জাদুর প্রদীপ পেলে জয়নুল আবেদিনের মতো শিল্পী হওয়ার বর চাইতাম — রফিকুন নবী

ছোটবেলায় বাবাকে দেখে তিনি উৎসাহী হন ছবি আঁকতে। ছবি আঁকার প্রতি সেই ভালোবাসা তিনি ধরে রেখেছেন আজীবন, সৃষ্টি করেছেন ‘টোকাই’-এর মতো অসাধারণ এক কার্টুন চরিত্র। তাঁর শৈশব কেটেছে চাঁপাইনবাবগঞ্জে। ঢাকার পোগোজ হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস করে ভর্তি হন ঢাকা আর্ট কলেজে (বর্তমান চারুকলা অনুষদ)। শিক্ষকতাও করেছেন সেখানে। পরবর্তী সময়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন গ্রিসের অ্যাথেন্স থেকে। মূলত ‘উডকাট’ নিয়েই তিনি সেখানে কাজ করেছেন। ছবি আঁকাই একুশে পদকপ্রাপ্ত এই চিত্রশিল্পীর ধ্যানজ্ঞান। তিনি বাংলাদেশের বরেণ্য চিত্রশিল্পী ও কার্টুনিস্ট রফিকুন নবী। রনবী নামেই তিনি অধিক পরিচিত। ২০১৬ সালের ১৮ এপ্রিল বিকেলে মিরপুরে নিজ বাড়িতে তিনি মুখোমুখি হয়েছিলেন কিশোর আলোর সাক্ষাৎকার দলের। সেই দলে ছিল ভিকারুননিসা নূন স্কুলের মুকাররামা আবতাহী, তেজগাঁও সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের জিনাতুন নেসা, বিয়াম মডেল স্কুলের মাশায়েখ হাসান, হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের ইকবাল হোছাইন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তাবাস্‌সুম ইসলাম। ছবি তুলেছেন কবির হোসেনখালেদ সরকার

প্রশ্ন :

আপনার জন্ম তো চাঁপাইনবাবগঞ্জে। ছোটবেলায় কখনো আম চুরি করে খাওয়ার শখ হয়েছিল?

চাঁপাইনবাবগঞ্জে কিন্তু চুরি করার কোনো সুযোগ নেই। এত আম, গাছে, বাড়িতে, খাটের তলায়—চুরিটুরির দরকার হয় না। যে যত পারে খায়। আর আমাদের সময় তো মানুষ কম ছিল, তাই ভাগে আম কখনো কম পড়েনি। চাঁপাইনবাবগঞ্জে সবাই ঝুড়ি নিয়ে আম খেতে বসে। নানা আম—এই ল্যাংড়া, গোপালভোগ, ফজলি—যা আছে সব। ছোটরা-বড়রা সবাই। আর আমের সময় তোমাদের বয়সীরা তো বাগানেই থাকত। আম গাছে ঝুলে থাকে কেউ ছুঁয়েও দেখে না, কিন্তু গাছ থেকে ধুপধাপ যখন আম পড়ে, সেই আমের মালিক, যে আগে নেবে সে। ঝড়ে আম পড়লে কুড়িয়ে নেয়। সেটা আমাদের আমলে তো ছিলই, এখনো আছে।

প্রশ্ন :

আপনি কোন আম পছন্দ করেন?

আমি সাংঘাতিক আম খাই। এমনিতে আমি সারা বছর কোনো ফল খাই না। কলাও না, মুলাও না! আমি তো গ্রিসে ছিলাম। ফলের কারখানা। আপেল, আঙুর যত আছে সব। আর এত সস্তা। অনেকেই দেখেছি যে সারা দিন ফল খেয়েই থেকে যায়। তখন আম খুব মিস করতাম। এখনো গ্রাম থেকে আম আনাই, সেগুলো শেষ হয়ে গেলে আম কিনেও খাই।

প্রশ্ন :

আপনার বাবা তো পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন। সাধারণত ছোটরা পুলিশদের রাগী মনে করে, ভয় পায়। পুলিশ বাবাকে দেখে আপনার কেমন লাগত?

আমার বাবা ছবি আঁকতেন, তো অফিসে হয়তো পুলিশ ছিলেন, কিন্তু ঘরে ফিরতেন শিল্পীর বেশে। আমরা ভয় পেতাম না। বাবা তো কোনো দিন ধমকও দেননি, চড়-থাপ্পড় মারা বা অন্য কিছু করতেনই না। আমি যখন ছোট, তখন দেখতাম তিনি ছবি আঁকতেন এবং তাঁর কাছ থেকেই আমি ছবি আঁকা শিখি।

প্রশ্ন :

ছবি আঁকার অনুপ্রেরণা কি আপনার বাবা ছিলেন?

