মিনার রহমান একাধারে কণ্ঠশিল্পী, গীতিকার, সুরকার ও কার্টুনিস্ট। শৈশব কেটেছে চট্টগ্রামে। চট্টগ্রাম সরকারি উচ্চবিদ্যালয় থেকে পাস করে কিছুদিন পড়েছেন বাংলাদেশ নৌবাহিনী কলেজে। পরে ‘এ’ লেভেল শেষ করে এখন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন গণমাধ্যম বিষয়ে। ২০০৮ সালে তাঁর প্রথম অ্যালবাম ডানপিটে যখন প্রকাশিত হয়, তখন তিনি মাত্রই এসএসসি পাস করেছেন। ‘সাদা’সহ সেই অ্যালবামের বেশ কয়েকটি গান হৃদয় জয় করে নেয় শ্রোতাদের। এরপর আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি। সারা দেশের মানুষ, বিশেষ করে কিশোর-তরুণদের কাছে মিনার এখন প্রিয় এক নাম। ইউটিউবে কোটি ভিউয়ার্স ক্লাবের সদস্য তিনি। তাঁর গাওয়া ‘ঝুম’ গানের মিউজিক ভিডিওটি দেখা হয়েছে প্রায় দেড় কোটিবার। ধানমন্ডির এক স্টুডিওতে কিশোর আলোর সাক্ষাৎকারর দলের মুখোমুখি হয়েছিলেন জনপ্রিয় এই শিল্পী। সেই দলে ছিল উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের সরদার আকিব লতিফ, কামরুননেসা সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের সাবা সিদ্দিকা, ধানমন্ডি সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়ের তাসনিমুল হাসান এবং ভিকারুননিসা নূন স্কুলের রিয়াহিনাল ফারুক ও তাসফিয়া তাবাসসুম। ছবি তুলেছেন সুমন ইউসুফ ও মাসুদুল হক।
পাঁচ বোনের একমাত্র ছোট ভাই আপনি। শৈশব-কৈশোর কি খুব আদর-যত্নে কেটেছে?
পাঁচ বোনের অনেক আদর পেয়েছি এটা সত্যি। তবে শৈশবে আমি পুরো হাবাগোবা ছিলাম। দুষ্ট ছিলাম না বলে কোনো বকুনি খাইনি। ছোটবেলা কেটেছে চট্টগ্রামে। সেখানে অনেক মজার ঘটনা ছিল। বন্ধুদের সঙ্গে, কাজিনদের সঙ্গে। তবে সবচেয়ে ভালো লাগত স্কুলে। আমার স্কুল ছিল চট্টগ্রাম সরকারি উচ্চবিদ্যালয়। আমি একটু ফাঁকিবাজ ছিলাম, তাই শিক্ষকদের বকুনিও খেতাম।
গানের জগতে আসা হলো কীভাবে?
ছোটবেলায় একটা কি-বোর্ড উপহার দিয়েছিল মেজ আপু। আমি তখন গান জানি না। সা রে গা মা কিছুই না। চট্টগ্রামে আমার একটা বড় ভাই ছিল—টুটুল ভাই। তিনি একটা স্কুলে চাকরি করতেন—ফ্রোবেল প্লে-স্কুল। সেই স্কুলে আমার কাজিন পড়ত। সেই সূত্রে আমি তার কাছে কি-বোর্ড শেখা শুরু করি। মাত্র তিন-চারটা ক্লাস করে বেরিয়ে যাই। এরপর থেকে নিজে নিজেই শেখা শুরু করি।
তারপর কীভাবে এগিয়ে যাওয়া?
