হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে কেমন সম্পর্ক ছিল সমরেশ মজুমদারের, বাংলাদেশের আর কারও লেখা কি তিনি পড়তেন?
প্রয়াত হয়েছেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার। ৮ মে বিকেলে কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
২০১৮ সালে ঢাকায় এসেছিলেন সমরেশ। তখন বিজ্ঞানচিন্তার নির্বাহী সম্পাদক আবুল বাসারকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন তাঁর জীবনের নানা কথা। সেই সাক্ষাৎকারে সমরেশ মজুমদার বলেছিলেন হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের কথাও।
হুমায়ূনের সঙ্গে আমার বেশ ভালো সম্পর্কই ছিল। আমি এ দেশে এলে হুমায়ূনের ওখানেই থাকতাম। ও মাঝেমধ্যে বলত, ‘দাদা, আমার একটা আফসোস। দেশ পত্রিকা বা আনন্দবাজার পত্রিকা আমার কাছে কখনো লেখা চায় না। আবার আমি দিলেও ওরা ছাপবে না।’ আমি ওকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এ দেশে একটা উপন্যাস লিখলে তুমি কত টাকা পাও?’ পাশে থাকা এক প্রকাশক রসিকতা করে বলল, ‘হুমায়ূন ভাই একটা উপন্যাস লিখতে দশ লাখ টাকা নেন।’ আমি তখন হুমায়ূনকে বলেছিলাম, ‘কলকাতায় ওরা তোমাকে সাত হাজার টাকা দেবে একটা উপন্যাসের জন্য। তুমি কেন লিখবে ওদের ওখানে?’ হুমায়ূন চোখ বড় করে বলেছিল, ‘দাদা, পয়সা লাগবে না আমার। যে পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, সেই পত্রিকায় আমার লেখা ছাপাবে। এর চেয়ে বড় সম্মানের কী হতে পারে বলুন?’ তো সেবার ও আমার সঙ্গে কলকাতায় গেল। আমি দেশ পত্রিকার সম্পাদকের সঙ্গে ওর আলাপ করিয়ে দিলাম। তবে আজ বলি, ওই সময় কিন্তু আসলেও পশ্চিম বাংলার মানুষ হুমায়ূন আহমেদের লেখা নিয়ে সচেতন ছিল না। সেবার ২০০২ সালের দেশ–এর পূজা সংখ্যার জন্য সম্পাদক হুমায়ূনকে উপন্যাস লিখতে বললেন। হুমায়ূন খুশিতে আমাকে জড়িয়ে ধরল।
হুমায়ূন আহমেদ বেঁচে থাকা অবস্থায় পশ্চিম বাংলায় সেভাবে তাঁর বই কিন্তু বিক্রি হয়নি। তাঁর মৃত্যুর পর পশ্চিম বাংলাসহ বিভিন্ন বইমেলায় তাঁর বই হু হু করে বিক্রি হয়েছে। এখন হুমায়ূন আহমেদের নাম কিন্তু সারা বিশ্বের বাংলা ভাষার যেকোনো পাঠকই জানেন। তাঁর মৃত্যুর খবর ছোট করে ছাপানো হলেও তাঁকে নিয়ে কিন্তু পরবর্তী সময়ে অনেক লেখালেখি হয়।
হুমায়ূন আমাকে বলত, ‘সমরেশদা, যে বাঙালি ১৬ বছর বয়সে পা দিয়েও হুমায়ূন পড়েনি, সে পাঠকই না। আর যে ২৪–এরপর হুমায়ূন পড়ে, সে নির্বোধ। পাঠক নয়।’ আমাকে হুমায়ূন এই কথা বলার পর আমি সেটা লিখেওছিলাম। হুমায়ূন নিজেই বলত, ‘আমার পাঠকের বয়স ১৬ থেকে ২৪ বছর।’ ও এটা খুব বিনয় নিয়ে বলত। একজন লেখকের ভেতর অসাধারণ কিছু না থাকলে এক বইমেলায় একেকটা বই ৩০-৩৫ হাজার কপি বিক্রি হয় না। ও নিজের সম্পর্কে নিজের মূল্যায়ন খুব ভালোভাবেই করতে পারত।
বাংলাদেশের অন্য লেখকদের লেখাও আমি পড়ি। আগে ইমদাদুল হক মিলনের লেখা পড়তাম। এখন নিয়মিত আসলে কিছুই পড়া হয়ে ওঠে না। রোগের জন্য নিজের লেখাই ঠিকমতো পড়তে পারি না। মানুষেরটা আর কী পড়ব, বলুন? তবে কেউ কোনো লেখা পড়ে দেখতে বললে সেটা পড়ার চেষ্টা করি। আনিসুল হকের লেখা পড়া হয়েছে প্রচুর। (আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের) ‘চিলেকোঠার সেপাই’ আজও পড়লে নতুন লাগে আমার কাছে। এসব লেখা থেকে এখনো আমি অনেক কিছু শিখি। এমন লেখাগুলো নিজের ভেতর নিতে পারলে আমি হয়তো নিজেকে নিয়ে গর্ব বোধ করতে পারতাম।
আমার সাথে একজন লেখকের কথা হতো। প্রণব ভট্টাচার্য, কাস্টমসে চাকরি করতেন। আমার সাথে আলাপ হওয়ার পর তিনি আমাকে বললেন দাদা আমি হচ্ছি তিন নম্বর লেখক। আমি বললাম, ‘ব্যাপারটা কী বলুন তো?’ তিনি বললেন, ‘এক নম্বর মিলন ভাই, দু নম্বর হুমায়ুন ভাই আর তিন নম্বরে হলাম আমি।’ তো আমি ওর লেখা পড়লাম। এভাবে আসলে সংখ্যা দিয়ে লেখককে মূল্যায়ন করা ভারি কঠিন।