তরুণ প্রজন্মের জনপ্রিয় ব্যান্ড ‘লেভেল ফাইভ’। ইউটিউবে তাদের গান ‘সিক্সটিজ লাভ’ ইতিমধ্যে শোনা হয়েছে এক কোটির বেশিবার। অথচ চাকরিজীবনের পাশাপাশি গান করে যাওয়া কিংবা কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে গিয়ে অ্যালবাম প্রকাশ করা—লেভেল ফাইভের যাত্রাটা মসৃণ ছিল না। নিজেদের গান এবং গল্প শোনাতে ১৮ মার্চ কিআড্ডায় হাজির হয়েছিলেন তাঁরা। গানের ফাঁকে নানা গল্পে জানা গেল ব্যান্ডটির অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনা।
প্রশ্ন :
লেভেল ফাইভের শুরু কবে?
শুরুটা ২০১১ সালে। ব্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য বলা যায় কাইজার (গিটারিস্ট) ও আইদিদকে (ভোকালিস্ট)। ওদের হাত ধরেই শুরু। এত দিনে এসে অবশ্য লাইনআপ পাল্টেছে আমাদের। কাইজার সঙ্গে না থাকলেও এখন পাঁচজনের ব্যান্ড লেভেল ফাইভ।
প্রশ্ন :
লেভেল ফোর কিংবা সিক্স না হয়ে, ব্যান্ডের নাম লেভেল ফাইভ কেন?
নাম নিয়ে আমরা বেশ সমস্যায় ছিলাম। কোনোভাবেই পছন্দের নাম পাচ্ছিলাম না। আমাদের ভোকালিস্ট আইদিদ প্রতিদিন পড়ার টেবিলে বসে একটা করে নাম লিখত। হুট করে একদিন মাথায় এল ‘লেভেল ফাইভ’ নামটা। দশের ভেতর যদি আমরা কাউকে কোনো গড় নম্বর দিতে চাই, তাহলে সেটা হয় পাঁচ। আমরাও নিজেদের মাঝামাঝি মনে করি। খুব অসাধারণও না, আবার খুব একটা খারাপও না। শ্রোতাদের কাছে সাধারণ কিন্তু স্নিগ্ধ হয়ে থাকতে চাই। এভাবেই আমরা লেভেল ফাইভ।
আর হ্যাঁ, আমাদের ব্যান্ডের সদস্যসংখ্যাও কিন্তু পাঁচ।
প্রশ্ন :
আপনাদের গানগুলোর পেছনে কি আলাদা কোনো গল্প আছে?
আমাদের একেক গানের পেছনের গল্পগুলো একেক রকম। দুইটা গানের গল্প শোনাই তোমাদের। ‘সিক্সটিজ লাভ’ আমাদের সবচেয়ে জনপ্রিয় গান। অন্তত ভিউস তা–ই বলছে। গানটার গল্প ষাটের দশকের। যখন ইন্টারনেট বা ফেসবুকের অস্তিত্ব ছিল না। তরুণ-তরুণীদের যোগাযোগের উপায় ছিল চিঠি। সে সময় আমাদের কাইজারের বাবা ওর মাকে একটা চিঠি পাঠিয়েছিল। অনেক দিন পর সেই চিঠি আমাদের হাতে আসে। চিঠিতে থাকা কথাগুলো থেকে আমরা গানটা বানাই। সে যুগে ছেলে–মেয়ে কথা বলাই তো বড় বিষয় ছিল। তখনকার প্রেমের স্মৃতি হলো ‘সিক্সটিজ লাভ’।
‘সত্য-মিথ্যে’ গানের কথাগুলো অনেক আগে লেখা। আমাদের ব্যান্ডের বেজিস্ট রাজিনের এক বন্ধুর নাম অনিক সেন। যে সময়ের গল্প বলছি, তখন জীবনের একটা বেশ কঠিন সময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিল অনিক। ওর সঙ্গে তখন দেখা হতো ঢাকার বিশ্বরোডে। লম্বা সময় বসে গল্প করতাম আমরা। গল্পের মধ্যেই একদিন অনিকের ব্যাগ থেকে কিছু একটা বের করতে গিয়ে অনেকগুলো কাগজ নিচে পড়ে যায়। তার ভেতর একটা পুরোনো কাগজ চোখে পড়ল। ছেঁড়া, পুরোনো আর কাটাকুটিতে ভরা। এই কাগজের লেখাগুলোই ছিল ‘সত্য-মিথ্যে’র লিরিক্স। আমরা চেয়েছিলাম এই গান দিয়ে অনিকের গল্পটা বলতে।
প্রশ্ন :
লেভেলে ফাইভের প্রথম অ্যালবামের জার্নিটা কেমন ছিল?