একদিন কি-বোর্ড বাজাতে বাজাতে দেখলাম যে আমি নতুন কিছু সুর পাচ্ছি। একটা নতুন টিউন বানাচ্ছি। তখন আমি তোমাদের মতোই ছোট। ক্লাস নাইনে পড়ি। আমি আবিষ্কার করি যে আমি আসলে গান বানাচ্ছি। তখন আস্তে আস্তে আমি গানগুলো রেকর্ড করি। ডেমো করি। আমার প্রথম অ্যালবামের গানগুলো, মানে সাদা, ডানপিটে, বন্ধু, জানি তুই—সেসব স্কুলজীবনের কম্পোজিশন। অ্যালবাম প্রকাশের আগে আমি ১৪-১৫টা গান বানিয়েছিলাম। যখন ইচ্ছা হচ্ছে বানাচ্ছি, কিন্তু বিষয়টা এমন না যে আমি গান অসম্পূর্ণ রেখে দিলাম। আসলে কোনো কিছু শুরু করার আগে সেটার একটা জার্নি আছে। শেখার একটা বিষয় আছে। তখন আমি নিজেকে অনেক সময় দিতাম। মিউজিক কম্পোজিশন অনুযায়ী অনেক গান শুনতাম। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশের গান শুনতাম। দেশের গান তো শুনতামই। অনেক কিছু মেনে চলতাম আমি। বিশেষত সময়ের বিষয়টি। গানের গঠনটা কী রকম হতে পারে, ভার্স অ্যান্ড কোরাস হবে, নাকি ভার্স আর কোরাসের মাঝখান দিয়ে প্রি-কোরাস হবে—এই বিষয়গুলোও আমি ভাবতাম। হঠাৎ দেখি, আমি ১৪-১৫টি গান বানিয়ে ফেলেছি। এটার মধ্যে কোরাসের রিপিটেশন আছে। কোরাস হচ্ছে আসলে পিক লাইনটা। চট্টগ্রামের স্টুডিওতে গিয়ে আমি আমার সব কটি গান রেকর্ড করলাম। রেকর্ড করার পর আমি ওই সিডিটা নিয়ে এলাম বাসায়। এরপর আমি ১৩টা গানের ১৩টা নাম দিলাম। তারপর সিডিটা আমি আরও কপি করলাম। তখন আমি মাত্র এসএসসি পরীক্ষা শেষ করেছি। ওই ফ্রি টাইমটাতে আমি এসব করছিলাম। সে সময় আমি কার্টুনিস্ট হিসেবে উন্মাদ-এ জয়েন করেছি। যেহেতু আমি কার্টুন আঁকি, তাই আমি আমার অ্যালবামের প্রচ্ছদ এঁকে ফেললাম। আমার স্কেচবুক ছিল। সেটা এখনো আছে। সেখানে আমি আমার প্রতিটি গানের অলংকরণ করে ফেলতাম। তখন সেটা একটা অ্যালবামে রূপ নেয়। এভাবে কারও কাছে না গিয়ে আমি আমার অ্যালবাম বানিয়ে ফেললাম। এখন এটা আমি কারও কাছে উপস্থাপন করতে পারব। কোনো একটা প্রোডাকশনকে আমি এটা দিতে পারি। তুমি যদি কোনো একটা জিনিস তৈরি করে সেটা জমা দিতে চাও, সেটা কিন্তু একটা উপস্থাপনের জায়গায় নিতে হবে। তারপর আমি সেটা জি সিরিজে জমা দিই। আমি যেদিন জমা দিই, সেদিনই ওরা বলে, আমরা তোমার অ্যালবামটা প্রকাশ করতে চাই। তারপর ১৩টা গান থেকে ১০টা গান দিয়ে তারা অ্যালবামটা প্রকাশ করে। সেই থেকে শুরু।
আপনার প্রথম অ্যালবাম প্রকাশের পর অনুভূতি কেমন ছিল?
আমার প্রথম অ্যালবাম ডানপিটে। ওই বয়সে অ্যালবাম প্রকাশ আসলেই অন্য রকম ব্যাপার। বেশ অন্য রকম অনুভূতি ছিল। প্রকাশের তারিখ আমার এখনো মনে আছে। ১৯ আগস্ট, ২০০৮। এরপরের দুটি অ্যালবাম প্রকাশের তারিখ আমার মনে নেই।
চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময় নাকি আপনি প্রথম গান লিখেছেন? কী লিখেছিলেন, মনে আছে?
