সাক্ষাৎকার
আইনস্টাইনের সঙ্গে দেখা হলে জানাতাম যে তাঁর অসমাপ্ত কাজ আমরা সফলতার সঙ্গে শেষ করেছি — দীপঙ্কর তালুকদার
বরগুনার মেঠো রাস্তা থেকে লাইগো সায়েন্টিফিক কোলাবোরেশন দলে যোগ দিয়েছেন একজন বাংলাদেশি। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার মহাকর্ষীয় তরঙ্গ আবিষ্কার করে গোটা বিজ্ঞান জগৎকে আলোড়িত করেছেন যাঁরা, তাঁদেরই একজন পদার্থবিজ্ঞানী দীপঙ্কর তালুকদার। জীবনের তাগিদে একসময় মাথায় করে কাঁঠাল বিক্রি করতেও দ্বিধা করেননি তিনি। শত বাধা আর প্রতিকূলতা সত্ত্বেও পড়ালেখা থামাননি। মানুষ যে তাঁর স্বপ্নের চেয়েও বড় তারই গল্প শোনাতে ২০১৬ সালের ২১ সেপ্টেম্বর কিশোর আলোর কার্যালয়ে হাজির হয়েছিলেন এই বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী।
কিশোর আলো :
আপনারা কীভাবে বুঝেছিলেন যে আপনাদের যন্ত্রে ধরা পড়া তরঙ্গটি ১৩০ কোটি আলোকবর্ষ দূরের দুটি ব্ল্যাকহোলের মিলিত হওয়ার ফলে সৃষ্টি?
প্রাথমিকভাবে আমরা আমাদের লাইগো দলের তৈরি একটি ডিটেক্টর যন্ত্র বসিয়েছিলাম। এটি ১০ থেকে ১০ হাজার হার্জ কম্পাঙ্ক পর্যন্ত তরঙ্গ শনাক্ত করতে পারে। বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের মহাকর্ষীয় তরঙ্গ-সম্পর্কিত সূত্রের সমাধান অনুসারে, আমরা প্রায় প্রতি ধরনের ব্ল্যাকহোলের মিলনের ফলে সৃষ্ট মহাকর্ষীয় তরঙ্গের গ্রাফ চিত্র তৈরি করি। পরবর্তী সময়ে আমাদের যন্ত্রে যে কম্পাঙ্ক ধরা পড়ে, সেটির তথ্যাবলিকে গ্রাফ চিত্রে রূপান্তর করা হয়েছিল। দেখা যায় যে সেটি আগের সূত্রানুসারে তৈরি করা অনেকগুলো গ্রাফের মধ্যে একটির সঙ্গে মিলে যায়। এর মাধ্যমে বোঝা গিয়েছিল, এটি কোনো জাহাজ, কোনো প্লেন কিংবা অন্য কোনো উৎস থেকে সৃষ্ট তরঙ্গ নয়। একমাত্র দুটি ব্ল্যাকহোলের মিলনের ফলেই এ রকম তরঙ্গ সৃষ্টি হওয়া সম্ভব। অন্যদিকে একটি তরঙ্গের তীক্ষতা হিসাব করলেই বোঝা যায়, সেটি কত দূর পথ পেরিয়ে এসেছে। কেননা প্রতিটি তরঙ্গ দীর্ঘ পথ অতিক্রমের ফলে দুর্বল হয়ে পড়ে। এর থেকেই বোঝা যায়, তরঙ্গটি কত দূর থেকে এসেছে। সার্বিক হিসাব-নিকাশের পরেই বলা সম্ভব হয়েছে যে তরঙ্গটি ১৩০ কোটি আলোকবর্ষ দূরের দুটি ব্ল্যাকহোলের মিলিত হওয়ার ফলে সৃষ্টি হয়েছিল।
কিশোর আলো :
পদার্থ বিজ্ঞানে আরও অনেক গবেষণার বিষয় রয়েছে। কিন্তু আপনি এমন একটি বিষয়ে গবেষণা করতে কেন আগ্রহী হলেন?
আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছি তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে। কেমব্রিজেও স্নাতকোত্তর করেছিলাম স্ট্রিং থিওরির ওপর। সেই সময়েই আমি লাইগো প্রজেক্টের ব্যাপারে জানতে পারি। লাইগো প্রজেক্টের কিছু ব্যাপার তখন ভালো লাগে। পদার্থবিজ্ঞানের জগতে লাইগো প্রজেক্ট অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং ছিল। কারণ কোনো বিজ্ঞানীই নিশ্চিত ছিলেন না ঠিক কবে নাগাদ মহাকর্ষীয় তরঙ্গ ধরা পড়বে। অন্যদিকে আমার পিএইচডির বিষয়ও ছিল দুটি ব্ল্যাকহোল মিলে গেলে কী হয়, তা ব্যাখ্যা করা। পাশাপাশি এই লাইগো প্রজেক্টের বিশেষজ্ঞ দলে ছিল আমার পিএইচডির সুপারভাইজার। তিনি আমাকে বেশ কয়েকবার করে তাঁদের গবেষণায় কাজ করার প্রস্তাব দেওয়ায় আমি রাজি হয়ে যাই। আর তারপরই জড়িয়ে পড়ি লাইগো প্রজেক্টের সঙ্গে।
কিশোর আলো :
আপনি কি ছোটবেলা থেকেই গণিতে পটু ছিলেন?
পটু ছিলাম কি না বলতে পারব না। তবে অন্যদের তুলনায় দ্রুত গণিতের সমাধান করতে পারতাম। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফল প্রকাশের দিন আমি বাবার সঙ্গে বাজার করতে গিয়েছিলাম। পরে আমি কলেজের নোটিস বোর্ডে দেখি, আমি বিজ্ঞানের সবগুলো বিষয়ে লেটার নম্বর পেয়েছি।
কিশোর আলো :
উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করার পর তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করতে আগ্রহী হলেন কেন?
আমিও তোমাদের মতো ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চেয়েছিলাম। কিন্তু ঢাকায় এনে, মেসে রেখে, ভর্তি কোচিং করিয়ে বুয়েটে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ানোর মতো সামর্থ্য আমার পরিবারের তখন ছিল না। ফলে সব দিক মিলিয়ে ভর্তি হলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরবর্তী সময়ে বিষয় নির্ধারণের সময় কোনো কিছু সেভাবে না বুঝেই তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান নির্বাচন করি। এখন মনে হয়, সেদিন ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।
কিশোর আলো :
আপনারা লাইগো প্রজেক্টে গবেষণার সময় মহাকর্ষ তরঙ্গের যে আওয়াজ শুনেছিলেন, সেটির ব্যাপারে জানতে চাই।
মহাকর্ষ তরঙ্গের আওয়াজ আসলে সরাসরি কানে শোনা যায় না। লাইগো ডিটেক্টরে মহাকর্ষ তরঙ্গ ধরা পড়ার পরে ডিটেক্টরের বিভিন্ন তথ্য গাণিতিকভাবে বিশ্লেষণ করার পরে তরঙ্গের আওয়াজ শোনা যায়। এই আওয়াজ প্রায় এক সেকেন্ডের পাঁচ ভাগের এক ভাগ সময় ধরে শোনা যায়। আমরা আরেকটি আওয়াজ পেয়েছিলাম ২০১৫’র ২৫ ডিসেম্বর। তবে সেটি প্রায় এক মিনিট ধরে শোনা গিয়েছিল। আসলে এ রকম আওয়াজ প্রায়ই শোনা সম্ভব। আমাদের লাইগো ডিটেক্টর আসলে এতটা শক্তিশালী নয়। তবে ২০১৯ সাল নাগাদ নাসা ‘লিসা’ নামের একটি ডিটেক্টর মহাকাশে পাঠাবে। এটি আমাদের নিজেদের গ্যালাক্সিসহ গোটা মহাজগতের অসংখ্য মহাকর্ষ তরঙ্গকে শনাক্ত করতে সাহায্য করবে।
কিশোর আলো :
আপনারা মূলত আইনস্টাইনের মহাকর্ষ তরঙ্গের সূত্রানুসারে গবেষণা করেছেন। এখন আইনস্টাইনের সঙ্গে দেখা হলে তাকে কী বলতেন?
