স্কুলে গানের প্রতিযোগিতা। ছেলেদের অংশগ্রহণের সংখ্যা খুব কম বলে দশম শ্রেণিপড়ুয়া ছেলেটাকে উঠিয়ে দেওয়া হলো মঞ্চে। আর তাতেই হলো বাজিমাত। রীতিমতো প্রথম হয়ে গেল সে। ছেলেটির নাম শায়ান চৌধুরী অর্ণব। শুধু গানেই নয়, একাধারে পারদর্শী ছবি আঁকায়, টি-শার্ট-জুতোয় নকশা করায়। এমনকি ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত ভরতনাট্যমও শিখেছেন তিনি। অর্ণব মানে সমুদ্র। শিল্পের প্রতি তাঁর সমুদ্রের মতোই গভীর ভালোবাসা। শিক্ষাজীবনের শুরুটা করেছিলেন ঢাকার উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলে। এরপর ক্লাস থ্রি থেকে ম্যাট্রিক অবধি পড়েছেন ভারতের শান্তিনিকেতনে। সেখান থেকেই ‘ছাপচিত্র’ নিয়ে স্নাতক পাস করেছেন। শত ব্যস্ততার ভিড়েও ‘কিশোর আলো’কে সাক্ষাৎকারের জন্য সময় দিয়েছেন তিনি। সাক্ষাৎকার দলে ছিল ধানমন্ডি গভ. বয়েজ হাইস্কুলের মাহমুদ সৌরভ, ঢাকা কলেজের আবু সাঈদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাহমিদা আলম এবং ভিকারুননিসা নূন স্কুলের সুবহানা উনজিলা নূর, অনুভা অনন্যা ও অনাদিনী মগ্ন।
প্রশ্ন :
আপনার ছোটবেলা সম্পর্কে বলুন। তখন গায়ক হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন নাকি অন্য কিছু?
ছোটবেলায় গায়ক হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম না। আমি ক্লাস থ্রিতে শান্তিনিকেতনে পড়তে যাই। ছোটবেলায় ইংরেজি মাধ্যমে পড়ার কারণে বাংলায় খুব দুর্বল ছিলাম। ভর্তি পরীক্ষায় রচনা ভালো লিখতে পারিনি। তাই বাংলায় ফেল করি। ভাইভায় আমাকে জাতীয় সংগীত গাইতে বলা হলো। আমি গাইলাম, সেটা এত ভালো হলো যে তারা আমাকে নিয়ে নিল। আবার ক্লাস টেনের সময় স্কুলের একটি প্রতিযোগিতা হলো। সেখানে ছেলেদের অংশগ্রহণের সংখ্যা কম হওয়ায় আমাকে গান করতে বলা হলো। আমি ‘আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে’ গানটা গেয়ে প্রথম হই। তখনই মনে হলো, গানটা আমি মনে হয় ভালোই পারি। তা ছাড়া চাচাতো-মামাতো ভাইবোনেরা মিলে গান করতাম। বাজানো থেকে শুরু করে কম্পোজিশন—সব নিজেরাই করতাম। কম্পোজ করতে গিয়ে নিজেই গান গাওয়া শুরু করলাম। এ ছাড়া ক্লাস টেনের পর ঢাকায় এসে জীবনে প্রথম রেকর্ডিং করেছিলাম।
প্রশ্ন :
শান্তিনিকেতনের সময় সম্পর্কে বলুন।
শান্তিনিকেতনে ছিলাম ১৭ বছর। মায়ের সঙ্গে গিয়েছিলাম। আমাদের স্কুল-কলেজ তো দালানকোঠা-বিল্ডিংয়ের। শান্তিনিকেতনে কিন্তু এমন না। সেখানে বড় মাঠ, বকুলগাছের তলায় ক্লাস, মাঠে-ঘাটে ঘুরে ঘুরে ক্লাস করতাম আমরা। এই গাছতলা থেকে ওই গাছতলায় ক্লাস করতে যেতাম। যখন বৃষ্টি আসত তখন ক্লাস সিক্স পর্যন্ত ছুটি হয়ে যেত। শান্তিনিকেতনে আমাদের ক্লাস সিক্স থেকে ছেলেদের পাঞ্জাবি পরতে হতো আর মেয়েদের ক্লাস এইট থেকে শাড়ি পরতে হতো। আমাদের ক্লাসে মালির ছেলে যেমন পড়ত, আবার কোনো টিচারের ছেলেও পড়ত। আমি মাঝেমধ্যে ঢাকায় এসে নানা রকম ফ্যান্সি ব্যাগ কিনতাম। ওখানে নিয়ে যাওয়ার পর যখন দেখতাম কেউ টিনের বাক্সে বই-খাতা আনছে, তখন খুব খারাপ লাগত। তখন ঢাকা থেকে কেনা নানা উপহার বন্ধুদের মাঝে বিলিয়ে দিতাম। সবাই মিলেমিশে থাকতাম। আমাদের সপ্তাহে এক দিন মাংস খেতে দিত। সেই দিন টিভিও দেখতে দিত। ‘চিত্রাহার’ নামের একটাই প্রোগ্রাম দেখতে পেতাম।
প্রশ্ন :
শান্তিনিকেতন কি আসলেই শান্তির নিকেতন...শুধুই শান্তি আর শান্তি?