তখন যা লিখতাম তা গান ছিল নাকি? হা হা হা। আসলে সে সময় মানবতাবাদী গান লিখতাম! সেটা আদৌ গান ছিল কি না জানি না।
সংগীতাঙ্গনে শুরুতেই পাশে পেয়েছিলেন আরেক সফল শিল্পী তাহসানকে। প্রতিভার বিকাশ হতে কারও সহযোগিতা খুব প্রয়োজন, নাকি যোগ্যতা থাকলেই হয়ে যায়?
প্রতিভাই মূল। প্রতিভা আর কঠোর শ্রম মানুষকে অনেক দূর নিয়ে যায়। তবে প্রতিভার সঙ্গে যদি সহযোগিতাও যুক্ত হয়, তবে সেটা কাজের ক্ষেত্রে এক অন্য মাত্রার সংযোজন করে। তাহসান ভাইয়ার সঙ্গে কাজ করাটা আমার জন্য অনেক অনুপ্রেরণার ছিল। আসলেই প্রথম অ্যালবামে তাহসান ভাইয়াকে পাশে পাওয়া আমার জন্য একটি বিশাল ব্যপার ছিল। সে সময় উনি আমাকে বলেছিলেন যে আমার গানগুলোতে তিনি নতুনত্বের ছোঁয়া পেয়েছেন।
প্রথম লাইভ কনসার্ট কবে করেছিলেন?
আমার অ্যালবাম বের হওয়ার আগে কখনো কোনো মঞ্চে গান করিনি। বন্ধুরাও অতটা জানত না গানের ব্যাপারটা। বন্ধুরা জানত ছবি আঁকি, ওরা মাঝেমধ্যে ক্যারিকেচার করে দিতে বলত। আর স্কুলে উপস্থিত বক্তৃতায় অংশ নিতাম সব সময়, পুরস্কারও পেতাম। ২০০৮ সালে প্রথম অ্যালবাম বের হওয়ার পর প্রথম গানটা জনপ্রিয় হয়—তুমি চাইলে বৃষ্টি (সাদা)। তারপরই প্রথম কনসার্ট করি। চট্টগ্রামে, তিন শর মতো মানুষ ছিল সামনে। দ্বিতীয় কনসার্ট হয় বেশ বড় আকারে, পাঁচ হাজারের মতো মানুষ ছিল।
খুব কম বয়সেই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। এই জনপ্রিয়তা চাপ, নাকি উত্সাহ হিসেবে কাজ করে?
সত্যি বলতে কম বয়সে জনপ্রিয় হলে কিছুটা চাপ আসেই। ওই বয়সে যখন আমি প্রথম অ্যালবাম বের করি, তখন ওই সময়টা অনেক ‘জোশ’ ছিল। তখন আমার মাথায় অনেক চুল ছিল, থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট পরতাম। সাইকেল চালাতাম টি-শার্ট পরে। রাস্তায় কেউ দেখলে অটোগ্রাফ চাইত, ছবি তুলত। ওই সময়টা বেশ মজার ছিল। কিন্তু তা-ও ওই বয়সে কিছু চাপ ছিল। যেমন যা নিয়ে আমার চিন্তার প্রয়োজন নেই, দেখা যেত সেটা নিয়েই বেশি চিন্তিত। তখন আমাকে সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকা হতো, আমার খুব ভালো লাগত। কিন্তু যে বয়সে আমার বন্ধুদের সঙ্গে অনেক আড্ডা দেওয়ার কথা, সেই সময় দেখা যেত আগের মতো আড্ডা হচ্ছে না। আর পরিবার থেকে একটা চাপ পড়াশোনার জন্য তো ছিলই। আমার পাঁচ বোন গান শুনত পাঁচ রকমের। ওখান থেকে আমার মিউজিক টেস্ট উন্নত হয়। আমাকে কি-বোর্ড, গিটার কিনে দেওয়া হয়েছিল। পরিবার থেকে আমি সব রকম গ্যাজেট সুবিধা পেয়েছি। কিন্তু আমি যে গান সুর করব, অ্যালবাম বের করব, তা মূলত আমার নিজেরই চেষ্টা ছিল। আমি যখন প্রথম অ্যালবাম বের করতে ঢাকা যেতে চাইলাম, তখন আম্মু পরিবারের মিটিং ডাকল। বলল, পড়াশোনার ক্ষতি হবে। আমি তাদের বোঝালাম যে পড়াশোনার ক্ষতি হবে না। শুধু দুই দিনের জন্য যাচ্ছি, পরে এসে তো আবার পড়তে বসব। এভাবে আমি পরিস্থিতিগুলো সামলে নিতাম।
আপনার গান ইউটিউবে এক কোটিবারের বেশি দেখা হয়েছে। ইউটিউবে কোটিপতি হওয়া আর অর্থের হিসাবে কোটিপতি হওয়া—কোনটি বেশি আনন্দদায়ক?
