সাই-ফাই লেখার বিপদ

‘নাম?’

‘বিরজু। বিরজু মহারাজ।’

‘মহারাজ? কে মহারাজ? শোনেন এটা কোর্ট। ফাজলামি করার জায়গা না। শুধু ইয়োর অনার বললেই চলবে। ঠিক আছে?’

‘ওটা আমার নাম ইয়োর অনার।’

‘কী?’

‘জি।’

রেগে গিয়েছিলেন। এবার গম্ভীর হলেন বিচারপতি।

‘আর কোনো নাম নেই?’

‘জি আছে। পরবাসী কোল।’

এটাও নিশ্চয়ই বানানো নাম। ভাবলেন বিচারক। কিন্তু এ নিয়ে আর বিতং করা ঠিক হবে না ভেবে পরের প্রশ্নে চলে গেলেন তিনি।

‘পেশা?’

‘আমি লিটারারি এজেন্ট। লেখকদের নিয়ে আমার কাজকারবার। মূলত সায়েন্স ফিকশন লেখকদের নিয়ে কাজ করি আমি। তাদের লেখা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ছাপার এবং বই প্রকাশের ব্যবস্থা করি। বেতন ছাড়াও বই বিক্রির ওপর কমিশন পাই।’

বিচারকের দৃষ্টি এবার স্থির হলো কোলের পরে। লোকটার মুখে স্মিত কিন্তু নিরানন্দ একচিলতে হাসি ঝুলে আছে। ফাজিল টাইপের লোক, কোনো সন্দেহ নেই, মনে মনে ভাবলেন তিনি। ‘শোনেন কোলাবাবু, ডক্টর জায়েদ ইকবালের মৃত্যুর বিচার বিভাগীয় তদন্ত চলছে। দায়িত্বটা দেওয়া হয়েছে আমাকে। আপনার বাড়ির কাছেই তার লাশ পাওয়া গেছে। হাতে পিস্তল আর মাথায় বুলেট ছিল। আত্মহত্যার একটা আওয়াজ উঠেছে, কিন্তু...’

‘...ধোপে টিকছে না।’

বিচারক চোখের পলক ফেললেন। ‘আপনি চাইলে ওভাবেও দেখতে পারেন।’

‘আমি আরও গভীরভাবে খতিয়ে দেখতে চাই বিষয়টা। আত্মহত্যার যে গুজব উঠেছে সেটা আসলেই হাস্যকর। ওটা ছিল একটা কাভারআপ। মূল বিষয়টা থেকে মনোযোগ সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা। বোঝাই যাচ্ছে, সেটা কাজে লাগেনি। তবে এ রকম পরিস্থিতিতে এর বেশি কিছু করার আইডিয়া আর মাথায় আসেনি আমার, ইয়োর অনার।’

তার মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন, আপনিই ডক্টর ইকবালকে খুন করেছেন?

‘অফ কোর্স।’ বেশ জোর দিয়ে বললেন কোল।

হকচকিত বিচারকের দৃষ্টি দ্রুত এক পাক ঘুরে এল জুরিবোর্ডের ছয় সদস্য, তাদের পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা দুজন পুলিশ কনস্টেবল এবং উপস্থিত দর্শকদের দিকে। সবাই রীতিমতো স্তম্ভিত। এমনকি শুনানি কাভার করতে আসা সাংবাদিকও সর্বশেষ সংবাদের স্কুপ দেওয়ার জন্য মোবাইল করতেও ভুলে গেল। বলে কী লোকটা? শুনানি শুরুর আগেই অপরাধ কবুল করে নিল।

বিচারক আবার তাকালেন কোলের দিকে। দোষ যখন কবুল করেছেই, এখন সাজা দিয়ে দিলেই হয়। কিন্তু বিষয়টা একটু খতিয়ে দেখতে চাইলেন তিনি। ‘তা কেন খুন করেছেন তাকে?’

‘আমাদের জন্য খুব বিপজ্জনক হয়ে উঠছিলেন উনি, ইয়োর অনার।’

‘আমাদের বলতে আপনি কী বোঝাতে চাচ্ছেন?’

‘আমরা মানে এলিয়েনদের কথা বলছি, ইয়োর অনার।’

এবার হতাশ হলেন বিচারক। লোকটা কি পাগল? পাগলেরাও খুন করতে পারে, কোনো সন্দেহ নেই। নাকি ভান করছে সাজা এড়ানোর জন্য? জেরা চালিয়ে যাওয়াই ঠিক করলেন বিচারক।

‘তাই নাকি? একজন এলিয়েনের বিচার করতে বসেছি তা জানা ছিল না আমার।’ একটু শ্লেষ মিশিয়ে বললেন তিনি।

কোল নির্বিকার। ‘আমি অবশ্য জুতসই অস্ত্রটা ব্যবহার করতে পারিনি তখন। করতে পারলে আর এত ঝামেলা হতো না। আপনারা কিছুই টের পেতেন না। যাহোক আমরা ভুল থেকে শিক্ষা নিচ্ছি। চেষ্টা করছি সতর্ক হওয়ার।’

