‘এত নির্জন কেন জায়গাটা?’ রবিন মিলফোর্ড বলল। ‘একেবারে আদিম! মনে হচ্ছে মধ্যযুগে চলে এসেছি!’
‘সে জন্যই তো যাচ্ছি,’ হেসে জবাব দিলেন রবিনের মা মিসেস মিলফোর্ড। ‘তোমার বাবার সঙ্গে আলোচনা করেই এখানে আসব ঠিক করেছি। উপকূলের বাড়িগুলোর কাছ থেকে সরাইখানাটা দূরে। সবচেয়ে কাছের এয়ারপোর্টটাও পঞ্চাশ মাইল দূরে। তবে ভারি সুন্দর। নির্জনে বসে সাগর দেখার এত সুন্দর জায়গা আর হয় না।’
স্টেশন ওয়াগন গাড়িটার পেছনে বসেছেন মা-ছেলে।
ড্রাইভিং সিটে মুসা। গাড়ি চালাচ্ছে। তার পাশে কিশোর।
জানালা দিয়ে বাইরের নির্জন রাস্তাটার দিকে তাকিয়ে আছে রবিন। সাগরের তীর ঘেঁষে চলে গেছে।
কিছুক্ষণ পর নাক-বরাবর সামনে পাহাড়ের একটা চূড়া দেখা গেল। ঠিক মাথার ওপর বসে আছে সাদা রঙের বাড়িটা। রবিন জিজ্ঞেস করল, ‘ওটা নাকি!’
‘হ্যাঁ,’ জবাব দিলেন মিসেস মিলফোর্ড। ‘ওটাকে প্রেসিডেন্টস ইন নামে চেনে লোকে। প্রেসিডেন্ট ইউলিসিস এস. গ্র্যান্ট আর থিওডোর রুজভেল্ট, দুজনেই নাকি বেড়াতে এসেছিলেন এখানে।
‘সত্যি সুন্দর!’ কিশোর বলল। ‘একেবারে ছবির মতো!’
রাস্তা থেকে মোড় নিয়ে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উঠে যেতে লাগল গাড়ি। কয়েক মিনিট পর গাড়ি পার্ক করল মুসা। সবাই নামল গাড়ি থেকে।
বিলাসবহুল পুরোনো বাড়ি। সামনে ছড়ানো লন। অসংখ্য ফুল ফুটে আছে বাগানে। গোধূলির আবছা আলোয় এখনো রং বোঝা যাচ্ছে কিছু কিছু ফুলের।
‘একেবারেই সরাইখানার মতো লাগছে না,’ মুখ উঁচু করে দেখতে দেখতে বলল কিশোর। ‘আগে বোধ হয় কোনো ধনী লোকের বাড়ি ছিল এটা। সংস্কার করে এখন সরাইখানা বানানো হয়েছে।’
‘হয়তো,’ মুসাও তার সঙ্গে একমত হলো।
রবিন বলল, ‘সুন্দর। তবে ভুতুড়ে। গা ছমছম করে।’
মুসার দিকে তাকাল কিশোর। মুসার বাড়িটাকে ভুতুড়ে লাগছে না, রবিনের লাগছে। এর চেয়ে অস্বাভাবিক আর কী হতে পারে!
রবিনের দিকে ফিরে হাসল কিশোর, ‘আসলে ক্লান্ত হয়ে গেছো।’
জবাব দিল না রবিন। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে বাড়িটাকে।
কিছুদিন থেকে অস্বাভাবিক কথাবার্তা বলছে সে। অনেক আগে মাথায় বাড়ি খেয়েছিল একবার। ‘রুপালি মাকড়সা’ কেসে। কিছুক্ষণের জন্য বেহুঁশ হয়ে গিয়েছিল। সেই সময়টুকু চিরকালের জন্য মুছে গিয়েছে তার স্মৃতি থেকে। ডাক্তার মনে করছেন মাথায় বাড়ি খাওয়ারই জের এখনকার এই অস্বাভাবিক আচরণ। নিরালা জায়গায় চেঞ্জে পাঠালে ঠিক হয়ে যেতে পারে ভেবে কোথাও নিয়ে যেতে বলেছেন রবিনের মাকে। সে জন্যই এই নিরালা সরাইখানায় আসা।
পায়ের শব্দে ফিরে তাকাল সবাই।
বারান্দা দিয়ে নেমে এল বাদামি চামড়ার একজন লোক। বিষণ্ন চেহারা। মাথায় ঝাঁকড়া কালো চুল। মোটা ভুরু।
কাছে এসে লোকটা বলল, ‘ওয়েলকাম টু দা প্রেসিডেন্টস ইন। আমার নাম হ্যারল্ড। আমি এখানকার বেলবয়। আসুন, প্লিজ।’ বিশাল থাবার মতো হাত দিয়ে গেস্টদের স্যুটকেস তুলে নিল।
আগে আগে হেঁটে মেহমানদের লবিতে নিয়ে এল হ্যারল্ড। ওখানে দেখা হলো সরাইখানার মালিকের সঙ্গে। মেহমানদের দেখে চেয়ার থেকে উঠে হাত বাড়িয়ে দিলেন তিনি।
‘রুয়ান জনসন,’ বললেন তিনি। ছিপছিপে শরীর। ‘নিউ ইংল্যান্ডে জন্ম, ওখানেই বড় হয়েছি। ওয়েলকাম টু দ্য প্রেসিডেন্টস ইন। কেমন আছেন, মিসেস মিলফোর্ড।’
ঘরের ভেতরটা খুঁটিয়ে দেখছে রবিন। কাঠের প্যানেলিং করা ঘর। চকচকে পালিশ। ছাত ধরে রেখেছে ভারী কাঠের কড়িবর্গা। নরম আলোয় অন্য রকম লাগছে ঘরটাকে।
‘কাঁটায় কাঁটায় সাতটায় ডিনার।’ রেজিস্টারে সই করা শেষ হলে বললেন, ‘হ্যারল্ড আপনাদের ঘর দেখিয়ে দেবে।’
বিষণ্ন চেহারার লোকটা এগিয়ে এল। পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল মেহমানদের। সুন্দর, ঘোরানো সিঁড়ি। দোতলার ল্যান্ডিংয়ে রয়েছে পুরোনো ধাঁচের আমেরিকান ফার্নিচার, এমনকি একটা সাত ফুট লম্বা গ্র্যান্ডফাদার ক্লকও রয়েছে।
‘দেখো!’ একটা অ্যান্টিক মাড়াইকল দেখাল কিশোর। ‘এ রকম জিনিস আর দেখিনি।’
‘আমেরিকার গৃহযুদ্ধের আগের জিনিস,’ হ্যারল্ড জানাল।
দোতলায় এসে মিসেস মিলফোর্ডকে ১২ নম্বর ঘরটা দেখিয়ে দিল। ‘ম্যাডাম, আপনার ঘর।’
পাশে আর একটা ঘরই আছে, দোতলার ডান পাশের শেষ ঘর।
১৩ নম্বর।
তিন গোয়েন্দাকে বলল, ‘এটা তোমাদের।’
কিশোর দেখল, ওদের ঘরটার দরজায় লকওয়ালা নব তো আছেই, বাড়তি একটা হ্যাচবোল্টও আটকানো। বড় একটা তালা ঝুলছে তাতে।
১২ নম্বরে, রবিনের মায়ের ঘরটায় ঢুকে দেখা গেল, একটা বড় বাথরুম রয়েছে, যেটা দিয়ে ১৩ নম্বরে ঢোকা যায়। দুই ঘর থেকেই ঢোকা যায় এই বাথরুমটায়। ১৩ নম্বরের তালা খোলার অপেক্ষায় না থেকে ওই বাথরুম দিয়েই নিজেদের ঘরে ঢুকে পড়ল তিন গোয়েন্দা।
ঘরটা বিশাল। দুই দিকের দুই দেয়াল ঘেঁষে দুটো খাট। একটা ডাবল, আরেকটা সিঙ্গল। প্রচুর বাতাস খেলে ঘরটায়। জানালা দিয়ে সাগর দেখা যায়।
ওটার কাছে এসে দাঁড়াল কিশোর। চেঁচিয়ে উঠল, ‘দারুণ, দারুণ!’