হ্যাঁ, শান্তিনিকেতন আসলেই শান্তির নিকেতন। যদিও আমরা কিছু অশান্তি সৃষ্টি করতাম! কোনো কিছুর জন্য চাপ দেওয়া হতো না সেখানে। সবাই খুব সহযোগিতাপূর্ণ ছিল। কোনো বিষয় নিয়ে সমস্যা থাকলে ছোট-বড় সবার কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে বুঝে নেওয়া যেত। যে যেই বিষয়ে বেশি পারদর্শী, তাকে সেই বিষয়েই বেশি জোর দিতে বলা হতো। অন্যান্য জায়গার মতো ক্লাসে খুব ভালো রেজাল্ট করা বা পজিশনে আসা নিয়ে বেশি মাথা ঘামানো হতো না। শিক্ষাটাকে সত্যিকার অর্থে গ্রহণ করানোই ছিল মূল উদ্দেশ্য।
প্রশ্ন :
স্কুলে শাস্তি কেমন ছিল?
শান্তিনিকেতনে শাস্তি হিসেবে মার-টার দিত না। এক স্যার ছিলেন, উনি আমাকে একেক দিন একেক নামে ডাকতেন। কখনো ডাক্তার অর্ণব বা প্রফেসর অর্ণব।
স্যারদের সেখানে দাদা আর মিসদের দিদি বলে ডাকা হতো। ফলে টিচারদের সঙ্গে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। ক্লাসে টিচারদের সঙ্গে আলোচনার সুযোগ বেশি ছিল।
প্রশ্ন :
শান্তিনিকেতনে মজার কোনো ঘটনা সম্পর্কে বলুন।
আমার একটা পোষা হনুমান ছিল। হনুমানটাকে টমেটো খাওয়াতাম, ও আমার মাথার উকুন বেছে দিত। তখন বেশি নড়াচড়া করলে চড় মারত।
বাজারে অনেকটা চাঁদা তোলার মতো করে হনুমানগুলো বিরাট পাল নিয়ে ঘুরে বেড়াত। বড় হনুমানগুলো কাঁটাতার পেরিয়ে পাউরুটি নিয়ে যেত।
প্রশ্ন :
আপনার কি শান্তিনিকেতনের মতো একটা স্কুল দেওয়ার ইচ্ছা আছে?
হ্যাঁ, আমার তো খুব ইচ্ছা বাংলাদেশে যদি এ রকম একটা স্কুল শহরের বাইরে থাকত। ওখানে তো ক্লাস-রিহার্সাল ঘোরাঘুরি এসব করে দম ফেলার সময় ছিল না। আমাদের আবার কাজ দিত কোনো এক গ্রামে গিয়ে পুকুর খোঁড়া—এমন সব আজব কাজ। এ রকম স্কুল বানাতে হবে। খুব কষ্ট হয় যখন দেখি আমার ভাগনিরা স্কুলে যেতে চায় না। আসলে খেলতে খেলতে শেখায় সবচেয়ে মজা। আনন্দের মাধ্যমে সব শেখা যায়।
প্রশ্ন :
প্রথম মঞ্চে ওঠার অনুভূতি বা অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
প্রথম মঞ্চে ওঠার সময় ভয় ছিল না। কারণ, স্কুলেই আমাদের শেখানো হতো মঞ্চে ওঠা। সেখানেই অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল।
প্রশ্ন :
পরীক্ষা দিতে কেমন লাগত?