হ্যাঁ অবশ্যই। এক্কেবারে ছোটবেলায়, তখনো লেখাপড়া শিখিনি, আমার বাবা একটা শ্লেট আর শ্লেট-পেনসিল কিনে এনে দিলেন। একটা আদর্শলিপি বইও কিনে দিলেন। সেটাতে অ, আ, ১, ২, ৩ ছিল। মানে যারা লেখাপড়া শুরু করবে তাদের জন্য। আজকালকার সাথে তুলনা করলে খুব পচা প্রোডাকশন। কিন্তু ওটা পেয়ে আমি মহাখুশি। তিনি আমাকে এঁকে এঁকে শেখাতেন। আমি অ, আ নিয়ে মাথা ঘামাইনি। অজগর, পাখি, হাতি কেমন করে আঁকতেন, এগুলো খেয়াল করতাম। উনি আমাকে শিখিয়ে দিয়ে বলতেন, ‘এইবার তুমি এগুলো লেখ।’ আমি লেখার চেয়ে উনি কী এঁকেছেন তা আঁকার চেষ্টা করতাম। হতো না। কিন্তু আঁকার খুব ইচ্ছা, তাই এঁকে ফেলতাম। অজগর আঁকা সোজা কথা না, ভয়ংকর একটা সাপ! কিন্তু উনি খুব মজা করে আঁকতেন আর আমি আঁকলে ভয়ংকর হতো। উনি মারতেনও না, ধরতেনও না। তবে একটা ভয় কিন্তু ছিলই। বাবা-মা দুজনের জন্যই। সামনে গিয়ে লম্ফঝম্ফ করতাম না। বাবা মাঝেমধ্যে তাঁর বন্ধুবান্ধব নিয়ে আসতেন। গল্পগুজব করতেন। তখন যদি ঢুকে পড়ি, মুখে কিছু বলতেন না। চাহনি দিয়ে বুঝিয়ে দিতেন ওখানে থাকা চলবে কি চলবে না। এটাকে শ্রদ্ধাও বলতে পারো, ভয়ও বলতে পারো। কিন্তু ভয়ে কাঁপিয়ে ছুটে যাওয়া—সেটা কোনো দিনই ছিল না।

প্রশ্ন :

পরবর্তী সময়ে ছবি আঁকতে পরিবার থেকে কতটুকু উৎসাহ পেয়েছেন?

এটা আমার জন্য খুব সুখের ব্যাপার যে ছোটবেলা থেকেই কীভাবে যেন স্বজনদের মধ্যে প্রচার হয়ে গেল আমি ছবি আঁকতে পারি। তখন আমরা জানতাম না যে ঢাকায় আর্ট কলেজ হচ্ছে। পাকিস্তান হয়েছে বছর খানেক। কথায় কথায় বাবা বলতেন প্রয়োজন হলে লন্ডনে পাঠিয়ে দেবেন ছবি আঁকা শেখার জন্য। আমি তো মনে মনে খুশিই হয়ে গেছি, লেখাপড়া আর না করলেও হবে। পরে জানতে পারলাম যে ঢাকা আর্ট কলেজে পড়তে গেলেও ম্যাট্রিক পাস করতেই হবে। আর আমার তো অঙ্ক বেশি সুবিধার ছিল না, তাই মনে হচ্ছিল পাসও করতে পারব না কোনো দিন। তবে অঙ্কে আমি যদি ত্রিশের উত্তর দিতাম, ত্রিশই পেতাম, পঁয়ত্রিশের উত্তর দিলে পঁয়ত্রিশই পেতাম এবং পঁয়ত্রিশের ওপর কোনো দিন যেত না। তবে ফেল করিনি কোনো দিন। অন্যান্য বিষয়ে ভালো করতাম। ম্যাট্রিক পাস করেই আর্ট কলেজে ভর্তি হয়েছি। যথারীতি সেখানে অঙ্ক নেই। আমি তো মহাখুশি। আর্ট কলেজে গিয়ে বুঝলাম যে দশ বছর ধরে যে লেখাপড়া করেছি তার সঙ্গে কোনো মিল নেই। অন্য রকম লেখাপড়া।

প্রশ্ন :

অল্প বয়সেই আপনি ঢাকা আর্ট কলেজে ভর্তি হন। তখন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসানের মতো ব্যক্তিদের সান্নিধ্যে পড়াশোনা করার অভিজ্ঞতা কেমন?

জয়নুল আবেদিনসহ তখনকার তরুণ শিক্ষকেরা ছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন। তাঁদের সান্নিধ্যে পড়াশোনা করা বিরাট গর্বের ব্যাপার ছিল। এখনো অনেক গর্ব করি যে তাঁদের ছবি আঁকতে দেখেছি, কথা বলতে শুনেছি, পড়াতে দেখেছি। তাঁরা শিক্ষক না হলে আমার শিল্পকলার শিক্ষা অসমাপ্ত থেকে যেত।

প্রশ্ন :

আর্ট কলেজে প্রথম বর্ষেই নিজের আঁকা ছবি ১৫ টাকায় বিক্রি করেন। তখন ব্যাপারটা কেমন লেগেছিল?