অর্থের হিসাবে কোটিপতি তো হতেই পারিনি। কখনো হতে পারব কি না জানি না। কিন্তু হলেও অবশ্যই ইউটিউবে কোটিপতি হওয়াই ভালো লাগবে।
এক সাক্ষাৎকারে আপনি বলেছেন, আপনার গানের মূল শক্তি গানের কথা। কিন্তু ইদানীং অনেক শিল্পীর গানের কথাই কি বেশ দুর্বল মনে হয় না?
আমার গানের কথা হয়তো তোমাদের কাছে গভীর লাগছে। তবে অন্যদের কাছে অন্যের গানের কথাগুলো আরও ভালো লাগতে পারে। আমার গান তোমার কাছে তখনই ভালো লাগবে, যখন সেটা তোমার জীবন-সম্পর্কিত হবে। আর আমি আসলে যেসব গান লেখার চেষ্টা করি, সেগুলোতে দৈনন্দিন জীবনের কথাগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করি। আমার গানে আমি কমিউনিকেটিভ ওয়ার্ড ব্যবহার করি। যেমন ‘আহারে’। সবাই কিছু হলেই বলে আহারে। তো এই ব্যাপারটা আমি মেইনটেইন করেছি। ‘ঝুম’ আসলে গানের টাইটেল হলেও আমরা মূলত বৃষ্টিটাকে ফোকাস করেছি। তা বৃষ্টিটাই এখানে আসল। সারাজীবনই বৃষ্টি পড়বে, আর মানুষ এটা শুনবে, সেটাই আসল।
রেডিওতে ‘মিনার লাইভ’ অনুষ্ঠানের উঠতি শিল্পীদের আপনার অতিথি হিসেবে আনা হয়। উপস্থাপক হিসেবে কেমন উপভোগ করেন অনুষ্ঠানটি?
আমার খুব ভালো লাগে এটা। যারা নতুন আসে, তারা খুব এক্সাইটেড থাকে, ভালো লাগে। একটা ব্যান্ড এসেছিল, গান কবি, ওরা একদম মূল লোকসংগীত নিয়ে গবেষণা করছে। নেত্রকোনার গান, চট্টগ্রামের পুরোনো গানগুলো করছে। বেশ ভালো লাগল দেখে। আর এমনিতে বেশির ভাগ ব্যান্ড আসলে কাভারগুলো করে।
আপনি তো একজন কার্টুনিস্ট। ২০১৩ সালে আপনার আঁকা কমিকস ‘গাবলু’ প্রকাশিত হয়েছিল। এরপর এই বিভাগে আপনার এত লম্বা বিরতি কেন?
একটা কারণ বলা যায়, কমিকস গল্প যারা লেখে, তারা গল্প দেয় না (হাসি)। অবশ্য গাবলুর গল্পটা ছিল আমার এবং আমার এক বড় ভাই খালেদ হাসানের। গাবলু আমার প্রথম কমিকস, এরপর আর বের হয়নি। কিন্তু উন্মাদ বা কিশোর আলো যেখানেই হোক, আমি আঁকাআঁকি চালিয়ে যেতে চাই।
‘উন্মাদ’-এ কাজ করার শুরু কীভাবে? কার্টুনিস্ট হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা কেমন?
