশোর, যারা আপনার মতো বা আপনার চেয়েও বড় হতে চায়, তাদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?
আমি পরামর্শ দেওয়ায় খুব একটা বিশ্বাস করি না। কথা বলায় বিশ্বাস করি। যাদের সঙ্গে কথা বলব, তারা যদি শিক্ষকতা করতে চাও অথবা অর্থনীতি বা দর্শন অথবা রাজনীতি অথবা সমাজনীতি নিয়ে লিখতে চাও, তাহলে তা কীভাবে লিখবে সে নিয়ে আমার বক্তব্য থাকতে পারে। কিন্তু সেই বক্তব্য তৈরি হবে তার সঙ্গে কথা বলে। কথা না বলে বক্তৃতা দেওয়া, যাকে বলে বাণী দেওয়া, সেটাতে আমি একেবারেই বিশ্বাসী নই।
প্রশ্ন :
আপনার মূল্যবান সময় থেকে কিছুটা সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
তোমাদেরও অনেক ধন্যবাদ।
সাক্ষাৎকার দলের পাঁচজন ছাড়া আরও যারা প্রশ্ন পাঠিয়েছিলে—আহমাদ মুদ্দাসসের, ফাহাদ মাসুম, হাসান আল ফেরদৌস, হাসনাইন সাকী, মনীষা আহমেদ, মীর মাইনুল ইসলাম, নাহার বিনতে আল রাজি, প্রমি মাহজাবীন, রিফাত কামাল, সাদেকীন হায়দার, সাদীয়া ইসলাম, সাফা জেরিন, শাফিন সাইফ, সুমাইয়া চৌধুরী, সৈয়দা আশফাহ্ তোয়াহা, তাবাসসুম খান ও তাসলিমা হোসেন।