(অবাক হয়ে) এই তথ্য তোমরা পেলে কোথায়! আমি তো জুলাই মাসে ভর্তি হলাম, নভেম্বর মাসে বার্ষিক প্রতিযোগিতা। এটা হলো চারুকলার সবচেয়ে বড় প্রতিযোগিতা। একটা বিশাল ব্যাপার ছাত্রদের জন্য। সেখানে প্রদর্শনী করে পুরস্কার কিংবা প্রশংসা পাওয়া ছিল খুব সম্মানের বিষয়। মাত্রই ভর্তি হয়েছি, কিছুই তো জানি না। তার মধ্যে ছবি জমা দিতে বলা হলো, আমরা যারা প্রথম বর্ষে পড়ি, সবাই ছবি জমা দিলাম। সেসব ছবি এখন হলে তো আমিই বাদ দিয়ে দিতাম। যাহোক সেই ছবি দেওয়ার পরে তিনটা ছবি নির্বাচিত হলো। তিনটার মধ্যে দুটো ছবি বিক্রি হয়ে গেল। ১৫ টাকা করে ৩০ টাকা। একটার দাম পাওয়া গিয়েছিল। আরেকটার দাম পাওয়া যায়নি। ওইটা যিনি নিয়েছিলেন তাঁর সঙ্গে আর যোগাযোগ হয়নি। কলেজ থেকেও কেউ করেনি। সে জন্য তোমাদের এই তথ্যটাতে একটা ছবি বিক্রির কথা বলা হয়েছে। তবে শিল্পী হিসেবে প্রথম আয় কিন্তু এটা না। এটা শিল্পী হিসেবে প্রথম ছবি বিক্রি। প্রথম আয় ছিল, আমি যখন মাত্র আর্ট কলেজে ভর্তি হয়েছি, তখন। ১০-১২ দিন হয়েছে, তখন এক ছেলে—আমাদের থেকে ধরো বছর দুই-তিনেকের বড় হবে, টিচার্স ট্রেনিং কলেজে পড়ে—আমাকে বলল, দেখো তুমি তো আর্ট কলেজে ভর্তি হয়েছ, তুমি আমাকে একটা সিংহ এঁকে দাও। আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। জীবনে সিংহ দেখিনি, তার ওপর আমার আঁকা ওই রকম ভালো একটা ফর্মেও আসেনি। বইপত্রে যে ছবি দেখেছি সেই পর্যন্তই। সিংহ আঁকা তো কঠিন ব্যাপার। বললাম, ‘ভাই, সিংহ আমি আঁকতে জানি না, জীবনেও দেখিনি। এটা আমি কী করে আঁকব!’ বলল সে, ‘আরে চেষ্টা করো, হয়ে যাবে।’ পাড়ার বড় ভাই, আমি তো না বলতেও পারি না, খুব মানসিক যন্ত্রণার মাঝে পড়লাম। অনেক বইপত্র ঘাঁটলাম। এখন তো চাইলেই অনেক বই দেখতে পারি, ইন্টারনেটে হাজার হাজার ছবি খুঁজে দেখতে পারি। তো ভাসা ভাসা যা দেখেছি, তা দিয়ে একটা সিংহ আঁকলাম। দুদিন পরে এসে সে বলে, ‘কী ব্যাপার? আমার সিংহ কোথায়?’ তখন বললাম, ‘সিংহ তো একটা এঁকেছি। কিন্তু আমার নিজেরই মনে হয় না সিংহের ছবি।’ ও বলে যে, ‘দেখাও দেখি।’ খুব লজ্জায় দেখালাম। যদি বলে, আর্ট কলেজে পড়ছ, একটা সিংহই আঁকতে পারলে না! কিন্তু সে তো দেখে খুব খুশি! বলে, ‘আরে সাংঘাতিক ভালো হয়েছে।’ তার কাছে এত ভালো লাগল কেন? কারণ পরে জেনেছি সেও সিংহ দেখেনি কোনো দিন। যাওয়ার সময় সে পকেট থেকে ১০ টাকার নোট বের করে বলে, এইটা রাখো। ১০ টাকার কিন্তু তখন অনেক দাম। অন্তত তোমার ১০টা সিনেমা দেখা যায়, অনেক কিছু খাওয়া যায়। এই হলো শিল্পী হিসেবে আমার প্রথম আয়। তবে ছবি বিক্রিটাকে আমি আয় ধরি না। ওটা হলো একধরনের সম্মানী।

চলছে সাক্ষাৎকার

প্রশ্ন :

আপনি মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অর্থ, কাপড় ও খাদ্য সংগ্রহ করেছিলেন। তখন মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক কাছ থেকে দেখেছিলেন...

মুক্তিযুদ্ধে সবাই একসঙ্গে যাওয়ার কথা ছিল। সবাই যে একসঙ্গে হুলুস্থুল করে গেছে তা তো না। চুপে চাপে একজন একজন করে যখন যেভাবে পারছে যাচ্ছে। আমি যখন যাওয়ার চেষ্টায় আছি তখন যুদ্ধে যাওয়া বন্ধুরা বলল যাওয়ার দরকার নেই। একটা আশ্রয়ের প্রয়োজন আছে। প্রয়োজনটা হলো, যখন একদল ঢাকায় অস্ত্রপাতি নিয়ে এল, সে অস্ত্রপাতিগুলো রাখার একটা জায়গা। এটাই ছিল সব থেকে বড় ঝুঁকি। শ্রদ্ধেয় আলতাফ মাহমুদ এই কারণে শেষে ধরা পড়ে গিয়েছিলেন। আমাদের ওপর মুক্তিযোদ্ধাদের কাপড়চোপড় দেওয়ার দায়িত্ব পড়ল। শুধু যে মুক্তিযোদ্ধাদের তা না, মুক্তিযোদ্ধারা আবার কাপড়চোপড় নিয়ে শরণার্থীদের পরতে দিত। মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। সবচেয়ে জরুরি ছিল ওষুধ। আমাদের চলাফেরা ঝুঁকির মধ্য দিয়ে চলত। কিন্তু সবার মধ্যে একটা দেশাত্মবোধ ছিল আমাদের অনুপ্রেরণা।

প্রশ্ন :

১৯৭৩ থেকে ১৯৭৬ সালে আপনি অ্যাথেন্সে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছেন। পরবর্তী সময়ে গ্রিক শিল্প আপনার আঁকাআঁকিতে কতটা প্রভাব ফেলেছে?

আমরা যা এখানে শেখাই বা শিখি, যা চর্চা করি ওরাও সেটাই করে। ইউরোপের দেশগুলোয় যোগাযোগ ভালো বলে ওরা একটু এগিয়ে। আমরা হয়তো পিছিয়ে ছিলাম। তো প্রাচীন গ্রিসের সেই আদ্যিকালের জিনিস দিয়ে আমরা কিছু চর্চা করিনি। আমরা যা করেছি আধুনিকতা নিয়েই। ওখানে আমি উডকাঠ নিয়ে কাজ করেছি।

প্রশ্ন :

১৯৭৮ সালে ‘বিচিত্রা’য় প্রথম ‘টোকাই’ শিরোনামে কার্টুন স্ট্রিপ ছাপানো হয়। তখন কি ভেবেছিলেন এই কার্টুন চরিত্র পরে এত জনপ্রিয়তা পাবে?

