পাখির ভাষা বোঝেন যিনি

ছবি: কবির হোসেন

শিকারি বাবার সন্তান শরীফ খান। বেড়ে উঠেছেন গ্রামীণ বনে ঘেরা পল্লিগাঁয়ে। যে গাঁয়ে তাঁদের নিত্যবসবাস ছিল মেছো বাঘ, শিয়াল, খাটাশ, বনবিড়াল আর পাখিদের সঙ্গে। বাবা ছিলেন বন কর্মকর্তা। বাবার চাকরির সুবাদে দেশের বিভিন্ন বনে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ পেয়েছেন খুব ছোটবেলায়ই। খুব কাছ থেকে দেখেছেন এ দেশের প্রাণপ্রকৃতি। প্রয়োজনে শিকার করেছেন। তবে তার চেয়ে বেশি ভালোবেসেছেন এ দেশের বন্য প্রাণী, পাখি আর বনজীবনকে। লেখালেখি করে প্রাণপ্রকৃতি রক্ষায় রেখেছেন বিশেষ অবদান।

গত শতাব্দীর সত্তর দশক থেকেই লিখছেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধ ও প্রকৃতিবিষয়ক গল্পে দেখা গেছে তাঁর বিশেষ মুনশিয়ানা। বিখ্যাত সেবা প্রকাশনী থেকেও বেশ কিছু বই বেরিয়েছিল তাঁর। নিয়মিত লিখতেন রহস্যপত্রিকায়ও। এখন প্রথম আলো, কিশোর আলো ও বিজ্ঞানচিন্তায় প্রকৃতি ও বণ্য প্রাণী নিয়ে নিয়মিত লিখে যাচ্ছেন। বন্য প্রাণী ও পাখি রক্ষার জন্য সচেতনতামূলক লেখাই বেশি লিখেছেন। তাঁর প্রায় প্রতিটি লেখা শিশু-কিশোর উপযোগী। ননফিকশন বইগুলোকেও তিনি তত্ত্ব আর তথ্যের ভারে জেরবার করেননি। বরং নিজের গ্রামীণ জীবনের অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে বন আর পাখির গল্প বলেছেন। এর ভেতরই দেখিয়ে দিয়েছেন এদের টিকে থাকার সংগ্রামের কাহিনি। শুধু গ্রামীণ বনের পাখি নিয়ে নয়, ঢাকা শহরের পাখি নিয়েও তিনি প্রচুর লিখেছেন এবং এখনো লিখে যাচ্ছেন।

শরীফ খান বাংলাদেশের পাখি বইয়ের জন্য ১৪১৪ বঙ্গাব্দে পেয়েছেন প্রথম আলোর বর্ষসেরা বইয়ের পুরস্কার। এই গুণী লেখক ও প্রকৃতিপ্রেমী ২০১৫ সালে পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার। কিশোর আলোর হয়ে জনপ্রিয় এই লেখকের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাংবাদিক কাজী আলিম-উজ-জামান

প্রশ্ন :

বাগেরহাটের ফকিরহাটে আপনার জন্ম। আপনার ছেলেবেলার কথা বলুন। তখনকার পরিবেশ, বন, বিল-বাঁওড়সহ ভূপ্রকৃতি কেমন ছিল?

আমার ছেলেবেলায় পুরো গ্রামটাই ছিল সবুজ। বিশাল বিশাল গ্রামীণ বন। উঠান-বাড়ির চারপাশেই বড় বড় গাছ। ভোর ও সন্ধ্যায় শিয়ালের দলের ‘খেয়ালসংগীত’-এ গ্রাম মুখর হতো। রাতে শজারুর দল ঝুমঝুম ‘কাঁটাসংগীত’ বাজাতে বাজাতে উঠান-বাড়ি পাড়ি দিত। মেছো বাঘে ছাগল-বাছুর মারত। নারকেলগাছে ভুতুম প্যাঁচা ডাকত। তক্ষক ছিল আমাদের ঘরের চালার তলায়। পাড়া কাঁপিয়ে ডাকত। বিষধর সাপের উপদ্রব খুব বেশি ছিল। বড় বড় গুইসাপ ছিল। ওগুলো ছিল আমাদের নিত্যপ্রতিবেশী (দিন ও রাতের)। বিল ছিল তিন-চারটি। গ্রামে কোনো পাকা রাস্তা ছিল না। ছিল না বিদ্যুৎ। ছিল না কোনো আধা পাকা বাড়িও। সব মিলিয়ে পরিবেশ ছিল নির্মল ও নির্ভেজাল। নির্জন।

