৩৬-৩৭ জনের একটা বাহিনী নিয়ে একের পর এক আমবাগান-লিচুবাগান লুট করা কিংবা বন্ধুদের নিয়ে সাঁতারের উন্মাদনায় উন্মত্ত হয়ে পড়া, কৈশোরের সম্ভাব্য সমগ্র দুরন্তপনাই নিহিত ছিল তাঁর স্বভাবসুলভ কাজকর্মের মধ্যে। পড়ালেখা নিয়ে খুব একটা মাথাব্যথা ছিল না। পড়ালেখা করলে টাকাপয়সা পাওয়া যায়, বিলেতফেরত মামার কাছে প্রথম এ কথা শুনে হয়েছিলেন প্রচণ্ড বিস্মিত। পড়ালেখা নিয়ে চিন্তাভাবনাহীন দিন কাটানো দেখে তাঁর বাবা আশঙ্কা করেছিলেন, ছেলে আবার দার্শনিক হয়ে যাচ্ছে না তো! বাবার সেই চিন্তার রেশ ধরেই মাধ্যমিকে পড়ার সময় বন্ধুদের নিয়ে গড়ে তোলেন ‘ফিলোসফিক্যাল সোসাইটি’। সেই যে শুরু! এরপর জীবনের অনেকটা পথ পেরিয়ে ‘আলোকিত মানুষ চাই’ স্লোগানে তিন দশক ধরে গড়ে তুলেছেন আজকের বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। এই মানুষটি আমাদের সবার প্রিয় আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, র্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার রয়েছে জীবন্ত এই কিংবদন্তির ঝুড়িতে। পাবনা জিলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক ও বাগেরহাটের প্রফুল্লচন্দ্র কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পড়ে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকিয়ে শুরু করেন শিক্ষকতা। একাধারে তিনি সাহিত্যিক, উপস্থাপক ও সংগঠকও। ষাটের দশকে বাংলাদেশে নতুন ধারার সাহিত্য আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী এই মানুষটি মুখোমুখি হয়েছিলেন কিআ সাক্ষাৎকার দলের। সেই দলে ছিল ভিকারুননিসা নূন স্কুলের মাইশা সামিহা, মোহাম্মদপুর মডেল স্কুল ও কলেজের মেহেদী হাসান, মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়ের অঙ্কন ঘোষ দস্তিদার, হলিক্রস কলেজের তাবাস্সুম ইসলাম ও রাজউক উত্তরা মডেল কলেজের শারিন মাহজাবিন।
প্রশ্ন :
স্যার, কিশোর বয়সে আমরা নানা ধরনের বন্ধুর সংস্পর্শে আসি। কেউ খারাপ পথে নিয়ে যায়, কেউ ভালো পথে। আপনার কিশোর বয়সে কি এ রকম বন্ধুর সংস্পর্শে আসা হয়েছিল?
শঙ্করাচার্যের একটা খুব সুন্দর কথা মনে পড়ছে। শঙ্করাচার্য ছিলেন একজন দার্শনিক। কথাটা হলো:
কা তব কান্তা কস্তে পুত্রঃ?...কে তোমার স্ত্রী, কে তোমার পুত্র?
সংসারঃ হয় মতিবঃ বিচিত্রঃ ...সংসার এক ভারি বিচিত্র জায়গা।
নলিনী জলবৎ, জলমতি তরলং...নলিনী হচ্ছে পদ্ম। পদ্মপাতার ওপর পানি যে রকম নড়ে,
তদ্মাৎ জীবনম অতিশং চপলম...সে রকম জীবনও অত্যন্ত চপল।
মা তরু ধনজম যৌবন গত...এখানে ধন-জন-যৌবনের গর্ব কোরো না। কারণ,
হরতি নিমেষাক কালং সর্ব...কাল সবকিছু মুহূর্তে-নিমেষে হরণ করে নেয়। তাহলে এখানে কী থাকল? একটা জিনিসই ঠিক থাকল। সেটা হলো:
তনমেহ সজ্জন সঙ্গতি রেখ...সজ্জনের, ভালো মানুষের বন্ধুত্ব। এটা হচ্ছে এই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জিনিস।
ভবতি ভবার্ণব তনমেহ...এই ভবসমুদ্র পার হওয়ার সবচেয়ে ভালো নৌকা হচ্ছে ভালো মানুষ, ভালো মানুষের বন্ধুত্ব। আমরা কত ওপরে যাব, সেটা নির্ভর করে এই বন্ধুদের ওপর। আমার আব্বা, আমার ধারণা, এটা বুঝতেন। আমি যখন ক্লাস ফাইভে ভর্তি হলাম, তখন তিনি আমাকে বললেন, তোদের ক্লাসে ভালো ছেলে কারা কারা রে? আমি বললাম, অমুক ভালো, তমুক ভালো। উনি বললেন, একদিন সবাইকে দাওয়াত দে। আমি দাওয়াত দিলাম, তারা সবাই এল। আব্বা তাদের সঙ্গে খুব হাসি-তামাশা করলেন। করে বললেন, তোমরা সবাই ভালো তো, তোমরা সবাই একসঙ্গে থাকবে। আমার আব্বাও শিক্ষক ছিলেন, পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের প্রিন্সিপাল। ওই যে আমরা বন্ধু হয়ে গেলাম, সেই বন্ধুদের অনেক প্রভাব জীবনে। ভালো মানুষের কাছ থেকে ভালো প্রভাবই আসে। তাদের মধ্যে ভালো ছাত্র ছিল, খারাপ ছাত্র ছিল। খারাপ ছাত্র মানে খারাপ মানুষ নয়। অনেক ভালো মানুষ খারাপ ছাত্র।
প্রশ্ন :
খারাপ মানুষকে কি ভালো করা যায় না? আমরা যদি তাদের বন্ধু হই...
নিশ্চয়ই। তুমি যদি ভালো হও, তাহলে তুমি খারাপকে তোমার পথে নিয়ে আসতে পারবে। তুমি ভালো কি না, সেটা আগে নিশ্চিত হও।
প্রশ্ন :
আমি ভালো কি না, কীভাবে বুঝব?
সেটা মানুষ বোঝে। যার আচরণে অন্য মানুষের ক্ষতি হয় না, অন্য মানুষ দুঃখ পায় না, কষ্ট পায় না। যে অন্য মানুষের দুঃখের কারণ হয় না, সুখের কারণ হয়, আনন্দের কারণ হয়, সেই মানুষ হচ্ছে ভালো মানুষ।
প্রশ্ন :
স্কুলে যেতে আর পড়াশোনা করতে কেমন লাগত?
অল্প বয়সে আমার পড়াশোনার ব্যাপারে কোনো আগ্রহই ছিল না। ছাত্র হিসেবে খুবই সাধারণ ছিলাম। আমার একটা সুবিধে ছিল, আমার স্মৃতিশক্তি ছিল খুব চমৎকার। একবার পড়লেই প্রায় মুখস্থ হয়ে যেত। আমি সারা বছর আর পড়তাম না, পরীক্ষার রাতে বা পরীক্ষার ছয়-সাত দিন আগে থেকে পড়তাম, একেক দিনে ১০-১২টা করে প্রশ্ন পড়তাম। তার ফলে একেবারে যে খারাপ ছিলাম তা না, মানে ধরো থার্ড হতাম, সাত দিন পড়ে আর কী হতে পারে বলো!
এখন তো বলা হয় মুখস্থবিদ্যাকে ‘না’ বলো...
আরে ওই আন্দোলনটা তো আমিই করছি। এই যে তোমাদের সৃজনশীল প্রশ্ন, এটার পেছনে আমি ছিলাম, এখনো আমি এটার সভাপতি। আমারও মুখস্থ করতে কষ্ট হতো তো! জাদুকরেরা কামানের গোলা খায়, খেতে তো হয়ই কিছু। সেটা তো খুব সুস্বাদু না। সুতরাং, আমার একদম পাঠ্যবই পড়তে ইচ্ছে করত না। কারণ, পাঠ্যবই তো জ্ঞান না। পাঠ্যবই হচ্ছে জ্ঞানের ছোবড়া। রবীন্দ্রনাথ, প্লেটো বা শেখ সাদির একেকটা বই হচ্ছে সরাসরি জ্ঞান। তাঁর একটা বই পড়ছি মানে আমি শেখ সাদিকেই পাচ্ছি। আর সেটার ওপরে যখন একটা পাঠ্যবই তৈরি হয়, তখন আসল শেখ সাদিকে পাওয়া যায় না। সে জন্য আমার ওসব ব্যাপারে কোনো আগ্রহ নেই।
প্রশ্ন :
ছোটবেলায় কী হতে চাইতেন?