না, এভাবে কখনো ভাবিনি। ’৭৮ সালে টোকাই প্রথম প্রকাশিত হলেও এর ভাবনা আসে আরও বহু আগেই। তাকে নিয়ে কিন্তু আগেও ছুটছাট অনেক কাজ করেছি। একসময় মনে হলো এটা নিয়ে একটা স্ট্রিপ করা দরকার। স্ট্রিপ কার্টুন হলো অনেকগুলো ছবির মধ্য দিয়ে গল্প বলার ব্যাপার। শেষে গিয়ে একটা চূড়ান্ত কথা বলে। আমার এটা ছিল সেমিস্ট্রিপ। প্রশ্ন-উত্তরের মাধ্যমে গল্প বলা। প্রশ্নগুলো খুব বুদ্ধিদীপ্ত ছিল, শুধু উত্তরটা হবে খুব সহজভাবে বলা রূঢ় কথা। বহু আগে থেকেই কিন্তু স্ট্রিপ কার্টুন হয়। তখনকার খুব বিখ্যাত স্ট্রিপ কার্টুন হলো ‘ডেনিস দ্য মিনেস’। ছোট্ট একটা দুষ্টু ছেলেকে নিয়ে এর কাহিনি। আমাদের দেশে তো ওই সব চলবে না। যা কিছুই আমরা করতে চাই তার একটা অর্থ থাকতে হবে। যে অর্থটা দেশের জন্য, মানুষের জন্য একটা বার্তা বহন করে। আমাদের দেশের মানুষেরা খুব রাজনীতিসচেতন। যা ইচ্ছা, তা-ই করা যাবে না। ডেনিস নিতান্তই দুষ্টু একটা ছেলে, মজার কাজ করে। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে কিন্তু টোকাইকে মজার মজার কথা বলতে হবে না। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক নানা দিক তুলে ধরতে হবে। একদিন একটা কিছুর দাম বেড়ে গেলে সেটা নিয়ে রিকশাওয়ালা থেকে শুরু করে সবাই কথা বলে। আমি কিন্তু দেশ-বিদেশ ঘুরেছি, অসংখ্য মানুষ দেখেছি। এমনভাবে সমালোচনা বা রাজনৈতিক আলোচনা করতে দেখিনি। অন্যান্য দেশে হয়তো যারা একটু পত্রপত্রিকা পড়ে, যারা বিত্তবান তারা এগুলো নিয়ে টুকটাক কথাবার্তা বলে। আমাদের দেশে সবাই বিশাল বিশাল রাজনীতিবিদ, কড়া কড়া কথা বলে। টোকাইও মাঝে মাঝে কড়া কিছু বলে দিল, সবার দেখি ভালোই লাগল। টোকাই কী বলবে, কী করবে এগুলো নিয়ে দেখি সবাই বেশ অপেক্ষাতেই থাকত। অনেক সময় পরামর্শও চলে আসত। কোনো কোনো ইস্যুতে কেন টোকাই কথা বলল না, এই প্রশ্নও আসত। কোন বিচার নিয়ে কী কথা বলব, কী প্রশ্ন আসবে তা বেশ মাথা খাটিয়ে বের করতে হতো।

প্রশ্ন :

কিন্তু টোকাই-ই কেন?

টোকাই এমন একটা চরিত্র, যে ছোট মুখে বড় কথা বলে ফেলে। অনেকটা ইঁচড়ে পাকা। টোকাই দুষ্টুমি বেশি করে না। ওর সময়ই নেই দুষ্টুমি করার। সব সময় ব্যস্ত। ও চারদিক দেখে, চারপাশ দেখে, মানুষ দেখে, মানুষের অভ্যাস দেখে, বড়লোক দেখে, গরিব লোক দেখে। এই সব দেখতে দেখতে সে অভ্যস্ত হয়ে যায়। সেখান থেকে ও বড় ধরনের কোনো কথা বলে, তবে কথাটা বলে খুব নিষ্পাপভাবে। কথাটা আমাদের জুতসই লাগে। টোকাই সারা দিন একটা বস্তা কাঁধে ঘুরে বেড়ায়, নানান কাজকর্ম করে, ওর দুষ্টুমি করার সময়ই নেই, সব সময় জীবিকার পেছনেই থাকে। এই যে বস্তা কাঁধে কাগজ, নানান কিছু এসব খুঁজে বেড়ায়, সেগুলো বিক্রি করে দু-এক পয়সা পায়, সেটাই তাদের সংসারের জন্য উপার্জন, এই যে কাগজ টোকায়, এখান থেকে আমি টোকাই নামটা বেছে নিই। প্রথমে ‘ট’ দিয়ে অনেক নাম দিই। কী কারণে ট বেছে নিয়েছিলাম সেটা আমি নিজেই জানি না। প্রথমে নাম দিই টোকামিয়া, দেখি যে জমছে না। তারপরে টগর নাম দিলাম, কিন্তু মধ্যবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্ত অনেকের ঘরে টগর নামটা আছে। তাই এটাও টিকল না। এই রকম করতে করতে অনেকগুলো ‘ট’ দিয়ে নাম করে, তারপরে টোকাইনা নামটা রাখলাম, তবে পরে মনে হলো যে টোকাইনা মানে তো ওকেই কুড়িয়ে পাওয়া বোঝাচ্ছে। তখন ছন্দ মেলাতে গিয়ে টোকাই, টোকাইনা, টোকাইয়া করতে করতে টোকাইতে থেমে গেলাম। তখন বললাম যে এইটা মন্দ হয় না। কারোরই নাম না, কাউকে ডেডিকেট করে না, কারও চেহারা ভাসে না। তখন বিচিত্রার সম্পাদক ছিলেন শাহাদাত চৌধুরী। আমার একদম ছেলেবেলার বন্ধু। আমি তো বিদেশ থেকে এসে পেইন্টিং নিয়ে এত ব্যস্ত ছিলাম, আমার কার্টুন করার কোনো ইচ্ছাই নেই। কিন্তু সে সারাক্ষণ বলত, কিছু একটা করো, কিছু একটা করো। ফলে সেটা শুরু করলাম। প্রথম সপ্তাহে যখন ‘টোকাই’-এর প্রথম কার্টুনটা বের হলো, তখন খুব একটা জমেনি। কাঁচা কাঁচা, ড্রয়িংও কাঁচা, কথাও খুব একটা ভালো না। কিন্তু সেটা দেখার পরে সেই সপ্তাহে অসংখ্য চিঠি এল। সেগুলো পড়ে মনে হলো টোকাই আর আমাকে ছাড়বে না। এটা চালিয়ে রাখতেই হবে। প্রথম কার্টুনটা ছিল আমার যতদূর মনে পড়ে, দুই দিকে ইট দিয়ে তার ওপরে তক্তা বসিয়ে ফুটপাতের দেয়ালে আরাম করে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে। কয়েকজন বলল, কিরে টোকাই কী করছিস? বলল, ‘আমি বড় সাহেব বড় সাহেব খেলতেছি।’ সেক্রেটারিয়েট টেবিল বানিয়েছে, সেটা দিয়েই আমার টোকাই কার্টুনের শুরু। তারপরে এত কার্টুন, এখন তো সব মনেও করতে পারি না।