প্রশ্ন :

আপনার বাবার কর্মক্ষেত্র ছিল সুন্দরবন। ৯ বছর বয়স থেকে ২০ বছর বয়স পয৴ন্ত আপনি সুন্দরবন এলাকায় ছিলেন বলে আমরা শুনেছি। পাখি, বন্য প্রাণী ও প্রকৃতির প্রতি আপনার আগ্রহের শুরুটা আমাদের বলুন।

সুন্দরবন নয়, সুন্দরবন লাগোয়া থানাগুলো ছিল বাবার কর্মক্ষেত্র। তিনি থানা কো-অপারেটিভ অফিসার (টিসিও) ছিলেন। বদলির চাকরি। ৯ থেকে ২০ বছর বয়স পর্যন্ত আমি বাবার কর্মস্থলগুলোতে বহুবার গেছি ও থেকেছি। সুন্দরবনে ঢুকেছিও বহুবার।

বর্তমানে খুলনা জেলার রূপসা উপজেলাসহ বর্তমান বাগেরহাট জেলার পুরোটাই ছিল ঘন গ্রামীণ বন ও ঝোপঝাড়ে ঢাকা। পতিত জমি ছিল প্রচুর। মানুষ ছিল কম। শৈশব-কৈশোরেই দেখেছি মেছো বাঘসহ নানা রকম বন্য জন্তু ও পাখি। এগুলোর প্রতি আমার আগ্রহ ছিল জন্মগতভাবে পাওয়া। বাড়ির পুকুরপাড়ের বাগানেও শিয়াল, খাটাশ, বনবিড়াল ও ভোঁদড় বাস করত। দেখে দেখে, কর্মকাণ্ড জেনে ও বন্দুকের গুলিতে শিকার হতে দেখেই ওগুলোর প্রতি প্রবল আগ্রহ জন্মে আমার। তা ছাড়া তখন দেখেছি, উঠান-বাড়ি ভরা পাখি। বাগান ভরা পাখি। মাঠ-বিল ভরা পাখি। পাখির ভেতরেই জন্ম আমার। আগ্রহী না হয়ে উপায় আছে!

প্রশ্ন :

আপনি কবে থেকে পাখি ও প্রাণী নিয়ে লেখালেখি শুরু করলেন? এ ধরনের লেখালেখি করে আপনি আসলে সমাজে কোন বার্তা দিতে চান?

ঢাকায় আসার পরে (১৯৭৪ সাল) আমি জানতে ও বুঝতে পারলাম, পাখি ও বন্য প্রাণী নিয়ে লেখালেখি করা যায়। আগে জানলে কী যে উপকার হতো!

লেখালেখির শুরু ১৯৭৬ সাল থেকে। শুরুর দিকে কোনো বার্তা দিতে চাইনি। আমার অভিজ্ঞতায় মনের আনন্দে লিখেছি। পরবর্তী সময়ে আশির দশক থেকে শুরু করে ২০১৪ সাল পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছি একাধিকবার। দেশের কোনো জেলা বাদ নেই, যেখানে আমি পাখি ও প্রকৃতি ভ্রমণে যাইনি।

মূলত বাংলাদেশের পাখি-প্রকৃতি ও বন্য প্রাণীদের সম্পর্কে জানাতে এবং এগুলো যাতে রক্ষা পায়, সেই বার্তাই আমি দিতে চাই।