অসহ্য। তবে যে বিষয়টা ভালো লাগত, সে বিষয়ে পরীক্ষা দিতে ভালোও লাগত। নম্বরের জন্য পরীক্ষা দেওয়া অসহ্য লাগে।
প্রশ্ন :
বাংলাদেশি ব্যান্ডের গান আমার খুব ভালো লাগে। কিন্তু বাসায় এ ধরনের গান কেউ শুনতেই পারেন না। তাঁদের ভাষায়, এটা চেঁচামেচি ছাড়া আর কিছুই না। তাঁদের বোঝাতে আমার কী করা উচিত?
তাঁদের বোঝানোর তো দরকার নেই। তাঁরা তাঁদের সময়ের গান বেশি পছন্দ করবেন এটাই স্বাভাবিক। তাঁরা যখন তাঁদের সময়ের গান শোনেন, তখন তাঁদের পুরোনো স্মৃতি ফিরে আসে। গানটার সঙ্গে সম্পর্কিত অনেক কিছু মাথায় এসে ঘুরতে থাকে। পোশাক যেমন বদলায়, তেমনি সংগীতও বদলায়। সুতরাং তাঁদের বোঝানোর প্রয়োজন নেই।
প্রশ্ন :
অনেকবারই তো দেশের বাইরে কনসার্ট করেছেন, সেসব জায়গায় মানুষ আমাদের গান কীভাবে নেয়?
সবাই খুব ভালোভাবে নেয়। অনেক অনুরোধও করে। ভারতের বিহারে একবার গান করতে গিয়েছিলাম। তখন তাঁদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনারা কি আমার ভাষা বুঝতে পারছেন? তখন তাঁরা বললেন, আপনি হিন্দি, বাংলা, ভোজপুরি যেকোনো ভাষায় বলুন। তখন আমার মনে পড়ল আমি তো একটা ভোজপুরি গান পারি। তখন একটা ভোজপুরি গান করেছিলাম। গানটা সবাইকে মাতোয়ারা করে দিয়েছিল।
প্রশ্ন :
কোনটা বেশি ভালো লাগে? গান লেখা, সুর করা নাকি গান গাওয়া?
একেক সময় একেকটা ভালো লাগে। কিছু কিছু সময় গান লিখতে, কিছু কিছু সময় গান গাইতে ভালো লাগে। আবার কখনো কখনো মনে হয় বাহ! এই গানের সুরটা তো অনেক ভালো হয়েছে।
প্রশ্ন :
হঠাৎ যদি কোনো দিন সকালে ঘুম ভেঙে দেখেন আপনি গিটার বাজাতে ভুলে গেছেন, কী করবেন তখন?
আবার শিখব। আগের ভুলগুলো শুধরে নেব। বেসিকে যেসব গন্ডগোল আছে, সেগুলো ঠিক করে নেব।
প্রশ্ন :
যদি বলা হয় এক মাস আপনাকে নির্জন কোনো জায়গায় গিয়ে একা থাকতে হবে এবং শর্ত হিসেবে দেওয়া হবে কেবল একটিই মাত্র জিনিস নিতে পারবেন, তবে কী নেবেন?
খাতা আর কলম।
প্রশ্ন :
অন্য কিছু না কেন?
ঝামেলা তো! খাতা-কলম এমন একটা জিনিস, যাতে আমি সব করতে পারি। গান লিখতে পারি, ছবি আঁকতে পারি, আশপাশের প্রকৃতিকে তাতে ধারণ করতে পারি।
প্রশ্ন :
আপনি তো দুই বাংলাতেই কাজ করেছেন। ওপার বাংলার সঙ্গে আমাদের গানের মিল-অমিল কতটুকু?