বাইরে থেকে ঘরের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল হ্যারল্ড। ‘সুন্দর, না? একটা কথা শুনে নিশ্চয় ভালো লাগবে তোমাদের, এই ঘরটার উদ্বোধন তোমরাই করলে। বাড়িটাকে হোটেলে রূপান্তরিত করার পর এই প্রথম ঘরটা খোলা হলো, গেস্ট থাকতে দেওয়া হলো।’
ভুরু কুঁচকে কিশোর বলল, ‘তাই নাকি? খুব ভালো।’
মাথা ঝাঁকাল হ্যারল্ড। ‘আশা করি ভালোই থাকবে এখানে। আর...কোনো সমস্যা হলেই ডাকবে আমাকে। তোমাদের কাছাকাছিই থাকব। বেশি দূরে যাব না।’ সামান্য দ্বিধা করে, কিছু বলতে চেয়েও বলল না সে, চলে গেল।
পরস্পরের দিকে তাকাল তিন গোয়েন্দা।
‘এর মানে কী?’ রবিনের প্রশ্ন। ‘লোকটা কী বোঝাতে চাইল?’
‘জানি না। তবে মনে হলো সতর্ক করতে চাইল আমাদের। শুনলে না, এই প্রথম গেস্টদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে, সরাইখানা হওয়ার পর থেকে বন্ধ ছিল,’ কিশোর বলল।
ভয় পেয়ে গেল মুসা। ‘কেন, ভূত আছে নাকি?’
‘থাকলে অবাক হব না,’ মাথা নাড়াল রবিন। ‘শুরু থেকেই বাড়িটাকে ভুতুড়ে লাগছিল আমার।’
মুসার হঠাৎ মনে হলো, তার নিজেকে সামলাতে হবে, ‘ভূত-ভূত’ করে রবিনের বর্তমান মানসিক অবস্থায় আশঙ্কাটা তার মধ্যেও ঢুকিয়ে দেওয়াটা ঠিক হবে না। তাড়াতাড়ি বলল, ‘আমার কিন্তু তা মনে হচ্ছে না। চমত্কার, খোলামেলা। জানালা দিয়ে সব সময় রোদ আসে। তবে হ্যাঁ, দীর্ঘদিন বন্ধ থাকাতে একটা ভাপসা গন্ধ আছে। খোলা থাকলেই চলে যাবে।’
‘ঠিকই বলেছ,’ জানালার কাছে দাঁড়িয়ে কিশোর বলল। ‘খুব সুন্দর জায়গা। রবিন, এসো, দেখে যাও। এখানে দাঁড়িয়ে শুধু প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার করে দেওয়া যায়।’
কিশোরের পাশে এসে দাঁড়াল রবিন আর মুসা। বাইরে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেল। তিনতলায় রয়েছে ওরা। বাড়ির একেবারে কিনার থেকে নেমে গেছে খাড়া পাহাড়ের দেয়াল। ওদের এক শ ফুট নিচে সাগরের ঢেউ আছড়ে পড়ছে পাথরভরা বালুর সৈকতে। বড় বড় ঢেউ ছুটে এসে পাথরের চাঙড়ে বাড়ি খেয়ে ফোয়ারার মতো পানি ছিটকে উঠছে শূন্যে। বাড়িটা এমন জায়গায় বানাল কীভাবে, ভেবে অবাক লাগল মুসার।
‘সত্যি,’ কিশোর বলল, ‘একটানা তাকিয়ে থাকলে কেমন যেন লাগে।’
‘মাথা ঘুরে ওঠে,’ রবিন বলল। ‘তবে সুন্দর, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।’
তামার তৈরি ফগহর্নের বিষণ্ন বিলাপের মতো আর্তনাদ কানে এল ছেলেদের। দূরে সাগরের বুকে ভারী কুয়াশা দেখা গেল। ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে তীরের দিকে। একটা লাল-সাদা রং করা ডোরাকাটা লাইট হাউস দাঁড়িয়ে আছে হোটেলের উত্তরে, তীর থেকে সাগরের মাঝে ঠেলে বেরোনো আঙুলের মতো জায়গাটায়।
জানালার বাইরের স্বপ্নলোক থেকে জোর করে নিজের দৃষ্টিকে ছাড়িয়ে আনল কিশোর। সঙ্গীদের ডাকল, ‘এসো, ব্যাগ থেকে আমাদের জিনিসপত্রগুলো খুলে গুছিয়ে ফেলি। ডিনারের আগে গোসল করে নিতে চাই।’
ঠিক এই সময় দরজায় টোকা পড়ল। দরজা খুলে দিল মুসা। দিয়েই চমকে পিছিয়ে গেল।
একজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। জানাল, সে এই হোটেলের পরিচারিকা।
তার দিকে তাকিয়ে রইল রবিন। হাসি ঠেকাল কষ্ট করে। মহিলা দেখতে সিনেমায় দেখা ওজের জাদুকরের পুব দিকের ভালো ডাইনির মতো। হাতের ঝাড়ুটাও সে রকম।
ওপরের পাটির একটা দাঁত নেই মহিলার। মাথায় পুরোনো আমলের ক্যাপ। খড়ের মতো খাড়া খাড়া চুল বেরিয়ে আছে ক্যাপের তলা দিয়ে। কথা বলতে গেলে কেমন চিঁ-চিঁ আওয়াজ বেরোয়।
‘আমার নাম ককনিয়া,’ ঘরে ঢুকে মহিলা জানাল।
পুরোনো আমলের ডাইনিদের এমন নামই থাকত, ভাবল রবিন।
‘আমি তোমাদের ঘর পরিষ্কার করতে এসেছি,’ ককনিয়া বলল। ‘তোমাদের কি বাড়তি তোয়ালে লাগবে, কিংবা অন্য কোনো কিছু?’
‘আপাতত লাগবে না। দরকার হলে জানাব। থ্যাংক ইউ,’ জবাব দিল কিশোর।
মাথা ঝাঁকাল মহিলা। যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়াতে গিয়ে থেমে ফিরে তাকাল। ‘আমার মনে হয় এখানে ভালোই থাকবে তোমরা। কী বলো?’
কিশোর জিজ্ঞেস করল, ‘কেন, খারাপ থাকার সম্ভাবনা আছে নাকি?’
‘না না, তা না, এমনি বললাম!’ বলে দ্রুত হেঁটে চলে গেল ককনিয়া।
আস্তে করে দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে এল মুসা।
‘সবাই এমন উদ্বিগ্ন কেন আমাদের নিয়ে?’ বলে উঠল রবিন।
‘সত্যিই অদ্ভুত!’ কিশোর বলল। ‘দেখি, হয়তো, ডিনারের সময় জানতে পারব।’
সাতটা বাজার কিছুক্ষণ আগে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে মায়ের ঘরের দরজায় টোকা দিল রবিন। কিশোর আর মুসা তার পেছনে দাঁড়ানো।
‘আসছি,’ সাড়া দিলেন মিসেস মিলফোর্ড।
কয়েক সেকেন্ড পর তিনি বেরিয়ে এলে, চারজনে মিলে ডাইনিং রুমে চলল।
ডাইনিং রুমে প্রত্যেকের জন্য চেয়ার সাজিয়ে রেখেছেন রুয়ান। লম্বা টেবিলের মাথায় বসে আছেন তিনি। কিশোররা টেবিলের একপাশে বসল। অন্য পাশে বসেছে চারজনের আরেকটা পরিবার—মা, বাবা আর তাদের দুই মেয়ে।
মেয়েগুলো টিনএজার, কিশোরদের সমবয়সী। দুই বোনের নাম স্যালি আর সিন্ডি। ওদের বাবার নাম মি. ফোল্ডার।
শিগগিরই সামুদ্রিক চিংড়ির স্টু আর সালাদ খেতে খেতে আলাপে ঢুকে পড়ল সবাই। চমত্কার রান্না। দারুণ স্বাদ। আর অসাধারণ সুন্দর পরিবেশ।
‘এই, তোমাদের সঙ্গে মেইড ককনিয়ার দেখা হয়েছে?’ নিচু স্বরে রবিন জিজ্ঞেস করল সিন্ডিকে।
স্যালি বলল, ‘মনে হলো, ঝাড়ুতে ভর করে জানালা দিয়ে উড়ে যাবে।’
হেসে উঠল সিন্ডি। ‘স্যালি তো ডাইনি ভেবে ভয়েই অস্থির, আরেকটু হলেই মরে যাচ্ছিল।’
‘তবে, দেখতে যা-ই হোক,’ রবিন বলল, ‘মহিলাটা খারাপ না।’
তার সঙ্গে সুর মেলাল মুসা, ‘তা ঠিক। তবে চেহারা আর পোশাক-পরিচ্ছদ কেমন আজব।’
‘জানো, বাড়িটাতে মনে হয় ভূত আছে,’ স্যালি বলল।
মুখ তুলে তাকাল কিশোর। ‘সবাই এমন ভূত-ভূত করছ কেন? ইচ্ছে করেই হয়তো ডাইনির পোশাক পরেছে ককনিয়া, গেস্টদের মজা দেওয়ার জন্য।’
‘কিন্তু আমাদের ঘরে ভূতের ওপর লেখা একটা বই পেয়েছি,’ স্যালি জানাল। ‘একজন ভূত গবেষণাকারী লিখেছেন বইটা। ভূতের ওপর অনেক তথ্য আছে তাতে।’
মুসার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে কিশোর বলল, ‘কি, মুসা, বইটা উল্টেপাল্টে দেখবে নাকি?’
