দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশিদের মনে একটি আক্ষেপ ছিল—বিশ্বকাপে বাংলাদেশের কোনো সেঞ্চুরি নেই। সেই আক্ষেপ ঘুচিয়েছেন মাহমুদউল্লাহ। গ্রুপ পর্বে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে করা সেঞ্চুরিটি শুধু বিশ্বকাপে বাংলাদেশেরই প্রথম সেঞ্চুরি নয়, তাঁর ওডিআই ক্যারিয়ারেও প্রথম সেঞ্চুরি। ধারাবাহিকতা না থাকার সমালোচনা উড়িয়ে দিয়ে পরের ম্যাচেই নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে করেছেন আরেকটি অনবদ্য সেঞ্চুরি। ডানহাতি ব্যাটসম্যান মাহমুদউল্লাহ ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি করেন অফব্রেক বল। টেস্ট-ওডিআই মিলিয়ে তুলে নিয়েছেন ১০৩টি উইকেট। ওডিআই শতক পেতে দেরি হলেও মাহমুদউল্লাহ কিন্তু সবার নজর কাড়েন আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের শুরুতেই। বিশেষ করে ২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে নিজের টেস্ট অভিষেকে দ্বিতীয় ইনিংসে ৫ উইকেটসহ ম্যাচে ৮ উইকেট নিয়ে চলে আসেন আলোচনায়।
শত ব্যস্ততার মাঝেও নিজের পড়াশোনাটা চালিয়ে যাচ্ছেন মাহমুদউল্লাহ। ময়মনসিংহ জিলা স্কুল থেকে এসএসসি ও মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে এইচএসসি শেষে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্পন্ন করেছেন বিবিএ। বর্তমানে করছেন এমবিএ।
টিম কিআর সঙ্গে দীর্ঘ দুই ঘণ্টার আড্ডায় নিজের ছেলেবেলা, স্কুলজীবন, পরিবার, ক্রিকেটসহ নানা বিষয়ে কথা বলেছেন। কিশোর আলোর সাক্ষাৎকার দলের হয়ে সেখানে উপস্থিত ছিল মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি উচ্চবিদ্যালয়ের হামীম ইসলাম, তেজগাঁও সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের সাবিহা শারমিন, শের-ই-বাংলা নগর সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের মাশরাবা আহমেদ চৌধুরী, ভিকারুননিসা নূন স্কুলের আনিকা তাসনিম ও সরকারি বিজ্ঞান কলেজের সজিব-উজ-জামান।
ছেলেবেলায় ক্রিকেট খেলতে গিয়ে জানালার কাচ ভেঙেছেন?
আমি আমার বাসার জানালার কাচই ভেঙেছি। আমাদের বাড়িতে বড় মাঠ ছিল, সেখানে খেলতাম। গলিতে খেলতে গিয়ে আরও কয়েক বাসার কাচ ভেঙেছি। কাচ ভেঙেই দৌড় (হাসি)। পরে এক দিন খেলতাম না, তার পরদিন থেকে আবার...
আপনাকে দেখলে শান্তশিষ্ট মনে হয়। আপনি কি ছোটবেলায়ও শান্তশিষ্ট ছিলেন?
খুব শান্তশিষ্ট ছিলাম। এখনো শান্ত। মজা করতেও পছন্দ করি, তবে আমার নিজস্ব পরিবেশে। কাছের বন্ধু বা টিমমেটদের সঙ্গে অনেক মজা করি।
স্কুলে যে ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হতো, সেসবে সফলতা কেমন?
খুব একটা সফলতা নেই। লাফিয়ে যে চকলেট ধরতে হয় মুখ দিয়ে, ওগুলোতে একবার অংশ নিয়েছিলাম। কততম হয়েছিলাম ভুলে গেছি। প্রথম তিনের মধ্যে ছিলাম না এটা নিশ্চিত। ক্রিকেটে আগ্রহ ছিল। স্কুল পর্যায়ে খেলে ২০০০ সালে চ্যাম্পিয়ন আর ১৯৯৯-এ রানার্সআপ হয়েছি।
ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহটা কবে থেকে?
