বড্ড গরম পড়েছে আজ। কিন্তু ওদের জিরানোর জো নেই। পেটের দায় বলে কথা! সুন্দরবনের কাছাকাছি গ্রাম ট্যাংরাখালিতে বাড়ি ওদের।
ভটভটিটা যখন ভটভট আওয়াজ তুলে ছাড়ল, আকাশে তখন একটুকরা মেঘও নেই। ওপরে নীল আকাশ, নিচে ঘোলা পানি, আর পানির ওপরে ভটভটি নামের ইঞ্জিন লাগানো ডিঙিতে ওরা তিনটি প্রাণী। সতীশ, মলয় আর কালু। ফরেস্ট অফিস থেকে ‘পারমিট’ নিয়ে বনে ঢুকবে। এখানে পয়লা এপ্রিল থেকে পনেরোই জুন পর্যন্ত মধু সংগ্রহের মৌসুম।
ফরেস্ট অফিসটা নদী এবং বন থেকে বেশ উঁচুতে। কাঠের খুঁটির ওপর তৈরি করা পাটাতনকে মেঝে হিসেবে বানিয়ে কাঠ দিয়েই নির্মাণ করা হয়েছে বন বিভাগের এই অফিস। পাশেই আলাদা পাটাতনের ওপর বানানো বাড়িতে বাস করে বন বিভাগের লোকজনের পরিবার-পরিজন। অফিসের সঙ্গে কাঠের তৈরি উঁচু পথ দিয়ে যাওয়া যায় সেই বাড়িতে। খুঁটির ওপর বানানো তেমন একটা উড়াল পথই গিয়ে থেমেছে নদীর ওপরে। সেখান থেকে মইয়ের মতো সিঁড়ি নেমে গেছে পানি পর্যন্ত। সেই সিঁড়িপথেই উঠে এল ওরা। সময় বিশেষ লাগল না। ওদের সঙ্গে বন বিভাগের লোকজনের ভালোই পরিচয় আছে। একে তো বাড়ি ওদের কাছের গ্রামেই, তার ওপর বনই ওদের জীবন-জীবিকা। তাই বন বিভাগের সঙ্গে সুসম্পর্ক না রেখে যে ওদের উপায়ই নেই। সেই সম্পর্ক রাখতে গিয়ে এটাসেটা ভ্যাটও দিতে হয় মাঝেমধ্যেই। মৌচাক কাটতে গেলে ফিরতি পথে চাক ভাঙা মধুর বেশ খানিকটা সাহেবদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষার কথা মনে রেখে এখানে রেখে যেতে হয়। বনে ঢুকতে ঢুকতে সূর্য একটু পশ্চিমে কাত হলো। ওরা বুঝল, কাজকর্ম খুব বেশি হওয়ার উপায় আজ আর নেই। তবু খানিকটা ভেতরে গিয়ে নৌকা ভেড়াল। কাদার ভেতর থেকে মাথা উঁচিয়ে রাখা শুলোর খোঁচা এড়িয়ে বনের মধ্যে কিছুটা এগোতেই মৌমাছির দেখা পেল। বনে আসে ওরা অনেক বছর। মৌমাছির গতিপ্রকৃতির সঙ্গে পরিচয় আছে ভালোই। তাই চাক খুঁজে বের করতে সময় লাগল না বিশেষ। লাঠির আগায় গোলপাতা বেঁধে তারা সামনের দিকে গেল। গাছের নিচে দাঁড়িয়ে লাঠির আগায় বাঁধা গোলপাতায় আগুন ধরিয়ে সেই ধোঁয়ায় মৌমাছি তাড়িয়ে গাছে উঠল সতীশ। তারপর কেটে আনল চাক। ততক্ষণে সূর্য বেশ হেলে পড়েছে। আরও দেরি করলে যে মহাবিপদে পড়ে যেতে পারে, সে কথা বেশ জানা আছে ওদের।