শিউরে উঠল যেন মুসা। তাড়াতাড়ি হাত নেড়ে মানা করে দিল, ‘না না, বাবা, আমি ওসব ভূতের খবর জানতে রাজি না।’
কিন্তু রবিন আগ্রহ দেখাল। ‘দিয়ো তো, স্যালি, বইটা। পড়ে দেখব।’
এই সময় বোমা ফাটালেন রুয়ান, ‘তোমাদের ভয় দেখানোর জন্য বলছি না, আসলেই নানা রকম অদ্ভুত সব কাণ্ড ঘটে এখানে...’ একটু থেমে বললেন, যার কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে পাইনি।’
‘যেমন?’ রবিনের প্রশ্ন।
চট করে দৃষ্টি মুসার দিকে তাকাল কিশোর। এখানে এসে দেখা যাচ্ছে, ভূতের ব্যাপারে মুসার চেয়ে রবিনের আগ্রহ বেশি।
সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলেন না রুয়ান। মুখের খাবারটা আস্তে আস্তে চিবিয়ে গিলে নিয়ে বললেন, ‘একটা অদ্ভুত ঘটনা, যেটা এখানে নিয়মিত ঘটছে। ইচ্ছে করলে তোমরাও গিয়ে দেখতে পারো’
‘কী!’ এতক্ষণ আগ্রহী মনে হলো কিশোরকে। রহস্যের গন্ধ পেয়েছে।
‘এই বাড়িটা, শুরুতে সরাইখানা ছিল না। সরাইখানার মতো করে বানানোও হয়নি,’ রুয়ান শুরু করল। ‘এর মালিক ছিলেন জাহাজের এক ধনী ক্যাপ্টেন। পনেরো বছর বয়সে একটা চার-মাস্তুলের জাহাজের কেবিনবয় হিসেবে নাবিক-জীবনের শুরু তাঁর। অনেক বন্দর ঘুরে শেষে চীনের সাংহাইয়ে যেত জাহাজটা। সেখানে একটা দারুচিনিগাছের রহস্যময় ট্রাংক খুঁজে পায় তখনকার ওই কেবিনবয়। জাহাজে চাকরি করার সময় ওটাতে তার জিনিসপত্র রাখত। পরবর্তীকালে, এই বাড়ি বানানো হলে, ট্রাংকটা এখানে নিয়ে আসে। বাড়ির ওপরতলায় সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ে রয়েছে ওটা, ইচ্ছে করলে গিয়ে দেখতে পারো।’
‘দেখব,’ রবিন বলল। ‘কিন্তু ঘটনাটা কী?’
‘বলছি, বলছি, ধৈর্য ধরো।’ হাত উঁচু করলেন রুয়ান। ‘সবটা গোড়া থেকে না শুনলে বুঝতে পারবে না। চার-মাস্তুলের জাহাজটার ক্যাপ্টেন মারা গেলে সেই কেবিনবয় ছেলেটা জাহাজের ক্যাপ্টেন হন। তারপর একদিন ওটা বেচে দিয়ে আরেকটা মালবাহী জাহাজ কেনেন। জাহাজটার নাম উইন্ডজ্যামার। ১৮৮৫ সালের ফেব্রুয়ারির এক প্রচণ্ড ঝড়ের রাতে হাতির দাঁত নিয়ে আফ্রিকা থেকে বাড়ি ফিরছিলেন। ঝড়ের কবলে পড়ল জাহাজটা। প্রবল বৃষ্টির মধ্যে জাহাজটাকে নিরাপদে বন্দরে ভেড়ানোর চেষ্টা করতে লাগলেন তিনি। ইতিমধ্যেই ওটার একটা মাস্তুল ভেঙে গেছে। জাহাজের একজন নাবিক ম্যালেরিয়ায় অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে।’
‘বাপ রে! শুনেই ভয় লাগে!’ বলে উঠল সিন্ডি।
‘হ্যাঁ,’ মাথা ঝাঁকালেন রুয়ান। ‘সেবারে অভিযানের সবটাই ক্যাপ্টেনের বিপক্ষে যাচ্ছিল। পশ্চিম আফ্রিকার উপকূলে ম্যালেরিয়ায় কাহিল করে দিয়েছিল তাঁকেসহ বেশির ভাগ নাবিককেই। ফেরার পথে একের পর এক দুর্ঘটনায় মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন তিনি। একজন নাবিক জাহাজ থেকে সাগরে পড়ে নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিল। খাবার পানির পিপে ভেঙে জাহাজে বহন করা মালপত্র ভিজিয়ে নষ্ট করে দিয়েছিল। এত ধকল সহ্য করতে না পেরে প্রায় পাগল হয়ে গিয়েছিলেন ক্যাপ্টেন। নিচু স্বরে বিড়বিড় করে সারাক্ষণ কী যেন বলতেন।’
‘বেচারা,’ স্যালি বলল। ‘বাড়ি ফিরতে পেরেছিলেন?’
বিষণ্ন ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন সরাইয়ের মালিক। ‘নাহ্। আরও দুঃখজনক হলো, ওই রাতে তাঁর তরুণী স্ত্রী উইডোজ ওয়াকে গিয়েছিলেন, উইন্ডজ্যামারকে নিয়ে তাঁর স্বামী ফিরে আসছেন কি না দেখতে।’
‘উইডোজ ওয়াকটা কী?’ জানতে চাইল সিন্ডি।
‘বাড়ির ছাদে বানানো একটা ছোট ব্যালকনি,’ বুঝিয়ে বললেন রুয়ান। ‘সেকালে নাবিকেরা বাড়ি বানাত সাগরের পারে। উইডোজ ওয়াক থেকে তাদের স্ত্রীরা বহুদূরের সাগর দেখত, জাহাজ দেখত, দেখত তাদের স্বামীরা ফিরে আসছে কি না।’
‘অনেক নাবিকই ফিরতে পারত না, আর সে কারণেই ব্যালকনিগুলোর নাম হয়েছিল ওইডোজ ওয়াক, মানে বিধবার পায়চারি,’ রুয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল কিশোর, ‘তাই না?’
‘হ্যাঁ,’ রুয়ান বললেন। ‘যা-ই হোক, আমাদের ক্যাপ্টেনের স্ত্রী দেখতে পেলেন তাঁর স্বামীর জাহাজটার করুণ অবস্থা। প্রচণ্ড ঝড় উইন্ডজ্যামারকে ভেঙে শুধু তছনছই করে দেয়নি, সেই সঙ্গে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল এই ক্যাপ্টেন দম্পতির সুখ।’
‘জাহাজের কেউ কি বাঁচতে পারেনি?’ বিষণ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল সিন্ডি, তার মুখ দেখে মনে হলো ক্যাপ্টেন দম্পতির দুঃখে কেঁদে ফেলবে। ‘কয়েকজন বেঁচে ছিল,’ রুয়ান বললেন। ‘তারা জানিয়েছে, জাহাজটা পাথরের ওপর আছড়ে পড়েছিল, লাইট হাউসটার কাছে। তাড়াতাড়ি জাহাজ থেকে নামার নির্দেশ দেন ক্যাপ্টেন। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত জাহাজে ছিলেন তিনি, আহত আর অসুস্থ নাবিকদের নামতে সাহায্য করেছেন, যাতে জাহাজের ভাঙা ভাসমান কাঠ ধরে ভেসে এসে কোনোমতে তীরে উঠতে পারে নাবিকেরা। সবাই নেমে গেলে তিনি একা রয়ে গেলেন জাহাজে। সারা জীবনের অর্জন জাহাজটা ছেড়ে নামতে ইচ্ছে করছিল না তাঁর। ক্যাপ্টেনের অবস্থা তখন ভূতে পাওয়া মানুষের মতো। নিজের ভাঙা কেবিনে ফিরে এলেন। নতুন কেবিনটার এই পরিণতি তিনি সহ্য করতে পারছিলেন না। সেখানে বসে নিজের প্রিয় বাঁশিটা বাজাতে বাজাতে অন্তিম মুহূর্তের অপেক্ষা করতে লাগলেন। নাবিকেরা যারা শুনেছে, তারা বলেছে, এত মিষ্টি সুর নাকি ওরা কখনো শোনেনি। এমনকি, তীরে যেসব মানুষ ছিল তখন, সিকি মাইল দূরে, তারাও শুনেছে ঝোড়ো বাতাসে ভেসে আসা ওই বাঁশির সুর। জোরালো, পরিষ্কার।’
এক মুহূর্ত বিরতি দিয়ে আবার বললেন রুয়ান, ‘বৃষ্টিভেজা ওয়াকে পায়চারি করতে করতে ক্যাপ্টেনের স্ত্রী-ও শুনেছেন সেই বাঁশি। প্রচণ্ড হতাশা আর দুঃখে বারবার কিল মেরেছেন ব্যালকনির রেলিংয়ে, আর সমানে কেঁদেছেন। তিনি বুঝে গিয়েছিলেন তাঁর প্রিয় মানুষটা আর কখনো ফিরে আসবেন না। কারণ, স্ত্রীর চেয়েও জাহাজটাকে তিনি বেশি ভালোবাসেন।’
‘এই দেখুন, আমার লোম খাড়া হয়ে গেছে!’ হাত উঁচু করে লোম দেখাল সিন্ডি। হাতটাও কাঁপছে।
‘সবচেয়ে ভুতুড়ে অংশটা তো এখনো শোনোইনি,’ রুয়ান বললেন। ‘সেদিনের পর, প্রবল ঝড়ের রাতে নাকি বন্দরে থাকা নাবিকেরা এখনো সেই বাঁশির শব্দ শুনতে পায়, হলফ করে বলেছে তারা। ওরা বলে মৃত ক্যাপ্টেনের বাঁশির ভুতুড়ে মিষ্টি সুর সাগরের তলা থেকে উঠে আসে।’
শিউরে উঠল মুসা। ‘খাইছে! ভয়ানক ব্যাপার!’