প্রশ্ন :

আপনার লেখা পড়ে বোঝা যায়, আপনি পাখির আচরণ ও ভাষা বুঝতে পারেন। এটা কীভাবে রপ্ত করলেন, রহস্যটা কিশোর আলোর পাঠকদের যদি বলতেন।

ছোটবেলা থেকেই পাখির প্রতি প্রবল আকর্ষণ ও আগ্রহ ছিল আমার। আজও তা সমানভাবে বহমান। শৈশব-কৈশোরে ভোরবেলায় ঘরে শুয়ে শুনতাম কমপক্ষে ৪০ প্রজাতির পাখির ডাক ও গান। পাখির গানে ঘুম ভাঙত। নানা রকম গাছপালায় ভরা বাড়ি, যেন বনের ভেতরে ছোট্ট একখানা ঘর। সারা দিনই উঠান-বাড়িজুড়ে নানা রকম পাখির আনাগোনা ছিল। ওদের দেখতাম অবাক চোখে। ওদের পেছনে লেগে থাকতাম মুগ্ধতায়। দেখতাম ওগুলোর কাণ্ডকারখানা। বাসা যখন বানাত পাখিরা, তখন বসে বসে দেখতাম নেশার ঘোরে। আমাদের বাগানটা ছিল বিশাল। ওই বাগানে বাস করত নানান প্রজাতির পাখি। বিশেষ করে ডাহুক, হালতি, রাঙা হালতি, দুধরাজ ও ফটিকজল। বাগানের কিনারের তেঁতুলগাছে ছিল গিন্নি শকুনের বাসা। আমাদের গ্রামের ১০টি স্পটে শকুনের বাসা ছিল। শৈশব থেকে তরুণ বেলা পর্যন্ত লেখাপড়ার প্রচুর ক্ষতি করে ও দিনের পর দিন স্কুল কামাই করে পাখির পেছনে লেগে থাকতে থাকতেই (এমনকি ২০২২ সাল পর্যন্ত লেগে থাকার নেশাটা আমার আছে) পাখির ভাষা, তথা আচার-আচরণ ও স্বভাব-চরিত্র কিছুটা রপ্ত করতে পেরেছি। এই রপ্ত করার বিষয়টা যদি ঢাকায় আসার আগে জানা থাকত, তাহলে হয়তো আরও একটু বেশি রপ্ত করতে পারতাম। প্রসঙ্গত বলতে চাই যে প্রতিটি পাখির নিজস্ব ভাষা আছে, আছে ইশারা ভাষা। গান-নৃত্য আছে, দলবদ্ধ আনন্দ-ফুর্তি উদ্‌যাপন আছে। ঝগড়াঝাঁটি আছে। লড়াই আছে। সুখ-দুঃখসহ হাসি-কান্নাও (সে হাসি-কান্নার ধরন অন্য রকম) আছে। প্রতিটি প্রজাতিরই নিজস্ব আচার-আচরণ আছে। নেশার ঘোরে, নিবিড় পর্যবেক্ষণে পাখির আচার-আচরণ রপ্ত করতে হয়।

প্রশ্ন :

আপনারা ছোটবেলায় দেখেছেন, এখন প্রকৃতিতে তেমন দেখা যায় না, এমন কিছু পাখির নাম বলুন।

বড় পাখির মধ্যে হাড়গিলা (ক্বচিৎ দেখতাম), মানিকজোড়, দুই প্রজাতির বুনো রাজহাঁস, কালো মানিকজোড়, রঙিলা বক, লোহারজন্দ, মদনটাক, ধূসর সারস, কাস্তেচরা, গিন্নি শকুন বা শুধুই শকুন ইত্যাদি। হরিয়াল-কোড়া বা জলমোরগ-সাগর ইগল, বাজকুড়াল বা কুড়াসহ অধিকাংশ প্রজাতির বুনো হাঁস। এগুলো বলছি আমি বৃহত্তর খুলনার গ্রামবাংলার কথা। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে হাড়গিলা বাদে অন্য পাখিগুলো কমবেশি দেখা যায়। ইগল ও বাজকুড়াল শরৎ ও শীতে বৃহত্তর খুলনার বিল-হাওরে দেখা যেত অন্তত ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত।