আমার মেজো ভাই এমদাদউল্লাহ ক্রিকেট খেলতেন। তখন আমি ক্লাস সিক্স বা সেভেনে পড়ি। ভাইয়ের সঙ্গে খেলে তখন থেকেই আকর্ষণ। পরে ময়মনসিংহে দ্বিতীয় বিভাগ প্রিমিয়ার লিগে খেলা শুরু করি।
বিশ্বকাপে বাংলাদেশের পক্ষে প্রথম ও একমাত্র সেঞ্চুরিয়ান আপনি। কেমন লাগে?
ভালো। আমি খুবই আনন্দিত। তবে আমার মনে হয় এটা একটা শুরু মাত্র। ইনশা আল্লাহ সামনে আরও ভালো করার চেষ্টা করব দলের জন্য।
নব্বইয়ের ঘরে যে পর পর দুবার গেলেন, নার্ভাস হননি?
প্রথমবার যখন ৯২-তে, তখন একটু নার্ভাস ছিলাম। মুশি (মুশফিকুর রহিম) এসে বলল, ‘ডোন্ট ওরি’। পরে যখন একটা চার হলো অ্যান্ডারসনের বলে, তখন কিছুটা স্বস্তি অনুভব করেছি। তারপর স্বাভাবিক। দ্বিতীয় সেঞ্চুরিতে তেমন কিছু মনে হয়নি।
সেঞ্চুরি দুটির পর কাকে মনে পড়েছিল?
দুটি সেঞ্চুরিই স্ত্রী ও সন্তানকে উৎসর্গ করেছি। ইংল্যান্ডের সঙ্গে খেলায় জাতীয় সংগীত শুনে চোখে পানি চলে এসেছিল। একটা অংশ আছে যে ‘মা তোর বদনখানি মলিন হলে আমি নয়ন জলে ভাসি’। শুনে আম্মুর কথা মনে পড়ছিল। মনে হয় তাঁর দোয়াতেই সেঞ্চুরি করতে পেরেছি।
তৃতীয় সেঞ্চুরিটা কি পরের সিরিজেই হয়ে যাবে?
সেঞ্চুরি তো বলে-কয়ে হয় না। চেষ্টা করতে হবে। যেহেতু টপ অর্ডারে ব্যাটিং করছি, সুযোগ থাকবে অনেক।
বোলিং, না ব্যাটিং—কোনটা করতে সবচেয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন?
ব্যাটিং। শুরু থেকেই আমি নিজেকে ব্যাটিং অলরাউন্ডারই ভাবতাম। বোলিংটা কখনো কখনো কাজে আসে। চেষ্টা করি দুটোতেই ভালো করার।
এবারের বিশ্বকাপে শেষ কয়েকটি ম্যাচে তেমন একটা বোলিং করেননি কেন?
নাসিরের প্রয়োজনীয়তাটা বেশি ছিল। আমিও চাইছিলাম আমার আগে যেন ওকে দেওয়া হয়। ঘরোয়া লিগে ওর ইকোনমিক রেট সবচেয়ে ভালো ছিল। আমি খুব খুশি যে ওকে সুযোগ দেওয়া হয়েছে আর ও সেটা কাজে লাগিয়েছে।
ডিন জোন্সসহ অস্ট্রেলিয়ার ধারাভাষ্যকারেরা আপনার বোলিংয়ের অনেক প্রশংসা করছিলেন...
তাই নাকি? আমি তো জানিই না!
হ্যাঁ। এদিকে আপনার ব্যাটিংটাও দারুণ হলো। আমরা কি তবে আরও একজন বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার পেতে যাচ্ছি?
সাকিব বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার, আমিও চেষ্টা করব। কষ্ট করছি যেন ব্যাটিং-বোলিং দুটোতেই দলের জন্য অবদান রাখতে পারি।
এবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলের ভালো করার মূল কারণ কী?
আমরা সারা বছর নিজেদের কন্ডিশনে লো বাউন্স পিচে খেলি। অস্ট্রেলিয়ায় বাউন্সের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া কঠিন। কিন্তু এখানে মাশরাফি ভাইয়ের অনেক অবদান ছিল। তিনি সব সময় বলতেন, যেকোনো পরিবর্তনের ক্ষেত্রে নতুনদের ভূমিকা অনেক বেশি থাকে। এই কথাটা নতুনদেরসহ সবাইকে অনেক অনুপ্রাণিত করেছে। আমাদের আত্মবিশ্বাস আর টিম স্পিরিট খুব ভালো ছিল। কষ্ট করছিলাম সবাই। এসব দলের মধ্যে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
এবার আমাদের ফিল্ডিং খারাপ হলো কেন?