মাথা ঝাঁকালেন রুয়ান। ‘আরও একটা ব্যাপার, ওই সময় সাগরে জাহাজে থাকা নাবিকেরা, আপাদমস্তক কালো কাপড়ে ঢাকা একটা মূর্তিকে এ বাড়ির ওয়াকে পায়চারি করতেও নাকি দেখে। ওরা বলে, হারানো স্বামীকে হাহাকার করে খুঁজে ফেরে ক্যাপ্টেনের স্ত্রীর প্রেতাত্মা, যাকে আর কোনো দিন খুঁজে পাবে না সে।’
রুয়ানের কথা শেষ হলে দীর্ঘ একটা মুহূর্ত চুপ করে রইল সবাই।
তারপর কিশোর জিজ্ঞেস করল, ‘কিন্তু এ কাহিনির সাথে সেই ট্রাংকটার সম্পর্ক কী, যেটা আপনি বলছেন এখন এ বাড়িতেই আছে?’
‘ও, সেই ট্রাংক,’ রুয়ান বললেন। ‘ওটা খুললে এখনো তাজা দারুচিনির গন্ধ পাওয়া যায়। তুমিও গিয়ে পরীক্ষা করে দেখতে পারো।’
খাওয়ার পর যার যার মতো উঠে গেল সবাই। কৌতূহলী হয়ে দুই সহকারীকে নিয়ে ওপরতলার সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ে উঠে এল কিশোর। হালকা রঙের একটা বাক্স দেখতে পেল ওরা। কোনাগুলো খাঁজ কেটে কারুকাজ করা। কবজাগুলো ড্রাগনের মুখের মতো করে তৈরি। বাক্সটার ওপরে বসার জন্য গদি বিছানো রয়েছে।
ডালা তুলতেই ঝাঁকি দিয়ে এসে ওদের নাকে লাগল দারুচিনির কড়া গন্ধ।
‘আশ্চর্য!’ গম্ভীর স্বরে কিশোর বলল। ‘এক শ বছর পর এই গন্ধ থাকারই তো কথা না। অথচ মনে হয় তাজা দারুচিনি রেখে দিয়েছে কেউ। আমার মনে হয়, এটা বুড়ো রুয়ানের কাজ। এর ভেতর এমন কিছু রেখে দিয়েছেন, যা থেকে গন্ধ বেরোয়।’
পকেট থেকে পেনসিল টর্চটা বের করে আলো ফেলে ভেতরে দেখল।
একটা বাঁশি পড়ে আছে।
অবাক হয়ে কিশোরের মুখের দিকে তাকাল রবিন। ‘এটা কার বাঁশি?’
‘বুঝলাম না,’ মাথা নাড়ল কিশোর। ‘রুয়ান তো কিছু বলেননি।’
মুসা বলল, ‘আমার মনে হয় ডিনারে বসার আগে এই গন্ধ স্প্রে করে গেছেন রুয়ান। চমক সৃষ্টি করার জন্য। সরাইখানায় নতুন অতিথি এলেই এই কাণ্ড করেন তিনি। তাদের গল্প শোনান। ট্রাংক দেখতে পাঠান।’ হাসল কিশোর। ‘প্রথমে গল্প বলে জমিয়ে নেন। তারপর ট্রাংক দেখান। ট্রাংকের ভেতর একটা বাঁশিও রেখেছেন ঘটনার সত্যতা প্রমাণ করার জন্য।’
আবার মাথা নাড়ল কিশোর। ‘উঁহু, আমার তা মনে হয় না। এর অন্য কোনো ব্যাখ্যা আছে।’
বাক্সটা বন্ধ করে নিজেদের ঘরে ফিরে এল তিন গোয়েন্দা। ক্লান্ত বোধ করছে কিশোর। তাই বালিশে মাথা দিতে না দিতেই ঘুমিয়ে পড়ল। ডাবল খাটটায় রবিনের সঙ্গে শুয়েছে সে। মুসা শুলো সিঙ্গল খাটে। তার ঘুমে জড়িয়ে আসছে চোখ। কয়েক মিনিট রুয়ানের কথাগুলো ভাবল। চাদরটা টেনে দিল মাথার ওপর। একসময় ঘুমিয়ে পড়ল।
কিন্তু রবিনের ঘুম আসছে না। তার মন জুড়ে রয়েছে ক্যাপ্টেন আর তাঁর বিধবা স্ত্রীর কথা। পাশ ফিরে কাত হয়ে কনুইতে ভর দিয়ে জানালার বাইরে তাকিয়ে রইল। লাইটহাউসের ঘূর্ণমান তীব্র আলোর রশ্মিটা ঘোরার সময় নিয়মিত বিরতিতে একটু পরপরই জানালা দিয়ে ঘরে আলো ফেলছে। ভাঙা ভাঙা স্বরে বেজে উঠে সতর্কবাণী জানাচ্ছে ফগহর্নটা, যেন কোনো জলদানবে আর্তচিত্কার। রবিন দেখল, উপকূলজুড়ে মস্ত চাদরের মতো ঝুলে রয়েছে কুয়াশা।
তারপর, কখন যে ঘুমিয়ে পড়ল সে, জানে না।
জেগে গেল বাচ্চা ছেলের ফোঁপানোর মতো শব্দ শুনে।
বিছানায় উঠে বসল সে।
কখনো ফোঁপাচ্ছে, কখনো চিত্কার করে কাঁদছে বাচ্চাটা।
কান পেতে শুনতে লাগল রবিন। ফগহর্নের শব্দ নয়। কোনো বাচ্চা ছেলেরই কান্না।
আজব তো, ভাবল রবিন। এখানে তো এত ছোট কোনো বাচ্চাকে দেখেছে বলে মনে পড়ে না। এখানে বর্তমানে যারা রয়েছে, তাদের মধ্যে সবচেয়ে কম বয়সী হলো স্যালি ফোল্ডার। আর তার বয়সও কম করে হলেও ষোলো বছর হবে।
কেঁদেই চলল বাচ্চাটা। অবশেষে কাত হয়ে কিশোরের গায়ে ঠেলা দিল সে।
‘কী-ক্কী হয়েছে!’ বলে উঠল কিশোর। কোথায় রয়েছে, বোঝার চেষ্টা করল।
ঠিক এই সময় কান্নাটা বন্ধ হয়ে গেল।
‘ইয়ে...একটা বাচ্চাকে কাঁদতে শুনলাম!’ রবিন বলল। ‘কিন্তু হোটেলে কোনো বাচ্চাকে তো দেখলাম না। তুমি দেখেছ?’
‘না,’ বিড়বিড় করল কিশোর। কাঁচা ঘুম ভাঙায় বিরক্ত। ‘আর কোনো শব্দও তো শুনতে পাচ্ছি না। খামোকা আমার ঘুম ভাঙালে কেন?’