জল-কাদা আর শুলো মাড়িয়ে খাল পর্যন্ত যাওয়াই দুষ্কর। কোনোমতে খালে গিয়ে নৌকায় উঠল ওরা। চাকটা বিশেষ বড় ছিল না বলে মধুও বিশেষ হলো না এ যাত্রায়। তবে সবে তো প্রথম দিন। রাতের বেলায় বড় খালের মাঝখানটায় খুঁটি গেড়ে নৌকা বেঁধে রাখল। তারপর ক্লান্ত দেহ এলিয়ে দিল নৌকার পাটাতনে।
পরিশ্রমী মানুষ ওরা। সারা দিনই হাড়ভাঙা খাটনি যায়। তাই সাঁঝরাতেই ঘুমিয়ে পড়ে। তবে ঘুম ভাঙে পাখি নীড় ছাড়ার সময়ই। পরদিনও তার ব্যতিক্রম হলো না। ভোরে আবার জাল পেতে মাছ ধরতে হবে। চাল, ডাল, লবণ, তেল আর মিষ্টি জল সঙ্গে আছে। মাছ ধরে রেঁধে খেতে হবে। নৌকাটা টেনে খালের ধারের বড় একটা গাছের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বাঁধল কালু। সেই গাছটার পেছনেই হেঁতাল ঝোপ। আকাশ তখন ফরসা। সূর্য কিছুক্ষণের মধ্যেই উঠবে। দড়ি বাঁধা শেষ করে খালের দিকে পা ফেলেছে সে। এমন সময় মলয় লক্ষ করল, হেঁতাল ঝোপটা আস্তে করে দুলে উঠল। বাতাস বইছে না। আশপাশের কোনো গাছের একটি পাতাও নড়ছে না। তাহলে ব্যাপারটা কী? জাত মৌয়াল ওরা। বাতাসের ঘ্রাণ শুঁকে বলে দিতে পারে বহু কিছু। তাড়াতাড়ি নৌকায় চলে আসার জন্য কালুকে ইশারা করার জন্য হাত উঁচিয়ে ডাকতে যাবে ও, এমন সময় প্রবল ঘূর্ণি উঠল হেঁতাল বনে। এরই মধ্যে হাতটা কোনো রকমে ওপরে তুলল ও। ঝোপের ডালে যেন একটা আলোড়ন উঠল। সে মাত্র মুহূর্তের ব্যাপার! দৃশ্যপটে আবির্ভূত হলো ডোরাকাটা যম। সঙ্গে সঙ্গে গগনভেদী হুংকারে কেঁপে উঠল বনভূমি। থেমে গেল পাখির ডাক, বানরের কিচিরমিচির। দাঁড়ানো কালু ধপাস করে মাটিতে পড়ে গেল। হই হই করে উঠল মলয় আর সতীশ। হাতে তুলে নিল দাঁড়। তারপর বাঘের মতোই গর্জন তুলে ঝাঁপিয়ে পড়ল বাঘের সামনে। বাঘটা এমন কিছু আশাই করেনি। দুপেয়ে দুর্বল এ প্রাণী দুটো পালাতে দিশে পাবে না বলেই ধরে নিয়েছিল সে। দুটো হ্যাংলাপাতলা মানুষই কিনা ঝাঁপিয়ে পড়েছে ওর ওপর? ঘটনার আকস্মিকতায় ভড়কে গেল বাঘ। একমুহূর্তের জন্য ওদের দিকে তাকিয়ে পিছু হঠল ভীমদর্শন।
কালুকে ধরাধরি করে আনা হলো নৌকায়। দেখা গেল, বাঘ তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার আগেই সে পড়ে গেছে মাটিতে। বাঘের গর্জন আর মলয়ের হাত ইশারার ঘটনা প্রায় একসঙ্গে ঘটায় কালু বুঝে ফেলে যে কী ঘটতে চলেছে। বাঘ যে তার ঘাড় মটকে দিল বলে, সেটা বুঝতে পেরে ভয় পেয়ে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে গেছে সে। ভাগ্যক্রমে তার গায়ে বাঘের একটা আঁচড়ও লাগেনি!