২০১১ সালে ব্যান্ডের পথচলা শুরু হওয়ার পরই আমাদের প্রথম অ্যালবাম ‘অবশেষে’র কাজ শুরু হয়। কিন্তু ২০১৪ সালের এক সন্ধ্যায় রাজিনকে ডেকে কাইজার জানায়, ও যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাচ্ছে। লেভেল ফাইভের গানগুলো অনেক দিনের স্বপ্ন, অনেক দিনের শ্রম। যদি রাজিন গানগুলোর কাজ শেষ করে শ্রোতাদের কাছে পৌঁছে দিতে পারে, তাহলে ভালো, নয়তো লেভেল ফাইভের শেষ এখানেই। তত দিনে শুধু রেকর্ডিংয়ের কাজ শেষ হয়েছে। মূল কাজ মিক্সিং-মাস্টারিং বাকি। কাইজারের পাশাপাশি বাকিরাও তখন নিজেদের জীবন গোছাতে ব্যস্ত। সময়টা কঠিন।
রাজিন অবশ্য লেভেল ফাইভকে হারাতে দেয়নি। ‘ওউনড’ ব্যান্ডের এ কে রাতুলের সাহায্যে আমাদের অ্যালবামের কাজ ধীরে ধীরে এগোতে থাকে। মাঝেমধ্যে গভীর রাতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভিডিও কলে যোগ দিত কাইজার। যেখানে লেভেল ফাইভের শেষটা ছিল চোখের সামনে, সেখানে একদিন রাজিন অ্যালবামের কাজটা শেষ করে ফেলল। ফোন দিয়ে কাইজারকে এই খবর জানানোর পর দেখা গেল, হাজার মাইল দূরে বসে কাঁদছে সে।
আমরা প্রথম অ্যালবামের ১০০টা সিডি বানিয়েছিলাম। তারপর একটা শোয়ের আয়োজন করি। সেদিন আমাদের সব সিডি বিক্রি হয়ে যায়। সেখান থেকেই নতুন করে লেভেল ফাইভের শুরু।
প্রশ্ন :
বেশ অল্প সময়ে লেভেল ফাইভ নিজেদের গানের একটা ধাঁচ তৈরি করেছে। কীভাবে হলো ব্যাপারটা?
আমাদের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য কাইজার শুরু থেকেই প্রচুর পরীক্ষা–নিরীক্ষা করত গান নিয়ে। কাজ শুরুর আগেই আমরা আলোচনা করে নিই, গানটা দিয়ে শ্রোতাদের কাছে ঠিক কী পৌঁছে দিতে চাচ্ছি আমরা। এরপর শুরু হয় কম্পোজিশন। চেষ্টা করি গানগুলো যেন সহজ, সাধারণ হয়। অর্থ খোঁজার জায়গা থাকে। ফলে শ্রোতারা নিজেদের মতো গানকে অনুভব করেন, নিজেদের জীবনের সঙ্গে গানগুলো মেলাতে পারেন।
প্রশ্ন :
আপনাদের গান যখন বিভিন্ন সময় শ্রোতাদের গাইতে দেখেন, তখন কেমন লাগে?
একটা ঘটনা বলি। ২০১৮ সাল। এক বৃষ্টির দিনে গুলশানের এক ক্যাফেতে বসে ছিলাম। দেখতে পেলাম দুটো ছেলে গান করছে। আমাদের গান, ঘোলাটে মেঘ। কী সুন্দর করে গাইল! মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম। পুরো ব্যাপারটাই স্বপ্নের মতো। এমন অনেক গল্প আছে। আমরা সবাই চাকরি করি নয়টা-ছয়টা। তারপরও গান করে যাওয়াটা খুব কঠিন। কিন্তু সুন্দর স্মৃতিগুলো আমাদের এগিয়ে নেয়। আমাদের গান যদি একটা মানুষের মনের কাছে পৌঁছায়, তাহলে এর বেশি কিছু চাওয়ার নেই।
প্রশ্ন :
‘লেভেল ফাইভ’ নিয়ে আপনাদের স্বপ্ন কী?
স্বপ্ন বড় দেখা উচিত। আমরা চাই লেভেল ফাইভ যেন শ্রোতাদের কাছে একটা অনন্য অভিজ্ঞতা হয়। কোল্ডপ্লের কনসার্ট শেষে অশ্রুসিক্ত চোখে মানুষ যেমন একগুচ্ছ অনুভূতি নিয়ে ঘরে ফেরে, তেমন এক অনুভূতি হয়ে উঠুক লেভেল ফাইভ।
প্রশ্ন :
কিশোর আলোর পাঠকদের উদ্দেশে কী বলবেন?
পড়াশোনা ঠিক রেখেই অনেক কিছু করা যায়। মা–বাবার কথা শুনবে সবাই। আর পড়ার পাশাপাশি নিজের মনের কথাও শুনবে।
প্রশ্ন :
সামনের দিনগুলোয় ব্যান্ডকে ঘিরে আপনাদের পরিকল্পনা কী?
এই মুহূর্তে আমাদের হাতে ১১টি গান আছে। তার মধ্যে ৬টি গানের কাজ শেষ। অতএব, আমাদের এখন আমাদের একমাত্র পরিকল্পনা, নতুন অ্যালবাম শ্রোতাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া। সময়ের সঙ্গে আমরা কে কোথায় চলে যাব, কেউ জানি না। তাই আমরা চাই, দ্রুত গানগুলো মুক্তি পাক।
সময়ের সঙ্গে শ্রোতারা বদলাচ্ছেন। পাল্টে যাচ্ছে গানের রুচি। গান তৈরির সময় কি এসব বিষয় আপনাদের ভাবায়?
এখন তো ইউটিউব কিংবা স্পটিফাইতে খুব সহজেই গান শোনা যায়। তাই আগের মতো মেমোরি কার্ডে গান ট্রান্সফার করে শোনার মতো নিবেদিত শ্রোতা এখন কমে গেছে, সেটা ঠিক। কিন্ত গান জোর করে তো ভালো লাগানো যায় না। আমরা তাই আমাদের মতো গান বানাই। সেই গান বাকিদের ভালোবাসা পেলে খুশি হই।