এক-দুইটা ম্যাচে, বিশেষ করে মেলবোর্নে একটু সমস্যা হয়েছে। অভ্যাস খুব বড় একটা বিষয়। বিশ্বের বড় বড় দলেরই ওই মাঠে ফিল্ডিং করতে অসুবিধা হয়। আমাদের ফিল্ডিং কোচ একটা কথা বলেছিলেন, ‘ক্যাচ মিস করো, সমস্যা নেই। কিন্তু ক্যাচ মিস করার পর তোমার যদি মনোবল কমে যায়, তাহলে তুমি আবারও মিস করবে। মনোবল একই থাকলে অসাধারণ ক্যাচও ধরে ফেলতে পারবে।’
আপনার তো ভারতের সঙ্গে হ্যাটট্রিক সেঞ্চুরি করার সম্ভাবনা ছিল। কী ভেবে ক্রিজে নেমেছিলেন?
সেঞ্চুরির চিন্তা ছিল না। শুধু চিন্তা ছিল স্বাভাবিক ব্যাটিং করব। ২৫ ওভার পর্যন্ত এভাবে খেলতে পারলে ওখান থেকে রানের গতি বাড়ানোর লক্ষ্য ছিল। চেষ্টা করছিলাম পার্টনারশিপ লম্বা করার। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমি আউট হয়ে যাই। এক-দুইটা বড় পার্টনারশিপ হলে ভালো হতো।
ভারতের সঙ্গে ম্যাচে ওটা কি ভুল সিদ্ধান্ত মনে হয়েছে?
আমারটা বলতে পারছি না। তবে রুবেলের ওই নো বলের সিদ্ধান্তটা তো ছিলই...
যখন বুঝতে পারেন আম্পায়ার একটি ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তখন নিজেকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন?
শুরুতে একটু খারাপ লাগে। কিন্তু এটা খেলারই অংশ। মেনে নিতেই হবে। আম্পায়ারের ওপরে কথা বললে তো আবার জরিমানা করবে।
আপনার চোখে প্রতিপক্ষ হিসেবে সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাটসম্যান ও বোলার কে?
কুমার সাঙ্গাকারা। তাঁর ফুটওয়ার্ক খুব ভালো। অনুমানও ভালো। কোন বলটি আস্তে বা জোরে করব, সেটি বুঝতে পারেন। আর আমার কাছে কোনো বোলারই সে রকম ভয়ংকর মনে হয়নি, কিন্তু আজমলের বল খেলতে একটু সমস্যা হয়।
আপনার উইক জোন ও স্ট্রং জোন কোনটা?
আমার উইক জোন অনেক। আরও উন্নতি করতে হবে। শারীরিক ও মানসিকভাবে আরও কষ্ট করতে হবে। স্কিলওয়াইজ ব্যাটিং, বোলিং ও ফিল্ডিং—তিন জায়গাতেই কাজ করার সুযোগ আছে। আর স্ট্রং জোন... বল অফ স্টাম্পের বাইরে পেলে খেলতে সুবিধা হয়।
কার বলে রান পেলে বা কাকে আউট করলে বেশি আনন্দ লাগে?
এই রকম কেউ নেই। যে-ই সামনে আসুক, আমি তাকেই ফেস করব, এটাই আমার চিন্তা থাকে।
ফর্মে না থাকলে কী করেন?
ফর্মে না থাকলে অনেক চিন্তা মাথায় ঘোরে। তখন খেলাটাকে যত সহজভাবে নেওয়া যায়, তত ভালো। সমালোচনায় মাথা না ঘামিয়ে সহজভাবে খেলা চালিয়ে যাওয়া উচিত।
তামিম ইকবালের খারাপ সময় যাচ্ছে। কোনো সতীর্থের এমন দুঃসময়ে আপনি কী করেন?