প্রশ্ন :

একটা মজার প্রশ্ন—আমাদের দেশে শীতকালে যে লাখো পরিযায়ী পাখি আসে, এই পাখিদের আমাদের দেশে রেখে দেওয়ার কোনো উপায় আছে?

কোনো উপায়ই নেই। গড়পড়তা শরৎ-শীত পর্যন্ত অধিকাংশ পরিযায়ী পাখির চারণক্ষেত্র বা খাবার উৎস থাকে বাংলাদেশে। রেখে দিলে ওরা পড়বে মহাসংকটে। রেখে দেওয়ার চেষ্টাটা হবে প্রকৃতিবিরোধী, তথা পরিযায়ী পাখিবিরোধী। রেখে দেওয়ার কোনো উপায়ও নেই। তবে মজা করে আপনাকেও বলছি যে রেখে দিলে আমাদের দেশের পেশাদার পাখিশিকারি ও নেশাদার পাখির মাংসখেকো মানুষের ‘বারোমাসি সুবিধা’ হতো।

প্রশ্ন :

আমাদের দেশে পাখির নামকরণ নিয়ে একটা সমস্যা আছে। আমাদের দেশি পাখির চমৎকার বাংলা নাম থাকার পরও কেউ কেউ নাম পাল্টানোর চেষ্টা করছেন। নতুন নাম দিচ্ছেন। এটা কেন করা হচ্ছে?

একটি পাখির একাধিক নাম আছে বা থাকতে পারে। পরম্পরায় আমরা বহু পাখির নাম জেনেছি ও জানছি। তা ছাড়া আমাদের দেশের নানা অঞ্চলে বিভিন্ন পাখির আঞ্চলিক নাম বা স্থানীয় নাম আছে। আমরা (বাংলাদেশ ওয়াইল্ড লাইফ ক্লাব) প্রায় দুই যুগ ধরে বৃহত্তর খুলনার দুই শতাধিক পাখির স্থানীয় নাম সংগ্রহ করেছি ও করে চলেছি। সেই নাম আমি আমার লেখা বাংলাদেশের পাখি ও বন্য প্রাণী (২০১৬) বইয়ে উল্লেখ করেছি। সেই নামগুলো প্রাণিবিজ্ঞানী, পাখি ও বাঘ বিশেষজ্ঞ মনিরুল এইচ খান তাঁর লেখা বই (ইংরেজি) ফটোগ্রাফিক গাইড অব টু দ্য ওয়াইল্ড লাইফ অব বাংলাদেশ–এ উল্লেখ করেছেন বা ব্যবহার করেছেন। তার আগে প্রকাশিত অন্য বইগুলোতেও পাখিদের নাম উল্লেখ আছে।

নতুন নাম বা নাম পাল্টানোর চেষ্টা নিয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না।

প্রশ্ন :

একই পাখির নাম একেক এলাকায় একেক রকম। আঞ্চলিক নাম কি কোনো সমস্যা?

আমার মতে, না। তবে আঞ্চলিক নামের পাশাপাশি বহুল পরিচিত বা প্রচলিত নামগুলোর উল্লেখ থাকা দরকার। কিন্তু কোনো আঞ্চলিক নাম যদি বহুল ব্যবহৃত বা বহুল প্রচলিত হয়, পরম্পরায় দেশের মানুষ নামগুলো বলে, সেটা ব্যবহারে বাধা দেখি না।

প্রশ্ন :

আজকাল গণমাধ্যমে অনেকেই পাখি, প্রাণী নিয়ে লিখছেন। এতে অনেক ভুলভাল তথ্য প্রকাশিত হচ্ছে। নতুন লেখকদের সম্পর্কে আপনার পরামর্শ কী?