প্রশ্ন :

‘টোকাই’ কখনো কখনো পাইপের ভেতরে থাকে। আপনি নিজে কখনো পাইপের ভেতরে ঢুকে দেখেছেন?

আমরা যখন স্কুলে পড়ি এই ফাইভ-সিক্সে, তখন মতিঝিলে এত বড় ভবন হয়নি। সব ইটের পাঁজা, পাইপ এসব রাখা। কোথাও কোথাও খোঁড়া হচ্ছে, বিল্ডিং হচ্ছে। আমরা ওখানে মাঠ দখল করে খেলতাম। একেক পাড়ায় একেক জায়গা দখল করে। দখল মানে যে যখন আগে গিয়ে পৌঁছাতে পারে। গিয়ে ওই সব পাইপের ছায়ার মধ্যে বসে থাকতাম। বকাঝকাও দিত দারোয়ান থাকলে। এগুলো যদি গড়িয়ে পড়ে তাহলে আবার সর্বনাশ। নিচে বসতাম না, অনেক সময় আমরা ভেতরেই গিয়ে বসতাম। এগুলো তো ছিল। এটাতে নিজে থাকার প্রয়োজন পড়ে তাও না। শিল্পীদের ব্যাপারে একটা কথা আমরা সব সময় বলি, তাঁরা সবাই কিন্তু পর্যবেক্ষণ করে। চারদিকে যা কিছু ঘটছে, পরিবেশ সবকিছু আমরা পর্যবেক্ষণ করি। অনেকে দেখেও দেখে না, কিন্তু আমাদের দেখতে হয়। একধরনের অনুসন্ধিৎসু মন শিল্পীদের থাকে। সবারই হয়তো থাকে, জানি না, শিল্পীদের থাকে, কবিদের থাকে। কবিরা আবার অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে শব্দ খোঁজে। নতুন শব্দ খুঁজে বেড়ায়। আমাদের তো সবকিছুই দেখতে হয়। সকালে একটা গাছ কেমন, রং কেমন, দুপুরে গেলে কী দাঁড়াবে, সন্ধ্যায় গেলে কেমন হয়। ধরো, সমুদ্রে গেলাম। সমুদ্রপারে সকালবেলা সূর্য উঠছে যখন তখন সমুদ্রের রং এক রকম, ধীরে ধীরে আলো যখন বাড়তে থাকে, সমুদ্রের রং বদলাতে থাকে। একদম রোদের সময় ধূসর হয়ে যাচ্ছে, সূর্যাস্তের সময় আবার পরিবর্তিত হয়। এই জিনিসগুলো কিন্তু আমাদের চোখে পড়ে। কারণ, ওগুলোই তো আঁকি।

প্রশ্ন :

একদিন দরজা খুলে দেখলেন, পরনে লাল লুঙ্গি, টেকো মাথায় কয়েকটা চুল, ফোকলা দাঁত আর পিঠে একটা বস্তা নিয়ে আপনার আঁকা সেই টোকাই দাঁড়িয়ে আছে। আপনাকে দেখে ফোকলা দাঁতের হাসি দিয়ে বলল, ‘স্লামালেকুম স্যার’। কী করবেন?

দরজা খুলে প্রায়ই দেখি আমি ওদের। আমার এখানে প্রায়ই আসে জাম নিতে। কেউ কেউ দেয়াল টপকে আসে। বাসার কেউ যদি বলে, আজকে জাম দেওয়া হবে না, তখন কেউ কেউ চলে যায়, আবার কেউ কেউ খেপে যায়। বলে, ‘দিবেন না? দিবেন না? গাছ কাইট্টা ফালামু!’ (হাসি)।

প্রশ্ন :

কখনো কি কোনো টোকাইকে বলেছেন যে আপনি ওদের মতো একজনকে নিয়ে আঁকেন?