আগেকার গানগুলোর যদি তুলনা করা হয় তাহলে দুই বাংলার গানের মধ্যে সে রকম বড় কোনো অমিল পাওয়া যায় না। কিন্তু আধুনিক গানগুলোর মধ্যে কিছু অমিল আছে। যেমন—কলকাতার গানগুলো বেশ কথানির্ভর। গানের কথাগুলো অনেক উন্নত এবং গানের প্রতিটি কথার মধ্যেই এক রকমের জোর আছে। কিন্তু আমাদের দেশের গানগুলো এতটা কথানির্ভর নয় বরং অনেক জাঁকজমকপূর্ণ। আমরা গান নিয়ে অনেক নিরীক্ষা করি, সবাই মিলে গান করি। গান বানাতে আমরা অনেক দক্ষ।
প্রশ্ন :
এক হাতে চাঁদ আরেক হাতে সূর্য এনে দিলেও আপনি কোন কাজটি করতে রাজি হবেন না?
ঘুষ নিতে পারব না, চুরি করতে পারব না...(একটু ভেবে) কোনো আইটেম গানের সঙ্গে নাচতে পারব না।
প্রশ্ন :
আপনার ব্যান্ড ‘অর্ণব অ্যান্ড ফ্রেন্ডস’ নিয়ে যে স্বপ্ন দেখেন....
আজকাল তো দুঃস্বপ্ন দেখছি! কারণ, ঈদে নতুন একটা অ্যালবাম বের করার কথা। কিন্তু অ্যালবামের কাজ এখনো শেষ হয়নি।
প্রশ্ন :
সেই অ্যালবাম থেকে কোনো একটা গানের দুই লাইন শোনান...
চাঁদের সিঁড়ি বেয়ে রূপকথা নেমেছে রাস্তায়/তার কথা ধুলোর সঙ্গে মিশে রঙিন করেছে সন্ধ্যা।
আরেকটি হলো:
পুলিশের শিরে টুপি, ছোট ছোট পিস্তল/ভোর হয়ে গেল ছাত্রসমাজ, ময়দানে ফুটবল।
প্রশ্ন :
অর্ণব মানে তো সমুদ্র। আপনার সমুদ্র না পাহাড় ভালো লাগে?
সমুদ্র ভালো লাগে। ছোটবেলায় আমি যখন প্রথম সমুদ্র দেখতে গিয়েছিলাম তখন সমুদ্রে ছাড়ার জন্য কাগজের একটা নৌকা নিয়ে গিয়েছিলাম। সমুদ্র এত বিশাল যে দেখে মনে হলো আমার নৌকা তো এখানে টিকবেই না। একবার প্লেনে ওঠার জন্য দড়িও তৈরি করেছিলাম। প্লেন যখন বাসার সামনে দিয়ে যাবে, দড়ি মেরে বেয়ে উঠে যাব। প্লেন অনেক ওপর দিয়ে যায় বলে সেই দড়ি কাজে লাগেনি। প্রথম যেবার প্লেনে উঠেছিলাম, একটা দড়িতে ইট বেঁধে নিয়ে গিয়েছিলাম। জানালা দিয়ে দোলাব বলে। পরে প্লেনে ওঠার পর লজ্জায় সেটা আর বেরই করিনি।
প্রশ্ন :
সেই আপেলটা, যেটা নিউটনের মাথায় পড়েছিল, আপেলটা আপনার মাথায় পড়লে কী করতেন?
খেয়ে ফেলতাম।
প্রশ্ন :
গান যদি পৃথিবীতে না-ই থাকত, তবে...?
মানুষ কিছু না কিছু বাজাত। আওয়াজ করার মধ্যেও আনন্দ আছে। আদিমকালে তো মানুষ নানা শব্দ করেই নিজেদের আনন্দ বা দুঃখের অনুভূতি ব্যক্ত করত।
প্রশ্ন :
আর যদি পুরো সংগীত বিষয়টাই না থাকত?
তাহলে নাচত, তখন সব সংগীতশিল্পী নৃত্যশিল্পী হয়ে যেত।
প্রশ্ন :
যত ধরনের বাদ্যযন্ত্র আছে—এগুলোর মধ্যে কোনটির সুর সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে?
