ক্লাসে স্যার জিগ্যেস করলেন, তোমরা বড় হয়ে কে কী হতে চাও?
কুড়িগ্রামের যাত্রাপুর স্কুল। ব্রহ্মপুত্র নদের পারে উঁচু একটা বাজার এলাকা এই যাত্রাপুর। তারই একপাশে বিশাল মাঠ। মাঠের এক প্রান্তে টানা টিনে ছাওয়া ইটের ভবন। যাত্রাপুর বহুমুখী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। এই স্কুলে অঙ্ক, বিজ্ঞান এসব পড়ান কাশেম স্যার, বিএসসি।
আজ তিনি বলেছেন, মেয়েরা, তোমরা বড় হয়ে কী হতে চাও।
রেহনুমাই সবার আগে দাঁড়াল। বলল, স্যার, আমি পাখি হব।
রেহনুমা মেয়েটা খুবই ফাজিল প্রকৃতির। সে বন্ধুদের সঙ্গে মজা করে বলে, স্যারের মাথাভরা টাক। পেছনে গোটা তিনেক চুল। তাতে তিনি রোজ নারকেল তেল মাখেন। আর যত্ন করে সিঁথি করেন। একদিন একটা চুল পড়ে গেল। তখন তিনি আরও বেশি করে তেল দিতে লাগলেন। আরও যত্ন করে সিঁথি করতে লাগলেন। তখন আরও একটা চুল পড়ে গেল। রইল আর একটা। তখন তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, আজ থেকে আর সিঁথিই করব না।
কাশেম স্যার বললেন, পাখি হবে মানে?
রেহনুমা তখন এক নিশ্বাসে গড়গড় করে মুখস্থের মতো বলতে লাগল, স্যার, আমাদের বইয়ে একটা কবিতা ছিল। ‘তোমরা যখন শিখছ পড়া মানুষ হওয়ার জন্য, আমি না হয় পাখিই হব, পাখির মতো বন্য।’ ওরা স্যার সবাই মানুষ হোক, আমি পাখি হব, পাখির মতো যেখানে খুশি স্বাধীনভাবে উড়ে বেড়াব।
কাশেম স্যার খানিকক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর তাঁর চোখের কোণে জল চিকচিক করে উঠল। তিনি ধরা গলায় বললেন, রেহনুমার কথা আমার পছন্দ হয়েছে। আমরা লেখাপড়া করি মানুষ হওয়ার জন্য, কিন্তু আসলে আমরা মানুষও হই না, কিছু শিখিও না। বরং যদি কেউ পাখি হতে চায়, সে অন্তত একটা সুন্দর স্বাধীন মনের মানুষ হবে। সে নদীর কাছে যাবে, গাছের কাছে যাবে, ফুলের কাছে যাবে।
আর কে কী হতে চাও? মুনমুন, তুমি কী হবে।
মুনমুন ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল। সে ভাবল, আমিই বা রেহনুমার চেয়ে পিছিয়ে থাকব কেন! সে বলল, স্যার, আমি ফুলের বাগানের মালি হব। অনেক ফুল ফোটাব। পৃথিবীটাকে সুন্দর করব, সুগন্ধে ভরে দেব। আমাদের নদীর ঘাটে স্যার একটা শিউলি ফুলের গাছ আছে। সেটাতে ফাংগাস ধরেছিল। আমি স্যার কৃষি অফিসারের কাছ থেকে ওষুধ এনে সেটাকে বাঁচিয়েছি। কী সুন্দর ফুল দেয়।
কাশেম স্যার বললেন, বেশ, বেশ।
আজকে ক্লাসের ছেলেমেয়েদের মন অন্যদিকে চলে গেছে। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক হওয়ার কথা কেউ বলতেই চাইছে না।
এর মধ্যে সোনিয়া উঠল। সে বলল, স্যার, মুনমুন গাছ বাঁচাতে চায়। ফুল ফোটাতে চায়। আমি স্যার মিডওয়াইফ হব। মিডওয়াইফরা মা ও নবজাতক সন্তানের জীবন রক্ষা করতে পারে।
তখন রেহনুমা গান গেয়ে উঠল, আজকের শিশু আগামীর...
স্যার ধমক দিলেন, রেহনুমা। কথা কম। বলো সোনিয়া। তুমি কেন মিডওয়াইফ হতে চাও। এর অর্থ জানো?
জানি, স্যার। মিডওয়াইফ হলো প্রশিক্ষিত ও পেশাদার স্বাস্থ্যসেবাদানকারী। মা ও নবজাতকের পরিপূর্ণ স্বাভাবিক সেবা দিতে ওরা বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত এবং তিন বছরের আন্তর্জাতিক মানের কোর্স করে তারা প্রফেশনাল হয়ে থাকে।
সোনিয়া বলল, স্যার, আমি যখন ক্লাস থ্রিতে পড়ি, তখন আমার মা মারা যান। তখন আমার ছোট ভাই সাবেরের জন্ম হয়। সাবের বেঁচে আছে, কিন্তু মা মারা যান। আমার তখন বয়স আট। আমি তখন থেকে আমার ছোট ভাইকে দেখি। ওকে কোলে নিতে নিতে আমার বাঁ কাঁখে ঘা হয়ে গেছিল, স্যার। মার কবরটা আমাদের বাঁশঝাড়ের নিচে। তার চারপাশে আমিও বেলি ফুল, কলাবতী ফুল, শিউলি ফুলের গাছ লাগিয়েছি। বেলিফুলের গন্ধ নাকে এলে আমার মায়ের কথা মনে পড়ে। স্যার, আমার মা দেখতে খুব সুন্দর ছিলেন। তাঁর হাসিটা খুব সুন্দর ছিল। আমার আব্বা স্যার একটা এনজিওতে চাকরি করেন। তিনি আমাকে বলেছেন, ইন্টারমিডিয়েট পাস করার পরে তিনি আমাকে মিডওয়াইফারি কোর্সে ভর্তি করাবেন। আমি তিন বছর পরে মিডওয়াইফ হব। মানুষের সেবা করব। প্রসূতির যত্ন নেব। সন্তান জন্মের সময় মায়ের পাশে থাকব।
জানেন স্যার, সেদিন আব্বা বললেন, পাশের গ্রামের একটি বাচ্চা জন্মানোর পর সবাই বলল, এ তো মরা বাচ্চা। কিন্তু প্রশিক্ষিত ও দক্ষ দাই এসে তাকে যত্ন করল। ১৫ মিনিট পরে বাচ্চাটা কেঁদে উঠল। তাকে দ্রুত কুড়িগ্রামের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। বাচ্চাটা এখন সুস্থ। স্যার, ফুল ফোটানো ভালো। কিন্তু শিশুর চেয়ে সুন্দর ফুল আর কী আছে, স্যার?
কাশেম স্যার কেঁদে ফেললেন। তিনি বললেন, সোনিয়ারে, তুই আমার মা। আমার মাও আমার জন্মের সময় মারা গেছেন। আজকে আমি আমার মাকে খুঁজে পেলাম। দোয়া করি, তুই ভালো একজন মিডওয়াইফ হ। আমাদের দেশে অনেক মিডওয়াইফ বা দক্ষ ধাত্রী দরকার, যারা উপযুক্ত মানের ও পেশাদার। আমি তোকে প্রাণভরে দোয়া করলাম।
রেহনুমাও সোনিয়ার সঙ্গে মিতা পাতাল। সোনিয়া মানুষের সেবা করবে। সোনিয়াকে ভালো না বেসে পারা যায়?