ছোটবেলায় আমার স্বপ্ন ছিল গুন্ডাসরদার হব। আমার ৩৬ না ৩৭ জনের বাহিনী ছিল, আমি তাদের নিয়ে আমবাগান লুট করতাম, লিচুবাগান লুট করতাম, অন্য পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে মারামারি করতাম, জিমনেশিয়ামে যেতাম নিয়মিত। রিংয়ের ওপর ৩০টি খেলা দেখাতে পারতাম, খুব ভালো সাঁতার পারতাম, মোটকথা স্পোর্টসম্যান ছিলাম। যারা স্পোর্টসম্যান হয়, তারা চিন্তাভাবনা বেশি করতে চায় না। আমাদের ওখানে ইয়াকুব গুন্ডা নামে একজন খুব বিখ্যাত গুন্ডা ছিল। তো সে যখন রাস্তা দিয়ে যেত, তখন লোকেরা দুই পাশে সরে তাকে সালাম দিত। আমার মনে হলো এর চেয়ে বড় কে!
একবার যাচ্ছিলাম দিনাজপুর আম খেতে। ঈশ্বরদী স্টেশনে গেছি। একটা ট্রেন, নর্থবেঙ্গল এক্সপ্রেস নাম, কলকাতা থেকে এক ধাক্কায় চলে আসত ঈশ্বরদী, আরেক ধাক্কায় চলে যেত পার্বতীপুর বা সান্তাহার। আমি প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ সেই ট্রেনটা ঢুকল প্ল্যাটফর্মে। সেকালের ট্রেন, ‘ফোঁস ফোঁস, ফোঁস ফোঁস...’ করতে করতে সেই দুর্ধর্ষ ট্রেন ঝমঝম গর্জন করতে করতে সেই যে রাজকীয়ভাবে প্ল্যাটফর্মে ঢুকে পড়ল, আমি বিস্মিত হয়ে গেলাম এই রকম একটা অসাধারণ দৃশ্য দেখে। আমার টিকিট ছিল ইন্টারক্লাস। আমি সেই ট্রেনটাকে ভালো করে দেখার জন্য থার্ড ক্লাসে উঠে, ওই ইঞ্জিনটার পাশে এসে বসলাম। হ্যান্ডেল ধরে ঝুলে ঝুলে দেখলাম যে ট্রেনটি ঝমঝম করতে করতে মাঠ-ঘাট-প্রান্তরের ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছে। প্ল্যাটফর্মের লোকেরা করুণ চোখে তাকিয়ে আছে, তাদের নেবে না। কারণ, সে তো থামবে না। তারপর দেখলাম একজন লোক, তার মাথায় লাল একটা কাপড় জড়ানো, সে মাঝেমধ্যে একটা দড়ি ধরে টান দিচ্ছে আর ট্রেনটা প্রচণ্ড গর্জন করে হুইসেল বাজিয়ে চারদিক প্রকম্পিত করে তুলছে। আমার মনে হলো যে এর চেয়ে রাজকীয়, এর চেয়ে দুর্ধর্ষ আর কিছু হয় না। এবং ওই লোকটাকে আমার মনে হলো সে-ই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ লোক। যদি কিছু হতে হয়, তাহলে ওই ট্রেনের ড্রাইভার।
প্রশ্ন :
বাবা কী চাইতেন, কী হতে হবে আপনাকে?
আব্বা আমাকে কোনো দিন পড়তে বলেননি। আমি ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেওয়ার আগ পর্যন্ত জানতাম না যে পড়ার সঙ্গে টাকাপয়সার কোনো যোগাযোগ আছে। আমার জানা ছিল, যে রকম খেতে হয়, যে রকম খেলতে হয়, তেমনি পরীক্ষায় পাস করতে হয়। আমি যখন ম্যাট্রিক পাস করলাম, তখন আমার মামা বললেন যে তুই চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হ। উনি তখন বিলেত থেকে পিএইচডি করে এসেছেন। ব্রিটিশ আমল। তাঁর কথা আমাদের কাছে বেদবাক্য, মানে আমাদের পরিবারের মধ্যে এমন বিরাট কেউ নেই। তিনি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হতে বললেন, কারণ তিনি লন্ডনে দেখে এসেছেন যে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টরা খুব ওয়েল-প্লেসড। গাড়ি হবে, বাড়ি হবে, এত টাকা বেতন হবে...মানে আমার কাছে প্রথম অভিজ্ঞতা যে পড়লে টাকা পাওয়া যায়! এখন তো ক্লাস ওয়ানের ছেলেটাও জানে। ভাগ্য ভালো আমি জানতাম না। সে জন্য আর পরে কখনো মনে হয়নি যে টাকা দরকার। জীবনে যারা টাকার পেছনে ঘোরে, তাদের খুব বোকা লোক মনে হয়। কোন টাকাওয়ালা লোককে পৃথিবী মনে রেখেছে?
বিল গেটস!
না, সেটা উনি টাকা রোজগার করেছেন বলে না, টাকা দিয়ে দিয়েছেন বলে। কথাটা মনে রাখবে, কত হাজার কোটি টাকাওয়ালা লোক পৃথিবীতে ছিল। মানুষ কাউকে মনে রেখেছে? মনে রেখেছে হাজী মুহম্মদ মুহসীনকে। টাকা রোজগার করেছিলেন বলে নয়, টাকা দিয়ে ফকির হয়ে গিয়েছিলেন বলে। সুতরাং, ফকিরকে মনে রাখে মানুষ। হাতেম তাই? তাঁকেও মনে রেখেছে মানুষ। উনিও রাজা ছিলেন, কিন্তু দিতে দিতে সব শেষ। বিল গেটসকেও এই কারণে মনে রাখবে যে তিনি সবকিছু দিয়ে দিয়েছিলেন।
একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, র্যামন মাগসাইসাই পুরস্কারের মতো কিছু অর্জন তো আপনার রয়েছে...
এটা ওরা দয়া করে দিয়েছে, মানে আমার এসবের প্রতি কোনো আগ্রহ নেই।
প্রশ্ন :
ছোটবেলার কোনো অর্জন আছে?
আমার সারা জীবনেই কোনো অর্জন নেই, গর্জন আছে শুধু। (হাসি)
প্রশ্ন :
পড়াশোনার প্রিয় বিষয় কী ছিল?
ওই যে আমি বললাম, আমি তো ছিলাম স্পোর্টসম্যান। আমি গুন্ডা হব, আবার দার্শনিক হওয়ার প্ল্যান হলো একবার। গালে হাত দিয়ে বসেছিলাম, তো আব্বা বললেন, বাপ রে বাপ! যেভাবে বসে আছে, ছেলে আমার দার্শনিক না হয়ে যায়! তখন আমি ভাবলাম দার্শনিক হব! যখন ক্লাস নাইনে উঠলাম, তখন একটা সোসাইটি বানালাম, তার নাম ফিলোসফিক্যাল সোসাইটি। তখন ফিলোসফি কাকে বলে জানি না, ফিলোসফিক্যাল সোসাইটি কী, তাও না। আমরা করতাম বার্নার্ড শর নাটক। তোমরা বার্নার্ড শ পড়েছ কি না জানি না। তাঁর নাটকে ছিল সাংঘাতিক নতুন নতুন আইডিয়া। আমরা তখন একেবারে পাগল হয়ে গেলাম। আর্মস অ্যান্ড দ্য মানি, ইউ নেভার ক্যান টেল, দ্য ম্যান অব ডেসটিনি, ক্যান্ডিডা, ম্যান অ্যান্ড সুপারম্যান। এই সব পড়ে-টড়ে পাগলের মতো হয়ে গেলাম।
প্রশ্ন :
এসব বই পড়ার কারণেই কি পরবর্তীকালে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য বইপড়া কর্মসূচি?
