মেধাকে হঠাৎ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। দাদু মতিউর শাহাদাতের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল যেন। তিনি একেবারে হতভম্ব হয়ে গেছেন। কোথায় গেল মেধা? বেশি সময় তো নয়। তিন-চার মিনিটের বেশি হবে না। এর মধ্যেই...নাহ্, ভাবতে পারছেন না তিনি। এত মানুষের ভিড়ে কোথায় খুঁজবেন মেধাকে?
এমনও নয় যে ওকে বাইরে কোথাও রেখে গেছেন। রীতিমতো গাড়িতে বসিয়ে রেখে গেছেন তিনি। সে যেন গাড়ি থেকে না নামে, সেটাও খুব স্পষ্ট করে বুঝিয়ে বলেছেন মতিউর শাহাদাত। এত লোকের মধ্যে একটু এদিক-ওদিক হলেই অনেক বড় সমস্যা হতে পারে। কিন্তু...এত করে বলার পরও...নিজের মাথার চুল টেনে ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে তার।
তার ওপর আজ শুক্রবার। বইমেলায় উপচে পড়া ভিড়। ঢাকা শহরের সব লোক যেন আজ মেলায় এসেছে। মানুষের ঢল নেমেছে যেন।
এমন একটা ব্যাপার, মতিউর শাহাদাত আজ তার ড্রাইভারকেও ছুটি দিয়েছেন। না হলে এ অবস্থায় পড়তে হতো না তার।
ছয় বছর বয়স মেধার। এক বছর হয় স্কুলে ভর্তি হয়েছে। এর আগে মিরপুরের টোলারবাগের বাসায় মায়ের কাছেই পড়াশোনা করেছে নিয়ম করে।
মেধা একাই। ওর আর কোনো ভাই-বোন নেই। বাবা শাহীন বখতিয়ার সরকারি অফিসে চাকরি করেন। বাংলাদেশ সচিবালয়ে তার অফিস। মা আয়েশা সিদ্দিকা খানম গৃহিণী।
মেধার গ্রামের বাড়ি সীমান্ত জেলা ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলায়। তার বাবার চাকরির সুবাদে ঢাকায় বসবাস। গত তিন বছর হলো মেধার দাদি আল্লাহর কাছে চলে গেছেন। দাদিকে খুব ভালোবাসত মেধা। দাদির মৃত্যুতে মেধা ভীষণ আঘাত পেয়েছে। দাদিকে হারিয়ে কদিন কেমন যেন বিমর্ষ হয়ে পড়েছিল মেধা। চঞ্চল মেয়েটা কেমন যেন চুপচাপ হয়ে যায় হঠাৎ। খেলতে ভালো লাগে না। খেতে ভালো লাগে না। কিছুই ভালো লাগে না মেধার। তারপর থেকেই দাদা মতিউর শাহাদাত মেধাকে কাছে কাছে রাখেন। দাদার সান্নিধ্যে এত দিনে সে দাদির কথা কিছুটা হলেও ভুলতে পেরেছে বলে মনে হয়। দাদা মতিউর শাহাদাতই মেধার এখন সব সময়ের সঙ্গী।
এর মধ্যে একুশে বইমেলা শুরু হয়েছে বেশ কিছুদিন হলো। মেধা সেই শুরু থেকেই বলে আসছে, এবার তাকে বইমেলায় নিয়ে যেতেই হবে। দাদাভাইও তাকে বলে এসেছেন, ‘অবশ্যই একদিন আমরা বইমেলায় বেড়াতে যাব। সেদিন সারা মেলা ঘুরে ঘুরে অনেক বই কিনব।’
আর আজ সেই দিন। শুক্রবার। ছুটির দিন। তা ছাড়া এই দিন মেলায় শিশুপ্রহর থাকে। মোটামুটি দু–তিন ঘণ্টা ছোটরা তাদের মা, বাবা, চাচু, মামা, দাদা অথবা তাদের অভিভাবকদের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে পছন্দের বইগুলো কিনে নিতে পারে।