একটি পাখির তথ্য পাওয়ার জন্য এখন নানা রকম সুবিধা আছে। প্রযুক্তির কল্যাণে একটি পাখি সম্পর্কে খুঁটিনাটি সবকিছু জানা যায়। তবে যে পাখি বা প্রাণীটি নিয়ে লিখবেন কেউ, তাঁকে পুরোপুরি ‘তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর’ না হতে পরামর্শ বা অনুরোধ আমার। পাখি বা প্রাণীটা সম্পর্কে তাঁর নিজের সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা থাকলে খুব ভালো হয়। এ দেশে যত বেশি পাখি-প্রকৃতি ও বন্য প্রাণীর চর্চা হবে ও লেখালেখি হবে, ততই মানুষ আগ্রহী হবে। এখনকার অধিকাংশ শিশু-কিশোর ও তরুণেরা সাধারণ পাখিরও নাম জানেন না, কোনো আগ্রহও নেই। পরম্পরা না থাকলে তাঁদের পরবর্তী প্রজন্ম হয়তো দোয়েল, টুনটুনি বা বুলবুলির নামও ভুলে যাবে!

প্রশ্ন :

উপমহাদেশে পক্ষীবিদদের মধ্যে কার কার কাজকে আপনি উৎকৃষ্ট মনে করেন? আপনার সঙ্গে কখনো ভারতের সলিম আলীর দেখা বা যোগাযোগ হয়েছে?

এ ব্যাপারে আমার জ্ঞান সীমিত। তবে একাধিক পক্ষীবিদ এ তালিকায় আছেন। বাংলাদেশের পক্ষীবিদ মনিরুল এইচ খানের কাজকে আমি ব্যক্তিগতভাবে উৎকৃষ্ট মনে করি।

সলিম আলীর সঙ্গে আমার কখনো দেখা হয়নি। হলে নিজেকে খুব সৌভাগ্যবান মনে করতাম।

প্রশ্ন :

বাংলাদেশের নিভৃত গ্রামগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। উন্নয়নের নামে গ্রামেগঞ্জে কাঁচা রাস্তা নেই বললেই চলে। পাকা রাস্তা দিয়ে শাঁ শাঁ বেগে যান্ত্রিক যান ছুটে চলে পাখিদের অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে। আপনার কেমন লাগে?

উন্নয়ন তো হবে। তবে সেটা জীববৈচিত্র্যের জন্য ক্ষতিকর না হয়ে পরিকল্পিত হওয়া জরুরি। প্রকৃতির কথাও মাথায় রাখতে হবে। ব্যাপারটা আমাকে খুব কষ্ট দেয়। আমি চেয়েছিলাম, বাংলাদেশের প্রতিটি ইউনিয়নের কমপক্ষে একটি গ্রামকে ‘আদর্শ গ্রাম’ হিসেবে রেখে দেওয়া হোক। যে গ্রামে থাকবে না কোনো পাকা রাস্তা, বিদ্যুৎ। থাকবে কাঁচা রাস্তা। যে গ্রামে থাকবে শুধু সাধারণ ঘরবাড়ি। থাকবে যার যার পেশার লোক। সেই গ্রাম থাকবে তেমন, যেমন ছিল শত বছর আগে। বিদেশি পর্যটকেরা এসে যেন রবীন্দ্রনাথের সোনার বাংলা, জীবনানন্দ দাশের রূপসী বাংলা, জয়নুলের আঁকা বাংলাদেশ ও নজরুলের বাংলাদেশ দেখতে পান। তবে ওই সব গ্রামের অধিবাসীদের জন্য সরকারের যথাযথ অনুদান থাকতে হবে। ২০০৮ সালে ঢাকার সোনারগাঁও হোটেলে প্রথম আলো ‘বর্ষসেরা বই’–এর পুরস্কার অনুষ্ঠানের বক্তব্যে আমি এই কথাগুলো বলেছিলাম। আমিও এমন স্বপ্ন দেখি। প্রতি জেলায় কি এ রকম একটি গ্রাম রাখা যায় না? গেলে বিদেশে বাংলাদেশের মডেল গ্রামগুলো প্রশংসিত হতো।