না, ওই জন্য করিনি। এটা হয়েছে দুটি কারণে। আব্বা যে ঘরে পড়াশোনা করতেন, ওই ঘরে আমরা কেউ যেতাম না। তো একদিন আব্বা আমাকে ডেকে বললেন, দেখ, তুই বড় হলে একটা জিনিস বুঝবি, নলেজ ইজ পাওয়ার। যাহোক, তিনি কী বললেন না-বললেন কিছু মনে নেই, কিন্তু ঘরভর্তি যে বই, সেই আমি প্রথম দেখলাম। দেয়ালজুড়ে বই। আমার কাছে মনে হলো যেন পৃথিবীজুড়ে বই। অল্প বয়স তো, তখন মনটা খুব কচি থাকে। তোমরা এখন বুঝবে না যে তোমাদের মনটা কচি। বুড়ো হলে তখন বুঝবে। তো মানুষের ওই বয়সে যেটা মনের মধ্যে এসে যায়, সেটাকে হয়তো সে সারা জীবন খুঁজে বেড়ায়। আমিও হয়তো খুঁজে বেড়িয়েছি। মানুষ ছোটবেলায় যেটা দেখে, সারা জীবন সেটাকেই রচনা করতে চায় বলে আমার মনে হয়। এই একটা কারণ। আর একটা হলো যে আমাদের একজন বিলেতফেরত হেডমাস্টার ছিলেন। উনি বলতেন, আমি যদি তোমাদের বিলেতের গল্প বলি, সে তোমরা ভাবতেও পারবে না, বুঝতেও পারবে না। সেই একটা গ্রাম থেকে একটা মানুষ সে যুগে বিলেতে গিয়েছিল। তার কাছে যে বিস্ময়! তখন লাইব্রেরিতে বই পড়া বাধ্যতামূলক ছিল। উনি বললেন, তোমরা লাইব্রেরিতে আসবে না, সবাই ক্লাসে থাকবে, আমি একটা করে লাইব্রেরি প্রতিটি ক্লাসে বানিয়ে দেব। উনি আমাদের ৩০ জন ছাত্রের জন্য একটা ছোট্ট বাক্স বানিয়ে দিলেন, তার মধ্যে ৫০টা বই। প্রত্যেককে প্রত্যেক সপ্তাহে একটা করে বই বাড়ি নিয়ে যেতে হবে। উনি কেন করেছিলেন এখন আমি বুঝেছি। উনি হয়তো ভেবেছিলেন, যে নিল, সে যদি নাও পড়ে, তার ভাইবোন, তখন তো অনেক ভাইবোন হতো, আমরা ১১ ভাইবোন, কেউ না কেউ পড়বে। নাহলে মা-বাবা পড়বে। কোনো বন্ধু পড়বে। বইটা সবার মধ্যে ছড়িয়ে যাবে। আবার ও পড়লে তো পড়লই। অনেকে ভাবতে পারে পড়ছি না, শুধু গাধার মতো বই আনছি, দেখি না পড়ে। হয়তো তিন-চার চ্যাপ্টার বই পড়ে ফেলল। ওই বয়সে একটা বই মানে এই বয়সে ১০০টা বই পড়ার সমান।
আমার মনে হয় এই দুটো জিনিস মিলে পরে এই চিন্তা আমার মাথায় আসে। প্রথমে অবশ্য আমি গিয়েছিলাম বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ছাত্রদের পড়াতে। তখন সাকসেস খুবই ভালো হলো, খুব ব্রিলিয়ান্ট ছেলেপেলেরা বেরোল। কিন্তু আমার মনে হলো, ওদের মেধা খুব ঝকঝকে হলো, কিন্তু হৃদয়টা? আমি যে রকম আরও মানবিক হবে ভেবেছিলাম, সে রকম হলো না। আমার মনে হলো, আমি হয়তো একটু বেশি বয়সের ছেলেপেলেদের নিয়ে কাজ করছি। তখন আমি কলেজের ছেলেদের কাছে গেলাম। দেখলাম অনেক বেটার। তারপর মনে হলো স্কুলের ছেলে দেখি। তখন দেখি এটাই সবচেয়ে ভালো। যা দেখছে, যা শুনছে, যা পড়ছে, সব ভেতরে চলে যাচ্ছে। চলে যাচ্ছে না শুধু, মানে ওটা সারা জীবনের জন্য। একটা বীজ, মনের মাটির ওপরে, পলিমাটির ওপরে। সেই বীজ থেকে হয়তো গাছ হবে, গাছে আবার ফুল হবে, সেখান থেকে ফল হবে। আবার সেই ফল মাটিতে পড়বে। আবার অনেক গাছ হবে, একটা অরণ্য হয়ে যাবে। যদি ওই বয়সে সত্যিকার অর্থে কিছু করা যায়, সে জন্য আমি স্কুলের ওপরে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিলাম।
এখন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র থেকে ‘আলোর ইশকুল’ করতে যাচ্ছি। এটা আরও গুরুত্বপূর্ণ। ইউনিভার্সিটি আর পোস্ট-ইউনিভার্সিটি লেভেলের। এখানে এসে ফিল্ম দেখবে, ডকুমেন্টারি দেখবে। এসব একেকটা কোর্স। নাটক বা আর্ট এক্সিবিশন দেখতে যাবে। বক্তৃতা শুনবে। তারপর বইপড়া-বিশ্বসাহিত্য পাঠচক্র। বিশ্ব-ইতিহাস পাঠচক্র। তার পরে গাছ-ফুল দেখবে। চারপাশে কত গাছ আছে, নাম জানো?
কিছু কিছু...
খুবই কম। ফুলগুলোর নাম জানো? জানো না। তো সেগুলো যাতে জানে। যত জানবে তত ভালোবাসবে। যেমন মা সন্তানকে এত ভালোবাসেন কেন? কারণ, মা সন্তানকে সবচেয়ে বেশি জানেন। জানা মানেই ভালোবাসা।
প্রশ্ন :
এগুলো কি তাদের পেশাগত পর্যায়ে সহায়তা করবে?
পেশাগত পর্যায়ে সহায়তা না করলে আমি খুব খুশি হব। এটা যেন ওর মানুষ হওয়ার ব্যাপারে সাহায্য করে। যে প্রফেশনাল লেভেলে ঢুকে গেল, সে তো গেল শেষ হয়ে। সে তো সাধারণ হয়ে গেল। সে তো ভৃত্য। সে তো পৃথিবীকে কিছু দিতে পারবে না। সে-ই দেবে, যে হেরে গেল বা ছিটকে গেল। যার মধ্যে শক্তি ছিল। শক্তি ছিল বলে টিকতে পারল না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তো ক্লাস সিক্সের ওপরে যেতে পারেনি। তাই না? এত শক্তি নিয়ে তো ক্লাস সেভেনে ওঠা যায় না। (হাসি) তাই না?
কিন্তু স্যার, এখনকার সময়ে সবাই ওই চিন্তাটাই বেশি করে। কী খেয়ে বাঁচবে...
না না, বাঁচে মানুষ। তোমরা শুধু ভয় পাও। কী খায় মানুষ? কী খায়? এই যে প্রধানমন্ত্রী কী খায়? বলো? রাষ্ট্রপতি কী খায়?
ভাতই খায়!
আরে না, ভাতও ওঁরা পায় না। আমি সেদিন শুনলাম মনমোহন সিং, যিনি ইন্ডিয়ার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, উনি দাওয়াত দিয়েছেন স্বাধীনতা দিবসে। অসংখ্য লোক এসেছে। পোলাও-কোর্মা...খুব রাজকীয় খাবারদাবার চলছে। দেদার ফুর্তি-আনন্দ। আর উনি দুটো চাপাতি রুটি আর লাউভাজি খেলেন! এই তো মানুষ আল্টিমেটলি খায়। আর যারা বেশি ফাস্টফুডের দোকানে ঘোরে, তারা এ-ই মোটা হয়ে যায় (হাত দিয়ে দেখিয়ে)! ৪৫ বছর বয়সে হার্ট অ্যাটাক করে মারা যায়। আমি সেদিন এক স্কুলে প্রাইজ দিতে গেছি, হ্যান্ডশেক করে আমি বলি, এত মোটা হাত কেন! দেখি ফিফটি পার্সেন্ট ছেলের হাত এ রকম!