মেলার অন্য সময় যে তারা বই কিনতে পারে না, তা নয়। অন্য সময় মেলায় বড়দের ভিড়ে ছোটরা ঠিকমতো বই দেখারই সুযোগ পায় না বললেই চলে। তাই বাংলা একাডেমি প্রতিবছর মেলায় শুক্র ও শনিবার একটা নির্দিষ্ট সময় শিশুদের জন্য আলাদা করে বই কেনার, বই দেখার সুযোগ করে দেয়।
মেধাও তার দাদা মতিউর শাহাদাতের সঙ্গে সেই শিশুপ্রহরের সময়টাতেই মেলায় এসেছে। কেবল বই নিয়ে এত বড় মেলা দেখে মেধা তো রীতিমতো ভিরমি খেল প্রথমেই। বাব্বাহ, সারি সারি এত্ত বইয়ের দোকান! আর সেসব দোকানে সুন্দর করে সাজানো কত্ত কত্ত বই! দেখে ওর মাথা ঘুরে যাওয়ার জোগাড়। এ ছাড়া মেলার সব জায়গা ঘুরে ঘুরে দেখতে ওর পা-টাই ব্যথা হয়ে গেছে। আবার কোনো কিছু অদেখা থাকুক, এটাও সে চায় না। ফলে কষ্ট হলেও দাদার হাত ধরে গুটি গুটি পায়ে সে হেঁটে বেড়িয়েছে গোটা মেলা প্রাঙ্গণ।
আর মেলার শিশু চত্বরটাকে তো সেই রকম করে সাজানো হয়েছে। দেখলেই চোখ জুড়ায়। সেখানে সবই শিশুদের বই। স্টলগুলোও মনকাড়া ডিজাইনের। তার ওপর আছে সিসিমপুর চত্বর। সেটাও শিশুদের আকর্ষণ করার মতো বাহারি রঙে সাজানো। গিয়ে শুনল, আজ এখানে টেলিভিশনে দেখানো সিসিমপুরের টুকটুকি, হালুম, শিকুরা আসবে। চাইলে তাদের সঙ্গে মেধা ওই স্টেজে গিয়ে নাচতেও পারে।
সত্যিই তা–ই। মেধাও সেখানে উপস্থিত থেকে হালুমদের দেখল। যা কেবল এত দিন সে তাদের টেলিভিশনেই দেখে এসেছে। ব্যাপারটা কী যে ভালো লাগল মেধার, তা সে বলে বোঝাতেই পারবে না। মন ভরে দেখতে লাগল ওদের। ‘চলছে গাড়ি সিসিমপুরে...’ গানটা তো ছোটদের পাগল করে দেয়। ওই গানে কেমন একটা জাদু আছে যেন। কারোর কানে এই সুর গিয়েছে, আর সে সেই সুরে গুনগুন করে ওঠেনি, এমন মানুষ পাওয়া ভার। একসময় দেখা দেল, দু–একজন করে স্টেজে উঠে টুকটুকিদের সঙ্গে নাচছে, গান গাইছে। মেধাই–বা বাদ যাবে কেন? দাদা মতিউর শাহাদাত মেধারও ইচ্ছে পূরণ করে দিলেন। ওকেও স্টেজে উঠিয়ে দিলেন। প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে বেশ মজা হলো। দাদা মেধার সঙ্গে ওদের ছবিও তুলে নিলেন। মেধার মনটা আনন্দে আরও টইটম্বুর হয়ে উঠল। সিসিমপুর শো শেষ হলে টুকটুকিরা হাত নেড়ে বিদায় নিল। মেধার মতো শত শত শিশুও তাদের বিদায় জানাল।
এর আগে মেধাকে তার বাবা শাহীন বখতিয়ার টেলিভিশনে সিসিমপুর দেখতে দেখতে ওদের সম্পর্কে অনেক কথা বলেছেন।
তিনি বলেছেন, সিসিমপুর হচ্ছে শিশুদের জন্য টেলিভিশন অনুষ্ঠান সিসেমি স্ট্রিটের বাংলাদেশি সংস্করণ। মূলত শিশুদের খেলার মাধ্যমে স্বপ্ন দেখায় ‘সিসিমপুর’। শিক্ষা গ্রহণকে আর কঠিন মনে হয় না, বরং হয়ে ওঠে আরও মজার। সেই সঙ্গে শেখানো হয় শিশুতোষ স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সচেতনতামূলক বিভিন্ন বিষয়। দিন দিন সিসিমপুর যেন হয়ে