সারেঙ্গি, এসরাজ এসব। এসরাজ ভালো লাগার কারণ হলো এই একটি বাদ্যযন্ত্রই আমি বাজানো শিখেছিলাম। একটানা চার বছর শিখেছিলাম।
প্রশ্ন :
আপনি তো অনেক ধরনের গান গেয়েছেন, কোন ধরনের গান গাইতে বা শুনতে পছন্দ করেন?
রবীন্দ্রসংগীত, ফোকগান শুনতে যেমন ভালো লাগে, তেমনি গাইতেও ভালো লাগে। এসব গান গাইতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। কারণ, ছোটবেলা থেকেই এসব গানের চর্চাটা আছে। নিজের গানগুলো করতে সবচেয়ে কম স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি।
প্রশ্ন :
নাচতে না জানলে উঠান বাঁকা আর গাইতে না জানলে...
(চিন্তিত) দাঁতে ব্যথা।
প্রশ্ন :
এমন একটা মিথ্যা বলুন যেটা সত্যি হলে ভালো লাগত।
কেন জানি ‘আমরা সবাই রাজা’ গানটা মাথায় আসছে। আমরা সবাই রাজা না, কিন্তু হলে ভালো লাগত।
প্রশ্ন :
তুমি তাদের নাম দিলে না...মনের ভুলে কেউ দিল না, তোমার দেওয়া আমার কোনো নাম ছিল না...আপনাকে কে কী নাম দিয়েছে? অর্থাৎ কে কী নামে ডাকে?
অনেকেই অনেক নামে ডাকে। কলকাতার শান্তিনিকেতনের বন্ধুরা বর্তমানে বাগচী নামে ডাকে। কলকাতার এক অনুষ্ঠানে উপস্থাপক হঠাৎ করে বলে বসলেন এখন গান গাইবে বাংলাদেশের অর্ণব বাগচী। সে বাগচী কোথায় পেল আমি জানি না। সেই থেকে বন্ধুরা বাগচী নামে ডাকে। এ ছাড়া অনেকে বাঙাল বলত। আমার ভালো নাম শায়ান চৌধুরী। শায়ান বলে বাংলায় কোনো শব্দ নেই। তাই অনেকে সায়ন বা সায়ান বলে। বাবা-মা অর্ণব বলেই ডাকে। ভজু, ভোঁদড়, চৌধুরী সাহেব বলেও ডাকে অনেকে।
প্রশ্ন :
আপনার গানে নানা রকমের রঙের কথা পাওয়া যায়। যেমন: কাঠগোলাপের সাদা রং কিংবা নীলচে তারার আলো। রং নিয়ে আপনার ভাবনার আলাদা কোনো জগৎ আছে কি?
রং, সুর, গান—এগুলোর আলাদা জগৎ আছে। আমি আমার গানে দৃশ্যপট দিতে চেষ্টা করি, ছবি আঁকতে চেষ্টা করি। ছবি আঁকার সময়ই রঙের ব্যাপারটি আসে। গানের মাঝে ছবি আঁকার জন্য আমি রং নিয়ে আসি। বিস্ময় তৈরি করার জন্য গানে রং সৃষ্টি করি।
প্রশ্ন :
আপনি তো ছাপচিত্র নিয়ে পড়েছেন। কার্টুন নিয়েও তো কাজ করতে পারেন। গায়ক অর্ণবের পাশাপাশি চিত্রশিল্পী অর্ণব হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছেন না কেন?