আসলে আইনস্টাইনের যেসব গবেষণামূলক কাজ আছে সেগুলোর মধ্যে একমাত্র মহাকর্ষ তরঙ্গ-সম্পর্কিত সূত্রই তিনি প্রমাণ করে যেতে পারেননি। ফটো-ইলেকট্রিক ইফেক্টের জন্য তিনি নোবেল পুরস্কার পেলেও তাঁর সবচেয়ে বেশি কাজ ছিল মহাকর্ষ তরঙ্গের ওপর। এখন তাঁর সঙ্গে দেখা হলে তাঁকে ধন্যবাদ দিয়ে জানাতাম যে তাঁর অসমাপ্ত কাজ আমরা সফলতার সঙ্গে শেষ করেছি।
কিশোর আলো :
সাম্প্রতিক সময়ে পদার্থবিজ্ঞানের জগতে বাঙালিদের উন্নতির একটি ক্রমধারা লক্ষ করা গেছে। এ ব্যাপারে আপনার মতামত কী?
হ্যাঁ, বিষয়গুলো খুবই আনন্দের। তবে এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে এ কাজগুলো কিন্তু বাঙালিরা করলেও সেটি বাংলাদেশভিত্তিক হচ্ছে না। কারণ আমাদের দেশে সরকার বিজ্ঞানের গবেষণা ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করছে না। পশ্চিমা দেশগুলোতে সরকার বিজ্ঞানীদের গবেষণায় বিনিয়োগ করে। বিজ্ঞানীরা তাঁদের গবেষণার ফলাফল কাজে লাগিয়ে প্রযুক্তিবিদদের সঙ্গে নিয়ে আধুনিক প্রযুক্তিগত সম্ভাবনা সৃষ্টি করছেন। ফলে সরকারের বিনিয়োগ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নকে কাজে লাগিয়ে দেশকে সামনে এগিয়ে নিচ্ছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতও একইভাবে উন্নয়ন পরিকল্পনা করছে। আমাদের লাইগো প্রজেক্টের আরেকটি ডিটেক্টর ভারতে তাদের নিজ অর্থায়নে বসানো হবে। ফলে এ রকম ডিটেক্টর পরিচালনা এগুলোর যন্ত্রাংশ ভারতে তৈরি হওয়ার ফলে ভারতের প্রযুক্তিগত খাতে ব্যাপক উন্নয়ন ঘটবে। আমাদের বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে, আমাদের দেশীয় বিজ্ঞানীদের সরকারি ব্যবস্থাপনায় দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগের মাধ্যমে তাঁদের কাজের নিশ্চয়তা দিতে হবে। কেননা একজন বিজ্ঞানী যতই বাংলাদেশের মানুষ হোক বাইরের দেশ যদি তাঁকে কাজ করার সুযোগ দেয়, নিরাপদ জীবনের নিশ্চয়তা দেয়, তিনি কখোনোই দেশে ফিরতে চাইবেন না। তাই একমাত্র সরকারি উদ্যোগেই বাংলাদেশের পদার্থবিজ্ঞান তথা বিজ্ঞান গবেষণার উন্নতি করা সম্ভব।
কিশোর আলো :
বিজ্ঞান কর্মকাণ্ডের বাইরে আর কী করতে ভালোবাসেন?