আমার মনে হয় ও যতটুকু না খারাপ করছে, সমালোচনাটা তার চেয়ে বেশি হচ্ছে। ও ইনজুরি থেকে ফিরেই পাকিস্তানের সঙ্গে অনুশীলন ম্যাচে ভালো করল। স্কটল্যান্ড হোক বা পাড়ার টিম হোক ৩২০+ চেজ করা হাসিঠাট্টার বিষয় নয়। তামিমের ৯৫ রানের ইনিংসটা আমাদের সবার মধ্যে আত্মবিশ্বাস দিয়েছে। ও অনেক ম্যাচিউরড। ও এসব নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে নিজের কাজ নিয়ে চিন্তা করে। ও খুবই পরিশ্রমী। ফিটনেস নিয়েও অনেক সচেতন। আমরা সমালোচনা করতে গিয়ে যেন আবর্জনা ছুড়ে না মারি।
নিউজিল্যান্ডে তো অনেক পোকা ছিল...
হ্যাঁ! ওরে আল্লাহ (হাসি)! আমি ব্যাটিংয়ে নামছি, আরে! কী হচ্ছে এগুলো!? সৌম্য ওপাশ থেকে বলে, ‘রিয়াদ ভাই, কী হচ্ছে এগুলো?’ আম্পায়ার ধর্মসেনাকে বললাম, ‘এভাবে তো ব্যাটিং করা যায় না’, উনি বললেন, ‘কী করব? এভাবেই খেলতে হবে।’ পরে আরেক আম্পায়ার আলিম দারের ঘাড়ে দিল কামড়! ধর্মসেনাকেও দিয়েছিল। আমি শুধু মুখটা ছাড়া সারা গায়ে স্প্রে দিয়েছিলাম, টি-শার্টের ভেতরে যে স্কিনস, তার ভেতরেও। কিন্তু ব্যাটিং করে এসে স্কিনস খুলে দেখি গায়ে বেশ কয়েকটা মরা পোকা লেগে আছে। ওই দিন খুব কষ্ট হয়েছিল।
কখনো ম্যাচ ফিক্সিংয়ের অফার পেয়েছেন?
এ পর্যন্ত পাইনি। কাউকে এমন প্রস্তাব দেওয়া হলে সোজা বোর্ডকে জানানোর নিয়ম। বোর্ড আইসিসিকে আর আইসিসি দুর্নীতি দমন বোর্ডকে জানাবে। আমাদের খেলোয়াড়েরা এ ব্যাপারে সতর্ক। অনেকেই অটোগ্রাফ নিতে বা ছবি তুলতে চায়। কারও সঙ্গে কথা বলছি, সে হয়তো একজন বুকি। আমি জানি না কিন্তু আকসু জানতে পারে ঠিকই। তাই জিনিসগুলো নিয়ে আমরা এখন অনেক সতর্ক।
আপনি নাকি আপনার শ্বশুর-শাশুড়ির প্রিয় জামাই। বাংলাদেশের মানুষের প্রিয় খেলোয়াড় হয়েছেন ভালো খেলে, কিন্তু শ্বশুরবাড়িতে প্রিয় জামাই হয়ে উঠলেন কী গুণে?
জানি না। তাঁদের জিজ্ঞেস করতে হবে। ওনারা বেশ স্নেহ করেন আমাকে। আমিও চেষ্টা করি তাঁদের সঙ্গে বিনীত থাকতে, শ্রদ্ধা করতে।
এক বনে নাকি দুই বাঘ থাকতে পারে না। অথচ আপনি আর মুশফিকুর রহিম একই পরিবারে বিয়ে করেছেন। বিষয়টা কেমন?
কখনো উপভোগ্য, আবার কখনো খুবই... খুবই... (হাসি)। আসলে বিয়ের আগেও মাঠের বাইরে আমি আর মুশি খুব ঘনিষ্ঠ ছিলাম। আমরা যে আত্মীয়, সেটা মাঠে কখনো মাথায়ই আসে না। মাঠের বাইরে পারিবারিক কোনো বিষয়ে কথা বলতে হলে আমরা আলোচনা করি। না হলে এ বিষয়ে মাথা ঘামাই না।
আপনি মিষ্টি খেতে খুব ভালোবাসেন, কিন্তু নিজেকে ফিট রাখতে নাকি ছয় মাস মিষ্টি খাননি?