মাছ ধরা লাটে উঠল। লগি ঠেলে খাল পেরিয়ে মাঝনদীতে এসে হাঁপ ছাড়ল ওরা। সতীশ বলল, ওই খালটার ধারে আছে বাঘের বাসা। কেনোরকমে বাঁচা গেছে। কান ছুঁয়ে গেছে গুলি। ওই খালে আর নয়।
ততক্ষণে কালুও সুস্থ হয়ে উঠে বসেছে। তিনজন মিলে ঠিক করল, আরও দূরের বনে যাবে, বন যেখানে আরও গহিন। তবে নদী থেকে ঢুকে যাওয়া বড় খালের আশপাশেই থাকবে, যাতে বিপদ দেখলে তাড়াতাড়ি সরে পড়া যায়। বড় নদী দিয়ে অনেকটা পথ গিয়ে বড় খালে ঢুকে ভেতরের একটা ছোট খালের মুখে গিয়ে বাঁধল নৌকাটা। জাল দিয়ে কিছু মাছ ধরল। তারপর রাঁধাবাড়া সেরে খাওয়াদাওয়া করতে করতে চলে গেল অনেকটা সময়। এবার চাক কাটতে যেতে হবে। তবে বনের ভেতর ঢোকার ব্যাপারে আগের চেয়ে বেশি সতর্ক ওরা। বাঘকে বিভ্রান্ত করার জন্য মাথার পেছন দিকে মুখোশ পরে নিয়েছে। ওরা জানে, বাঘ সব সময় পেছন দিক দিয়ে আক্রমণ করে। লাফিয়ে উঠে কামড় বসায় ঘাড়ে। বাঘের চোয়ালে ভীষণ জোর। দুই চোয়াল দিয়ে চেপে ধরে দাঁত বসিয়ে দিলে, মটমট করে মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙে গেলে মানুষের মৃত্যু হয় তৎক্ষণাৎ। মুখোশের চেহারাকে আসল মানুষের বলে ভুল করে বাঘ ঘোরা পথে মানুষের পেছন দিক মনে করে সামনের দিকে এলে তাকে প্রতিরোধ করা যায়, আবার তার কাছ থেকে পালিয়ে আত্মরক্ষাও করা যায়।
গমগমে আওয়াজ তুলে বলল ধেড়ে ডাকাতটা, তুই তো ভারি ত্যাঁদড়! মুখে মুখে তর্ক করেই চলেছিস! মোবাইল নেই, এটা বললেই চুকেবুকে যায়। এবার বাড়ির কাছের বা গাঁয়ের কারও মোবাইল নম্বর দে।
দা, লাঠি এসব নিয়ে বনে ঢোকার উদ্দেশ্যে তৈরি হলো ওরা। এমন সময় ঘটল এক আশ্চর্য ঘটনা। এই খালের মুখটার ঠিক উল্টো পাশে ঢুকে গেছে আরেকটা ছোট খাল। সেই খাল থেকে তীরবেগে বেরিয়ে এল একটা ছোট নৌকা। তাতে বসা সাতজনের একটা দল। প্রত্যেকের হাতে আছে পাইপগান। নৌকার ওপরেও পড়ে আছে অস্ত্র। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওদের বেঁধে ফেলল সেই লোকগুলো। ওদের আর বুঝতে বাকি রইল না যে বনডাকাতের খপ্পরে পড়েছে। এবার ওদের চোখ বেঁধে নিয়ে গেল। তবে কোথায় নিয়ে গেল, তা তো আর বোঝার সাধ্য ওদের রইল না। শুধু বুঝল, ভয়ংকর এক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে।
দীর্ঘ সময় ধরে পথ চলে বনের এক প্রত্যন্ত এলাকায় গিয়ে থামল ডাকাতদের নৌকা। চোখের বাঁধন খুলে দিলে ওরা দেখল, ওদের বসিয়ে রাখা হয়েছে বড় একটা নৌকায়। হাত বাঁধা পিছমোড়া করে। ডাকাতদের সরদার গোছের একটা গুঁফো লোক ওদের সামনে চেয়ারে বসে ঠ্যাং দোলাচ্ছে। তিরিক্ষি মেজাজ নিয়ে বলল সে, বনে এসেছ। তো টাকাপয়সা কোথায়? চাল-ডালও তো কিছুই পাওয়া যায়নি। খাবে কী?