প্রশ্ন :
আপনি কী খেতে পছন্দ করেন?
আমি সব খেতে পছন্দ করি, সব। এই দুনিয়ার কোনো জিনিসকে অপছন্দ করার প্রতিভা আমি দেখাতে পারিনি! অন্তহীনভাবে আমার খেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু এখন খেতে খেতে কী যেন হয়েছে, বোধ হয় টেনশন-ফেনশন থেকেই। ছয়-সাত বছর ধরে এখন আর খেতে পারি না। মানে কোনো টক-ঝাল-তেল খেতে পারি না। মানে যা কিছু মজার, যেমন পোলাও-কোর্মা খেতে পারি না। তবে আমি তো খেয়ে নিয়েছি। আমার তো কোনো দুঃখ থাকার কথা না।
প্রশ্ন :
খাওয়া নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে বাজি ধরতেন?
হ্যাঁ। আমি যখন ক্লাস এইটে পড়ি, তখন ১৮টা পরোটা খেয়েছিলাম। (হাসি) তার পরও আরও ১০টা পারতাম। কিন্তু পলুর মা, যে পরোটা ভাজছিল আর দিচ্ছিল, বলে যে দিমু কিন্তু! বলে খুন্তিটা এভাবে করেছিল এবং সত্যি সত্যি ওটা আমার লেগেছিল। সঙ্গে সঙ্গে এখানে (চোখের পাশটা দেখিয়ে) ফোসকা পড়ে। এই নিয়ে আবার স্কুলে যেতাম। তো আমি খুব খেতাম। বাচ্চারা এক বোতল করে দুধ খায় না? আমি প্রতিবার তিন বোতল খেতাম। এবং আমি গ্লাক্সোবেবি ছিলাম! আমাকে কেউ তুলতে পারত না। এটাতে আমার বাপ-মা খুব গর্ববোধ করতেন। (হাসি) এমন ছেলে, যাকে কেউ তুলতে পারে না।
আসলে আমার শৈশবটা খুব সুন্দর ছিল। আমাদের একদিকে ছিল পাবনা শহর, একদিকে ছিল বিশাল জঙ্গল। পাশ দিয়ে ইছামতী নদী। নদীটা পার হলেই বিশাল শালগাড়িয়ার জঙ্গল। আর নদীর এপারেও তিন-চার মাইল জঙ্গল। আমি একদিন হাঁটতে হাঁটতে জঙ্গল পার হয়ে দেখি বিশাল দিঘি। তখন পানি ছিল না, শীতকাল। ঝপঝপ বিল। ঝপঝপ শুনলেই মনে হয় কিছু একটা রহস্যময়! কোনো একটা প্রাণী যেন ওই পানির মধ্য দিয়ে হেঁটে চলল ঝপঝপ শব্দ করে। বাপ রে বাপ! মাঝেমধ্যে একেকটা গাছ, আমার মনে হলো সেটা সেই রূপকথার গাছ, এই গাছেই বোধ হয় ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমী থাকে! রাজপুত্রকে নিয়ে কোথায় চলে যায়! বাবা আমাকে একটা একটা বন্দুক এনে দিয়েছিলেন। খেলনা। কিন্তু ওগুলোর মধ্যে বারুদ ছিল, দ্রুম করে শব্দ হতো। আমাদের শালগাড়িয়ার জঙ্গলে শীতকালে বাঘ আসত। আমি ওসব নিয়ে...
প্রশ্ন :
বাঘ মারতে চলে গিয়েছিলেন?
হ্যাঁ! (হাসি) এবং আমি বিশ্বাস করতাম যে বাঘ মারব। এই বন্দুক যদি বাঘ মারতে না পারে, তাহলে কে কী মারবে? সেটা মিথ্যা হতে পারে, কিন্তু আমি বিশ্বাস করতাম, এটা তো মিথ্যা না। আমরা ভাবি যে বাংলাদেশ একদিন সুখের বাগান হবে, সবাই আমরা ভালো থাকব। সব মিথ্যে হতে পারে, কিন্তু আমি যে ভাবছি, এটা তো সত্যি। তাই না? বাইবেলে একটা খুব সুন্দর কথা আছে। ‘হি হু লিভস অ্যান্ড হি হু বিলিভস, শ্যাল নেভার ডাই।’ যে বাঁচবে এবং বিশ্বাস করে বাঁচবে, সে মরবে না। তো, এইটা ওই রকম একটা শৈশব। তবে আমার কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল না, এখনো নেই। আনন্দ হলো আমার আকাঙ্ক্ষা।
প্রশ্ন :
আপনি বললেন, মানুষ বাঁচার জন্য কীই আর খায়, সেটা তো আমরা মেনে নিলাম। কিন্তু আমাদের মা-বাবা তো মানবে না। সে ক্ষেত্রে আমরা কীভাবে মা-বাবাকে বোঝাব?
দেখো, মা-বাবা কোনো দিনই মানে না। আমার মা আশা করতেন যে আমি ডাক্তার হব। তো, ভাগ্য ভালো, আমার মা একটু তাড়াতাড়িই পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন! তা যদি না নিতেন, তাহলে নির্ঘাত ওনার সঙ্গে আমার একটা বিরোধ হতো। কিন্তু আমার আব্বা ছিলেন একদম উল্টো। বলতেন, নিজের ভেতর থেকে যা বলবে, তুই সেটাই কর। সেখানে তোর বাবা নেই, মা নেই, আত্মীয় নেই, বন্ধু নেই, কেউ নেই। তুই একা। রাজার মতন একা।
প্রশ্ন :
তাহলে কি আমরা পরিবারের বিরুদ্ধে যাব?
সেটা তোমার শক্তি যদি থাকে তুমি যাবে। আমি তোমাকে বললে যে যাবে, তা তো না। যখন সমস্ত আরব বিশ্বাস করত, মক্কা শহরের প্রতিটি মানুষ বিশ্বাস করত, মূর্তিপূজা করতে হবে, তখন তো কারও কাছে মনে হয়েছে, মূর্তিপূজা ভুয়া...আর তা নিয়ে কী দ্বন্দ্ব, কী বিরোধ, কী যুদ্ধ। তাই না? এটা তোমার শক্তির ওপর নির্ভর করবে।
প্রশ্ন :
কিন্তু আমাদের তো ছোটবেলা থেকেই এই পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়। ছোটবেলা থেকেই আমাদের শেখানো হচ্ছে...
ছোটবেলা থেকেই তো হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর চারপাশে সবাই পূজা করত। তাই না? একসময় তাঁর মনে হয়েছে মূর্তিপূজা ঠিক না। আবার তায়েফে...তিনি যাচ্ছেন আর বলছেন, আল্লাহ এক, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু...। চারপাশ থেকে পাথর মারা হচ্ছিল...উনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন। তার আগে পর্যন্ত পাথর মারল। তোমারও তো শক্তি থাকতে হবে। খালি সবাই খারাপ, তুমি ভালো, পৃথিবী কি এতই সোজা?
প্রশ্ন :
আপনি বলেছেন, আপনার মা-বাবা কখনোই আপনাকে পড়তে বাধ্য করেনি। আপনি কি করেছেন আপনার ছেলেমেয়ের সঙ্গে?
না, আমিও বলিনি। নেভার। আমি এতই ব্যস্ত ছিলাম, আমার ছেলেমেয়ে যে কোনখান দিয়ে বড় হয়েছে, সেটা দেখিইনি। ওদের ভালো করে আমার দেখাও হয়নি।
প্রশ্ন :
তাদের কোনো অভিযোগ?
অভিযোগ নিশ্চয়ই তাদের আছে। বড় মেয়ে তো খুবই অভিযোগ করে।
প্রশ্ন :
পড়াশোনায় অকৃতকার্য হয়ে অনেকে হতাশাগ্রস্ত, নেশাগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যা করে। এসব কাটিয়ে ওঠার উপায় কী?
পড়াশোনাকে এত বড় ভাবলে তো গোলমাল হবেই। তাই না?