প্রশ্ন :

প্রায়ই দেখা যায়, শহরের সড়ক বিভাজকে বিদেশি গাছ লাগানো হয়। অথচ বিদেশি গাছে আমাদের দেশি পাখি বসে না। বাসা বানায় না। মৌমাছি, প্রজাপতির মতো কীটপতঙ্গও আসে না। এ ক্ষেত্রে আমাদের নগর–পরিকল্পনাবিদদের প্রতি আপনার পরামর্শ কী?

দেশি গাছ যেমন, দেশি দেবদারু, দেশি আম, দেশি গাব, লিচুসহ লম্বা কাণ্ডের গাছ লাগালে ভালো হবে। শিরীষগাছ, বকুলসহ অন্যান্য দেশি গাছও লাগানো দরকার। আমাদের রাজধানী ঢাকা শহরে শতাধিক প্রজাতির আবাসিক পাখির স্থায়ী বসবাস। ওরা রাজধানীবাসী। এই শহরের এমন পাড়া-মহল্লা নেই, যেখানে বেজি নেই। আছে কাঠবিড়ালি। কাঠবিড়ালিরাও গাছে বাসা করে। কাঠবিড়ালি ও এই সব পাখি যে গাছগুলোর ডালপালা বা কোটর-ফোকরে বাসা করতে পারে, এমন গাছ নির্বাচন করলে ঢাকা পাখিময় শহর হয়ে যাবে। এই শহরের মানুষেরও ঘুম ভাঙবে পাখির ডাকে ও গানে। সন্ধ্যা নামবে পাখির ডানায় ভর করে। পাখি ও প্রজাপতি তো প্রকৃতির উড়ন্ত-দুরন্ত সৌন্দর্য। ফুল তো অপার্থিব। সব মিলেই তো প্রকৃতি। এই শহরে যদি অনেক মৌমাছি আসে, মৌচাক হয়, সেটা ঢাকা শহরের সৌন্দর্য বর্ধিত করবে বহুগুণে। অদৃশ্য ছোট কীটও প্রকৃতির বন্ধু। দেশের ছোট–বড় সব শহরেই দেশি গাছ লাগানো জরুরি। শুধু সড়ক বিভাজকে নয়, ঢাকার পার্ক-উদ্যানের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। সড়ক বিভাজকের দুপাশ দিয়ে অনবরত যান্ত্রিক যান চলাচল করছে, অথচ বিভাজকের ভেতরের গাছের ডালের বাসায় বুলবুলি পাখি ডিমে তা দিচ্ছে নিশ্চিন্তে, খাওয়াচ্ছে ছানাদের, এমন দৃশ্য প্রায়ই দেখা যায় এই রাজধানী শহরে। মতিঝিলের মতো ব্যস্ত এলাকায় বহু বুনো কবুতর বাসা করে ডিম পাড়ে ও ছানা তোলে। এই শহরের সঙ্গে তাল-লয়-ছন্দ মিলিয়ে বসবাস করছে পাখিরা। সেই পরিবেশ যত বেশি সামনের দিকে যাবে, ততই মঙ্গল হবে ঢাকা শহরের।

প্রশ্ন :