জোরে নিশ্বাস ফেলল রবিন। ‘উত্তেজিত হয়ে গিয়েছিলাম, মনে হয়।’
‘আসলে, দুঃস্বপ্ন দেখছিলে! নাও, এখন ঘুমাও।’ পাশ ফিরে শুয়ে চাদরটা কানের ওপর টেনে দিল কিশোর।
মরার মতো ঘুমাচ্ছে মুসা। জোরে নাক ডাকছে। তার ঘুম ভাঙল না।
তারপর, দীর্ঘ সময় চুপচাপ পড়ে রইল রবিন। আবার শব্দ শোনার আশায়। অবশেষে ঘুমের জগতে চলে গেল। বেশিক্ষণ থাকতে পারল না। আবার চমকে জেগে গেল। এবার কোনো শব্দ শোনা গেল না। তবে অদ্ভুত একটা অনুভূতি হলো। যেন, ঘরে কেউ এসেছে। কিশোরের পাশে।
আস্তে চোখ মেলল রবিন। হোটেলের বাইরে সারা রাত জ্বালানো থাকা মৃদু আলো ঘরে ঢুকছে, সইয়ে নিতে খানিক সময় লাগল তার। হঠাৎ, বাথরুমের দরজাটা ধীরে ধীরে খুলে যেতে দেখল সে।
শিরশির করে উঠল চামড়া। মনে পড়ল, দরজাটা খোলার সময় ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ করে। এখন করছে না।
আতঙ্কিত হয়ে বিছানায় পড়ে থেকে, দরজাটার দিকে তাকিয়ে রইল সে। ক্রমেই ফাঁক হচ্ছে দরজাটা। হয়তো কেউ মায়ের ঘরে ঢুকেছিল, মনে হলো তার। জিনিসপত্র চুরি করে নিয়ে এখন বাথরুম দিয়ে বেরোচ্ছে। কিংবা তারচেয়েও খারাপ কিছু। অপঘাতে মরা ক্যাপ্টেনের ভূত তার স্ত্রীকে দেখতে এসেছে।
অবশেষে, পুরো ফাঁক হয়ে খুলে গেল দরজাটা। কিন্তু কেউ বেরোল না। হয়তো ভূতটা অদৃশ্য, ভাবল রবিন। হয়তো এ মুহূর্তে আমার মাথার কাছেই দাঁড়িয়ে আছে। অবাক হয়ে ভাবছে আমি কে। হয়তো মনে করেছে, তার স্ত্রীর কোনো ক্ষতি করতে এসেছি আমি। তাই এখন আমাকে গলা টিপে মারবে!
মাথা ঝাড়া দিয়ে উদ্ভট ভাবনাটা তাড়ানোর চেষ্টা করল রবিন। জোরে এক চিত্কার দিয়ে বিছানার পাশের আলোটা জ্বেলে দিল।
চাদরের নিচ থেকে ছিটকে বেরিয়ে এল মুসা। লাফ দিয়ে নামল মেঝেতে। আত্মরক্ষার জন্য কারাতে-মারের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে গেল, শত্রুকে আঘাত করার জন্য। সে মনে করেছে কেউ আক্রমণ করতে এসেছে ওদের। চিত্কার করে বলল, ‘কে-ক্কে!’
কিশোরও জেগে গেছে।
ঘুমজড়ানো চোখের দৃষ্টি যখন স্পষ্ট হয়ে এল মুসার, রবিন আর কিশোরকে ছাড়া অন্য কাউকে দেখতে পেল না, তখন বিছানার কিনারে বসে পড়ল।
‘কী হয়েছে?’ জিজ্ঞেস করল কিশোর।
‘নিঃশব্দে আপনা-আপনি খুলে গেছে বাথরুমের দরজাটা,’ রবিন জানাল।
গুঙিয়ে উঠল কিশোর। ‘তুমি আবারও স্বপ্ন দেখছিলে।’
‘না। ওই দেখো।’ হাত তুলে দেখাল রবিন।
‘ঘুমাতে যাওয়ার আগে নিশ্চয় খুলে রেখেছিলে,’ কিশোর বলল।
‘না, রাখিনি। বন্ধ করে দিয়েছিলাম, আমার মনে আছে।’
‘তাহলে বাতাসে খুলেছে। এসব বন্ধ করবে, রবিন? আমি একটু ঘুমাই।’
‘কিশোর, আমি মিছে কথা বলছি না। তা ছাড়া, দরজাটা খোলার সময় ক্যাঁচক্যাঁচ করে। এই যে দেখাচ্ছি।’
উঠে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করল রবিন। জোরে ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ হলো। ঘরের সবচেয়ে ভারী চেয়ারটা মেঝের ওপর দিয়ে টেনে আনল সে। তারপর ডোরনবের নিচে ঠেস দিয়ে রাখল। বিড়বিড় করে বলল, ‘মনে হয় আর খুলবে না।’
চুপচাপ বিছানার কিনারে পা ঝুলিয়ে বসে কেমন বোকার মতো তাকিয়ে রইল মুসা। রবিনের কথা ঠিক বুঝতে পারছে না।
‘এই মুসা, শুয়ে পড়ো!’ বলে আবার শুয়ে পড়ে গায়ের ওপর চাদর টেনে দিল কিশোর। হুমকি দিয়ে রবিনকে বলল, ‘আর যদি চেঁচামেচি করো, তোমার মুখে চাদর গুঁজে দিয়ে হাত-পা বেঁধে ফেলে রাখব!’
‘তার আগেই যদি ভূতটা আমাকে মেরে ফেলে তাহলে আর বেঁধে লাভ কী!’ বিড়বিড় করে চোখ বুজল রবিন।
আবার জেগে গেল, বাচ্চা ছেলের মৃদু কান্নার শব্দে। শুরু হলো কী আজ! কোনখান থেকে আসছে শব্দটা, বুঝলে না।
বাথরুমের দরজার দিকে তাকাল। পুরো ফাঁক হয়ে খুলে আছে। চেয়ারটাকে ঠেলে নিয়ে দেয়ালের সঙ্গে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে।
আস্তে করে বিছানা থেকে নামল রবিন। অযথা শব্দ করে কিশোর আর মুসার ঘুম ভাঙাল না। বাথরুমের দরজার পাল্লা ও চেয়ারটা ছুঁয়ে দেখল, স্বপ্ন দেখছিল কি না। আনমনে মাথা নাড়ল সে। বিড়বিড় করল, ‘মনে হয় স্বপ্নই দেখছিলাম!’
ক্লান্ত ভঙ্গিতে বিছানায় এসে শুয়ে পড়ল আবার। অদ্ভুত ঘটনাগুলো নিয়ে ভাবতে লাগল যতক্ষণ না সূর্য ওঠে। তারপর ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুম ভাঙল খোলা জানালার পাশে মুসার ব্যায়াম করার শব্দে। চোখ পড়ল চেয়ারটার দিকে। দেয়াল ঘেঁষে আগের জায়গাতেই রয়েছে ওটা। বাথরুমের দরজাটাও খোলা।
বিছানা থেকে নামল কিশোর।
‘চেয়ারটাকে রাতে তুমি নিয়ে গেছো ওখানে?’ মুসাকে জিজ্ঞেস করল রবিন।
‘না। আমি ভেবেছি তুমি নিয়েছ। ঘুম ভাঙার পর দেখি ওভাবেই রয়েছে।’
হতাশ ভঙ্গিতে রবিনের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়তে লাগল কিশোর।
নাশতার জন্য নিচে নামল ওরা। দিনের আলোয় রবিন এখন ভাবছে, পুরো ব্যাপারটাই স্বপ্ন! মাকে জিজ্ঞেস করল, বাথরুমের দরজা খুলে উঁকি দিয়ে ওদের দেখতে ঢুকেছিল কি না।
হেসে উঠলেন মা।
‘প্রশ্নই ওঠে না,’ বললেন তিনি। ‘রাতে উঠে তোমার ঘরে তোমাকে দেখতে যাওয়ার অভ্যাসটা আমি তোমার চার বছর বয়সেই বন্ধ করে দিয়েছি।’
‘গতরাতে রবিনের মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল,’ মুসা জানাল। ‘ভূত দেখেছে ভেবে তিনবার ঘুম ভাঙিয়েছে আমাদের।’
‘ভুল বললে,’ মিনমিন করে শুধরে দিল রবিন, ‘তোমার একবার, কিশোরের দুবার।’
চমত্কার একটা দিন কাটল সেদিন সরাইখানার অতিথিদের। সাঁতার কেটে, টেনিস খেলে, লাউঞ্জে বসে প্রকৃতি দেখে। তবে রবিনের সময়টা ভালো কাটল না। আনন্দের মাঝেও থেকে থেকেই যেন দুঃস্বপ্ন হয়ে মাথায় ঢুকতে লাগল রাতের ঘটনাগুলো। আগেই মুসাকে নিষেধ করে দিয়েছে সিন্ডি আর স্যালিকে যেন কিছু না বলে। তাহলে খেপিয়ে মারবে তাকে। কিশোরকে কিছু বলতে হলো না। সে নিজে থেকেই বলল না, অস্বস্তির মধ্যে ফেলল রবিনকে।
সেদিন সন্ধ্যায় ডিনারে বসে আরও বেশি অমনোযোগী হয়ে রইল রবিন। সামনের ভুতুড়ে রাতটার কথা ভেবে প্রচণ্ড অস্বস্তি লাগছে তার।
‘কি হয়েছে তোমার, রবিন?’ সিন্ডি জিজ্ঞেস করল। ‘শরীর খারাপ লাগছে?’