ঠিক, আমি খুব মিষ্টিপ্রেমী হলেও তখন একদমই খাইনি। আমার স্ত্রী খুব ভালো গাজরের হালুয়া বানাতে পারে। বিরিয়ানি খুব পছন্দ করি। আম্মুর বানানো পায়েস আমার খুব প্রিয়। এগুলো সব খাওয়া বাদ দিয়েছিলাম। এবার আসার পর বলেছিলাম, বিরিয়ানি খাব, খিচুড়ি খাব, পোলাও খাব, রোস্ট-এটা-সেটা-মিষ্টি যা আছে সব খাব। তো কাল (২৯ মার্চ) আমার দিন শেষ। গত রাতে স্ত্রীকে বলছিলাম যে কাল পর্যন্ত যা রান্না করার করো। এরপর আমি আর খাচ্ছি না।
সাধারণ জীবনটা কি মিস করেন?
আমি খুব সাধারণভাবেই জীবন যাপন করতে চেষ্টা করি। বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হলে গল্পগুজব করি। তবে মিস করি আগের সময়টা। তখন খুব মজা ছিল। এখন অন্য রকম জীবন। এটাও ভালোই লাগে।
নানা সময় আপনাকে নানা পজিশনে, এমনকি আট নম্বরেও খেলতে হয়েছে। আপনি কি ব্যাটিং অর্ডার নিয়ে সন্তুষ্ট?
এ মুহূর্তে আমি খুব খুশি। চার নম্বরে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছি। চেষ্টা করব এখানে যেন আরও ধারাবাহিক হতে পারি। অন্য পজিশনে দেওয়া হলে সেখানেও সেরাটা খেলতে চেষ্টা করব।
ইংল্যান্ডের সঙ্গে ম্যাচসেরা হলেন, কিন্তু বেশি আলোচনা হলো রুবেল হোসেনকে নিয়ে। লাইমলাইটে না আসার কারণ কী?
আমি এসব নিয়ে একদম চিন্তিত না। তবে আমার মনে হয়, ওই ম্যাচে রুবেলের অবদানটা আমার চেয়ে বেশি। যদি ওই দুইটা উইকেট না পড়ত, তাহলে আমার শতকের কোনো মূল্য থাকত না। মুশি দারুণ ব্যাটিং করেছে, সৌম্য ৫০ করেছে। সবারই অবদান আছে।
আপনার মতে বাংলাদেশের সেরা অধিনায়ক কে?
এখন পর্যন্ত মাশরাফি ভাই।
মাশরাফি বিন মুর্তজার অধিনায়কত্ব কি একটু বেশিই রক্ষণাত্মক নয়?
না, এটা নির্ভর করে উনি কীভাবে চিন্তা করছেন তার ওপর। তাঁর তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেওয়া লাগে। মাঠে সাকিব-তামিম-মুশিসহ আমরা যারা সিনিয়র খেলোয়াড় আছি, তাদের সঙ্গে আলোচনা করে উনি সিদ্ধান্ত নেন। ক্রিকেটে অধিনায়কত্ব বেশ কঠিন বিষয়। খুব করিতকর্মা হতে হয় তাঁকে। অনেক সময় ভুল সিদ্ধান্ত হতে পারে। ক্রিকেটে এসব খুব স্বাভাবিক। আর মাঠের বাইরেও ম্যাশকে আমি ১০০-তে ১০০ দেব। উনি খেলোয়াড়দের উজ্জীবিত করেন। সবার সঙ্গে, বিশেষ করে তরুণ খেলোয়াড়দের সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলেন। অধিনায়কের ভালো কথা যেকোনো খেলোয়াড়ের কাছে অনেক অনুপ্রেরণাদায়ক।
আপনি নিজেও তো বিভিন্ন পর্যায়ে অধিনায়ক ছিলেন, জাতীয় দলের সহ-অধিনায়ক ছিলেন। আপনার অধিনায়কত্বে আপনি কোন বিষয়টাকে গুরুত্ব দেন?
আমি সব সময় যেটা অনুভব করি, সেটাই করি। এ পর্যন্ত এটি বেশ কাজেও দিয়েছে। খেলোয়াড়দের সব সময় চাপে রাখা উচিত না। বুঝতে হবে কোন খেলোয়াড়কে কীভাবে সামলানো যায়। কাউকে হয়তোবা বকা দিয়ে, কাউকে ভালো আর অনুপ্রেরণামূলক কথা বলে সেরাটা আদায় করা যায়।
আপনার প্রিয় খেলোয়াড় কে?