উঠেছে আমাদের পরিবারেরই অংশ। অনুষ্ঠানটি শুরু হয় ২০০৪ সালের ১৪ এপ্রিল। তার মানে, আমাদের বাংলা নববর্ষের দিন থেকেই তারা বাংলাদেশে তাদের যাত্রা শুরু করে। সিসিমপুরের জনপ্রিয় চরিত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে হালুম। সে হচ্ছে বন্ধুবত্সল বাঘ। হালুম মাছ ও সবজি খেতে ভালোবাসে। প্রকৃতি আর গাছপালা তার খুব প্রিয়। সে খেলাধুলা পছন্দ করে এবং ভালো গান গাইতে পারে। হালুম সবাইকে সাহায্য করতে চায়, কিন্তু সাহায্য করতে গিয়ে পরিস্থিতি গুলিয়ে ফেলে।
ইকরি হলো তিন বছর বয়সী একটি মেয়ে। সে প্রশ্ন করতে ভালোবাসে আর প্রতিদিন একটা নতুন কিছু শেখে। সে তার কল্পনার জগৎ দিয়ে যা ইচ্ছা তা ঘটাতে পারে। কল্পনায় সে নানা খেলাও খেলতে পারে। সে ছড়া বলতে ও ছবি আঁকতে পছন্দ করে।
এলমো। তিন বছর বয়স তার। সে বন্ধুবত্সল, প্রাণোচ্ছল, কৌতূহলী। প্রশ্ন করে নতুন কিছু জানতে চায়। সে তার চারপাশের সবকিছুর অংশ হতে চায়। বড় হয়ে এলমো সাংবাদিক হতে চায়।
শিকু হচ্ছে ছয় বছর বয়সী একটা ছেলে শিয়াল। সে খুবই বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদী, গোয়েন্দা। সে কৌতূহলী ও পরিস্থিতি পর্যবেক্ষক। পুরোনো জিনিস সংগ্রহ করে সেগুলো দিয়ে নতুন কিছু তৈরি করা তার শখ। সে বড় হয়ে বিজ্ঞানী হতে চায়।
রায়া। সে ছয় বছর বয়সী একটা মেয়ে। সে হাসিখুশি, মিশুক এবং অন্যদের সঙ্গে দলগতভাবে কাজ করতে পছন্দ করে। সব সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকে, নিজের ও অন্যের স্বাস্থ্যকর অভ্যাসচর্চার ব্যাপারে সচেতন। বড় হয়ে সে ডাক্তার হতে চায়।
খেপু। পুরোনো ও ফেলে দেওয়া যন্ত্রপাতি, খেলনা বা জিনিসপত্র দিয়ে সে খেলতে ভালোবাসে। খেপু কিছুটা জেদি ও ঝগড়াটে প্রকৃতির। বৃষ্টি ও কাদা তার পছন্দ। সে কাদা নিয়ে খেলতে ভালোবাসে।
শেরালি একটা মোরগ। তার চলাফেরায় রাজকীয় ও গর্বিত ভাব আছে। রেগে গেলে ডানা ঝাপটায়। পরিবারের প্রতি সে দায়িত্বশীল। তার ডাকে সিসিমপুরবাসীর ঘুম ভাঙে রোজ।
বিজলি হলো একটা মুরগি। শেরালি পরিবারের সদস্যা। সে স্পষ্টবাদী।
টুকটুকি হচ্ছে ছয় বছর বয়সী একটা মেয়ে। সে স্কুলে যেতে পছন্দ করে। পড়তে, গল্প শুনতে, বলতে, নাচতে ও গাইতে ভালোবাসে। টুকটুকি স্বপ্ন দেখতে ও কল্পনা করতে পছন্দ করে। নতুন কিছু জানার ও অন্যদের জানানোর আগ্রহ তার প্রবল। খেলাধুলা তার পছন্দ। সে ক্রিকেট খেলতে বেশি পছন্দ করে। সে বড় হয়ে নভোচারী, কৃষক, শিক্ষক অনেক কিছু হতে চায়।
মেয়েটার কথায় কেমন অনুনয়ের সুর। মেধার খুব খারাপ লাগল। ওর মতোই একটা মেয়ে সে। সারাটা দিন উপোস। মায়ের অসুখ। মেধার ছোট্ট বুকটা কেঁপে উঠল। খুব মায়া হলো মেয়েটার জন্য। আহা রে, বেচারি!