আমি তো অনেক জায়গায় অনেক কাজ করেছি। টি-শার্ট ডিজাইন করেছি, সিডির কভার করেছি, বইয়ের প্রচ্ছদ করেছি, জুতা ডিজাইন করেছি, বাবাকে নিয়ে ডকুমেন্টারি বানিয়েছি। আমি চাই আমার আঁকা সব জায়গায় ঘুরে বেড়াক। এক জায়গায় আটকে পড়ে না থাকুক। একটা সিনেমা বানানোরও ইচ্ছা আছে।
প্রশ্ন :
আপনার বাবা স্বপন চৌধুরী অনেক বড় চিত্রশিল্পী। তাঁর সঙ্গে আপনার কোনো স্মৃতি যদি বলতেন।
ছোটবেলাতেই দেশের বাইরে পড়তে চলে যাওয়ায় ওভাবে আসলে বাবার সঙ্গ পাওয়া হয়নি খুব একটা। তবে মনে আছে, ছোটবেলায় বাবা বিভিন্ন রকমের ডিজাইনের ঘুড়ি বানাতেন, আমরা একসঙ্গে ঘুড়ি ওড়াতাম। বাবার মতো ও রকম ঘুড়ি কেউ বানাতে পারত না। কখনো বাবার সঙ্গে কারাতে বা কুস্তি খেলতাম। একবার তার হাতে মারতে গিয়ে লাথি মেরে বসেছিলাম মুখে।
প্রশ্ন :
বাইরের দেশের মিউজিক ভিডিওগুলোর তুলনায় আমাদের দেশের বেশিরভাগ মিউজিক ভিডিওই গতানুগতিক। এ ব্যাপারে মন্তব্য কী?
বাইরের দেশে মিউজিক ভিডিওর জন্য অনেক বাজেট রাখা হয়। ওদের বাজারটাও বড়। আমাদের দেশে মিউজিক ভিডিওর জন্য বাজেট অনেক কম রাখা হয়। সে ক্ষেত্রে স্বল্প বাজেটে ভালো মিউজিক ভিডিও বানানোর জন্য আইডিয়ার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।
প্রশ্ন :
আপনার তো বড় চুল ছিল, ছোট চুলও আছে। কোন চুল বেশি ভালো লাগে?
বড় চুল বেশি ভালো লাগে। তবে বড় চুল রাখলে চুল পড়ে যায়। যত্ন নেওয়াও কষ্টকর।
প্রশ্ন :
নিজের গাওয়া বা লেখা সবচেয়ে প্রিয় গান কোনটি?
নিজের লেখা সবচেয়ে প্রিয় গান হলো ‘আধখানা’। আর নিজের গাওয়া প্রিয় গান ‘হারিয়ে গেছি’।
প্রশ্ন :
আপনার জীবনে এমন কোনো ঘটনা কি আছে, যার জন্য আপনি অনুতপ্ত এবং যেটা এখন স্বীকার করতে চান?
আমার একটা কুকুর আছে। নাম ডুব্বা। একবার ওকে মেরেছিলাম। এরপর ওকে আদর করতে গেলে বা ওকে ডাকলে খুব খেপে যায়। মনে হয় মেরেছিলাম বলেই।
প্রশ্ন :
ঠিক এই মুহূর্তে যদি আপনি আমাদের মতো কিশোর সময়ে ফিরে আসতেন। তবে কী করতে চাইতেন?
আমি তো কিশোরই। সবাই আমাকে বলে, তুমি বাচ্চাদের মতো কাজ করো। আমার কাছে সবচেয়ে বেশি মূল্যবান হলো সরলতা। বড় হলে তো আমরা সব মেনে নিই। ছোটরা যেমন সব সময় জিজ্ঞেস করে ‘এটা কেন ওটা কেন’ সেটা বড় হলে করি না। আমার গানের মধ্যেও আমি সরলতা রাখতে চেষ্টা করি। একটা গান আছে না (গেয়ে) ‘হোক কলরব ফুলগুলো সব লাল না হয়ে নীল হল ক্যান?’ বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সরলতা হারিয়ে যায় বা যাচ্ছে। সরলতা এখনো আছে বলে আমার বয়স বাড়ছে না।
প্রশ্ন :
নিজেকে কখনো ‘বাক্সে বাক্সে’ বন্দী মনে হয়েছে?
হ্যাঁ, হয়েছে। একবার স্টুডিওতে কাজ করার সময় জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি, গাছের ডালপালা নড়ছে। তখন ফেসবুকে বন্ধুকে জেজ্ঞস করে জানলাম, বাইরে প্রচণ্ড ঝড় হচ্ছে। অথচ জানালাটা সাউন্ড প্রুফ হওয়ায় বুঝতেই পারলাম না। তখন বাক্সে বাক্সে বন্দী মনে হয়েছিল।
প্রশ্ন :
গোয়েন্দা উপন্যাসের ‘তুখোড় গোয়েন্দা’ নাকি কিশোর উপন্যাসের ‘চঞ্চল কিশোর’ হতে চান?