‘না, তেমন কিছু না!’ প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল রবিন। ‘নতুন জায়গায় ভালো ঘুম হয়নি কাল রাতে।’
ঘরে ফিরে যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল রবিন।
ঘরে এসে শোয়ার প্রস্তুতি নিতে লাগল কিশোর। কাপড় বদলাতে বদলাতে রবিনকে বলল, ‘তোমার ভূত নিয়ে তুমি কী করবে সেটা তোমার ব্যাপার, দয়া করে আমাকে এর মধ্যে ঢুকিয়ে জ্বালাতন কোরো না। বুঝতে পেরেছ?’
‘আমাকেও না,’ মুসা বলল। ‘এমনিতেই ভূতের ভয়ে সারাক্ষণ অস্থির থাকি, রাতে তোমার চেঁচামেচিতে শেষে মূর্ছা যাব।’
‘জ্বালাব না,’ জবাব দিল রবিন। ‘ভূতে আমাকে মেরে ফেললেও আজ তোমাদের ডাকব না।’
‘গুড। শুয়ে শুয়ে তাহলে স্বপ্ন দেখতে থাকো।’
বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়ল ওরা। গত রাতের মতো সেই একই ব্যাপার। কিশোর আর মুসা ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুম এল না রবিনের। দূর থেকে ভেসে আসা ফগহর্নের শব্দ শুনতে লাগল। অপেক্ষা করেই চলল, করেই চলল সে। কিন্তু কিছুই ঘটল না। জেগে থাকলে ভূতটা যেন আসতে চায় না। অবশেষে ঘুমিয়ে পড়ল রবিন। হঠাৎ জেগে ওঠে দেখে ভূতটা তার বিছানার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
একটা ছোট ছেলে। চার-পাঁচ বছর বয়স। পরনে ভিক্টোরিয়ান পোশাক। ১৮৯০ সালের দিকে এ রকম পোশাক পরত আমেরিকার মানুষ। গাঢ় লাল মখমলের সুট, গলায় বড় বো-টাই, হাঁটু ঢাকা প্যান্ট, লম্বা মোজা, আর বকলেসওয়ালা কালো জুতো। ডান গালে একটা জন্মদাগ। দুই চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে।
এক কনুইয়ে ভর দিয়ে আস্তে শরীরটা উঁচু করল রবিন। ছেলেটা কে?
আস্তে করে মেঝেতে পা রাখল রবিন। এক মুহূর্তের জন্য মুখ নামিয়ে তার স্লিপার খুঁজতে ব্যস্ত হলো। মুখ তুলে দেখল ছেলেটা নেই। উধাও হয়ে গেছে! যেন ছিলই না কখনো ওখানে।
হতাশায় দীর্ঘশ্বাস ফেলল রবিন। আবার শুয়ে পড়ল বিছানায়। কিশোর ঠিকই বলেছে। আমার মাথা বোধ হয় গরম হয়ে গেছে, ভাবল সে। সে জন্যই এসব দেখছি। মানসিক রোগের চিকিত্সা তো করাই হচ্ছে, শেষে বদ্ধ পাগল হয়ে যাব না তো?
বালিশে মুখ গুঁজল সে। আবার ঘুমিয়ে পড়ল। স্বপ্ন দেখল, জানালা দিয়ে বেরিয়ে গেল সে। শূন্যে উড়ে উড়ে লাইট হাউসের আলোটার দিকে চলল। ডানে তাকিয়ে দেখল, তার সঙ্গে ডাইনিটাও চলেছে, ককনিয়া, তার ঝাড়ুতে ভর করে। চিঁ-চিঁ শব্দ করছে। বিশাল চক্কর দিয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ আকাশে উড়ে বেড়াল ওরা। ফিরে এল সরাইখানার কাছে। ডাইভ দিয়ে নিচে নামল। খুব নিচু দিয়ে ওড়ার সময় দেখতে পেল, উইডোজ ওয়াকে পায়চারি করছে বেচারা ক্যাপ্টেনের দুঃখী বউটা, বৃষ্টিতে চুপচুপে ভেজা।
তারপর ডাইনি চলে গেল। ঘরে ফিরে এল রবিন। দেখল, বেলবয় হ্যারল্ড তার দিকে এগিয়ে আসছে। মখমলের সুট পরা ছেলেটা আঁকড়ে ধরে আছে হ্যারল্ডের হাত। কাঁদছে। রবিনের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়, এক মুহূর্ত থেমে হ্যারল্ড জিজ্ঞেস করল, ‘যে রুমটা দিলাম তোমাদের, তাতে কি তোমাদের ভালো লাগছে?’
মাথা ঝাঁকাল রবিন। হঠাৎ বাঁশির সুর তার কান যেন ভরিয়ে দিল। এতই জোরালো শব্দটা, চমকে জেগে গেল রবিন।
পরদিন সকালে নাশতার সময় কিশোর বলল, ‘ম্যারিনা থেকে একটা মোটরবোট ভাড়া করেছি। লেকে বেড়াতে যাব। উপকূল ধরে চলে যাব যত দূর পারা যায়।’
অন্য সময় হলে শুনে হয়তো লাফিয়ে উঠত রবিন। কিন্তু গত দুই রাত ধরে প্রচুর ধকল গেছে ওর ওপর দিয়ে। ক্লান্ত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। ‘নাহ্, আমার যেতে ইচ্ছে করছে না। আমি লাউঞ্জে বসে ফুল দেখব।’
চিন্তিত ভঙ্গিতে রবিনের দিকে তাকাল কিশোর। কিছু বলল না। মুসা আর রবিন বাদে অন্য সবাই টেবিল থেকে উঠে গেলে চেয়ারে বসেই কাত হয়ে এল কিশোর রবিনের দিকে, ‘গত রাতে কি আবার ভূতের দেখা পেয়েছিলে?’