শিকু-হালুম-ইকরি-টুকটুকিদের নিয়ে দিনের পর দিন কত্ত কাহিনি। কত কিছু শেখায় তারা। তবে শুধু টিভির পর্দায় নয়। সিসিমপুরের চরিত্রগুলোর দেখা মেলে এখন বিভিন্ন জায়গায়। আউটরিচ প্রকল্পের আওতায় দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সিসিমপুরের দল যায়। অমর একুশে বইমেলায়ও দেখা মেলে তাদের। বইমেলার শিশুপ্রহরে শিশুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার জন্য হাজির হয় সিসিমপুরের হালুম, ইকরি, টুকটুকিরা।
মেলায় হালুমদের দেখে বাবার কথাগুলো খুব মনে পড়ল মেধার।
মেলা ঘুরে অনেক বইও কেনা হয়েছে তাদের। আর তা নানা রকমের, নানা বিষয়ের বই। মেধার জন্য মজার মজার ছড়া-কবিতা, কমিকস আর গল্পের বই কিনে দিয়েছেন দাদাভাই।
দাদা মতিউর শাহাদাত নিজের জন্যও অনেক মোটা মোটা বই কিনেছেন। তার আম্মুর জন্য কিছু রান্নার বই কিনেছেন দাদা।
কিনতে কিনতে এত্ত বই জমা হয়েছে যে সেগুলো নিয়ে দাদার হাঁটতেই ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। তার ওপর তাকে মেধাকেও সামলাতে হচ্ছে।
ঘুরতে ঘুরতে প্রায় শেষবেলা হয়ে গেছে। বইগুলো ঠিকঠাক এত দূর বয়ে নিয়ে এলেও আর পারছিলেন না মতিউর শাহাদাত। তাই কিছু বই মেলার বের হওয়ার গেটে একজন সিকিউরিটি আঙ্কেলের কাছে জমা রেখে মেধাকে নিয়ে গাড়িতে ফিরে এলেন। তাকে গাড়িতে বসিয়ে বললেন, ‘তুমি বসো দিদিভাই, বাকি বইগুলো নিয়ে আমি এক্ষুনি ফিরে আসছি। খবরদার নামবে না, বুঝেছ।’ মেধা ‘আচ্ছা’ বলে মাথা দোলাল দাদাভাইয়ের কথায়।
তারপর মতিউর শাহাদাত বাকি বই নিয়ে ফিরে এসে আর মেধাকে খুঁজে পাননি।
আসলে হয়েছে কী? মতিউর শাহাদাত চলে যেতেই প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একটা মেয়ে এল। প্রায় মেধার বয়সী। হাতে ফুলের বেণি। কয়েক রকম ফুল দিয়ে তা বানানো। মেধা দেখেছে, এ রকম ফুলের বেণি মাথায় দিয়ে বড়রা অনেকেই মেলায় ঘুরছে। তার মতোই কারও কারও মাথায়ও দেখেছে মেধা। মেয়েটা এসে গাড়ির জানালায় টোকা দিল।
মেধা বুঝে নিল, তার হাতে থাকা ওই ফুল বিক্রি করতে চাইছে তার কাছে। খালি পা। ধুলায় ধূসরিত। গায়ের জামাটাও ময়লা, ছেঁড়া। অপরিপাটি রুক্ষ চুল। মুখটা মলিন। মনে হলো অনেকক্ষণ সে কিছুই খায়নি।
গাড়ির বন্ধ গ্লাস খুলে ফেলল মেধা। মেয়েটা কী বলছে, তা শুনতে চায় সে। মেয়েটা এবার একটু ঝুঁকে বলল, ‘ছুডু আফা গো, একটা বেণি ন্যান গো। হারা দিন কিছু খাই নাই। মায়ের অসুখ। এই ফুলগুলান বেইচ্যা অষুধ কিনুম গো আফা। ন্যান না গো আফা একটা বেণি।’
মেয়েটার কথায় কেমন অনুনয়ের সুর। মেধার খুব খারাপ লাগল। ওর মতোই একটা মেয়ে সে। সারাটা দিন উপোস। মায়ের অসুখ। মেধার ছোট্ট বুকটা কেঁপে উঠল। খুব মায়া হলো মেয়েটার জন্য। আহা রে, বেচারি!
মেধা গাড়ির ভেতর থেকে বাইরে বেরিয়ে এল। প্রথমে ওর নাম জানতে চাইল।
মেয়েটা বলল, ‘মোর নাম নয়ন ছুডু আফা।’
‘বাহ্, সুন্দর নাম তোমার!’