বিশ্ববিদ্যালয়ে তো একবার এক দঙ্গল টোকাই চলে এল। ছাত্ররা ওদের টোকাই ডাকে, এই নিয়েই ওদের অভিযোগ। ছাত্রদের বলে, ‘আমার নাম শরীফ, ওর নাম জহির, এর নাম অমুক—আর আমাগো এইডা কী নাম ধইরা ডাকেন!’ তখন ছাত্ররাই আমাকে দেখিয়ে বলেছে যে ওই স্যার তোমাদের এই নাম দিয়েছে। তো তখন এক দল টোকাই এসে আমাকে বলে, আপনে বলে আমাগো এই নাম দিছেন! আমি বলি যে, আমি তো তোমাদের এই নাম দিই নাই! ওরা মানে না। তো কথা ঘোরাতে বললাম, তোমরা ছবি আঁকতে পারো? একজন বলে, ‘আমি তো অনেক ছবি আঁকি!’ জিজ্ঞেস করলাম, কীভাবে? বলে, ‘রাস্তায়! ক্যান আপনে দ্যাখেন নাই? রাস্তায় ইটা (ইটের টুকরো) দিয়া যে কত লম্বা লম্বা ছবি আঁকছি! সূর্যডা যখন এই জায়গায় থাকে, তখন ঐডার ছায়াডা যত লম্বা হয় ঐ বরাবর দাগ দেই। দিলে ঐটা হয় আমার ছবি।’

প্রশ্ন :

টোকাই আঁকার সময় কোনো স্মরণীয় ঘটনা...

তেমন একটা মনে নেই, তবে একটা ঘটনা বলতে পারি। এক ব্যক্তির অফিসের কর্মকাণ্ড নিয়ে একটা টোকাই করি। তার বিষয় নিয়ে পত্রিকার একটা খবর থেকে কার্টুন। দু-তিন দিন পরেই তাঁর সঙ্গে শিল্পকলায় দেখা, একটা প্রদর্শনীতে উনি দাওয়াত পেয়ে এসেছেন। আমাকে দেখে বললেন, ‘আপনার কার্টুনটা ভালো হয়েছে। এই যে আমাদের নিয়ে যেটা করেছেন।’ আমি বললাম, ‘কোনটা বলেন তো?’ উনি বলার পর আমি বললাম, ‘না না, আপনাকে নিয়ে তো করিনি।’ উনি বললেন, ‘ওই তো হইল। ভালো, আই এনজয়েড।’ আমি তো এনজয় করার জন্য কার্টুন করতাম না। যাকে নিয়ে করা হলো তাকে ঘাই মেরে আমার মধ্যে এনজয় করার কোনো ব্যাপার থাকে না। মূল বিষয়টা তুলে ধরা। এই তো, সেটাও আবার বললাম আমি।

প্রশ্ন :

২০০৪ সালের পর নিয়মিত টোকাই আঁকা থামিয়ে দেন কিন্তু কেন?

এটা কেন হলো আমি জানি না। প্রত্যেক সপ্তাহের সোমবারে কার্টুন পাঠাতে হতো। মাস দুয়েক ধরে পিয়নটা আসে না। কিন্তু আমি লোক দিয়ে আমার কার্টুন পাঠাতাম। সোমবারে পাঠাতে হবে, মঙ্গলবারে পেস্টিং, বুধবারে ছাপা হবে, পরদিন বাজারে। কবে থেকে যে টোকাই ছাপা হয় না আমি জানতেও পারিনি। কেন ছাপা হয়নি, কী কারণ সেটাও কেউ বলেনি। হঠাৎ একদিন সেই পিয়নের সঙ্গে দেখা। জিজ্ঞেস করলাম কেন আসে না, সে বলল, ‘স্যার, এটা তো বন্ধ। এখন আর ছাপায় না।’ আমাকে সম্পাদক মঈনুল আহসান সাবের শ্রদ্ধা করত বলে কখনো বলতে পারেনি যে টোকাই ছাপানো বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কেন হয়েছে, সেটি পরে জেনেছি। এখানে বলা যাবে না। টোকাই বন্ধ হয়েছে, আমার জন্য ভালোই হয়েছে। টোকাই আরও জনপ্রিয় হয়ে গেছে। আমিও আমার অন্যান্য ছবিতে মনোযোগ দিতে পারলাম। পরপর দুইটা প্রদর্শনী করতে পারলাম।

প্রশ্ন :

আপনি আবার টোকাই আঁকা শুরু করতে চান?

আর করব না। তবে আমি ঠিক করেছি বছরে বছরে একটা করে ‘টোকাই’ ভলিউম বের করব। সব একটা চর্চার মধ্য দিয়ে চলে তো। আগে আঁকতে বসলেই ‘টোকাই’ মাথায় থাকত, দশ-বারোটা পত্রিকা নিয়ে বসতাম। বিষয় নিয়ে দেখতাম। কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ। মোটামুটি গবেষণার একটা ব্যাপার ছিল। সেই দিকটা নেই। আর জোকস যেটুকু প্রয়োজন হতো, সেই জোকটা কিন্তু তখন বয়সের তাড়নায় হোক, একটা সময় ছিল যখন সেটার জন্য বসতে হতো না, নিজে থেকে চলে আসত। কাকে ধরব, তখন কিন্তু ব্যাপারটা মাথায় ছিল। তারপর তো সেই অভ্যাসটা নেই। এখন মাথার মধ্যে থাকে কীভাবে রং দেব, কোন বিষয় নিয়ে কীভাবে কাজ করব, কোন ধরনের কাজটা হবে। সেসব নিয়ে চিন্তা করতে করতে টোকাই আর নেই। তবে টোকাই আঁকব আমি। টোকাইয়ের অপ্রকাশিত কার্টুন নিয়ে বার্ষিক একটা বই বের করব। এযাবৎকালের যত টোকাই সেগুলো বাছাই করলেও মোটামুটি চারটা ভলিউম হবে। দুইটা ভলিউম টোকাই, দুইটা ভলিউম অন্য কার্টুনের।

টোকাই ও কিশোর আলোর সাক্ষাৎকার দলের সঙ্গে রফিকুন নবী

প্রশ্ন :

২০ বছর পর টোকাইকে কেমন দেখা যাবে?