‘না, তবে অনেক দুঃস্বপ্ন দেখেছি,’ রবিন বলল।
বেলা তিনটের সময় সেদিন, বৃষ্টি শুরু হলো। ঝড় আসবে মনে হচ্ছে। ইতিমধ্যেই উত্তাল হয়ে উঠেছে সাগর। ঘণ্টা খানেক পরে পুরোদমে আছড়ে পড়ল ঝড়। মুসা আর কিশোর তখনো ফেরেনি। উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল রবিন আর মিসেস মিলফোর্ড। হোটেলের লবি থেকে ফোন করে ম্যারিনায় খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করল রবিন। কিন্তু টেলিফোন লাইন বিচ্ছিন্ন। হয়তো খুঁটি উপড়ে পড়েছে, কিংবা তার ছিঁড়ে গেছে।
‘শহরে গিয়ে কোস্টগার্ড স্টেশনে ফোন করতে পারো,’ পরামর্শ দিলেন সরাইখানার মালিক। ‘সেটাই সহজ হবে। শহর এখান থেকে বারো মাইল দূরে। স্টেশন আরও দূরে।’
‘ঠিক!’ তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে এল রবিন। গাড়ি নিয়ে রওনা হলো। একটা রেস্টুরেন্টে একটা ফোন পাওয়া গেল, যেটার লাইন ঠিক আছে। ওখান থেকে কোস্টগার্ডকে ফোন করল। নিজের নাম আর কোথায় উঠেছে জানিয়ে বলল, তার দুই বন্ধু মোটরবোট নিয়ে লেকে বেড়াতে গেছে, এখনো ফেরেনি। তার আশঙ্কা হচ্ছে বোটের ইঞ্জিন বিকল হয়ে বা অন্য কোনো দুর্ঘটনায় আটকা পড়েছে ওরা।
ওপাশ থেকে একটা ভারী কণ্ঠ ওকে আশ্বস্ত করে বলল, ‘এখনই খুঁজতে বেরোচ্ছি আমরা। চিন্তা কোরো না। ওদের আমরা খুঁজে বের করব। খোঁজ পাওয়ামাত্র সরাইখানার শর্টওয়েভ রেডিওতে জানিয়ে দেওয়া হবে তোমাকে।’
সরাইখানায় ফিরে রবিন দেখল, তার মা ফোল্ডারদের রুমে বসে আছে। সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে খবরের অপেক্ষা করতে লাগল। কিন্তু কোনো খবরই এল না। ঝড়-বৃষ্টির দিনে সন্ধ্যা নামল তাড়াতাড়ি। বিকেলেই যেন রাতের অন্ধকার ঘনিয়ে এল। ঠান্ডা ভয় যেন চেপে ধরছে রবিনকে। কান পেতে শুনছে ফগহর্ন আর পাথরে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের শব্দ, সেই সঙ্গে চলছে বাতাসের একটানা গর্জন। মনে হচ্ছে তার, এরই মাঝে যেকোনো সময় শোনা যাবে সুরেলা বাঁশির সুর।
হঠাৎ থাবা পড়ল দরজায়। খুলে দিতে দেখা গেল হ্যারল্ড দাঁড়িয়ে আছে। মুখে চওড়া হাসি। ‘এইমাত্র কোস্ট গার্ডের কাছ থেকে রেডিওতে একটা মেসেজ পেলাম, কিশোর-মুসাকে খুঁজে পাওয়া গেছে। এখন স্টেশনে আছে ওরা।’
‘থ্যাংক গড!’ চেঁচিয়ে উঠলেন মিসেস মিলফোর্ড।
স্বস্তিতে মাকে জড়িয়ে ধরল রবিন।
‘মোটরবোটের হাল ভেঙে গিয়েছিল,’ হ্যারল্ড জানাল। ‘কোস্টগার্ডের একটা হেলিকপ্টার ঝুঁকি নিয়ে অনেক কষ্টে মোটরবোট থেকে তাঁদের তুলে নিয়েছে। এই ঝড়ের মধ্যে রাতে আর স্টেশন থেকে বেরোতে দেবে না। সকালে ঝড় থামলে আসবে।’
সবাই খুশিতে চিত্কার করে অভিনন্দন জানাল হ্যারল্ডের কথাকে। ডিনার খাওয়া শেষে ফোল্ডার দম্পতির সঙ্গে গল্পে মাতলেন মিসেস মিলফোর্ড। রবিন, সিন্ডি আর স্যালি ক্যারম খেলতে বসল। একজন প্লেয়ার কম হয়ে যায় বলে ওদের সঙ্গ দিলেন রুয়ান।
সাড়ে দশটার দিকে সবাই ঘুমোতে গেল ওপরতলায়। মাকে ‘গুড নাইট’ জানিয়ে শুতে চলল রবিন। এতক্ষণে মনে পড়ল, ভুতুড়ে ঘরটায় আজ রাতে একা ঘুমোতে হবে। কিশোর, মুসা, দুজনের কেউই নেই। অস্বস্তি বোধ করতে লাগল সে।
কিছুক্ষণ বই পড়ার চেষ্টা করল। ভালো লাগল না। শেষে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ল। সবে তন্দ্রাটা এসেছে, এই সময় একটা শব্দে চোখ খুলে গেল। মনে হলো, জানালার দিক থেকে এসেছে শব্দটা। পাশ ফিরে বাতির সুইচ টিপল। কিন্তু জ্বলল না। বিদ্যুৎ চলে গেছে। জানালার দিকে তাকাল সে। দেখল, লাল সুট পরা ছেলেটা ওখানে দাঁড়িয়ে আছে। এখন আর কাঁদছে না। বরং আঙুলের ইশারায় রবিনকে ডাকল।
ঠোঁট কামড়াল রবিন। যতটা সম্ভব আস্তে বিছানা থেকে নামল। চোখ সরাল না ছেলেটার ওপর থেকে। ধীরে ধীরে বারান্দায় বেরোনোর দরজার দিকে এগোল ছেলেটা। উদ্দেশ্যটা পরিষ্কার। রবিনকে নিয়ে বেরোতে চায়। দরজা খুলল রবিন। ভূতটাকে অনুসরণ করে ওপরতলার সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ে উঠল।
দারুচিনি কাঠের বাক্সটার কাছে দাঁড়াল ছেলেটা। খুলতে ইশারা করল রবিনকে।
ডালা তুলল রবিন।
ঝুঁকে বাঁশিটা তুলে নিল ছেলেটা। রবিনের দিকে তাকিয়ে হাসল। কিছু বলতে যাচ্ছিল রবিন, কিন্তু তার আগেই মিলিয়ে গেল ভূতটা।
কয়েক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল রবিন। তারপর বাক্সের ডালা নামিয়ে ফিরে এল নিজের ঘরে। জানালার একটা পাল্লা বাতাসে বাড়ি খাচ্ছে। এই শব্দেই জেগে গিয়েছিল সে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল কয়েক মিনিট। তারপর পাল্লা লাগিয়ে হুড়কো আটকে ফিরে এল বিছানায়। গায়ের ওপর চাদর টেনে দিতে গেল, এই সময় কী যেন পড়ার শব্দ হলো।
বেডসাইড ল্যাম্পের সুইচটা টিপে দিল সে। আলো জ্বলল। সব কিছুই কেমন অদ্ভুত। ঘরের চারপাশে চোখ বোলাল সে। দেয়ালে ঝোলানো একটা ছবি মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখল।
অনেকগুলো ছোট ছোট ছবির মাঝখানে এই ছবিটা ঝোলানো ছিল। বিছানা থেকে নেমে এসে মেঝেতে পড়ে থাকা ছবিটা তুলে নিল। দেখেই চিনতে পারল। সেই ভূত ছেলেটার ছবি। জাহাজের ক্যাপ্টেনের পোশাক পরা। ছবির কাগজের বাদামি হয়ে যাওয়া রং দেখে বুঝতে পারল এটা অনেক দিন আগের ছবি।
‘ওই ছেলেটাই,’ বিড়বিড় করল সে। ‘কোনো সন্দেহ নেই তাতে। এমনকি গালের জন্মদাগটাও দেখা যাচ্ছে।’
ছবিটা তুলে এনে বিছানার পাশের ছোট টেবিলে রাখল। দীর্ঘক্ষণ বসে রইল বিছানায়। তারপর শুয়ে পড়ল। সেদিন রাতে আর ঘুম ভাঙল না, যতক্ষণ না ঝটকা দিয়ে দরজাটা খুলে গেল।
দরজায় দাঁড়িয়ে আছে কিশোর। তার পেছনে কাঁধের ওপর দিয়ে উঁকি দিচ্ছে মুসা।
‘এই, রবিন! কটা বাজে?’ হাসি হাসি কণ্ঠে বলল কিশোর। ‘জলদি ওঠো। নইলে আজ আর নাশতা পাবে না।’
‘কিশোর, তুমি ঠিক আছো?’ লাফ দিয়ে উঠে বসল রবিন। ‘মুসা, তুমি?’
‘ভালো। রাতে ওরা আমাদের দুটো ক্যাম্প খাট দিয়েছিল। সকালে ভরপেট নাশতাও খাইয়েছে। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখো, কী সুন্দর রোদ! ঝড়ের চিহ্নও নেই।’
টেবিলে রাখা ছবিটার দিকে তাকাল রবিন। ‘দেখে যাও।’
‘কী?’ জিজ্ঞেস করল কিশোর।
এগিয়ে এসে ছবিটা দেখল কিশোর আর মুসা।
‘যদি হাসাহাসি না করো, তাহলে সব বলতে পারি,’ রবিন বলল।
কথা দিল কিশোর-মুসা, হাসাহাসি করবে না।
রাতে যা যা ঘটেছে, সব ওদের খুলে বলল রবিন। দুই হাতে ধরে ছবিটা তুলে নিল কিশোর। ভালোমতো দেখল।
‘এটা দেখলে রুয়ান হয়তো কিছু বলতে পারবেন। ওঠো। তাড়াতাড়ি কাপড় পরে নাও। তাঁকে জিজ্ঞেস করতে হবে।’
মিনিট দশেক পর রুয়ানকে ছবিটা দেখাল ওরা। জিজ্ঞেস করল রবিন, ‘এই ছেলেটা কে, চেনেন?’
হাতের কফির কাপটা টেবিলে নামিয়ে রাখলেন রুয়ান। নীরবে একটা মুহূর্ত তাকিয়ে রইলেন ছেলেদের দিকে। ‘তার মানে দেখেছ তাকে।’
‘কাকে?’ প্রশ্ন করল কিশোর।
‘কী দেখেছ তোমরাই বলো না আমাকে,’ রুয়ান বললেন।
রবিনের দিকে তাকাল কিশোর। ‘কী দেখেছ, বলো।’
‘গত দুই রাত ধরে এই ছেলেটাকে দেখেছি আমি,’ রবিন জানাল। ‘আমাদের ঘরে এসেছে, কেঁদেছে। আমাদের ঘরে এসেছিল। গত রাতে এসে আমাকে ইশারায় ডেকে নিয়ে গেছে দারুচিনির বাক্সটার কাছে। বাক্সটা খুলতে বলেছে। ভেতরে একটা বাঁশি পড়ে ছিল। তাড়াতাড়ি ওটা নিয়ে উধাও হয়ে গেছে সে।’
‘হয়তো এত দিনে শেষ হলো!’ রুয়ান বললেন।
‘কী শেষ হলো?’