এবার বলুন আপনার লেখালেখি ও সাহিত্যজীবন সম্পর্কে।

লেখালেখির শুরু ছাত্রজীবনেই। ঢাকা থেকে প্রকাশিত এমন কোনো জাতীয় দৈনিক নেই, যেগুলোর সাহিত্য পাতায় আমার লেখা ছোটগল্প ছাপা হয়নি। অনেকগুলো ঈদসংখ্যায় আমার লেখা উপন্যাস ছাপা হয়েছে। এমন কোনো জাতীয় দৈনিকের ‘শিশু-কিশোর’ পাতা নেই, যেখানে আমার লেখা গল্প প্রকাশিত হয়নি, হয়েছিল, হচ্ছে এবং হবে। পাখি ও বন্য প্রাণিবিষয়ক লেখার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। জাতীয় সাপ্তাহিক-পাক্ষিক ও মাসিক পত্রিকায়ও আমার লেখা ছাপা হয়েছে।

আমার লেখা মোট বইয়ের সংখ্যা ৭৭। এর মধ্যে উপন্যাস ৯টি, শিশুসাহিত্যের (মুক্তিযুদ্ধের অ্যাডভেঞ্চার গল্প-উপন্যাসসহ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা গল্প) বইয়ের সংখ্যা ১৮। সব কটি বই খ্যাতনামা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত। তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে (ইংরেজি ও বাংলা) প্রকাশিত পাখিবিষয়ক একটি বইও প্রকাশিত হয়েছে।

প্রশ্ন :

এখন শুনতে চাই আপনার পরিবার ও সন্তানদের সম্পর্কে।

আমার দুই ছেলে। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির শিক্ষক। অন্যজন ব্যাংকার। দুই পুত্রবধূও উচ্চশিক্ষিত ও চাকরিজীবী।

আমি নিজেও সরকারি কর্মকর্তা ছিলাম। কয় বছর ধরে অবসর জীবন যাপন করছি। স্ত্রী মনিরা খানম লিলি। বড় ছেলের ঘরে এক পোতা অর্নিভ (১১) ও ছোট ছেলের ঘরে এক পুতনি তাথৈ (৩)। ঢাকায় বসবাস আমার ৪৭ বছর ধরে। গ্রামের বাড়িতে যেমন আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধব আছে, (‘টিম টুয়েলভ’-এর কজন মারা গেছেন, বাকিদের সঙ্গে বন্ধুত্ব অটুট আজও) ঢাকা শহরেও তা আছে। আমার বড় ছেলে ইমরান খান একজন গল্পকার। ইতিমধ্যে সে কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার পেয়েছে। ছোট ছেলে তানভীর খান সেই ক্লাস ফোর থেকে আমার সঙ্গে সারা বাংলাদেশে ঘুরেছে এবং প্রাণী ও পাখির ছবি তুলেছে। সেসব ছবি আমার বিভিন্ন বইয়ে ছাপা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়া শেষে চাকরিতে না ঢোকা পর্যন্ত সে একটি মূল্যবান ক্যামেরা নিয়ে আমার বা আমাদের সঙ্গে দেশের নানা প্রান্তে ঘুরেছে। সেই ক্যামেরা কেনার সময় প্রাণিবিজ্ঞানী মনিরুল এইচ খান সঙ্গে ছিলেন ও পরামর্শ দিয়েছিলেন (২০০১)। সেই ক্যামেরা এখন বাক্সবন্দী। সব মিলে আল্লাহর রহমতে সুখী পরিবার আমরা।

প্রশ্ন :

একবার শুনেছিলাম ১৯৭১ সালের পর আপনি নিজে আর ছবি তোলেননি। একটু কি বলবেন আমাদের?

এই ছবি না তোলার পেছনে আছে দুঃখজনক ঘটনা। আমার জন্য সেটা আজও বেদনাদায়ক। স্কুল-কলেজজীবনে আমি মোট তিনটি সাধারণ ক্যামেরা উপহার পেয়েছিলাম। প্রথমটি লন্ডন থেকে এনে দিয়েছিলেন আমার দাদির এক ভাইপো, ওনার নাম ছিল জ্যোতি। উনি ব্যারিস্টারি পড়তে লন্ডন গিয়েছিলেন। দ্বিতীয়টিও পেয়েছিলাম চার বছর পরে ওই লন্ডন থেকেই। লন্ডনে সরকারি ট্রেনিংয়ে গিয়ে ভাগনের জন্য আমার এক মামা একটি সাধারণ ক্যামেরাই এনেছিলেন। ১৯৬৮ সালে আমাদের টিম টুয়েলভের খুরশিদ আলম আগফা ক্লিক-১২০ (৫০ টাকা) ক্যামেরা কিনেছিলেন। এই ক্যামেরায় এক রোলে ফিল্ম থাকত ১২টি। সাদা-কালো ফিল্ম। লন্ডনের ক্যামেরা দুটি ছিল জাপানিজ ইয়াসিকা। এক রোলে ফিল্ম থাকত ৩৬টি।