পরিবারের কেউ তো বুঝবে না। আপনার যেমন বইয়ের দুনিয়া দেখতে দেখতে মনে গেঁথে গেছে, আমাদের তো ছোটবেলা থেকে টাকা দেখতে দেখতে ওগুলোই গেঁথে গেছে।
না আমার পাশে গুন্ডাও তো ছিল, আমি তো গুন্ডা হইনি। তুমি কী হবে, সেটা তোমার সিদ্ধান্ত। যখন তোমার সিদ্ধান্তের ওপর দিয়ে তোমার চারপাশের সংখ্যাগরিষ্ঠ বোকা লোকগুলো তোমাকে প্রভাবিত করে ফেলতে পারে, তাহলে তোমাকে বুঝতে হবে যে তোমার মধ্যে সেই শক্তিটা নেই।
কিন্তু আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা যেভাবে গড়ে উঠছে, ছোটবেলা থেকেই চারপাশে...
কোনো সময়ই সুসময় না। চিরদিন এই প্রভাব আছেই। এর মধ্য থেকে মানুষ বেঁচে থাকে।
প্রশ্ন :
স্যার, আপনি কি মনে করেন যে ‘এ প্লাস পেতেই হবে’, এমন চিন্তা থেকে দেশের মানুষ বের হয়ে আসতে পারবে?
শোনো শোনো, আমি যখন ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিলাম, ভূগোলের প্রশ্ন খুব খারাপ হলো। এত খারাপ যে আমি প্রশ্নের উত্তরই দিতে পারলাম না। যখন পরীক্ষা শেষ হলো, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে বসলাম। দেখলাম সবার অবস্থাই শোচনীয়। তখন আমরা ভাবলাম যে সারা দেশের সবারই অবস্থা বোধ হয় এ রকম। ভূগোলের প্রশ্ন যে করেছে, সে খুবই খারাপ লোক (হাসি)। আমাদের ফেল করানোর জন্য আর খারাপ রেজাল্টের জন্য সে এ রকম প্রশ্ন করেছে। এই সব নিয়ে, তাকে গালাগালি দিয়ে, চৌদ্দপুরুষ উদ্ধার করলাম। কিন্তু যখন রেজাল্ট বেরোল, তখন দেখলাম ওই ভূগোলেই ২৫৬ জন লেটার পেয়েছে। তাহলে খারাপ কে? আমি পারছি না মানে এই না যে সবাই পারছে না। আমি পারছি না মানে আমি ডুবে যাচ্ছি। তুমি নিজেকে বিশ্বাস করো, ওই যে আমি যেভাবে বাঘ মারার ব্যাপারটাকে বিশ্বাস করেছিলাম!
প্রশ্ন :
বাঘ দেখেছিলেন?
শীতকালে নদী শুকিয়ে গেলে আমাদের বাসার সামনের পুকুরে বাঘ পানি খেতে আসত। আমরা অনেক দূরে ফেউয়ের ডাক শুনে ছাদে গিয়ে দেখতাম। চারপাশে তো গাছপালা, শীতকালে ঠান্ডা একটু বেশি ছিল। কাঁপতে কাঁপতে দেখতাম যে বাঘ আসছে। ওই মেছো বাঘ না, একদম রয়েল বেঙ্গল টাইগার। তখন তো বাঘ বহু জায়গায় ছিল। এখন না মার খেতে খেতে এমন জায়গায় গেছে, যেখানে মানুষ নেই। এই ঢাকার পুরোনো বিমনবন্দরের কাছে, বিজয় সরণির পাশে ১৯৪৭ সালে বাঘ মারা হয়েছিল। রয়েল বেঙ্গল টাইগার। আমি ১৯৫৩ সালে পুরানা পল্টন থেকে এই রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে যেতাম, আর আমার গা শিরশির করত। দুপাশে ঘোর জঙ্গল।
প্রশ্ন :
আপনি ছোটবেলায় মুনীর চৌধুরী, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, গোবিন্দচন্দ্র দেবের মতো শিক্ষকদের সান্নিধ্যে এসেছেন। আপনার জীবনে তাঁদের প্রভাব কতটা?
ভীষণ প্রভাব। মুনীর স্যারের কথা বলার ভঙ্গিতে আমি এমনই প্রভাবিত হয়েছিলাম যে এক বছর তাঁর মতো কথা বললাম। (হাসি) যে-ই একটু ভালো কথা বলত, আমি কান খাড়া করে শুনতাম। যেমন আমাদের একজন শিক্ষক ছিলেন, আসাফাদ্দৌলা রেজা। এত সুন্দর কথা বলতেন, রেডিওতেও একসময় খুব নাম করেছিলেন। তখনো টেলিভিশন আসেনি। তাঁদের প্রতিটা কথাকে আমি শুষে নিতাম।
প্রশ্ন :
এ থেকেই কি উপস্থাপনার প্রতি আগ্রহ?
হ্যাঁ। উপস্থাপনার প্রতি আগ্রহ না, কথা বলার প্রতি আগ্রহ। পরে একসময় উপস্থাপনার যুগ যখন এল, তখন টেলিভিশনের লোক এসে বলল করতে।
প্রশ্ন :
সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলা একটা অনেক বড় গুণ। আর আপনি হলেন এর একটি বড় উদাহরণ। এত সুন্দর করে কথা বলা কীভাবে আয়ত্ত করলেন?
একটু চর্চা করতে হবে। অনেকে গুছিয়ে সুন্দর করে বাক্য লেখে না? লেখকেরা গুছিয়ে কত সুন্দর কথা বলেন না? প্রথম দিন হয়তো তাদের লেখা অত গোছানো হয় না। আস্তে আস্তে লিখতে লিখতে গোছানো হয়ে যায়। আর তুমি একটা জিনিস নিয়ে যত নেশাগ্রস্ত হবে, যে কয় মিনিট, ওইটুকুই তোমার জীবন। আর বাকি সব করে রব! (হাসি)
প্রশ্ন :
আপনি তো অনেক গল্প জানেন। আপনি এত গল্প মনে রাখেন কীভাবে?
এখন আর তো মনে থাকে না! গল্প বলি এ জন্য যে গল্প বললে লোকেরা সহজে বুঝতে পারে। যিশুখ্রিষ্টের বাইবেল গল্পে ভরা। রামায়ণ-মহাভারত গল্পে ভরা। কারণ, গল্পের মধ্য দিয়ে মানুষ সবচেয়ে সহজে বোঝে। সেই জন্য আমি গল্প দিয়ে কথা বলি। আমি প্রতিনিয়তই একটু-আধটু পড়ি। এক-আধটা গল্প পেলাম, মনে থেকে যায়।
প্রশ্ন :
এত ব্যস্ত সময়েও আপনি পড়ার সময় পান?
এক-দেড় ঘণ্টা পড়ি। আমার তো কোনো সময় নেই। পড়ার কোনো সময় নেই, লেখার কোনো সময় নেই। আমার তো করতে হয় বক্তৃতাবাজি, তোমাদের এই সব ইন্টারভিউ। আমি সেদিন হিসাব করলাম যে আমি ১৫ হাজার বক্তৃতা দিয়েছি। (হাসি) ১৫ হাজার বক্তৃতা মানে কিন্তু ১৫ হাজার ‘আধঘণ্টা’ না। এই বক্তৃতার জন্য একটা মানসিক প্রস্তুতি আছে। ওই জায়গাটাতে যেতে সময় লাগে। তারপর প্রধান অতিথি দেরি করলে বলে যে আপনারা ধৈর্য ধরুন। মানে প্রধান অতিথির মান-ইজ্জত...তার ফলে আমাকে অপেক্ষা করতে হয়। এরপর অন্যদের বক্তব্য শুনে শেষে নিজে কিছু বলি। তারপর আবার ফিরতে এক-দেড় ঘণ্টা। ফিরে আর কোনো কাজ করার শক্তি থাকে না।
প্রশ্ন :
আপনি নিজে সর্বোচ্চ কতক্ষণ বক্তৃতা দিয়েছেন?
পাঁচ-ছয় ঘণ্টা! (হাসি)
প্রশ্ন :
কোথায় ছিল?