এসএসসির পরের ফ্রি টাইমে উন্মাদ-এ কার্টুনিস্ট হিসেবে জয়েন করি। বসের (আহসান হাবীব) কাছে আমি কার্টুন নিয়ে গিয়েছি। বসকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনতাম না। তাঁকে বলেছি, ‘বস, আমি কার্টুন আঁকতে চাই। এই হলো আমার স্কেচবুক।’ বিষয়টা হলো আত্মবিশ্বাস নিয়ে চলে যাওয়া। আমার মাথায় ছিল যে এটা করেছি, এটা দেখে আমাকে ফিরিয়ে দিতে পারবে না। উন্মাদ-এর অফিস মিরপুরে। বস বললেন, ‘আচ্ছা তুমি আঁকো।’ আমার এখনো মনে আছে, ২০০৮-এ মার্চ মাসে উন্মাদ-এ আমার প্রথম কার্টুন বের হয়। প্রচ্ছদের পরের পৃষ্ঠার কার্টুনটাই ছিল আমার। একটা মানুষ এ রকম ‘হা-আ’ করে আছে, ‘হা-আ’-এর সামনে বার্গার, স্যান্ডউইচ, সাথে সূচিপত্রটা দেওয়া। পরে আমি রস+আলোতে একটা সিরিজ করতাম ‘ডানপিটে’ নামে।
উন্মাদ অফিসটাই অন্য রকম। অফিসে গিয়ে দেখবে পানির ফিল্টারের ভেতরে গোল্ডফিশ ঘুরছে! কোনো এক্সিবিশনের আগে আমরা সবাই একসঙ্গে বসতাম। বস এক বিশাল বালতিতে পেঁয়াজু, বেগুনি, আলুপুরি নিয়ে আসতেন। ওগুলো আমরা খেতাম, বসে বসে আইডিয়া, কার্টুন, ফ্রেমিং করতাম। ওই অভিজ্ঞতা অনেক মজার। এক্সিবিশন দেখে মানুষ অবাক হয়ে যেত। ওই অ্যাফোর্টটা আমরা দিতাম। সবাই একসঙ্গে থাকলে দশ জনের দশ ঘণ্টার কাজ এক ঘণ্টায় হয়ে যায়। উন্মাদ আসলে আমার দ্বিতীয় পরিবার। আহসান হাবীবের সঙ্গে আড্ডা দিতে পেরেছি—এটা একটা বড় পাওয়া। ঈদের দিন রাতে আমরা বসের বাসায় যেতাম, মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যার আসতেন। বসের কাছ থেকে, উন্মাদ অফিস থেকে আমি জীবনের অনেক কিছু পেয়েছি। উন্মাদ আমাকে আত্মবিশ্বাস দিয়েছে সামনে আরও কিছু করার। বস সব সময় অন্য রকম একটা প্রেরণা।
আপনি গল্প লিখতেন। পত্রিকায়ও প্রকাশিত হয়েছে। আপনি নাকি ভালো ছড়াও লেখেন। লেখালেখি নিয়ে আপনার পরিকল্পনা কী?
আমি একটা গল্প লিখেছিলাম কিশোর ম্যাগাজিন হট্টগোল-এ। পাভেল ভাই আর আদনান ভাই এখন যে কিশোর আলো করেন, ওনারাই তখন ওটা বের করতেন। ওখানেই আমার প্রথম গল্প ছাপা হয়েছিল। গল্পের নাম ছিল ‘নাম’। সেটা খুব মজার ছিল। তোমরা পড়ে দেখতে পারো। ‘একটি অচেনা কণ্ঠ এবং একজন সুখী মানুষ’ নামে একটি গল্প লিখেছিলাম। সেটা অনিক খানের তবুও ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়। এই দুটোই আমার প্রকাশিত গল্প। আমি একটা নাটকের চিত্রনাট্যও লিখেছি। ইচ্ছা আছে একটা সময় আমি অনেক লেখালেখি করব।
আপনার প্রায় সব গানের ভিডিওতেই আপনাকে কালো হ্যাট পরা দেখা যায়। এর পেছনে কোনো রহস্য আছে?