এই সঙ্গে মেধা তার নিজের নামটাও বলল নয়নকে। মেধা জানে, কারও সঙ্গে পরিচিত হতে গেলে নিজের নামটাও বলতে হয়।
নয়ন ওর নাম শুনে বলল, ‘তোমার নামটাও সোন্দর গো ছুডু আফা।’
মেধা খুশি হলো। তারপর সে জেনে নিল, মেয়েটার হাতে থাকা একটা বেণির দাম ৫০ টাকা।
মেধা বলল, ‘তোমার হাতে তিনটা বেণি। আর নেই?’
মেয়েটা বলল, ‘আছে গো ছুডু আফা। আর দিয়া কী করবেন?’
‘আমি তোমার সব ফুলের বেণিই কিনে নেব। কোথায় তোমার বেণিগুলো? আমাকে দেখাবে? আমার দাদাভাই এই চলে এলেন বলে। তিনি এলে তোমার সব বেণি কিনে নেব আমি।’
নয়নের নয়ন সে সময় সত্যি সত্যি চকচক করে উঠল।
‘আহেন আফা, আহেন।’ বলে মেট্রোরেলের মোটা পিলারের ওপাশে নিয়ে গেল মেধাকে।
আর এরই ফাঁকে দাদাভাই ফিরে এসে মেধাকে গাড়িতে না দেখে প্রায় আর্তনাদ করে উঠলেন। আশপাশে ছোটাছুটি শুরু করে দিলেন তিনি। কেউ এ রকম একটা মেয়েকে দেখেছেন কি না, এর-ওর কাছে জিজ্ঞেসও করছেন, কিন্তু কেউ ঠিক বলতে পারছে না। আসলে সবাই সবাইকে নিয়ে ব্যস্ত। কেই–বা খোঁজ রাখবে এসবের? নিজের চুল টেনে ছিঁড়তে ইচ্ছা করছে তার। কেন তিনি গাড়ির দরজা বাইরে থেকে লক করে গেলেন না? আসলে ভেবেছিলেন, এই তো যাবেন আর আসবেন। বেশি সময়ের ব্যাপার তো নয়।
মিনিট তিন-চারের বেশি হবে না। ভয় করতে শুরু করল মতিউর শাহাদাতের এতক্ষণে। কেউ কিছুর লোভ দেখিয়ে মেধাকে নিয়ে গেল না তো! যা দিনকাল পড়েছে। উহ্, তিনি আর ভাবতে পারছেন না।
এ রকম যখন অবস্থা, তখন পেছনে তিনি মেধার ডাক শুনলেন। দাদাভাই, ‘এই যে আমি এখানে...’ মতিউর শাহাদাত চট করে পেছনে ফিরে মেধাকে দেখতে পেয়ে প্রায় দৌড়ে গিয়ে মেধাকে কোলে তুলে নিলেন। ডুকরে কেঁদেও ফেললেন তিনি।
মেধা ঠিক কিছু বুঝতে পারল না, দাদাভাই কাঁদছেন কেন? সে বলল, ‘কী হয়েছে দাদাভাই, তুমি কাঁদছ কেন?’
দাদাভাই ওর কপালে চুমু দিয়ে ভেজাকণ্ঠে বললেন, ‘তুই কই চলে গিয়েছিলি দিদিভাই? আমি না তোকে পইপই করে নিষেধ করলাম, গাড়ি থেকে নামবি না? আমার তো তোকে না দেখে ভয়ে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল। চল, আর না। এখন বাসায় ফিরে যাই।’
ওদিকে নয়ন তার দাদাভাই এবং মেধার কথোপকথন ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে চেয়ে দেখছে। এই ঘটনায় যেন ও–ই দায়ী, এমনভাবে মুখ কাঁচুমাচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
মেধা দাদাভাইয়ের কোল থেকে নামল। বলল, ‘আমি দূরে কোথাও যাইনি তো দাদাভাই। এই যে নয়নের সঙ্গে ওই যে ওখানে গিয়েছিলাম।’ হাত দিয়ে দেখাল সে দাদাভাইকে।
ঘটনার আকস্মিকতায় নয়ন বিমূঢ় হয়ে পড়েছে। অতগুলো টাকা পেয়ে ভীষণ খুশি হয়েছে নয়ন, কিন্তু মেধার দাদাভাই না বললে সে তো নিতে পারবে না এই টাকা। আর এত টাকার বেণি তার কাছে নেইও।
আর বলল, ‘জানো দাদাভাই, ওর নাম নয়ন। ওর মা খুব অসুস্থ। বাবা নেই। ওষুধ কেনার টাকা নেই। আজ সারা দিন প্রায় কিছুই খায়নি। এই ফুলের বেণি বিক্রি করে মায়ের জন্য ওষুধ কিনবে। নাও না দাদাভাই, ওর কাছ থেকে বেণিগুলো কিনে।’
মেধার দাদাভাই মতিউর শাহাদাত বুঝলেন ব্যাপারটা। মেয়েটার মন বড্ড বেশি নরম। খুব খুশি হলেন তিনি। বললেন, ‘সে তুমি কিনতেই পারো ওর কাছ থেকে। কিন্তু তুমি গাড়ি থেকে বের হলে কেন? কত রকম বিপদ হতে পারত জানো?’