একদিন আমাদের কলেজেই করেছিলাম পাঁচ ঘণ্টা। তখন যৌবন ছিল, শক্তি ছিল। এখনো করি। সেদিন অস্ট্রেলিয়ায় তিন না সাড়ে তিন ঘণ্টা বক্তৃতা করলাম।
প্রশ্ন :
১৯৬৫ সালে কবি জসীমউদ্দীনের সাক্ষাৎকারের মধ্য দিয়ে আপনার টেলিভিশনে প্রথম আসা। কবির সঙ্গে সেই অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
অভিজ্ঞতা আর কী, কবি তো আর কবিতা না!
মানে প্রথম দিন টিভিতে...অত বড় একজন কবি...
ভয় পেলাম। আমি ঢুকলাম স্টুডিওতে...বাবা রে বাবা, তখন একেকটা ক্যামেরা ছিল এত বড় (হাত দিয়ে দেখিয়ে)। তারপর চারদিক থেকে লাইট, নেমে আসছে এটা-সেটা। আমি ভাবলাম, বাপ রে, শুধু আমাকে দেখানোর জন্য এত ব্যবস্থা! (হাসি) এই দেখেই ভয় পেলাম। টেলিভিশন তখন নতুন, ক্যামেরাটা চালু হলেই সব ঘরে ঘরে আমাকে দেখা যাবে! তখন তো এত চ্যানেল ছিল না। আমাকে ক্যামেরায় ধরল মানে সারা জাতি আমাকে দেখছে, তাই একটা টেনশন, চাপ মনের ওপরে।
প্রশ্ন :
আপনাকে উপস্থাপক হিসেবে আমাদের বড়রা দেখেছে এবং বলেছে এত ভালো উপস্থাপক তারা আর দেখেনি। আমাদের সেই সৌভাগ্য হয়নি। এখন কেন উপস্থাপনা করেন না?
আরে সবকিছু কি আর সব সময় হয়? তুমি কি এখন হামাগুড়ি দাও? তোমার কি এখন দাঁত পড়ে?
প্রশ্ন :
ফেসবুক ব্যবহার করেন?
করি না, তবে এখন করব। আমি এখন কম্পিউটারে লিখি। পড়া-টড়ার অনেক কিছুই কম্পিউটারে করি। মানে যে পড়া চিন্তামূলক বা তথ্যমূলক। নেই নেই করতে করতেও আমি দেখলাম যে আমি পরিমাণের দিক থেকে কবিগুরুর অর্ধেকের বেশি লিখে ফেলেছি। আমি মাত্র ১০ বছর লিখেছি। এখন আবার লিখতে শুরু করলাম। আমার ইচ্ছে ছিল আরও দেড় শ বই লেখার। কারণ, আমার মাথার মধ্যে দেড় শ বই আছে। কিন্তু লিখতেই পারিনি। এই ১৫ হাজার বক্তৃতা, ১৫ হাজার বেলা। বেলা মানে অর্ধেক দিন। তাই যদি হয়, তো ১৫ হাজার বেলায় কত দিন শেষ হয়েছে আমার?
সাড়ে সাত হাজার দিন!
সাড়ে সাত হাজার দিন, মানে ১০ বছর শুধু বক্তৃতাই দিয়ে গেলাম। তো কখন লিখব? এই প্রতিষ্ঠান বানাতে হয়েছে না সারা দেশে?
তবে এটাও একটা কাজের কাজ হয়েছে যে বক্তৃতাগুলো সারা দেশে বই আকারে বের হয়েছে...
না, সেটা কয়েকটা। ২৫টা বক্তৃতা বই আকারে বের হয়েছে। এমনকি ভিডিওতে পর্যন্ত আমার বক্তৃতা নেই। আমার দুঃখের আর কোনো শেষ নেই। এত সুন্দর সুন্দর বক্তৃতা করেছি একেক সময়। আমি এখন ঠিক করেছি ভিডিও করব। একটা চ্যানেল এসেছিল, ওরা সম্প্রচার করবে।
প্রশ্ন :
আপনি একাধারে সাহিত্যিক, শিক্ষক, উপস্থাপক। কোন পেশাটা আপনার কাছে সবচেয়ে ভালো লেগেছে?
আমার কাছে সবচেয়ে ভালো লেগেছে শিক্ষকতা। পড়াতে ভালো লাগে।
প্রশ্ন :
ঢাকা কলেজে যখন পড়াতেন, তখন কেমন লাগত?
ভালো। ঢাকা কলেজে তো তখন দেশের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্ররা থাকত। তখনকার মেধাবীরা বোধ হয় এখনকার চেয়ে ভালো ছিল। এখন ব্রাইট, কিন্তু খুব উপরিতলের, গভীরতার জায়গাটা কম। এখন পয়সা ছাড়া কেউ কিছুই বোঝে না। কিন্তু সেই সময় সারা দেশে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রায় পাঁচ হাজার স্বেচ্ছাসেবক ছিল। এখন কাউকে কোনো কথা বললেই বলে, কী পাব। জীবনের একটা উদ্দেশ্য, জীবনের একটা স্বপ্ন, একটা অর্থ তখন ছিল। এরা খুব মেধাবী, প্রায় ৮০ শতাংশ নম্বর না পেলে ভর্তি হতে পারত না। তখনকার ৮০ শতাংশ কিন্তু খুবই কঠিন। তার ফলে এ দেশের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্রদের আমি পড়িয়েছি। খুব ভালো লাগত। একটা কথা ওরা মাটিতে পড়তে দিত না। একটু এদিক-ওদিক হলে ‘খপ’! সুতরাং, সারাক্ষণ একটা চ্যালেঞ্জ এবং আনন্দ। আমি বিজ্ঞান কলেজে ছিলাম। ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ জালাল সাহেব এসে আমাকে টানতে টানতে নিয়ে চলে গেলেন। বলেছিলেন, ‘ভালো মাস্টার তো ভালো ছাত্র খোঁজে। যারা বুঝবে। আপনি আমার কলেজে আসেন।’ আমার ক্লাসে ছাত্ররা কথা বলত না, শুনত। কেউ কথা বলতে গেলে অন্যরা তাকে বসিয়ে দিত। নিজের আনন্দে কথা বলে গেছি। ছেলেরা উপভোগ করেছে। আমিও উপভোগ করেছি। এর চেয়ে আর সুন্দর কিছু হয় না।
প্রশ্ন :
এর জন্যই কি আপনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর সুযোগ পেয়েও পড়াননি?
ওইখানে কী যাব বলো দেখি? মানে আমাদের ঢাকা কলেজে তখন একটা সেকশনে যত ভালো ছাত্র, পুরো ইউনিভার্সিটিতে ততগুলো ভালো ছাত্র নেই। কেন যাব?
লাইব্রেরি থেকে অনেকে বই নেয়, আর ফেরত দেয় না...
আরে এ তো সাধারণ মানুষ। অনেক মহামানব আছেন, যাঁরা বই মেরে দেওয়াটাকে একটা অতি উচ্চমানের পুণ্যকর্ম মনে করেন।
প্রশ্ন :
বই চুরি করে নাকি লাইব্রেরি করা যায় না?
আরে চোর কি কোনো দিনও কিছু করতে পারে নাকি!
কিন্তু স্যার সে তো বই চোর...