উন্মাদ! বদ্ধ উন্মাদ! ভাবলেন বিচারক। লোকটার জন্য করুণাও তৈরি হলো তাঁর মনে। তবু ফের জিজ্ঞেস করলেন, ‘ডক্টর ইকবালের মতো একজন গুণী লোককে ঠিক কী কারণে মেরেছেন বলুন তো? কেন সে বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিল। সামান্য একজন লেখক...।’

‘লেখক, কিন্তু শুধু লেখক নন। উনি সায়েন্স ফিকশন রাইটার। আমরা এলিয়েনরা লক্ষ করেছি, আমাদের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক হচ্ছে এসব সায়েন্স ফিকশন লেখকেরা। বানিয়ে বানিয়ে আমাদের নিয়ে গল্প লেখে এরা। কিন্তু ঘটনাচক্রে কিছু কিছু আবার মিলেও যায়। এদের কিছু গল্পের কারণে আমাদের কিছু প্ল্যান ফাঁস হয়ে গেছে, ইয়োর অনার। যদি হঠাত্ লোকজন বুঝে উঠতে শুরু করে যে...’

২.

কোলের সঙ্গে তাল মেলালেন বিচারক, ‘তার মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন যে ডক্টর ইকবালকে খুন করেছেন কারণ তার লেখায় আপনাদের কোনো একটি বিষয় ফাঁস করে দিয়েছিল?’

‘জি। আপনি ঠিকই ধরেছেন। আমি তাঁর এজেন্ট। তাঁকে এত করে বললাম যে এই ট্রপোমেট্রিক বইটা প্রকাশের দরকার নেই। এটা বিকোবে না। উনি আমার কথা পাত্তাই দিলেন না। হুমকি দিলেন, আমি না ছাপলে অন্য কোনো প্রকাশককে দিয়ে দেবেন। এটা নাকি তাঁর খুব গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস। নোবেল টোবেলের স্বপ্ন দেখছিলেন হয়তো।’

‘কিন্তু সায়েন্স ফিকশন রাইটার তো আরও আছে। আপনি তো সবাইকে কন্ট্রোল করতে পারবেন না।’

‘সবাইকে না পারলেও, আপাতত নব্বই শতাংশ লেখক আমাদের নিয়ন্ত্রণে আছে। আপনি লক্ষ করে দেখবেন, সব প্রকাশনী কিন্তু সায়েন্স ফিকশন ছাপে না। যে কজন ছাপে তারা কোনো না কোনোভাবে আমাদের নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই আছে। আমরা গেল বছর বইমেলার আগেই সায়েন্স ফিকশন প্রকাশক এবং এজেন্টদের একটা সংগঠনও করেছি। এটা করা খুব জরুরি ছিল।’

‘আই সি।’ খুব শান্ত স্বরে শব্দ দুটো উচ্চারণ করলেন বিচারক, কিছুটা বিভ্রান্তও মনে হলো তাঁকে। ‘আপনাদের জন্য ক্ষতিকর এমন যেকোনো লেখাই আপনারা বাতিল করে দেন বা বদলে ফেলেন লেখককে দিয়ে।’

‘না ঠিক তা নয়। আমরা লেখককে বোঝাতে চেষ্টা করি কী ধরনের লেখা দিলে পাঠক খাবে, লেখকের এবং প্রকাশকের লাভ হবে। তো তিনিও সেভাবে করেন, এই আরকি।’

‘আপনাদের কথা সব সময় মেনে নেন লেখকেরা?’

সব সময় মানেন না। এ রকম ত্যাড়া লেখকদের ক্ষেত্রে আমাদের একটাই ওষুধ। আমরা ক্রমাগত বলতে থাকি যে, ‘আপনার এই লেখাটা কেউ ছাপতে চাচ্ছেন না। সবাই ফিরিয়ে দিচ্ছে।’

বিচারক পুলিশ দুজনের দিকে তাকালেন। দুজনকেই হতবিহ্বল মনে হচ্ছে। তারা বিচারকের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। মনে হচ্ছে, আদেশ দেওয়ামাত্র গ্রেপ্তার করবে কোলকে।

বিচারক লক্ষ করলেন, কোলের মুখে তখনো সেই একচিলতে হাসি লেগে আছে। এ রকম হাসির পেছনে বাতিকগ্রস্ত সহিংসতা লুকিয়ে থাকে, মনে হলো বিচারকের। সম্ভবত কোলের সঙ্গে অস্ত্র আছে। যদিও কোর্টে কেউ অস্ত্র নিয়ে ঢুকতে পারে না। তবে যা দিনকাল, টাকাপয়সা দিয়ে ম্যানেজ করাও বিচিত্র কিছু না। এখনই কিছু না বলে বরং আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তা চালানো যাক, ভাবলেন তিনি। কথা বলে কোনোভাবে যদি পাগলামির রাস্তাটা বন্ধ করা যায়।