তত দিন তো আমি থাকব না। আমার থাকার সুযোগ কম। থাকতেও চাই না। এত দুর্যোগ, এত ঘটনা-দুর্ঘটনা—সবকিছু ডিঙিয়ে এতদূর যাওয়ার ইচ্ছা নেই। আমাদের সমাজ-সংসারের কাঠামোগত দিক যেভাবে চলছে, দেশের যত অর্থনৈতিক উন্নতিই হোক, যদি শ্রেণি বিভাজনের দিকে তাকাই, তাহলে দেখা যাবে আগামী ২০ বছর কেন, ৫০ বছরেও টোকাইদের আমরা তুলে আনতে পারব না। আগেও যা দেখেছি, পরেও যা দেখেছি, এখনো যা দেখছি সব এক।

প্রশ্ন :

যদি সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখেন জয়নুল আবেদিন আপনার পাশের চেয়ারে বসে আছেন আর আপনাকে কোনো ছবির ভুলের জন্য বকা দিচ্ছেন, তাহলে আপনি কী করবেন?

আমি কিন্তু তাঁর ছাত্র, ফলে সব সময় তিনি আমাদের মাথায় আছেন, হাতে আছেন, চোখে আছেন। আমরা যখনই ছবি আঁকতাম কখনোই উনি ‘না’ করতেন না। এই লাইন এমন কেন, এটা এমন কেন—এ রকম কিছুই বলতেন না। তাঁদের যে চেষ্টা, তাঁরা যেভাবে আঁকতেন সেগুলো আমাদের মাঝেও নিজে থেকেই আসত। সে ক্ষেত্রে তিনি আমাদের মাথায়ও উপস্থিত। আর, হঠাৎ করে তো ওনাকে সশরীরে দেখার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু কয়েক দিন পরে আমিই হয়তো ওনার কাছে চলে যাব সশরীরে।

প্রশ্ন :

অনেকের ধারণা, আর্টিস্ট মানেই একগাদা দাড়ি-গোঁফ আর মাথায় একঝাঁক চুল, হাতে রংতুলি। আপনার দৃষ্টিতে আর্টিস্ট কেমন?

এ রকম ধারণা আর এখন বোধ হয় নেই। আমরাও অবশ্য আমাদের আমলে এমনই ভাবতাম, সিনেমা-টিনেমাতেও দেখতাম। আর্ট কলেজে যখন ভর্তি হলাম ভর্তির আগ পর্যন্ত আমার ধারণা ছিল ও রকম। ভর্তি হয়ে দেখি, হায় হায়! জয়নুল আবেদিন থেকে শুরু করে একেবারে যে তরুণ শিক্ষক কিংবা অন্যান্য ছাত্রছাত্রী—সবাই দারুণ স্মার্ট। কামরুল হাসান ছিলেন বডি বিল্ডার। আর চালচলন থেকে শুরু করে কথাবার্তায় সবাই ভীষণ স্মার্ট। আমাদের ভাবনার সঙ্গে আসলে কোনো মিল নেই। এককালে হয়তো ছিল যখন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়রা লিখতেন।

প্রশ্ন :

অবসরে কী করেন আপনি?

আমার কোনো অবসর নেই। আটটায় নাশতা করে স্টুডিওতে ঢুকি। তারপর একনাগাড়ে দেড়টা-দুইটা পর্যন্ত ছবি আঁকি। তারপর নিচে আসি, খাওয়াদাওয়া করে আড়াইটার দিকে আবার স্টুডিওতে ঢুকি। স্টুডিওতে ঢুকে আবার সাড়ে নয়টা-দশটার দিকে বের হই। তারপর খাওয়াদাওয়া করে, টেলিভিশনে খবর দেখে ঘুমিয়ে পড়ি। এই হলো আমার রুটিন।

প্রশ্ন :

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হলে কী করবেন?

সেটার সুযোগ তো নেই। আর এই দুর্গতির মধ্যে কেউ জেনেশুনে যাবে বলে মনে হয় না। আমার মতে প্রধানমন্ত্রী হওয়া সাংঘাতিক দুর্গতির, দুর্বুদ্ধির। তারপরও আমি প্রধানমন্ত্রী হলে প্রথম যেটা বাতিল করব সেটা হলো পয়লা বৈশাখে পান্তা-ইলিশ খাওয়া। এটা কিন্তু আগে ছিল না। যেদিন প্রথম এটা খাওয়া শুরু হলো, সেদিনই আমি টোকাই এঁকেছিলাম। এটা এত হইচই করে করার তো কোনো ব্যাপার নেই।

প্রশ্ন :

ধরেন আপনি একটা প্রদীপে ঘষা দিলেন আর একটা দৈত্য বের হলো...

এইটা আমি প্রায়ই চিন্তা করি। এই রকম যদি একটা আমি পেতাম! প্রদীপে একটা ঘষা দিলেই হাহা করে এসে হাজির হবে বা গুপি গাইন বাঘা বাইনের মতো ভূতের রাজা আসবে। তিনটা বর দেবে। আমি তো জয়নুল আবেদিনের মতো শিল্পী হওয়ার বর চাইতাম। বড় একজন সফল শিল্পী। ওদের কাছে বাড়িঘর চেয়ে লাভ নেই। এই দৈত্যের স্বভাবটা হলো যার হাতে পড়বে তার কথা অনুযায়ী এই বাড়ি তুলে নিয়ে চলে যাবে।

প্রশ্ন :

অনেক বাবা-মা ছেলেমেয়েকে চারুকলায় পড়তে দিতে চান না, মেডিকেল, বুয়েট বা অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে চান...