যে চোর, সে চোরই। অনেকে মনে করে যে বইয়ের ব্যবসা হচ্ছে খুব ভালো ব্যবসা। আরে ব্যবসা তো ব্যবসাই। সেটা তুমি বইয়ের ব্যবসাই করো, আর লোহা-লক্কড়ের ব্যবসা করো। পার্থক্যটা কোথায়? আমার একটা বই একবার বেরিয়েছে, আমি প্রকাশককে ফোন করলাম যে আমি কি নিতে আসব কপিগুলো? ২৫ কপি বই তো দেয় সৌজন্য। বলে, স্যার আসেন। গেলাম, এক্কেবারে খুব খুশি। স্যার আসেন, বসেন, চা না কফি, গরম না ঠান্ডা...এই সব বলে-টলে তার পরে খাওয়া-টাওয়া দিচ্ছে, দিতে দিতে হঠাৎ তার ছেলেটাকে ডেকে বলল, এই যে ওই ঘরে অত নম্বর তাকে কিছু ‘মাল’ আছে না, ওইগুলো লইয়া আয় তো! আমি বলি, আমার বুকের রক্ত, তার কাছে মাল! (হাসি)
বই মেরে দেওয়াটা উচিত না। কারণ, তুমি একটা লাইব্রেরি থেকে যখন বই মেরে দিচ্ছ, তখন তুমি আরও ২০ জন লোককে ওই বইটা পড়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করছ। বই মারা পয়সা মারার মতো না। ওর একটু মর্যাদা আছে (হাসি)। আমাকে অনেকে বলত, তুমি যে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র করছ, কার টাকায় করছ? দেশের কতগুলো চোর-ডাকাত-দস্যুর টাকায় করছ। আমি বললাম, দেখো, তারা দস্যু, ডাকাত, চোর, কিন্তু তাদের টাকাটা তো চোর না। সে টাকা দিয়ে আমি যে বই কিনেছি, সে বইটা তো চোর না। সেই বই পড়ে একটা ছেলে বা মেয়ের মধ্যে যে চেতনার বিকাশ ঘটছে, সেই বিকাশটা তো চোর না। তাই না?
অনেকে বন্ধুর বই মেরে দেয়, কারণ বন্ধু সেটা পড়তে দিতে চায় না। যদি চুরিও করো, বইটা পড়ে আবার তার হাতে ফেরত দিয়ে দাও। বোলো যে, ‘আমি নিয়েছিলাম, তুমি দেবে না তো ভাই, তাই। বইটা পড়েছি, আমার খুব উপকার হয়েছে।’ বই পড়ার সময় সবচেয়ে ভালো লাইনগুলো লিখে রাখবে। কারণ, বই চলে যাবে, লাইনগুলো থেকে যাবে।
প্রশ্ন :
আপনার সব বই যদি উইপোকা কেটে ফেলে বা হারিয়ে যায়, তখন কী করবেন?
আবার জোগাড় করব।
প্রশ্ন :
আর সব বই যদি চুরি হয় তাহলে?
আমার কাছে যে বই আছে, তা নষ্ট হলে আমার কোনো আপত্তি নেই। আমি হয়তো দুঃখ পাব। যেকোনো জিনিস হারালেই তো মানুষ দুঃখ পায়। তোমার একটা কলমও যদি কেউ মেরে দেয়, তোমার দুঃখ হবে। হারাতে তো পারেই। আলবিরুনি ভারততত্ত্ব নামে একটি বই লিখেছিলেন। দিল্লির কাছ দিয়ে তিনি যখন যাচ্ছিলেন, হঠাৎ দস্যুরা তাকে আক্রমণ করে বইটা নষ্ট করে দেয়। তিনি আর নড়লেন না, ওখানে বসেই দুই বছর ধরে আবার সেই বই লেখা শেষ করলেন।
প্রশ্ন :
যদি পুরো পৃথিবী বইশূন্য হয়ে যায়, তাহলে?
বইশূন্য হলে মানুষ আবার বই লিখবে। আলেক্সান্দ্রিয়া লাইব্রেরি পুড়ে গেছে বলে কি জ্ঞান থেমে আছে পৃথিবীতে? মানুষের চিন্তা তো শেষ হবে না।
প্রশ্ন :
প্রায় ত্রিশ বছর ধরে ‘আলোকিত মানুষ চাই’ স্লোগান নিয়ে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র কাজ করে চলেছে, এত বছর পরে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রাপ্তি কী?
প্রাপ্তি-টাপ্তি আমি বুঝি না, আমার প্রাপ্তি আনন্দ। আমি খুবই আনন্দে ছিলাম। কী হলো, কী হবে, কী হবে না, এটা নিয়ে কিছু কিছু ভাবনা আসে মাথার মধ্যে দু-একসময়। তবু তো দেখি আমাদের ছেলেমেয়ে যারা একটু বই-টই পড়েছে, তারা একটু বেটার। তার আশপাশেদের চেয়ে। আমি এটা টের পাই, দেখতে পাই। হ্যাঁ, অনেকে বলে যে আপনাদের তো বার্ষিক প্রতিবেদন নেই, আপনারা কী করে বোঝেন আপনাদের ছেলেমেয়েদের কী হচ্ছে না হচ্ছে? আমি শুধু দেখি যে গলার আওয়াজটা বদলাল কি না। যদি অন্য রকম হয়, তাহলে বুঝব ও উপকৃত হয়েছে। কারণ, গলার আওয়াজ, হূদয়টা যদি বদলায়, একটু ভালো হয়, তাহলে গলার আওয়াজটাও একটু সুন্দর হয়। তুমি একটা মানুষের দিকে তাকালে বুঝতে পারো না তার মধ্যে কী আছে? বোঝা যায়। দেখলেই বোঝা যায়, আর গলা দিয়ে একটা আওয়াজ করলে তো সঙ্গে সঙ্গে বোঝা যায়। তুমি দেখবে যে বড় মানুষের ছবিতে তাঁর মাথার চারপাশে একটা বলয় দেওয়া থাকে। ওটা কি তাঁর ছিল? ছিল না। কিন্তু মানুষ যখন তাঁর সামনে যেত, তখন তাঁর মধ্যে একটা অসাধারণত্ব দেখতে পেত। ওটাকে মানুষ ওইভাবে এঁকে বোঝায়।
প্রশ্ন :
সব সময় খদ্দরের পাঞ্জাবি পরেন কেন?
মনে হয়েছে যে যত সাধারণ হই, তত শান্তি হয়। তোমার যদি খুব দামি একটা কিছু থাকে, তাহলে তোমার সারাক্ষণই টেনশন থাকবে। লোকে কী বলল, কী ভাবছে, কী দেখছে। আর না থাকলে তো ঝামেলাই নেই। আমার একটা জামা থাকল, যেটার দিকে কেউ তাকালই না। তো আমি বেঁচে গেলাম না? তাকালে আমার দিকে তাকাক, জামা দিয়ে কী হবে?
আপনি তো বিশাল মাঠ পেয়েছেন, বিল, জঙ্গল পেয়েছেন। আমরা তো সেসব পাচ্ছি না...
তোমাদের জন্য এটা সত্যিই দুঃখের ব্যাপার। আমি ওই যে জঙ্গলের মধ্যে একা একা তিন মাইল-চার মাইল চলে যেতাম, বাঘের খোঁজে...সেই যে ঝপঝপ বিল...আমার মাও তো ছিলেন খুব ডেঞ্জারাস। আমাকে সাঁতার শিখিয়েছিলেন পানির মধ্যে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে। মরতে মরতে আমি সাঁতার শিখেছিলাম। উনি দাঁড়িয়েও ছিলেন পাশে। তো আমি যখন মরার কাছাকাছি, তখন উনি তুলতে গেলেন। কিন্তু ততক্ষণে আমি নিজেই উঠে গেছি। মানে আমি সাঁতার শিখে ফেলেছি। তোমরা এখন নিজেরা হঠাৎ হঠাৎ চলে যেয়ো প্রকৃতির কাছে। আমাদের এখানে কিন্তু আলোর ইশকুলে বাইরে যাওয়া বাধ্যতামূলক। তিন মাসে একবার করে বাইরে যেতেই হয়। আর কিছু না পারো, তুমি একটা জঙ্গলের মধ্যে গিয়ে বসে থাকো। ভাওয়ালে যাও, জঙ্গল পাবে। তুমি গাছের পাতার শব্দ শোনো, বাতাসের শব্দ শোনো। নীল আকাশটার দিকে একটু তাকাও। মেঘগুলোকে দেখো। ঢাকায় তো তুমি মেঘ দেখছ না, এখানে তো বর্ষাকাল নেই। বাসা, তার তিন ফুট পরে আরেকটা বাসা, মাঝখানে একটা দুর্ভেদ্য দেয়াল। তার মাঝখানে ছিটেফোঁটা একটু বৃষ্টি। এই হলো আমাদের কাছে বর্ষাকাল। তাই না? কিন্তু আমরা যে বর্ষাকালটা দেখেছি, তা হলো একেবারে মুষলধারে বৃষ্টি। নদীতে চলে যাও। আমাদের একটা নৌকা আছে আশুলিয়ার কাছে। ওটার নাম জলবতী। পানির মাঝখানে বসে থেকে সবাই আড্ডা-টাড্ডা দেয়। তোমরাও চাইলে একদিন যেতে পারো। পানির কাছে যাও, ঘাসের কাছে যাও, আকাশের কাছে যাও। পূর্ণিমার রাতে গিয়ে দেখো। পূর্ণিমার রাতে নাই-বা বাইরে যেতে পারলে, অমাবস্যার রাতে গেলে। তোমার মনে হবে তারাগুলো কত কাছে চলে এসেছে। এখান থেকে তো তুমি কোনো দিন তারাই দেখোনি। কাছেই যাও, বেশি দূরে যাওয়ার দরকার নেই। বেশি দূরে যেতে পারলে তো কথাই নেই।
প্রশ্ন :
অনেকেই লেখক হতে চায়, কিন্তু কীভাবে শুরু করবে, তা বুঝতে পারে না। তাদের কীভাবে শুরু করা উচিত?