অবশ্যই গোয়েন্দা উপন্যাসের তুখোড় গোয়েন্দা হতে চাই। নিজেকে মাঝেমধ্যে শার্লক হোমস ভাবতে বেশ মজা লাগে। শার্লক হোমস আমার খুব প্রিয়। এ ছাড়া ফেলুদা, পঞ্চপাণ্ডব ইত্যাদি গোয়েন্দা উপন্যাস ছোটবেলা থেকেই আমার খুব পছন্দের। ছোটবেলায় ‘প্রাইভেট ডিটেকটিভ ফর হায়ারস’ নামের একটি এজেন্সি খুলেছিলাম বন্ধুরা মিলে। এজেন্সিটি নিয়ে একটি পোস্টারও বানিয়েছিলাম। একবার পাশের বাসার একজনের বারান্দা থেকে টব চুরি হয়ে যাচ্ছিল। তখন আমরা চোরকে বের করার দায়িত্ব কাঁধে নিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত চোরকে বের করতে না পেরে নিজেদের এক বন্ধুকে ‘চোর’ সাজিয়ে নিয়ে গেলাম। তাকে দিয়ে স্বীকার করালাম যে সে-ই চুরি করেছে।
প্রশ্ন :
এখন যদি আমরা আপনাকে অপহরণ করে গুম করে দিই, কেমন হবে?
প্লিজ! গুম করে দাও! তাহলে অনেক দায়িত্ব পালন করা থেকে বেঁচে যেতে পারি। বড় হওয়া মাত্রই অনেক দায়িত্ব পালন করতে হয়। এত দায়িত্ব পালন করতে আর ভালো লাগে না। যারা আমাকে গুম করবে, তখন আমার সব দায়িত্ব তাদের হয়ে যাবে।
প্রশ্ন :
আপনি নাকি একবার ইভ টিজিংয়ের প্রতিরোধ করতে এক ইভ টিজারের মাথায় গিটার দিয়ে বাড়ি মেরেছিলেন?
হ্যাঁ। আমার অনেক বড় বড় চুল থাকায় কয়েকজন ছেলে আমাকে মেয়ে ভেবে পেছন থেকে বিরক্ত করছিল। আমি তখন ঘুরে গিটার দিয়ে দিলাম বাড়ি। আমার অনেক দিনের শখও ছিল কারো মাথায় গিটার ভাঙব। এদিক দিয়ে আমার শখটাও পূরণ হলো, প্রতিবাদও করা হলো। ইভটিজিংয়ের ব্যাপারে তোমাদের উচিত সচেতন হওয়া। মেয়েদের অনেক দৃঢ় হওয়া প্রয়োজন। আর ছেলেদের নিজ নিজ জায়গা থেকে এগিয়ে এসে প্রতিবাদ করা দরকার।
প্রশ্ন :
রানা প্লাজায় দুর্ঘটনার পর আপনি ‘মন খারাপের বৃষ্টি’ গানটি থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের সাহায্য করেছেন। এ ভাবনাটা কীভাবে এল?
রানা প্লাজার দুর্ঘটনার কবলে পড়া মানুষগুলোর জন্য কিছু করতে চাচ্ছিলাম। চিন্তা করে দেখলাম, সাভারে অনেকেই কাজ করছে, আমি সেখানে গিয়ে তেমন কিছু করতে পারব না। হঠাৎ একদিন বন্ধুরা বলল যে তারা ওয়েবে গান দিয়ে সাহায্যের টাকা সংগ্রহ করবে। তাই সঙ্গে সঙ্গে আমিও গান দেওয়ার জন্য রাজি হয়ে গেলাম।
প্রশ্ন :
আপনার জীবনে অনুপ্রেরণা হিসেবে আপনি কাকে দেখেন?