ধোনিকে খুব ভালো লাগে। বিশেষ করে তাঁর শান্তশিষ্ট স্বভাবের জন্য। তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আপনি এই ১০০ কোটি মানুষের চাপ নিয়ে মাথা ঘামান না? শান্ত থাকেন কীভাবে?’ উনি বললেন, ‘আমি শুধু চিন্তা করি আমার দায়িত্ব নিয়ে। এর বাইরে আমি কিছু চিন্তা করি না।’ এটা আমার খুব ভালো লেগেছে।
আপনি কি স্লেজিং করেন?
নাহ্! আমরা তো খুব ভদ্র দল (হাসি)। আমরা অমায়িক।
কিন্তু স্লেজিং কি কাজে দেয়?
এটা নির্ভর করে। আমরা তো খেলা নিয়েই ব্যস্ত থাকি, এগুলো নিয়ে মাথা ঘামাই না।
কখনো স্লেজিংয়ের শিকার হয়েছেন?
ব্রেন্ডন টেইলরের সঙ্গে একবার হয়েছিল। আমি আবার জবাব দিয়েছিলাম। জবাব দেওয়াটা ঠিক হয়নি। আমি খুব একটা জবাব দিই না। কেউ বললে বলুক। টেইলর গালি দিয়েছিল। আমি বলেছি, ‘তুমি তোমার কাজ করো। তুমি তো আজকে রান করতে পারোনি, চুপ থাকো।’ (হাসি)।
আপনার ছেলে রায়ীদ কি ক্রিকেট খেলা বোঝে?
ওর বয়স দুই বছর আট মাস। ও খেলা ভালোই বোঝে। বাউন্ডারি-ছক্কা সবই। আমি যখন বাসায় যাই, ও আমার ব্যাট-গ্লাভস সব বের করে নেড়েচেড়ে দেখে। আমার ব্যাট অনেক ভারী বলে ওর জন্য অস্ট্রেলিয়া থেকে ছোট ব্যাট কিনে এনেছি। কিন্তু ও ওটা না নিয়ে আমারটা নিয়েই থাকে।
জীবনের স্মরণীয় ম্যাচ কোনটি?
২০১১ এবং এবারের বিশ্বকাপের বাংলাদেশ বনাম ইংল্যান্ডের ম্যাচ দুটি। তবে এই বিশ্বকাপেরটা বেশি স্পেশাল।
পরবর্তী বিশ্বকাপে সরাসরি খেলতে হলে নাকি র্যাংকিংয়ে প্রথম আটের মধ্যে থাকতে হবে। র্যাংকিংয়ে এগিয়ে যাওয়ার জন্য তাই ছোট দলগুলোর সঙ্গে খেলা উচিত না?
না। আমরা এখন যে পর্যায়ে আছি, সেখানে খুব ভালো কিছু করার সুযোগ আছে। সামনে পাকিস্তান, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়া—চারটা বড় সিরিজ। আমরা কত ভালো দল, এই সিরিজগুলোতে তা বিশ্বকে দেখিয়ে দেওয়ার সুযোগ আছে। আমাদের কন্ডিশনে আমরা খুবই ভালো দল। বিশ্বকাপের পারফরম্যান্সও আত্মবিশ্বাস জোগাবে। শুধু খেয়াল রাখতে হবে, আমরা ধারাবাহিকভাবে যেন ভালো খেলতে পারি।
জাতীয় দলে সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু কে?
মেহরাব জুনিয়র। শাহরিয়ার নাফীস, আরাফাত সানি আর আমি একসঙ্গে অনূর্ধ্ব-১৫ দলে খেলেছি। সানির সঙ্গে আমি খেলার বাইরে অনেক কথাই শেয়ার করি।
শৈশব-কৈশোরের বন্ধুদের সঙ্গে কি এখনো যোগাযোগ আছে?
ফোনে যোগাযোগ হয়। এ মুহূর্তে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড আমার স্ত্রী। খেলা থাকলে তেমন একটা সময় দেওয়া হয় না। তাই খেলার বাইরে পরিবারের সঙ্গেই সময় কাটাতে পছন্দ করি। স্কুলের তিন-চারজন কাছের বন্ধুর সঙ্গেও দেখা হয়।
জাতীয় দলের কোন মজার ঘটনাটি সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে?