আসলে এখন নিজের এই গবেষণার কাজের বাইরে সময় পাই অনেক কম। পাই না বললেও চলে। তবে যুক্তরাষ্ট্রে যে চার-পাঁচ মাস গ্রীষ্মকাল চলে তখন আমি বড়শি নিয়ে মাছ ধরতে চলে যাই। মাছ ধরাও আসলে বেশ কিছু বিজ্ঞানের ব্যাপার। ছোট থাকতে আমি একটু আঁকা-আঁকি করলেও আমার পরিবার আমাকে সেই ব্যাপারে উৎসাহ দেয়নি। আগে অনেক গল্পের বই পড়লেও এখন আর সময় পাই না। তবে একটু সুযোগ পেলেই নিজে নিজে রান্না করে খেতে ভালোবাসি।
কিশোর আলো :
মহাকর্ষ তরঙ্গ আমাদের গ্রহের ওপর কোনো রকম প্রভাব ফেলবে কী?
না। আমাদের ডিটেক্টরে যখন মহাকর্ষ তরঙ্গ ধরা পড়ে, তখন আমাদের চার কিলোমিটারের ডিটেক্টরটি একটি পরমাণুর মধ্যবর্তী ইলেকট্রন ও প্রোটোনের মাঝের দূরত্বের ১০ হাজার ভাগের ১ ভাগ পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। আমাদের গ্যালাক্সিতে কিংবা খুব কাছাকাছি এ রকম ব্ল্যাকহোলের মিলনের ফলে তরঙ্গ সৃষ্টি হলে তা হয়তো আমাদের ডিটেক্টরে বড় মাত্রায় ধরা পড়লেও পৃথিবীতে এটির তেমন কোনো প্রভাব ফেলবে না।
কিশোর আলো :
গাণিতিক কিংবা যেকোনো সমস্যা সমাধানে আপনি কীভাবে চিন্তা করেন?
ছোটবেলায় কোনো গাণিতিক সমস্যা সমাধানে আমার মূল অসুবিধা হতো যে আমি বুঝতেই পারতাম না যে কীভাবে শুরু করতে হবে। এখন যেটা করি যে শুরুতেই সমস্যাটির একটি গাঠনিক চিত্র এঁকে ফেলি। সেটা ধরে ক্রমান্বয়ে খুব সহজেই যেকোনো সমস্যার সমাধান করা সম্ভব।
কিশোর আলো :
বাংলাদেশের শিক্ষাক্রমের বিজ্ঞানবিষয়ক যে পাঠ্যবই তার মান নিয়ে আপনার মতামত কী? আপনি নিজে কি কোনো বই লেখার কথা ভাবছেন?
আমাদের সময় বইগুলোতে প্রতিটি অধ্যায়ে থাকত ‘এসো নিজে করি’। তবে সে সমস্যাগুলো কীভাবে সমাধান করতে হবে, সে ব্যাপারে কিছুই বলা থাকত না। ইংরেজি মাধ্যমের বইগুলো সেদিক থেকে বেশ এগিয়ে। বিজ্ঞানের বিষয়গুলো তারা যেমন সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করে, তেমনি সেগুলোর সমস্যা সমাধানের দক্ষতাও বাড়ায়। অন্যদিকে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কও একটা বড় ব্যাপার। আমাদের দেশে ছাত্ররা শিক্ষকদের ভয় পায়। ফলে তারা অনেক কিছুই মুখস্থ করে। যা বাইরের দেশে লক্ষ করা যায় না। তাই ছাত্র-শিক্ষক সুসম্পর্ক তৈরি ও সমস্যা সমাধানে দক্ষ করে তোলে এমন বই আমাদের বাচ্চাদের জন্য প্রয়োজন। আর বই লেখার মতো বড় বিজ্ঞানী আমি না। আমাদের লাইগো প্রজেক্টের এক হাজার জন বিজ্ঞানীর মাঝে আমি একজন। লাইগো প্রজেক্টের ওপর হয়তো কোনো বই আমি আমার কর্মজীবনের শেষে লিখব। তবে আগামী বছরের মাঝামাঝি সময়ে আমি লাইগো প্রজেক্টের ওপর একটি ছোট তথ্যকণিকা লিখব।