লেখক যে হতে চায়, তার লেখা শুরু করতে হবে। তুমি যদি হাঁটতে চাও তো কী শুরু করতে হবে? হাঁটা। যদি সাইকেল চালাতে চাও? সাইকেল চালাতে হবে।
তার সঙ্গে পড়াটাও...
অত কিছুর দরকার নেই, তুমি আরম্ভ করো না। তারপরই রাস্তা তোমাকে টেনে নিয়ে যেতে শুরু করবে। কেউ কেউ ভাবে, পৃথিবীর অমর লেখাটি লিখে যেতে হবে। সে আর কোনো দিন লিখতে পারে না। (হাসি)
প্রশ্ন :
আমাদের উদ্দেশে তো অনেক কিছুই বললেন। অভিভাবক আর শিক্ষকদের উদ্দেশে আপনার পরামর্শ কী?
পরামর্শ নেই। অভিভাবকেরা কোনো খারাপ মানুষ নন। তাঁরা তোমাদের খারাপ চান না। এই কথাটা বুঝতে হবে। অনেক সময় কিসে তোমার ভালো, সেটা হয়তো কোনো কোনো অভিভাবক নাও বুঝতে পারেন। তখন তোমার সঙ্গে তাঁর একটা বিভেদ সৃষ্টি হয়। কারণ, তিনি তাঁর মতো করে ভালোটা চান, তুমি তোমার মতো করে চাও। তখন তোমার মনে হতে পারে অভিভাবকেরা খারাপ। কিন্তু বাবা-মা এত কষ্ট করে তোমাদের মানুষ করেছেন, একেবারে গায়ের ঘাম ঝরিয়ে, সব শেষ করে, তাঁরা কি তোমার খারাপ চাইতে পারেন? হয়তো যে ভাষায় বললে তুমি বুঝবে, সে ভাষায় উনি বলতে পারেন না। যা বললে তোমার ভালো লাগত, তোমার সঙ্গে মিলত, হয়তো সেটা উনি বলতে পারেন না, কারণ উনি তো অন্য মানুষ। কিন্তু তাঁর ইচ্ছাটা, তার চাওয়াটা কিন্তু মিথ্যা না এবং ভুলও না। যদি তুমি অন্য কিছু করতে চাও, যেমন বই পড়তে...লুকিয়ে-টুকিয়ে পড়ো না! আমরাও তো করতাম। যে করতে পারে, সে পারেই। চোর কী করে ঘর থেকে জিনিস নিয়ে যায়, বলো? দেয়াল আছে, জানালা আছে, মজবুত শিক আছে। তার মধ্য থেকেও তোমার কাপড়চোপড়, সোনা-গয়না নিয়ে চলে যাচ্ছে। নিশ্চয়ই তার মধ্যে কিছু আছে। কিছু একটা তাকে করতে হয়। তোমরাও সে রকম কিছু করো।
প্রশ্ন :
আপনার প্রিয় কিছু জিনিস সম্পর্কে জিজ্ঞেস করব, আপনি যদি এক কথায় উত্তর দেন...
আমার সবই প্রিয়। আমি আজ পর্যন্ত জীবনে এমন একটা খাবারও পাইনি, যেটা আমার মজা লাগেনি। আমি পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত কিছু পাইনি, যা খারাপ।
‘বিশ্বরূপের খেলাঘরে কতই গেলেম খেলে/ অপরূপকে দেখে গেলেম দুটি নয়ন মেলে।’
রবীন্দ্রনাথের খুব সুন্দর কথা এটা।
‘যাবার বেলা এই কথাটি জানিয়ে যেন যাই/ যা দেখেছি, যা পেয়েছি, তুলনা তার নাই।’
পৃথিবীটাকে ভালো মনে করো, দেখবে পৃথিবীটা ভালো। আর তুমি যদি তোমার ব্যর্থতার জন্য প্রথমেই ভাবো, তোমার বাবা খারাপ, মাস্টার খারাপ, ওই লোকটা কীভাবে যেন তাকাল...তাহলে কীভাবে আনন্দে থাকবে? তবে ছোটবেলায় মুক্তির মধ্যে যে আনন্দ...ওই যে রবীন্দ্রনাথের ‘ছুটি’ গল্পে বালকদিগের সর্দার ফটিক চক্রবর্তীর মাথায় চট করিয়া একটা নতুন ভাবোদয় হইল...একটা গ্রামের মধ্যে সে একটা প্রকৃতি রাজ্যের সম্রাট। ইচ্ছে করলে সে কাঠটাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে পারে, এমনকি মাখনলাল যদি এসে বসে, মাখনলালসহ ধাক্কা দিয়ে ফেলতে পারে। এই যে স্বাধীনতার আনন্দ সে পেল, এই ছেলেটাকে শহরের মধ্যে ইটের পরে ইট, মাঝখানে মানুষ, নাইকো ভালোবাসা, নাইকো স্নেহ...তার মধ্যে যখন তুমি পাচ্ছ...তখন তো আর সে প্রকৃতির সেই আনন্দের মাঝে নেই। ছোটবেলায় আমরা প্রকৃতির আনন্দের মধ্যে বড় হয়েছি। তোমরা সেটা পাচ্ছ না। ছোটবেলায় প্রাণটা মরে গেছে! তবে চাইলে সেটাকে বাঁচিয়ে তুলতে পারো। এখনই তোমরা বেরিয়ে যাও। আমি সেই ছোটবেলায় তৈমুর লংয়ের জীবনী পড়েছিলাম। সেই ঘোড়ায় চড়ে একেক দিন ১০০ মাইল, ২০০ মাইল...সেই হিন্দুকুশ পাহাড়ের ওপর দিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে পার হচ্ছে। আমিও সাইকেল নিয়ে শুরু করলাম। আমি যখন ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিলাম তখন সাইকেলে করে সারা বাংলাদেশ ঘুরলাম। তিনজন রওনা দিলাম, একজন ৬০ মাইলের পরে শুয়ে পড়ল, একজন ২৫০ মাইলের পর শুয়ে পড়ল। আমি একাই চললাম। এই যে আনন্দ। এই যে মুক্তি...তোমরা প্রকৃতির কাছে যাও। এখনো তোমরা দল বেঁধে ঘুরতে বেরিয়ে যাও। দেখবে জীবনটা সুন্দর।
সাক্ষাৎকার দলের এই পাঁচজন ছাড়াও আরও যাদের প্রশ্ন নির্বাচিত হয়েছে আবিদা তাসকীন, আফিয়া ফাহমিদা ফাহিম, আফরা ইবনাত, আফসানা চৌধুরী, আনতাসুম মুনতাজেরিন, প্রণব সরকার, বিদিতা জামান, ফারহান মাহমুদ, হুমাম সালওয়া সালভীন, জিতু আহসান, মাহাতাব রশীদ, মাশরিক ফাইয়াজ, মো. আল আমিন খান, মো. হানিফ, মো. শাফায়াত হোসেন, মেহেদী হাসান, নাহিদা ইসলাম, পঙ্কজ কান্তি দত্ত, পায়েল আসাদ, প্রজ্ঞা আহমেদ, সাব্বির হায়দার, সাইয়েদুল আবরার, সুচয়ন শামস, তাবাসসুম খান, তাহমিদ-উল-ইসলাম ও তানজিনা আলম।