মোট তিনটি ক্যামেরা দিয়ে আমরা টিম টুয়েলভের সদস্যরা কুকুর-বিড়াল-গরু-ছাগল-হাঁস-মুরগি ও মানুষের ছবি তুলতাম। শিয়ালছানা-খাটাশছানা-বনবিড়ালছানা-শজারুছানা-বুনো খরগোশছানাসহ নাগালে পাওয়া পাখির বাসার (ডিম-ছানাসহ) ছবি তুলতাম। বাড়ির দাদি-নানি-চাচি-খালা ও ভাইবোনদের ছবি তুলতাম। পাখির ছবির মধ্যে দুই প্রজাতির পাখির ছবি আমরা প্রতি সিজনেরই তুলতাম। পাখি দুটি হলো হালতি (Hooded pitta) ও রাঙা হালতি (Slaty-legged crake)। বাসায় ডিম বা ছানা বুকে নিয়ে বসে থাকলে এই দুটি পাখির ছবি ৬ ইঞ্চি থেকে ১ ফুট দূর থেকে তোলা যায়। ওড়ে না ওরা। এ ছাড়া বাবা যেসব পাখি শিকার করে বাড়িতে আনতেন, তার মধ্যে অনেকগুলোই আহত অবস্থায়ও বেঁচে থাকত। ছবি তুলতাম ওগুলোরও। বাগেরহাট শহরের নাথ স্টুডিওতে যেতাম। তিন আনা থেকে এক টাকা লাগত ফিল্ম ওয়াশের জন্য। প্রতি কপি ছবি প্রিন্টে চার আনা। বাড়িতে রাখার জন্য সাদা–কালো ছবিগুলোর জন্য ছিল আলাদা একটি টিনের বাক্স। নেগেটিভগুলো রাখার জন্য আরেকটি টিনের বাক্স।

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকেই (তখন আমি বাগেরহাট প্রফুল্লচন্দ্র কলেজে অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্র) মে মাসের ২ তারিখে আমার মা মারা যান। দিন সাতেক পর আমার নানা-নানি, মামা-মামি, খালারাসহ বাবা বললেন, ‘তোর মায়ের কয়েকটা ভালো ছবি বের কর, কাচের ফ্রেমে বাঁধিয়ে দেয়ালে টাঙিয়ে রাখা হবে।’ আমরা টিম টুয়েলভের সবাই মিলে দুটি টিনের বাক্স তন্নতন্ন করে তল্লাশি করেও মায়ের কোনো ছবি পেলাম না। তখন মনে পড়ল, তাই তো! উঠান-বাড়ি-মাঠ-বাগান ও পুকুর-দিঘির পাড়ে ছবি তোলার সময় মা প্রায়ই দেখেছেন, মজা পেয়েছেন, কিন্তু আমি বা আমরা কখনো তাঁকে বলিনি ছবি তুলতে, উনিও কখনো বলেননি আমার একটা ছবি তুলে দে। সিঙ্গেল ছবি তো দূরের কথা, কোনো গ্রুপ ছবিতেও আমার ‘মা’ নেই!

সব ছবি ও প্রিন্টেড ফিল্ম আমরা কুটোর আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে ফেলেছিলাম। মায়ের ছবিই যখন তুলিনি, তখন আর কিসের ছবি তুলব!