মূলত আমি হ্যাট পরা শুরু করেছি ‘আহারে’ দিয়ে এবং সেটা আসলে একটু লুকওয়াইজ এক্সপেরিমেন্ট করার জন্য। নতুন কিছু আনার জন্য। আমি তো আসলে এমনিতে হ্যাট পরি না। এখন সাক্ষাৎকার দেখে পরে আছি! (হাসি) হ্যাটটা আসলে পার্ট অব আইডেনটিটি বা নিজস্বতা। হ্যাট ছাড়াও আমি কিন্তু অনেক অনুষ্ঠানে যাই, গেছি। এমন কিছু না এটা, হ্যাটটা একটা সিগনেচারের মতো।
যদি তিন দিনের জন্য পৃথিবী থেকে গান শোনা ও গাওয়া নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়, তাহলে আপনি কী করবেন?
গান ছাড়া তিন দিনের জন্য বেঁচে থাকতে পারব, তবে সারাজীবন হলে পারব না। সারাজীবনের জন্য গান বন্ধ হলে আন্দোলন করতাম...কমিটি করে অনেক কিছুই করে ফেলতাম। তবে তিন দিনের একটা বিরতি আমার গানের জন্য ভালোই হবে। সৃজনশীল বিষয়গুলোতে একটা বিরতি পেলে জিনিসটা আরও ভালো হয়।
ঘুম থেকে উঠে যদি দেখেন আবার কিশোর জীবনে ফিরে গেছেন, তাহলে এমন কিছু কি আছে, যা ফিরে পেতে চান?
আম্মুর একটা কথা রাখতাম। তাঁর ইচ্ছা ছিল আমি যেন স্থাপত্যবিদ্যা পড়ি।
ধরুন আপনাকে পৃথিবীর সর্বশেষ কাগজটি দেওয়া হলো। এরপর থেকে আর কোনো কাগজ তৈরি করা হবে না। আপনি কার্টুনিস্ট, তাই আঁকতে পারেন, গীতিকার বলে গানও লিখতে পারেন। আপনি কোনটা করবেন?
আমি সবই করতাম। কাগজের এক পাশে গান লিখতাম, তারপর সেই গানের সঙ্গে মিল রেখে ছবি আঁকতাম। যা যা আছে জীবনে সবকিছু দিয়েই কাগজটা ভরিয়ে দিতাম। তারপর সেটা বাঁধাই করে আমার টেবিলের পাশে রাখতাম।
অবসর সময়ে কী করতে ভালো লাগে?
আমি প্রচুর মুভি দেখি। আমার মূলত রহস্য আর থ্রিলার চলচ্চিত্রগুলো ভালো লাগে। অ্যাকশন তেমন ভালো লাগে না। আর আমি ফিফা গেমও খেলি।
প্রতিটি মানুষের জীবনে কিছু অপূর্ণতা থাকে। আপনার জীবনের অপূর্ণতা কী?
আমার জীবনে কোনো অপূর্ণতা নেই। তবে আমার আব্বু আরও কিছুদিন বেঁচে থাকলে ভালো হতো। আব্বু বলতে পারতেন, ‘এইটা আমার ছেলে।’
কিশোর আলোর ভলান্টিয়ারদের নিয়ে আয়োজিত ‘নিশ্বাসে কিআ, বিশ্বাসে আনন্দ—কিআনন্দ’ পিকনিকে আপনি অতিথি হিসেবে গিয়েছিলেন। কেমন ছিল সেই অভিজ্ঞতা?