বাবা-মা, ভাই-বোন, বন্ধু-বান্ধবী—সবার কাছে অনুপ্রেরণা পাই। তোমরা যারা আমার গান শোনো, তারা আমার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা। যারা অন্য রকম চিন্তা করে, অন্য রকমভাবে চলে, ভাবতে চায়, মানুষ হয় তো তাদের ‘খ্যাত’ বলে কিন্তু তারাই আমার অনুপ্রেরণা।
প্রশ্ন :
আপনি, বুনো, আনুশেহ একসঙ্গে বাংলা ব্যান্ডে ছিলেন। এখন আলাদা কেন?
আমরা তিনজনই ফোকগান নিয়ে কাজ করতাম। তখন মনে হলো, তিনজনই যখন একই কাজ করছি তখন একটা ব্যান্ড করলে কেমন হয়। পরে বাংলা ব্যান্ড হলো। অনেক দিন গান গাওয়ার পর আমার মনে হলো, লালনের আদর্শটা আমরা মেনে চলি না। আসলে লালনের গান তো শুধু গান নয়, এটা একটা জীবন আদর্শ। তাই আমরা আলাদা হয়ে নিজেদের জায়গা শক্ত করতে কাজ করছি। আনুশেহ মৌলিক গান নিয়ে কাজ করছে। বুনো সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে কাজ করছে। তবে তার পরও কেউ ডাকলে আমরা যাই তো। পরে আমরা একসঙ্গে আবার এক হব।
প্রশ্ন :
এখন যারা গান শিখতে, লিখতে বা সুর করতে চায় তাদের উদ্দেশে আপনি কী বলবেন?
প্রচুর গান শুনতে হবে। বিশেষ করে পুরোনো গান অনেক বেশি করে শুনতে হবে।
প্রশ্ন :
আমাদের মতো কিশোরদের কখনো সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন?
না, তোমরাই প্রথম এবং তোমাদের প্রশ্নগুলো অনেক কঠিন ও বুদ্ধিদীপ্ত। আমি তো উত্তরই দিতে পারছি না।
সাক্ষাৎকার দলের পাঁচজন ছাড়া আরও যাদের প্রশ্ন নির্বাচিত হয়েছে— অচ্যুত সাহা, আদিলা জামান, আঁখি আলম, আমানী মোহাম্মদ, অনন্যা শুভ্রা, আনিতা আহমেদ, আহমেদ রাফি আর রহমান, আসাদুল্লাহ ইবনে মাসুদ, আহ্নাফ তাহিমদ খান, ইফতেখার রাকিন, ইসতিয়াক হোসেন, ইশরাত জাকিয়া তাসনীম, ঐশিক দে, কান্তাময়ী স্নেহা, ফাবিহা হোসেন, ফাইজাহ রাব্বী, ফারদীন এহসান খান, ফারিহা রাইসা, ফারহাত মৃত্তিকা, ফারিহা যাহিন, জয়তসিংহ, জিতু আহসান, মাহাতাব রশীদ, মারুফ জায়ান, মশিউর রহমান, মাশরিক ফাইয়াজ, মাশরুর মুনতামিম, মারিয়া ফেরদৌস, মীমনুর রশিদ, মেহেদী হাসান, মো. মুকতাদির মাওলা, মো. ফিরোজ মাহমুদ, মো. মঈন উদ্দিন খালেদ, মৃত্তিকা জাকির, নাবিলা জলিল, নাফিসা হোসেন, নাহার আল রাজি, নোশিন তাবাসসুম, পূর্ণতা তালুকদার, প্রভাতিকা নাজমিন, রিফা নাজীবা, সাহিব নিহাল, সাদিয়া ফাইরোজ, সানজানা ফারিয়াল, সার্বিক ফেরদৌস, সাজিদ হাসান, সামিয়া শারমিন, সাবিহা শারমিন, সুমাইয়া রহমান, সুপান্থ দে, শতাব্দী দাস, তাবাসসুম ইসলাম, তাবাসসুম খান, তানজিনা কাকন, তারিকুল হাসান, তাসনীম আকবর ফারুকী, তনিমা ইসলাম, জাহিদুল ইসলাম ও যাহরা হাফিজ।