‘আমি সেদিন গল্পটার শেষ অংশটা বলিনি, মেয়েরা ভয় পাবে ভেবে। বাক্সের ভেতর যে বাঁশিটা দেখেছ, ওটা সেই ক্যাপ্টেনের বাঁশি। ঝড়ের পর লাইট হাউসের কাছে পানিতে ভাসতে দেখে, তুলে এনে ক্যাপ্টেনের স্ত্রীকে দিয়েছিল একজন পরিচিত নাবিক। বাঁশিটা বাক্সে রেখে দিল মহিলা। স্বামী ফিরবে না, নিশ্চিত হয়ে, সেই রাতেই একমাত্র ছেলেকে নিয়ে বাড়ির ছাদ থেকে সৈকতের পাথরে লাফিয়ে পড়ে ক্যাপ্টেনের স্ত্রী। তোমরা যে ঘরে থাকছ এখন, ওটাই ছেলেটার ঘর ছিল। এই ছবিটাও তারই।’
‘ঘরটা নাকি বহু বছর ধরে বন্ধ ছিল,’ কিশোর বলল। ‘হ্যারল্ড বলেছে।’
মাথা ঝাঁকালেন রুয়ান। ‘কয়েক বছর আগে আমি যখন বাড়িটা কিনি, আমাকে জানানো হয়েছে ওই ঘরটায় ভূত আছে। একটা ছোট ছেলে নাকি রাতে ওই ঘরে এসে কান্নাকাটি করে। গেস্টরা ভয় পেলে এখানে আসাই ছেড়ে দেবে ভেবে দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। ওটাতে এত দিন থাকতে দিইনি কাউকে। কিন্তু আমি কেনার পর কখনো কারও কান্না শুনিনি। তাই মনে হলো আর বন্ধ করে রেখে লাভটা কী, খুলেই দিই। তোমাদেরই প্রথম থাকতে দিয়েছি।’
‘আর অমনি শুরু হলো ভূতের অত্যাচার। আমাদের আগেই সতর্ক করা উচিত ছিল আপনার,’ রবিন বলল। ককনিয়া আর হ্যারল্ডের কথা ভাবল। বুঝতে পারল, ওদের এখানে থাকতে দিতে এত দ্বিধা করছিল কেন ওরা।
‘হ্যাঁ, সতর্ক করা উচিত ছিল, ভুলই হয়ে গেছে,’ রুয়ান বললেন।
‘আমি কিন্তু অস্বাভাবিক কিছুই শুনিনি, দেখিওনি,’ কিশোর বলল। ‘আমি ভেবেছি, রবিন দুঃস্বপ্ন দেখেছে।’
‘আমিও দেখিনি,’ মুসা বলল।
‘কিন্তু ভাবছি,’ নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল কিশোর, ‘রবিনকেই দেখা দিল কেন ওটা?’
‘হয়তো আমার মগজের সমস্যার কারণে নানা রকম অদ্ভুত জিনিসের প্রতি অতিসংবেদনশীল হয়ে আছে আমার মগজ,’ জবাবটা রবিনই দিল। ‘ভূতের ওপর লেখা যে বইটা পাওয়া গেছে, ওটাতে এ ধরনের তথ্য রয়েছে।’
‘হুঁ!’ চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা দোলার কিশোর।
মুসা বলল, ‘ভাগ্যিস, আমার মগজ অতিসংবেদনশীল নয়। তাহলে স্বয়ং ক্যাপ্টেনের ভূতটাই এসে আমার ঘাড় চেপে ধরত, বাঁশি বাজাতে বাজাতে।’
‘আহ্, বাঁশির কথায় মনে হলো,’ রবিন বলে উঠল। ‘বাক্সটা আরেকবার খুলে দেখা দরকার।’
‘কেন?’ কিশোরের প্রশ্ন।
‘পরে বলব,’ জবাব দিল রবিন।
রবিনের নাশতা খাওয়া শেষ হলে আবার ওপরতলার সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ে উঠল তিন গোয়েন্দা।
টান দিয়ে বাক্সের ডালা তুলে ফেলল রবিন। তিনজনেই উঁকি দিল ভেতরে। অস্ফুট শব্দ করে উঠল মুসা।
বাঁশিটাশি কিচ্ছু নেই ভেতরে।
ঝুঁকে বাক্সটা শুঁকল রবিন। সোজা হয়ে বলল, ‘যা ভেবেছিলাম! শুঁকে দেখো? দারুচিনির গন্ধ নেই। শুধু পুরোনো কাঠের গন্ধ।’
শুঁকে দেখে বিস্মিত ভঙ্গিতে চিত্কার করে উঠল মুসা। ‘সত্যিই তো! গন্ধটা নেই!’
ভুরু কুঁচকে রবিনের দিকে তাকিয়ে বলল কিশোর, ‘তার মানে বলতে চাও, যেহেতু বাঁশি নিয়ে চলে গেছে ছেলেটা, আর গন্ধ পাওয়া যাবে না? বাক্সটা এখন ভূতের আছরমুক্ত?’
‘এ ছাড়া আর কী জবাব?’ রবিন বলল।
কিন্তু এসব ভূতের কাণ্ড, আমি বিশ্বাস করতে পারছি না,’ মাথা নাড়ল কিশোর। আবারও বলল, ‘এর অন্য কোনো ব্যাখ্যা আছে!’
‘ব্যাখ্যাটা কী?’ রবিনের প্রশ্ন।
‘ব্যাখ্যাটা হলো, ওই বাঁশির মধ্যে দারুচিনি পুরে রেখে দেওয়া হতো, তার তাতে তাজা দারুচিনির গন্ধ বেরোত।’
‘কে রাখত, ভূতে?’ মুসা জিজ্ঞেস করল।
হাসল কিশোর। ‘না। মি. রুয়ান। সরাইখানাটাকে আকর্ষণীয় করার জন্য এই নাটক সাজান তিনি। নতুন কেউ এলেই তাঁকে ভূতের গল্প শোনান। প্রমাণ হিসেবে দেখান দারুচিনির বাক্স আর বাঁশিটা। অতিথিরাও ভূত ভেবে দারুণ মজা পায়। ফিরে গিয়ে প্রচার করে। তখন অন্য ট্যুরিস্টরাও দেখতে আসে। আবার তিনি নতুন ট্যুরিস্টকে ভূতের গল্প শোনান। আবার বাঁশি রেখে দেন। ককনিয়াকে সাজিয়ে রাখেন ডাইনি। আর হ্যারল্ডকে আজব মানুষ। ১৩ নম্বর ঘরটা বন্ধ করে রাখেন। এভাবেই চলতে থাকে। লোকেও পছন্দ করে। এটা তাঁর ব্যবসা চালানোর, নতুন নতুন ট্যুরিস্ট আনানোর একটা কৌশল।’
ভুরু কোঁচকাল রবিন। ‘তাহলে আমি যে ভূতটাকে দেখলাম?’
‘এটা তোমার মগজের সমস্যা। পুরোটাই হ্যালুসিনেশন।’
‘ঠিক!’ মাথা ঝাঁকাল মুসা। ‘নইলে ভূত তো আমার দেখার কথা। আমি দেখলাম না, আর তুমি দেখে ফেললে, এটা হতেই পারে না।’
‘তার মানে, আমি ভূত দেখার কথা বলে রুয়ানকে ভূতের গল্প প্রতিষ্ঠিত করার বাড়তি সুযোগ করে দিলাম?’
‘হ্যাঁ,’ কিশোর বলল।
‘সত্যি বলছ, আমি ভূত দেখিনি?’ এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না রবিনের।
‘না। ভূত বলে কিছু নেই। রকি বিচে ফিরে ডাক্তারকে জিজ্ঞেস কোরো, ডাক্তারও বলবেন, হ্যালুসিনেশন।’
স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল রবিন।
তিন গোয়েন্দার চাপাচাপিতে স্বীকার করতে বাধ্য হলেন রুয়ান, কিশোরের কথাই ঠিক। অনুরোধ করলেন তিনজনকে, বাড়ি ফিরে এ কথা যেন কাউকে না বলে।
কথা দিল ওরা, কাউকে বলবে না।