‘যাহোক, নাও একটা বেণি। এই মেয়ে, দাম কত বেণিটার?’
মেধা বলল, ‘না দাদাভাই, একটা নয়। সব বেণি কিনতে হবে। আমি বলেছি ওকে। তুমি এসে সব বেণি কিনে নেবে।’
‘কিন্তু এত বেণি দিয়ে কী করবে শুনি? একটাই নাও, দিদিভাই।’
মেধা তার কথায় অনড়। বলল, ‘না, তা হবে না। ওর মায়ের অসুখ, তুমি বুঝতে পারছ না?’
মেধা যে কী চায়, মতিউর শাহাদাত বুঝলেন আবার। আরও একটু পরখ করার জন্য তিনি বললেন, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, দুটো-তিনটে নিয়ে নাও। এই মেয়ে, দাও দেখি তিনটে বেণি। আর এই নাও টাকা...’ বলে তিনি মেয়েটার হাতে এক শ টাকার একটা নোট গুঁজে দিতে গেলেন।
মেধা যেন এবার ফুঁসে উঠল। বড় মানুষের মতো করে বলল, ‘ছি! দাদাভাই। এমন করে না। তুমি না আমার জানটু দাদাভাই...’ এই বলে সে দাদাভাইয়ের পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিল। আর বের করে আনল বই কিনে অবশিষ্ট থাকা সব টাকা। তা–ও দেড় হাজারের মতো হবে। মুঠো করে নয়নের হাতে দিয়ে দিল মেধা। বলল, ‘যাও, এই টাকা দিয়ে মায়ের জন্য ওষুধ কিনবে। আর খাবার কিনে নিয়ে যাবে, বুঝেছ?’
ঘটনার আকস্মিকতায় নয়ন বিমূঢ় হয়ে পড়েছে। অতগুলো টাকা পেয়ে ভীষণ খুশি হয়েছে নয়ন, কিন্তু মেধার দাদাভাই না বললে সে তো নিতে পারবে না এই টাকা। আর এত টাকার বেণি তার কাছে নেইও।
দাদাভাই মতিউর শাহাদাত মেধার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আর কিছু বলতে চাইলেন না। অবশ্য, ভেতরে–ভেতরে দারুণ খুশিই হয়েছেন তিনি। তার এই ছোট্ট দিদিভাইয়ের এই হৃদয়টা চিরদিন বেঁচে থাক, এই কামনা করলেন মনে মনে।
বললেন, ‘ঠিক আছে। তুমি যা বলছ, তা–ই হোক। এই মেয়ে, তাহলে তোমার বেণিগুলো দাও।’
নয়ন এবার সাহস ফিরে পেয়েছে। আনন্দে ওর মুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। খুশিতে ও কিছু বলতেই পারল না। ফুলের বেণিগুলো মেধার হাতে তুলে দিল সে। নয়ন তো হতভম্ভ।
এখানেও মেধা আরেকটা কাজ করল। ও বেণিগুলো থেকে একটা ছোট ওর মাথার জন্য, আরেকটা বড়, যা ওর মায়ের জন্য বেছে নিয়ে বাকিগুলো নয়নের হাতে ফেরত দিল। আর বলল, ‘এগুলোও তোমার নয়ন। এই বেণিগুলো বিক্রি করে যে টাকা হবে, তা দিয়ে একটা সুন্দর জামা কিনবে তুমি। বুঝেছ?’
মেধার দাদাভাই মতিউর শাহাদাত এবং নয়ন যেন নতুন করে বোবা হয়ে গেছে। কেউই আর কিছু বলতে পারল না।...