ছেলেমেয়েকে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার বানাব কিংবা বিসিএস দিয়ে বড় একজন কর্মকর্তা হবে—এটা কিন্তু বাপ-মা ছেলেমেয়েদের ভালোর জন্যই চিন্তা করেন। মানে ওগুলোতে লেখাপড়া করে চাকরি করলে একটা জায়গায় জীবন প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল। ভালো একটা চাকরি পেলে আর কোনো দুশ্চিন্তা থাকে না। আমাদের সময় ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত ছিল। এখন তো আর অনিশ্চিত না। এখন কম্পিউটার নিয়ে বসে গেলে শিল্পীরা কত কিছু করে ফেলে। অনেক অনেক পয়সা আসে। বাপ-মা যা ভাবে, পয়সার দিকটা ভাবে—ছেলেমেয়ে ভালো ইনকাম করবে, আর ভালো মানুষ হবে, সম্মান পাবে। এখন আর্ট কলেজ থেকে শয়ে শয়ে ছাত্র পাস করে বের হয়। সবাই নামীদামি কিছু হতে পারবে কি না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এ জন্যই বাবা-মার মনে খটকাটা লাগে। তবে এটা ঠিক যে এই মুহূর্তে যতগুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে, বেশির ভাগেরই চারুকলা অনুষদ আছে। এখন পিএইচডি করছে এর ওপর। কিন্তু যদি শিল্পী একবার হয়ে যায়, যদি নাম হয়ে যায়, তাহলে কিন্তু পরবর্তী সময়ে বাবা-মা খুশিই হয়।

প্রশ্ন :

এত সুন্দর বাসায় থাকেন। বাসায় কি চড়ুই পাখি আছে?

চড়ুই পাখি আছে। চারতলায়। খুব যন্ত্রণা করে। তবে একটা মজার পাখি আছে—কাঠঠোকরা। কাঠঠোকরার প্রতিদিনের কাজ হলো যখন সবকিছু নীরব হয়ে আসে, চতুর্দিক যখন নিঝুম হয়ে যায় আর আমি ওপরে বসে কাজ করি তখন দুইটা কাঠঠোকরা এসে জানালার পুটিং খসায়। এমন একটা কর্কশ শব্দ করে। আমি বহুদিন পর্যন্ত টের পাইনি। একদিন দুপুরবেলা দেখি আমার বাড়ির ভেতরের এই আওয়াজটা আসে কোথা থেকে। এদিক খুঁজি, ওদিক খুঁজি। খুঁজতে খুঁজতে একদিন হঠাৎ চোখে পড়ল। তখন ঝিম মেরে বসে থাকে। জানালাগুলায় কাঠঠোকরা কীভাবে যে পাখা মেলে বসে থাকে সেইটা আমি বুঝি না। তারপরে আর পাখিগুলোকে তাড়াইনি। ভালোই লাগল, খুব রঙিন। লাল রং, ওপরে কালো স্ট্রাইপস। খুবই সুন্দর। তখন কিছু বলিনি। এই যে বলিনি এটা আমার ভুল হয়ে গেছে। প্রতিদিন বা এক দিন-দুই দিন পরপরই আমার জানালা আক্রমণ করে। কবে যে আমার জানালা ভেঙে পড়বে।

কিশোর আলোর জন্য টোকাই আঁকছেন রনবী

প্রশ্ন :

এই কাঠঠোকরা কিংবা চড়ুই একদিন সকালে যদি বলে, ‘বেরিয়ে যান আমার বাড়ি থেকে’, তখন কী করবেন?

চড়ুই খুব একটা পারবে না। শক্তিশালী না। কাঠঠোকরাও পারবে না। কিন্তু চামচিকা বা বাদুড় যদি বলে, তাহলে আমি বের হয়েই আসব। যখন রুমের ভেতরে কিছু উড়তে থাকে তখন তো আমি বের হয়েই আসি। তবে বর্তমানে মানুষেরই যে মনোভাব হয়েছে, তাতে মনে হয় চড়ুই না, মানুষই কবে এসে বলে বেরিয়ে যান!

প্রশ্ন :

অনেকে আপনাকে আদর্শ মনে করে শিল্পী ও কার্টুনিস্ট হতে চায়। তাদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?

আদর্শ মনে করে নাকি? আমি জানি না। করলে খবর আছে! আমি তো চাই যে দেশের সব ছেলেমেয়ে চিত্রশিল্পী হয়ে যাক এবং আমাকে গুরু মানুক (হাসি)। ব্যাপারটা ভালোই তো! যাহোক, যদি আমাদের সামাজিক অবস্থা, পারিপার্শ্বিক অবস্থা, অর্থনৈতিক অবস্থা সব বিবেচনা করে দেখি, তাহলে বলব, যে পেশায়ই যাও, যেখানেই যাও এমন একটা কিছু দৃষ্টান্ত স্থাপন করা উচিত, যাতে সবাই ভালো মানুষ বলে। যা-ই হোক, অনেকেই কার্টুন করতে চায়, নিজের বোধবুদ্ধি, হিউমার থেকে কিছু করতে চায়। এটা আসলে সম্পূর্ণ চর্চার ব্যাপার।

নির্বাচিত ৫ জন ছাড়াও আরো যাদের প্রশ্ন নির্বাচিত হয়েছে— আফিফ আবিদ চৌধুরী, ইরহান খান, ঈশিকা ফাইরুজ, এহসান আহমেদ, জাহিদ হাসান, তাসফিয়া তাবাসসুম, দেবোপম সূত্রধর, ফয়সাল আহমদ, ফারহান ইশরাক, মাহাতাব রশীদ, রাফি আহমেদ, রাফিদ আরিয়ান, সাদিয়া সুবর্ণা, সাব্বির আহমেদ, সুপ্রীতি মালাকার ও হাসিবুল ইসলাম।

(কিশোর আলোর জুন ২০১৬ সংখ্যায় প্রকাশিত)