একবার প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে খেলা। খুব রোদ। প্রায় ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা। রবিউল থার্ডম্যানে ফিল্ডিং করছিল। বল গেল তার দিকে। হঠাত্ সে থেমে গিয়ে রোবোকপের মতো নড়া শুরু করে। ওর আসলে মাংসপেশিতে টান পড়েছিল। সেটা দেখে সবাই হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাওয়া শুরু করে।
ক্রিকেটকে পেশা হিসেবে নেওয়ার লক্ষ্য কখন ঠিক করা উচিত?
যেকোনো সময় খেলা শুরু করতে পারো। আমি ক্রিকেটার হওয়ার জন্য না, ভালোবেসে খেলেছি, পরে পেশা হিসেবে নিয়েছি। ছোটবেলায় পড়াশোনা করতাম, ক্রিকেটও খেলতাম। ক্রিকেট আর পড়াশোনা দুটোই একসঙ্গে ভালোভাবে চালিয়ে যাওয়া কঠিন। একটার জন্য আরেকটা বিসর্জন দিতে হয়। তাই এখন পড়াশোনা করার পাশাপাশি ভালোবেসে খেলে যাও। পরে সুযোগ হলে পেশা হিসেবে নেবে।
কিশোর যারা ক্রিকেটার হতে চায়, তাদের প্রতি আপনার পরামর্শ কী?
যা খেতে মন চায় খাও। ফাঁকিজুকির কাজ যেন না করো। যেকোনো কাজই সততার সঙ্গে করো।
দর্শকদের কাছে প্রত্যাশা কী?
ভালো-খারাপ সব সময় যেন আমাদের পাশে থাকে। আমরা খুব ক্রিকেটপাগল জাতি। অনেক রিকশাওয়ালা রিকশা চালানো রেখে খেলা দেখেন। খুব মন ছুঁয়ে যায় যে একজন মানুষ তাঁর জীবিকা রেখে আমাদের খেলা দেখেন। তাই আমরা সব সময় চেষ্টা করি। এখন আরও বেশি চেষ্টা করব।
কৃতজ্ঞতা: বিনস অ্যান্ড অ্যারোমা
(কিশোর আলোর এপ্রিল ২০১৫ সংখ্যায় প্রকাশিত)
সাক্ষাৎকার দলের পাঁচজন ছাড়াও আরও যাদের প্রশ্ন নির্বাচিত হয়েছে—অদিতি বৈরাগী, অরিত্রা দাশ, আফরা ইবনাত, আফরিনা আসাদ, আহমেদ ইমরান হালিমী, আতকিয়া মাইশা, বেলাল হুসাইন, ফাহমিদ মুনতাসির, ফারভেজ মোশাররফ, ফুয়াদ আরমান, হা-মীম জুলফিকার, হাসান আল ফেরদৌস, ইসাবা শুহ্্রাত, ইসতিয়াক হোসেন, জিতু আহাসান, কাজী ফারহিন ইসলাম, লাইবা তাবাসসুম, মাহফুজুর রহমান, মারজুকা আহমেদ, মাশায়েখ হাসান, নাহিয়ান হাবিব, নশিন তাবাসসুম, নওশিন ইবনাত, নুরুল করিম, রাফিউস সালেহীন, রাইসা তাহসিন, রাশেদ মজুমদার, রিয়াহিনাল ফারুক, সাব্বির আহমাদ, সাদেকীন হায়দার, সাদিয়া তাসনিম, সাদীয়া ইসলাম, সাইরা তাসফিয়া রশীদ, সামিয়া ইসলাম, সাইয়েদুল আবরার, শাফকাত হোসেন, শাহাদাত্ হোসেন, সারিকা আকরাম, শ্রুতি খীসা, সুমাইয়া সাদিক, সুপ্রীতি মালাকার, সৈয়দা আশফাহ্ তোয়াহা, তানজিলা সুলতানা, তারিকুল হাসান, তাসফিয়া নিশাত, তাসফিয়া তাবাসসুম, তাসমিয়া বিনতে তারেক, তাসমিমা ইসলাম, ইউশরা জাহান ও জাহিদুল ইসলাম।