সতীশ একটু ঠোঁটকাটা ধরনের। বন্ধুরা বলে, কাণ্ডজ্ঞানেরও ঘাটতি আছে কিছুটা। কোথায় কী বলতে হবে, তা না ভেবেই বেফাঁস একটা কিছু বলে ফেলে সে। তবে ওর নিজের ধারণা, বেফাঁস কিছুই বলে না সে। সত্য কথাটা একটু সোজাসাপ্টা বলে দেয়, এ-ই যা। সরদারটা যখন রাগ দেখাচ্ছে, তখন মৃদু স্বরে বলল সতীশ, বনে তো বড় কোনো বাজার নেই, হোটেলটোটেলও নেই। তা টাকাপয়সা কোন কারণে আনবে মানুষ? যারা যে কদিন বনে থাকবে, তার উপযোগী চাল-ডালই তো আনবে। এখানে তো দান–দক্ষিণার জায়গা নেই। তাহলে বাড়তি টাকা আনার দরকারটাই–বা কী? তবে আমাদের কথা বিবেচনা করলে এত সব কথা না বললেও চলে। কারণ আমরা হলাম গরিব মৌয়াল। দিন আনি দিন খাই। আমাদের কোনো ছুটি নেই। এক দিন কাজ করতে না এলে বাড়িসুদ্ধ লোক না খেয়ে মারা পড়বে। ভিটেটা ছাড়া এক চিলতে জায়গাও নেই। চাক কেটে, মাছ ধরে অতি কষ্টে দিন কাটে আমাদের। বলতে গেলে মরতে মরতে বেঁচে আছি। আমরা টাকা কোথায় পাব?
রক্তজবার মতো চোখ দুটো পাকিয়ে হুংকার দিয়ে উঠল সরদার, তবে রে শয়তান! মুখে মুখে তর্ক জুড়েছিস? জানিস, কার সামনে কথা বলছিস? বিশু ডাকাতের চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারে, এমন মানুষ এখনো পয়দা হয়নি। টাকা নেই? তোদের এমনি এমনি এখানে এনেছি? জনপ্রতি এক লাখ টাকা করে আমার চাই। দিনমজুরি করিস? টুকরা টুকরা করে কেটে কুমির দিয়ে খাওয়ালে তখন সবাই টের পাবে। মেরে জলে ভাসিয়ে দেওয়ার কথা জানতে পারলে দেখবি সুড়সুড় করে কেমন টাকার বান্ডিল নিয়ে হাজির হয় বাড়ির লোকেরা। টাকা কী করে বের করতে হয়, তা আমার বেশ জানা আছে। এক লাখ করে তিনজনে তিন লাখ টাকা! হায় হায় করে উঠল মৌয়ালরা। লাখ টাকা তো ওরা বাপের জন্মেও চোখে দেখেনি। তিন লাখ টাকা কী করে জোগাড় করবে ওদের পরিবার? চোখে সর্ষে ফুল দেখল তারা। এবার গাট্টাগোট্টা একটা ধেড়ে ডাকাত চোয়াল শক্ত করে বলল, পরশু বিকেলের মধ্যে আমাদের হাতে তিন লাখ টাকা না এলে নির্ঘাত কামোট-কুমিরের পেটে চালান হয়ে যাবে। অনন্তকাল তোমাদের অন্ন ধ্বংস করতে দেব না।
মলয় ধরা গলায় বলল, আমাদের প্রাণে মারবেন না হুজুর। টাকা আমরা কোথায় পাব? ভিটেমাটি ছাড়া এক চিলতে জায়গাও নেই।
টাকা নেই তো ধার করবি, জ্ঞান দিল ধেড়েটা।
কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল মলয়, আমাদের মতো পথের ভিখিরিকে কে দেবে ধার? তা–ও অতগুলো টাকা! ওই টাকা শোধ করব কী করে? তা ছাড়া জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যারা জঙ্গলে মাছ আর কাঁকড়া ধরতে আসে, তাদের সেই ন্যায্য টাকাই মহাজনেরা দিতে চায় না। গরিবকে তারা কি টাকা ধার দেবে? দুনিয়ায় গরিবের জন্য কে আছে?
সুদে ধার নিবি, উপদেশ বর্ষণ করল ধেড়ে ডাকাত।
কিন্তু তাকে থামিয়ে দিয়ে হুংকার দিয়ে উঠল সরদারটা, কে তোকে টাকা দেবে, কীভাবে শোধ করবি, সেসব নিয়ে ভেবে ভেবে আমরা মাথা নষ্ট করি আর কী! যত্তসব! তোদের বাড়ির ঠিকানা দে। মোবাইল নম্বর দে। হাহাকার করে উঠল কালু, হুজুর, মোবাইল আমরা পাব কোথায়? আর যদি বিনে পয়সায় কেউ মোবাইল-টোবাইল দানটান করে, তাহলেও তো তা চালাতে পারব না। ওতে তো কী সব ইংরেজি-টিংরেজি লেখা থাকে, কী সব নম্বর-টম্বর থাকে। আমরা ওসবের জানিটা কী! বাংলাও তো পড়তে পারি না। তবে বাড়ি আমাদের ট্যাংরাখালি, এটুকু বলতে পারি।
গমগমে আওয়াজ তুলে বলল ধেড়ে ডাকাতটা, তুই তো ভারি ত্যাঁদড়! মুখে মুখে তর্ক করেই চলেছিস! মোবাইল নেই, এটা বললেই চুকেবুকে যায়। এবার বাড়ির কাছের বা গাঁয়ের কারও মোবাইল নম্বর দে। যেভাবেই হোক, তোদের বাড়িতে কাল সকালের মধ্যেই খবর পৌঁছে যাবে। পরশুর মধ্যেই টাকা চাই, নইলে ঘ্যাচাং।
কথা শেষ হতেই অট্টহাসি দিল সরদারটা। সঙ্গে তাল মেলাল ধেড়েটা। কিন্তু তিন দরিদ্র মৌয়ালের মাথায় পড়ল বাজ। ওরা খুব জানে, কিছুতেই ওদের কোনো পরিবারই এক লাখ করে টাকা জোগাড় করতে পারবে না। এর পরিণতি হলো ওদের মৃত্যু। আর তার ফলে তিনটে পরিবারই পথে বসে যাবে। কথা শেষে তিনজনকে তিন আলাদা নৌকায় রাখল ডাকাতেরা। প্রতিজনের জন্য পাহারায় রইল দুজন করে ডাকাত। হতভাগা মৌয়ালদের নিজেদের মধ্যে কথা বলার সুযোগটা পর্যন্ত নষ্ট হলো। অন্য দুজন পুরোপুরি ভেঙে পড়লেও সতীশ ভাবতে লাগল, কী করে রক্ষা পাওয়া যায়। নিশ্চেষ্ট হয়ে হাত-পা ছেড়ে দিলে মৃত্যু যে অনিবার্য, তা–ও ভালোভাবে বুঝল।
রাতে একসময় সবাই ঘুমিয়ে পড়ল। পাহারাদার দুটোও ঢুলতে শুরু করল। কিন্তু ওর চোখে ঘুম এল না।
রাতের তখন শেষ প্রহর। দুই পাহারাদারই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আকাশে চাঁদ থাকলেও তার আলো ওপরের গাছের ডালপালার ছাদ গলিয়ে নৌকা পর্যন্ত আসতে পারছে না। চারদিকে ভুতুড়ে নীরবতা এবং নিকষ আঁধার। সেই অন্ধকারেই নিশাচরের মতো এগিয়ে গেল সে একটা গলুইয়ের দিকে। মৃত্যু তার আগেও নিশ্চিত ছিল, এখনো। শুধু শেষবারের মতো চেষ্টা, বাঁচার। ওর নড়াচড়াতে নৌকা একটু দুলে উঠেছিল, কিন্তু দুটো লোকই পাশাপাশি শুয়ে হাত-পা ছড়িয়ে দিয়েছে। পাশে পড়ে আছে বন্দুক। পাটাতনের ওপর গড়াগড়ি খাচ্ছে মদের বোতল। বোঝা যাচ্ছে নেশা করেছিল এবং এ ঘুম হলো নেশার ঘুম। তাই ঘুম ভাঙার কোনো সম্ভাবনা নেই। তবু সাবধানের মার নেই। বোতল দিয়ে কষে দুটো বাড়ি মারল দুই ডাকাতের মাথায়। আঘাতের শব্দ আর ঢেউয়ের ছলাৎ ছলাৎ মিলেমিশে হয়ে গেল একাকার। অন্য নৌকাগুলোতেও সবাই ছিল গভীর নিদ্রায়। তাদের কারোরই ঘুম ভাঙল না। আর আঘাতের পর এই নৌকার পাহারাদারদের নিদ্রা হলো গভীরতর। ওরা যে জ্ঞান হারিয়েছে, তা বুঝতে ওর অসুবিধা হলো না মোটেও।
আমি তোমার মতো সাহসী আর বুদ্ধিমান মৌয়ালের দেখা এ জীবনে পাইনি। তুমি যা করে দেখালে, তা ভাবা যায় না। ধূর্ত বিশু ডাকাতের টিকিটির নাগালও আমরা কেউ পাইনি।
মাঝি হিসেবে সতীশ খুবই দক্ষ। তুফানের রাতেও জোয়ারের বিপরীতে দাঁড় বাওয়ায় ওর কোনো জুড়ি নেই। অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে অতি সন্তর্পণে নৌকার বাঁধন খুলে দিল সে। নৌকাটা সামান্য একটু দুলে উঠল। তারপর লগির ঠেলায় কিছুক্ষণের মধ্যেই খাল ছেড়ে পড়ল গিয়ে নদীতে। কিছুটা সময় দাঁড় বেয়ে তারপর স্টার্ট দিল ইঞ্জিন। প্রথম লক্ষ্য ডাকাতদের আস্তানা থেকে দূরে যাওয়া। পরবর্তী লক্ষ্য বন বিভাগের লোকজনের সাহায্য নিয়ে মলয় আর কালুকে উদ্ধার করা। ও জানে, কাজ বড় কঠিন। কিন্তু এত রাতে কাকেই–বা পাবে সে! যদিও বন্দুকের কবজা এখন ওর হাতে, কিন্তু ডাকাতগুলোর জ্ঞান ফেরার আগেই করতে হবে যা কিছু করার। অনিশ্চিত যাত্রার মধ্যে রাত শেষ হয়ে এল। আলো-আঁধারির মধ্যেই নদীর ধারে গোলপাতার একটা বড় নৌকার দেখা পেল সে। কাছে গিয়ে দেখল, তাদের ঘুম তখনো ভাঙেনি। তাড়াতাড়ি তাদের ডেকে তুলে সব ঘটনা খুলে বলল। নৌকায় গোলপাতার বড় কারবারি নিজেই ছিলেন। তিনি বললেন, আমার কাছে মোবাইল আছে। ব্যাটারি দিয়ে মোবাইল চার্জারের ব্যবস্থাও আছে। তবে বনের এখানটায় নেটওয়ার্কের বড্ড সমস্যা। টাওয়ার পাওয়া যায়, আবার যায় না। ফরেস্ট অফিসে টাওয়ার আছে। ফরেস্ট অফিসের নম্বর আমার কাছে আছে। অফিসারের সঙ্গে আমার সম্পর্কও খুব ভালো। দাঁড়াও দেখছি।
কিছুক্ষণের চেষ্টায় ফরেস্ট অফিসে যোগাযোগ করতে পারলেন তিনি। তারপর বললেন, ওরা আসছেন। তার আগে আমরা বেঁধে ফেলি দুই শয়তানকে। বলা তো যায় না, কখন জ্ঞান ফিরে আসে!
ডাকাত দুটোকে কষে বেঁধে বড় নৌকায় তোলা হলো। তারপর কারবারি বললেন, আমরা বরং আরও একটু এগিয়ে যাই ফরেস্ট অফিসের দিকে। ওদের সঙ্গে আমরা নদীতে মিলিত হয়ে একসঙ্গেই এগিয়ে আসব। বলা তো যায় না, কখন ডাকাতেরা এসে পড়ে বা সটকে পড়ে।
খুব বেশিক্ষণ অবশ্য চলতে হলো না। বড় নদীতেই দেখা হয়ে গেল বনরক্ষী বাহিনীর সঙ্গে। তারা খবর দিয়ে কোস্টগার্ডের একটা টহল বোটকেও আনিয়েছেন। দলটা এখন বেশ বড়। বিশু ডাকাতের কথা শুনে তারা বেশ উত্তেজিত। কারণ বেশ কিছুদিন থেকেই এই ডাকাত ছিল সুন্দরবনের একটা বিরাট অংশের ত্রাস। বনরক্ষীরা তাদের দমন করতে হিমশিম খাচ্ছিল।
চলতে চলতেই জ্ঞান ফিরল ডাকাতগুলোর। ওদের কাছ থেকে বেশ কিছু তথ্য পাওয়া গেল। তবে সবচেয়ে দামি তথ্য হলো, বিশু ডাকাতের আস্তানার ঠিকানা। ওরা যখন ডাকাতদের আস্তানায় পৌঁছাল, তখন সূর্য ওঠে ওঠে অবস্থা। কিন্তু গাছপালার ঠাসবুননির মধ্যে যেখানে ওদের আস্তানাটা, সেখানে তখনো রাতের আঁধার। পুরো দলের ডাকাতগুলোর তখনো ছোটেনি নেশার ঘুম। বেমক্কা ধরা পড়ল তারা। তাদের নিয়ে আসা হলো ফরেস্ট অফিসে। উদ্ধার পেল মলয় আর কালু।
ফরেস্ট অফিসার বললেন সতীশকে, আমি তোমার মতো সাহসী আর বুদ্ধিমান মৌয়ালের দেখা এ জীবনে পাইনি। তুমি যা করে দেখালে, তা ভাবা যায় না। ধূর্ত বিশু ডাকাতের টিকিটির নাগালও আমরা কেউ পাইনি। আমাদের লোকজনও তাকে এবং তার বাহিনীকে বাগে আনতে পারেনি, তুমি তার সাঙাতদের পর্যন্ত ধরিয়ে দিলে! নিজের জীবন শুধু নয়, অন্য দুজনের জীবনও রক্ষা করলে। আজ বন বিভাগের বোটে করে তোমরা বাড়ি ফিরবে সসম্মানে।
জবাবে মাথা নিচু করে বিড়বিড় করে কিছু একটা বলার চেষ্টা করল সতীশ। ওর সেই কথাগুলো শোনা গেল না। শুধু ওর চোখের কোণে চিকচিক করা পানি স্পষ্ট দেখা গেল।