‘পৃথিবীর অন্য আরও ক্ষেত্রে নিশ্চয় অনুপ্রবেশ করেছেন আপনারা?’ জিজ্ঞেস করলেন তিনি।

‘অবশ্যই। সরকার, শিল্প, শিক্ষা। সবখানেই আমরা আছি। আমজনতার দিকেও আমাদের বিশেষ মনোযোগ আছে। ইনফ্যাক্ট, যখন সময় হবে, শক ট্রুপস গঠন করতে এই আমজনতাকেই আমাদের কাজে লাগবে।’

‘কখন হবে সেই সময়? আমি কি দেখে যেতে পারব?’ এবার একটু কৌতুক করলেন বিচারক।

কোল বুঝল কি না কে জানে। গায়ে মাখল না। ‘শিগগিরই।’ বলল সে। ‘খুব শিগগিরই সময় হবে।’

হাসিটা আর চেপে রাখতে পারলেন না বিচারক। ‘সত্যিকার বিজ্ঞানীদের চেয়ে সায়েন্স ফিকশন রাইটারদেরই ক্ষতিকর মনে করছেন আপনারা?’

‘ঠিক, তাই। পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা তাদের জ্ঞানের আওতার বাইরে যা প্রমাণযোগ্য নয় তার সবটাই প্রত্যাখ্যান করে।’ কথাটার ভেতর দিয়ে একটু যেন বিদ্রূপ ছড়িয়ে পড়ল কোলের কণ্ঠে। ‘বিজ্ঞানীরা খুব সহজেই আমাদের অস্তিত্ব নাকচ করে দিতে পারে।’

‘কিন্তু সায়েন্স ফিকশন লেখকেরা তা করবে না, এই তো?’

‘কল্পনাপ্রবণ মনের হুমকিটাই আসল হুমকি। সেটাকে উপেক্ষা করা চলে না।’

বিচারক জানেন ভালো করেই এখন তাকে কী করতে হবে। পুলিশ দুজনকে বললেই এই উন্মাদকে হাতকড়া পরিয়ে পয়লা গারদে চালান করা হবে। শুনানির উপসংহার টানতে চাইলেন তিনি, ‘আচ্ছা আপনি বলছিলেন, আপনাদের কাছে যদি ঠিক অস্ত্রটা মজুত থাকত...’।

বলার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই বুক পকেট থেকে একটা কলম বের করে ধরল কোল। ‘এই যে এটার কথা বলেছি আমি। তাত্ক্ষণিকভাবে খুন করবে, কিন্তু শরীরের কোথাও কোনো দাগ রাখবে না এটা। ময়নাতদন্তে মৃত্যুর কারণ হিসেবে হার্ট ফেইলিওর থেকে শুরু করে স্বাভাবিক সব কারণ উঠে আসবে। কেউ সন্দেহ করার অবকাশ পাবে না।’

এবার পেছনে হেলান দিয়ে বসলেন বিচারক। যাক, কোলের কাছে কোনো অস্ত্র নেই এটা পরিষ্কার। পুলিশ অফিসারকে নির্দেশ দেওয়ার জন্য হাতটা ওঠাবেন ভাবছিলেন, তখনই বলে উঠল কোল, ‘আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে আপনাকে আমি বাঁচিয়ে রাখতে পারছি না।’

যথেষ্ট হয়েছে ভেবে, এবার নির্দেশ দিলেন বিচারক, অফিসার একে কাস্টডিতে নিয়ে যান।

বলে নিচের দিকে তাকিয়ে কাগজে সই করার জন্য কলমটা ওঠালেন। সই করতে শুরু করবেন, এমন সময় মনে হলো তার নির্দেশটা মানা হয়নি। মাথা উঠিয়ে তাকালেন।

তাই তো, পুলিশ অফিসার দুজনই আগের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে। তাঁর দিকে তাকিয়ে হাসছে। কোল তার হাতের কলমটা তুলে বিচারকের দিকে তাক করল। শরীরের মাংসপেশিতে তীব্র ঠান্ডা অনুভব করলেন তিনি। জুরিদের দিকে তাকালেন। তাকালেন রিপোর্টার আর উপস্থিত সব দর্শকের দিকে। সবাই তাকিয়ে আছে বিচারকের দিকে, সবার মুখেই ঠান্ডা একচিলতে হাসি।

৩.

কিছুক্ষণ পরই রিপোর্টার তার পত্রিকা অফিসে ফোন করল। বিকেলের সংস্করণেই খবরটা বেরোল।

হার্ট অ্যাটাকে বিচারক শমসের খানের মৃত্যু।

আজ সকালে ডক্টর জায়েদ ইকবালের মৃত্যুর শুনানির কিছু পরেই হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন বিচারক খান। শুনানিতে জুরিদের সবাই কোলকে বেকসুর খালাস বলে মত দিয়েছেন। ডক্টর ইকবালের মৃত্যু আত্মহত্যা বলে মনে করছেন তাঁরা।

অলংকরণ: বিপ্লব চক্রবর্তী