পিকনিকে আমি আমার স্কেচবুক নিয়ে গিয়েছিলাম। তো আমি সেখানে স্কেচ করেছি। ফুটবল খেলেছি, দুটো গোল দিয়েছি, আবার গোল খেয়েছিও। হা হা হা। বাসের জার্নিটা ভালো লেগেছে। দুই ভাগনিকে নিয়ে গিয়েছিলাম। সবাই ভেবেছিল আমি গান গাইব। কিন্তু আমাকে গাইতে হয়নি। ভলান্টিয়াররাই খুব জমিয়ে রেখেছিল।
গান নিয়ে অনেকের মনে নেতিবাচক ধারণা আছে। গানবাজনার জন্য পড়ার ক্ষতি হয়, এসব ছেলেমেয়েদের নষ্ট করে দেয়—এমন নানান কথা। এ সম্পর্কে আপনার মতামত কী?
গান নিজেই পড়ালেখার অংশ। এটা পড়াশোনার ক্ষতি করতে পারে না। আজকাল তো গান নিয়েই পড়াশোনা করা যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই সংগীত নিয়ে পড়ার সুযোগ আছে। অন্যান্য দেশে চাইলে গানের পেছনে পুরো জীবনটাই ব্যয় করা যায়। কোনো কিশোর যদি নিজের ইচ্ছাতে পড়াশোনার পাশাপাশি গানের সমন্বয়কে ধরে রাখতে পারে, তবে পড়ালেখার ক্ষতি হওয়ার প্রশ্নটাই আসে না। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ তাহসান ভাই। তিনি একাধারে একজন শিক্ষক আর বিখ্যাত সংগীতশিল্পী। অভিভাবকদের উচিত গানের প্রতি ছেলেমেয়েদের উৎসাহিত করা।
কিশোর যারা গায়ক হতে চায়। তাদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?
গানটা ভালোমতো চর্চা করো, শেখো। আর সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হলো, নিজের ইউনিক দিকটা খুঁজে বের করো। যদি সেটাকে খুঁজে বের করতে পারো আর ভালোমতো পরিচর্যা করতে থাকো তাহলে খুব ভালো হয়। নিজস্ব একটা স্টাইল তৈরি করো।
বাংলাদেশের গানের বাজার কতটুকু এগিয়ে যাবে বলে মনে করেন?
বাংলাদেশের গানের বাজার যেভাবে চলছে, আমার মনে হয় এগিয়ে যাবে। ইউটিউবে আমার ‘ঝুম’ গানটি ১ কোটি ৪০ লাখ বার দেখা হয়েছে। তা শুধু বাংলাদেশ থেকে নয়, প্রবাসীরাও দেখেছেন। আসলে প্রবাসীদের একটা বড় বাজার রয়েছে, যা আমরা সহজেই ইউটিউব দিয়ে ধরতে পারছি। আগে কিন্তু শুধু সিডি দিয়ে তা সম্ভব ছিল না।
নিজেকে যদি কোনো গানের জন্য অ্যাওয়ার্ড দিতে পারতেন, তাহলে নিজের কোন গানটি নির্বাচন করতেন?
যে গানটিতে অ্যাওয়ার্ড দেব, তা আমি এখনো তৈরি করিনি। (হাসি)
প্রথম কিআনন্দে কিশোর আলোতে কার্টুন আঁকার অনুরোধে আপনি উত্তর দিয়েছিলেন যে আগামীকাল থেকে শুরু করবেন। আগামীকালটার দেখা আমরা কবে পাচ্ছি?
(হাসি) এই দোষটা আমার নয়। সবকিছুই গল্পকারদের জন্য হচ্ছে। এই যে, কিশোর আলোর আদনান মুকিত ভাই আমাকে গল্প দিলেই এঁকে ফেলব। আর শিগগিরই আমি আঁকাআঁকিতে ফিরে আসতে চাই। হয়তোবা কালকেই। উন্মাদ-এর অফিসটাকে বেশ মিস করা হয়। বিশেষ করে বস, অন্যান্য সহকর্মী আর একসঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলো।