স্কুল ছুটি হলো বেলা আড়াইটায়। কিন্তু বাসায় ফিরতে ফিরতে বেজে গেল পৌনে চারটা। রাস্তায় কী ভীষণ যানজট!
বাসায় ফিরে মা বললেন, ‘বিকেল হয়ে গেল। আজ আর গোসল করতে হবে না। সাবান দিয়ে ভালো করে হাত-মুখ ধুয়ে এসে খেতে বসো।’
তুমুল আর তুয়া দুই ভাইবোন এগিয়ে গেল দুই বাথরুমের দিকে। মা-বাবার শোবার ঘরটার বাথরুমে ঢুকে পড়ল তুয়া। আর তুমুল ডাইনিং স্পেসের লাগোয়া কমন বাথরুমের দরজার ছিটকিনি খুলে কপাট ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই একদম চমকে উঠল: কমোডে বসে আছে আরেক তুমুল।
‘মানে?’
নিজের অজান্তেই কথাটা তুমুলের মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল।
অবিকল তুমুলেরই মতো দেখতে, ঠিক ওরই মতো স্কুলের পোশাক পরা একটি ছেলে, ঠিক ওরই সমান: তুমুলের হুবহু ডুপ্লিকেট।
তুমুল এমনই অবাক হয়ে গেল যে ওর মুখ থেকে আর একটিও কথা বের হলো না। একদম ভ্যাবাচেকা খেয়ে ও তাকিয়ে রইল ছেলেটির দিকে। ছেলেটিও কমোডে ঘাপটি মেরে বসে চোখ দুটি ছোট ছোট করে ঠোঁট চেপে মুচকি হাসি মুখে নিয়ে চেয়ে রইল তুমুলের মুখের দিকে।
‘কে তুমি?’ জিজ্ঞাসা করল তুমুল। কিন্তু ছেলেটি কিছু বলল না। কমোড থেকে উঠলও না। এমনভাবে বসে রইল, যেন সারা দিন ওখানেই বসে থাকবে।
‘কী হলো? কথা বলছ না কেন?’
এবার মুখ খুলল ছেলেটি: ‘কী বলব? দেখছ না, আমি হাগু করছি? এই সময় কথা বলতে নেই।’
তুমুল এবার লক্ষ করে দেখতে পেল, ছেলেটি বসে আছে কমোডের ঢাকনার ওপর। মানে, প্রাকৃতিক কর্ম কিছুই সে করছে না। শুধু শুধু বসে আছে।
এবার তুমুল ধমকের সুরে বলল, ‘এই, তুমি বের হও। আমি পিশু করব।’
কিন্তু ছেলেটি পাত্তাই দিল না। যেমন বসে ছিল তেমনি বসে রইল।
‘কী হলো? শুনতে পাচ্ছ না?’
ছেলেটি তবু উঠল না। দুষ্টুমিতে ভরা হাসি মুখে নিয়ে চেয়ে রইল।
‘আমার সাথে দুষ্টামি! দাঁড়াও, দেখাচ্ছি মজা!’ বলতে বলতে তুমুল প্যান্টের জিপার খুলে কমোডের দিকে এগিয়ে যেতেই ফোঁওস শব্দ করে একদম অদৃশ্য হয়ে গেল ছেলেটা।
‘আম্মু!’ নিজের অজান্তেই ভয়ার্ত চিত্কার বেরিয়ে এল তুমুলের গলা দিয়ে। ওর চিত্কারটা এমনই আর্তনাদের মতো শোনাল যে তা শুনে ছুটে এলেন মা। বাথরুমের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে মা বললেন, ‘কী হয়েছে?’
তুমুল দরজা খুলে মায়ের মুখোমুখি হয়ে বলল, ‘একটা ছেলেকে দেখেছ?’
মা অবাক হয়ে বললেন, ‘ছেলে?’
এতক্ষণ বাথরুমের ভেতরে যা ঘটে গেল, তুমুল মাকে সব বলল। শুধু এইটুকু বলা বাকি রাখল যে ছেলেটি দেখতে ছিল অবিকল তার নিজের মতো। মা শুনে বললেন, ‘দুষ্টামি করে না তো! তাড়াতাড়ি হাত-মুখ ধুয়ে খেতে এসো। আমার কিন্তু দেরি হয়ে যাচ্ছে।’
মা সকালবেলা তুমুল আর তুয়াকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে অফিসে চলে যান। দুপুরবেলা তুমুলদের স্কুল ছুটি হলে মা অফিস থেকে বেরিয়ে স্কুল থেকে ওদের বাসায় নিয়ে আসেন। খাইয়ে-দাইয়ে আবার চলে যান অফিসে। আজ পথে বাড়তি যানজটে এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে। এখন তুমুল-তুয়া যদি চটজলদি খেতে না বসে, তাহলে মায়ের অফিসে যেতে আরও দেরি হবে। তাই মা বললেন, ‘এক্ষুনি টেবিলে আসো!’
দুই
খাওয়া শেষ হলো। মা তুয়াকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে তুমুলকে টিভি দেখতে নিষেধ করে, বাবা কী লিখতে বলেছিল সেটা লিখে শেষ করতে বলে বাসার দরজা বাইরে থেকে লক করে আবার অফিসে চলে গেলেন।
তুমুল নিজের ঘরে ঢুকে আবার চমকে উঠল: তার বিছানায় আরাম করে শুয়ে আছে সেই ছেলেটি। তুমুল তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে পিছিয়ে গেল দু’কদম। খিক খিক করে হেসে উঠল ছেলেটি। দূরে দাঁড়িয়ে তুমুল ছেলেটিকে ভালোভাবে লক্ষ করতে শুরু করল। বাথরুমে যে ছেলেটি বসে ছিল, তার পরনে ছিল স্কুলের পোশাক, আর এই ছেলেটি পরে আছে নীল জিনস ট্রাউজার আর সবুজ টি-শার্ট।
কী করে সম্ভব? একই ছেলে দুই পোশাকে দুই জায়গায়? তুমুল ঘর থেকে বেরিয়ে আবার সেই বাথরুমটির দরজা খুলে ভেতরে উঁকি মারল। কী আশ্চর্য! ঠিকই বসে আছে ছেলেটা!
তুমুল বলল, ‘এই, তুমি কে?’
ছেলেটি বলল, ‘আমি হলাম আমি। দেখতে পাচ্ছ না?’
তুমুল বলল, ‘আর আমার ঘরে যে আরেকজন আরাম করে শুয়ে আছে, ওইটা কে?’
ছেলেটি বলল কিছু বলল না।
তুমুল বাথরুম থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরে ফিরে দেখতে পেল, সেখানেও সেই ছেলেটি আগের মতোই শুয়ে আছে তার বিছানায়। বাথরুমে এইমাত্র যাকে দেখে তুমুল বেরিয়ে এল, এই ছেলেটিও অবিকল তারই মতো। শুধু পরনের কাপড়চোপড়ই আলাদা। আর সবই হুবহু এক। অবাক তুমুল নিজের ঘরের দরজার কাছে ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে চোখ দুটি বড় বড় করে চেয়ে রইল ছেলেটির দিকে।
ছেলেটির চোখে-মুখে সেই দুষ্টুমিভরা হাসি। এবার সে একটা পা অন্য পায়ের হাঁটুর ওপর তুলে দিল। পা দোলাতে দোলাতে হাসি হাসি মুখ করে বলল, ‘তোমার কি ভয় লাগছে?’
তুমুল জোর করে মনে সাহস আনার চেষ্টা করতে করতে বলল, ‘কিসের ভয়? ভয় লাগবে কেন?’
কিন্তু যতই সাহস দেখানোর চেষ্টা তুমুল করুক না কেন, কথাগুলো বলতে গিয়ে ওর গলা বেশ কেঁপে গেল, ভয় পেলে মানুষের যেমন হয়। ছেলেটি সেটা লক্ষ করে মৃদু হেসে বলল, ‘ভয়ের ঠেলায় তোমার তো হালুয়া টাইট। এখন যদি আমি উঠে তোমার দিকে যাওয়া শুরু করি, তুমি তো প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলবে! ’
লজ্জায় তুমুলের ফরসা মুখটা লাল হয়ে উঠল, গরম হয়ে জ্বলতে শুরু করল কান দুটো। লজ্জা পেলে বোধ হয় ভয় কেটে যায়। তুমুল চিৎকার দিয়ে উঠল, ‘আমার ঘরে বসে বসে আমাকেই ভয় দেখানো হচ্ছে? এসবের মানে কী?’
‘তোমার পিশু পেয়ে থাকলে আগে সেরে আসো। কখন কী হয়ে যায়! প্যান্ট নষ্ট করার তো কোনো মানে হয় না।’
ছেলেটার কথা শুনে তুমুলের পিত্তি জ্বলে গেল। কিন্তু সত্যিই তুমুলের তুমুল প্রস্রাব চেপেছে। সেই যে তখন বাথরুমে সে প্যান্টের জিপার খুলেছিল, কিন্তু ছেলেটি অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল বলে ভয় পেয়ে চিৎকার করে ডাকতে হয়েছিল মাকে, সেই ডামাডোলের মধ্যে আর প্রস্রাব করা হয়নি, তারপর খাওয়ার সময়টুকু পার হয়েছে, তারপর মা অফিসে চলে যাওয়ার পর থেকে তো এই পরিস্থিতি। কী যে শুরু হলো এসব! ভাবতে ভাবতে তুমুল আবার গিয়ে বাথরুমে ঢুকল। এবার সেখানে সেই ছেলেটি নেই।
বাথরুম থেকে নিজের ঘরে ফিরে তুমুল দেখতে পেল, যেখানে ছেলেটি শুয়ে ছিল, সেখানে এখন শুয়ে আছে তুয়া। ঘুমাচ্ছে না, জোড়াহাঁটু মুড়ে বুকের কাছে নিয়ে শুয়ে আছে ঘাপটি মেরে; এমন পিট পিট করে তাকাচ্ছে যেন ভয় পেয়েছে। ভয়ে ভালো করে চোখ মেলে তাকাতেই পারছে না। তুমুল ওর কাছে গিয়ে বলল, ‘তুয়া, কী হয়েছে?’
তুয়া: ভয় লাগছে ভাইয়া!
তুমুল: কিসের ভয়? এই ঘরে কীভাবে এলে তুমি?
তুয়া: আমি জানি না। আমার ভয় লাগছে।
তুমুল: কেন? কিসের ভয়? কী দেখেছ?
তুয়া: কিছু দেখিনি। শুধু ভয় লাগছে।
তুমুল: কিছু দেখনি? এই ঘরে কেউ ছিল না?
তুয়া: না। ঘুম ভেঙে দেখি, আমি তোমার বেডে শুয়ে আছি। আমি এখানে কীভাবে এলাম?
তুমুল: একটা ছেলেকে দেখনি?
তুয়া: না তো! কোন ছেলে?
তুমুল: না না। কেউ না। ভয় নাই। তুমি ঘুমাও।
তুয়া: তুমিও আমার পাশে একটু শোও না, ভাইয়া।
তুমুল: দাঁড়াও, ওই ঘর থেকে তোমার বালিশটা নিয়ে আসি।
তুমুল তুয়ার বালিশ আনার জন্য মা-বাবার শোবার ঘরে ঢুকে দেখতে পেল, তুয়ার বালিশে শুয়ে আছে সেই ছেলেটি।
তুমুল: এসব কী? তুয়াকে আমার ঘরে রেখে এসেছ কেন?
ছেলেটি: আমি রেখে আসিনি।
তুমুল: তাহলে কার কাজ এটা?
ছেলেটি: তুয়া নিজে নিজেই গেছে।
তুমুল: কিন্তু তুয়া তাহলে বলছে কেন ও জানে না কীভাবে ও ওই ঘরে গেল?
ছেলেটি: জানে না কারণ, ও ওই ঘরে গিয়ে তোমার বিছানায় শুয়ে পড়েছে ঘুমের মধ্যেই।
তুমুল: মানে?
ছেলেটি: মানে হলো, তোমার বোন ঘুমের মধ্যেই হেঁটে বেড়ায়।
তুমুল: বাজে কথা বলো না। মানুষ আবার ঘুমের মধ্যে হাঁটবে কীভাবে?
ছেলেটি: কোনো কোনো মানুষ ঘুমের মধ্যে হেঁটে বেড়ায়। ইংলিশে তাদের বলা হয় স্লিপওয়াকার। জানো না?
তুমুল: তুমি একটা মিথ্যুক।
ছেলেটি হাসতে হাসতে বালিশের পাশ থেকে বের করল একটা যন্ত্র; সেটি দেখার সঙ্গে সঙ্গে দুই চোখ চক চক করে উঠল তুমুলের। ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতির প্রতি ওর আগ্রহের শেষ নেই।
তুমুল: ওয়াও! আইপ্যাড?
ছেলেটি: কিসের আইপ্যাড?
তুমুল: তাহলে? গ্যালাক্সি ট্যাব?
ছেলেটি: রাখো তোমার আইপ্যাড, গ্যালাক্সি ট্যাব..
তুমুল: তাহলে? কী এটা? বলছ না কেন ছাই!
ছেলেটি আর কিছু বলল না। ওর হাতে আপনাআপনিই চালু হয়ে গেল ট্যাবলেট কম্পিউটারের মতো দেখতে যন্ত্রটি। পর্দায় ভেসে উঠল একটা ওয়েবসাইটের হোমপেজ। সার্চবক্সে সে ইংরেজিতে লিখল: ‘স্লিপওয়াকিং’। সঙ্গে সঙ্গে দেখা গেল একটা লিংক, সেটিতে ক্লিক করল ছেলেটি, তারপর তুমুলকে কাছে ডেকে বলল, ‘পড়ো, কী লেখা আছে।’
তুমুল পড়া শুরু করে তোতলাতে লাগল। ওর তোতলানো দেখে ছেলেটি বলল, ‘মূর্খ নাকি? কোন ইশকুলে পড়ো? ইংলিশ শেখায় না? সরো!’
তারপর সে গড় গড় করে পড়ে চলল, ‘স্লিপওয়াকিং, অলসো নৌন অ্যাজ সোমনামবুলিজম, ইজ আ স্লিপ ডিসঅর্ডার বিলোঙিং টু ডা প্যারাসোমনিয়া ফ্যামিলি...’
তুমুল: মানে?
ছেলেটি: মানে বুঝতে পারলে না? ইল্লিটারেট ইন ইংলিশ?
তুমুল: ইংলিশ বকতে হবে না, বুঝিয়ে বলো।
ছেলেটি: স্লিপওয়াকিং মানে ঘুমের মধ্যে হেঁটে বেড়ানো, ব্যস, তোমার এইটুকু জানলেই চলবে। তোমার বোন একটা স্লিপওয়াকার।
তুমুল: তুমি এত কিছু জানো কীভাবে? কোন ইশকুলে পড়ো?
ছেলেটি: আমি ইশকুলে পড়ি না। প্রফেসর আমাকে সব শেখান।
তুমুল: প্রফেসর মানে? কোন প্রফেসর?
ছেলেটি: তোমার এত কথার উত্তর দিতে পারব না।
তুমুল: আইপ্যাডটাও উনিই দিয়েছেন তোমাকে?
ছেলেটি: তোমাকে তো বলেছি, এটা আইপ্যাড না।
তুমুল: তাহলে কী?
দমকা বাতাসে মোমবাতি নিভে গেলে শব্দ যেমন হয়, তেমনি একটা শব্দ হলো: হুপ্!
সঙ্গে সঙ্গে অদৃশ্য হয়ে গেল ছেলেটি।
চমকে উঠল তুমুল; তার অজান্তেই মুখ থেকে বেরিয়ে গেল: ‘এই!’
তারপর, বিস্ময়ের ঘোর কেটে গেলে ভীষণ আফসোস জেগে উঠল ওর মনে: আহা, ছেলেটা যদি ভুল করে যন্ত্রটা রেখে যেত!
‘ভাইয়া!’ ওই ঘর থেকে ভেসে এল তুয়ার চিৎকার। চমকে উঠল তুমুল, ভাবল, ছেলেটা নিশ্চয়ই এবার ওই ঘরে গেছে তুয়াকে ভয় দেখাতে। সে ছুটে গেল ওই ঘরের দিকে, কিন্তু গিয়ে দেখল, না, ছেলেটি সেখানে নেই। তুয়া বলল, ‘বালিশ আনতে গিয়ে আর আসছিলে না কেন? আমার খালি ভয় লাগছে।’
‘কিসের ভয় আপু? কিছু দেখেছ?’
‘না, কিছু দেখিনি। কিন্তু ভয় লাগছে। তুমি একটু আমার কাছে শোও না, ভাইয়া।’
তুমুল তুয়ার পাশে শুয়ে তার গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘ভয় নাই। ভয় কিসের? আমি আছি না?’
তিন
গভীর রাত। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল তুমুলের। সে চোখ মেলে দেখতে পেল, দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে সেই ছেলেটি। ঘরের লাইট নেভানো, তবু তুমুল ছেলেটিকে স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছে। ছেলেটির মুখে হাসি। চোখের ইশারায় সে তুমুলকে ডাকছে।
তুমুল খাট থেকে নেমে দাঁড়াল। নিজের অজান্তেই পা বাড়াল ছেলেটির দিকে। ছেলেটি দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। ওর গায়ে বুঝি চুম্বক আছে, আর সে চুম্বকের টানেই যেন-বা তুমুল ছেলেটির পেছন পেছন হাঁটতে শুরু করল। ছেলেটি তুমুলের শোবার ঘরের দরজা দিয়ে বের হলো। তারপর মাঝখানের প্যাসেজটা পার হয়ে ড্রয়িংরুমে গিয়ে তুমুলের দিকে পেছন ফিরে তাকাল।
‘আসো।’
কানের একদম কাছে শুনতে পেল তুমুল, যেন ফিসফিস করে কেউ বলল। কিন্তু ছেলেটি দাঁড়িয়ে আছে তুমুলের কাছ থেকে বেশ কয়েক কদম দূরে; তার ঠোঁট নড়তেও দেখল না তুমুল। হঠাৎ তুমুলের সামনে দিয়ে চলে গেল ধবধবে সাদা বেশ বড়সড় একটা বিড়াল। একদম নিঃশব্দে বিড়ালটি এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল ছেলেটির পায়ের কাছে; তারপর তুমুলের মুখের দিকে চেয়ে এক চোখ টিপে মুচকি একটা হাসি দিল। তা দেখে হাসি পেল তুমুলেরও। সে এগিয়ে গেল ছেলেটি ও বিড়ালটির দিকে।
ছেলেটি বাসার দরজা খুলল, কোনো শব্দ হলো না। ছেলেটি ও বিড়ালটি বেরিয়ে গেল নিঃশব্দে, তাদের পিছু পিছু বেরিয়ে এল তুমুলও। তার পেছনে নিঃশব্দে বন্ধ হয়ে গেল দরজা। ছেলেটি ও বিড়ালটির পিছু পিছু তুমুল সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল নিচে। গ্যারেজে গাড়িগুলো ঘুমাচ্ছে, তাদের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের মিহি শব্দ শুনতে পাচ্ছে তুমুল। দারোয়ানেরা কেউ নেই; গেটে তালা লাগিয়ে নিজেদের ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।
ছেলেটি বাড়ির গেটের কাছে গিয়ে দাঁড়াল, তার পায়ে পায়ে সাদা বিড়ালটিও। ঢাউস তালা লাগানো গেটটি কেমন করে ছেলেটি খুলল তুমুল বুঝতে পারল না। বিড়ালটি ও ছেলেটি গেট দিয়ে বের হয়ে গেল। তুমুলও বেরিয়ে এল তাদের পিছু পিছু।
বাইরের সড়ক নির্জন, শুয়ে আছে অলস এক অজগরের মতো। কোথাও কেউ নেই: না গাড়ি, না রিকশা, না বাস, না ট্রাক। সুনসান নীরবতা; কোথাও কোনো শব্দ নেই। হঠাৎ একটা কর্কশ শব্দে পিলে চমকে উঠল তুমুলের। সঙ্গে সঙ্গে তার চোখ ছুটে গেল রাস্তার পাশে ইলেকট্রিকের তারের দিকে: ঢাউস এক প্যাঁচা বসে আছে বিদ্যুতের তারে। সাদা বিড়ালটি পেছনের দুই পায়ের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে সামনের দুই পা হাতের মতো ঝুলিয়ে দিল দুপাশে। তারপর সামনের ডান পা তুলে মানুষ যেভাবে হাত নেড়ে মানুষকে ডাকে, সেইভাবে ইশারা করে বিড়ালটি ডাকল প্যাঁচাটিকে। বিশাল দুই ডানার ঝাপটা মেরে বিদ্যুতের তার থেকে উড়ে উঠল প্যাঁচাটি, তারপর উড়ে এসে বসল ছেলেটির পাশে দুই পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ানো সাদা বিড়ালটির সামনে। বিড়ালের সামনের ডান পা আর প্যাঁচার ডান পাখার প্রান্ত পরস্পরকে স্পর্শ করল। তুমুলের মনে হলো, ওরা হ্যান্ডশেক করছে। বেশ মজা লাগল তুমুলের। সে দেখতে পেল ছেলেটির মুখে হাসি। তারপর ছেলেটি হাঁটু ভাঁজ করে নিচু হলো; সাদা বিড়ালটি আর ঢাউস প্যাঁচাটির কাছে মুখ নিয়ে তিনজনে কী যেন পরামর্শ করে নিল। তারপর ছেলেটি উঠে দাঁড়াল; বিড়াল, প্যাঁচা ও ছেলেটি একসঙ্গে তাকাল তুমুলের দিকে।
তুমুল বলল, ‘কী বিষয়?’
মিষ্টি সুরে বেজে উঠল টুং টাং শব্দ। ছেলেটি, বিড়ালটি আর প্যাঁচাটি একসঙ্গে তাকাল আকাশের দিকে। তাদের দেখাদেখি তুমুলের চোখ দুটিও ছুটে গেল একই দিকে। আকাশে বাবু আসনে বসে আছে এক লোক, তার হাতে ছোট্ট একটা ঘণ্টা, টুং টাং শব্দে সেটি সে বাজাচ্ছে। বিড়ালটি ডান হাতে কিছু ইশারা করল, লোকটি ঘণ্টা বাজানো থামাল; তারপর এক হাত নেড়ে কী যেন বলল। সঙ্গে সঙ্গে প্যাঁচাটি বসে পড়ল, দুই পাশে মেলে ধরল তার দুটি পাখা। তারপর ফুলেফেঁপে বড় হতে শুরু করল প্যাঁচাটি, বড় হতে হতে তার আকৃতি হয়ে গেল ছোটখাটো একটা উড়োজাহাজের সমান। ছেলেটি তখন হাতের ইশারায় তুমুলকে ডাকল। তুমুল এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল ছেলেটির পাশে। প্যাঁচার পিঠে লাফ দিয়ে উঠে বসল সাদা বিড়ালটি, তারপর ছেলেটি উঠে বসে একটা হাত বাড়িয়ে দিল তুমুলের দিকে। তুমুল ডান হাত বাড়িয়ে ধরল ছেলেটির হাত, ছেলেটি এক টানে তাকে তুলে নিল প্যাঁচার পিঠের ওপর। আকাশে বেজে উঠল টুং টাং শব্দ। নড়ে উঠল প্যাঁচার দুই বিশাল পাখা।
‘ভালো করে ধরে বসো,’ ছেলেটি বলল তুমুলের কানে কানে, ‘নইলে কিন্তু পড়ে যাবে।’
তুমুল দুই হাতে খামচে ধরল প্যাঁচার পিঠের পালক। সঙ্গে সঙ্গে মানুষের কণ্ঠে আর্তনাদ করে উঠল প্যাঁচাটি: ‘আউ!’
বিড়ালটি থাবা মেরে সরিয়ে দিল তুমুলের দুই হাত। তুমুল বলল, ‘সরি!’
ফ্যাঁচ শব্দ করে হেসে ফেলল বিড়াল। হাসল ছেলেটিও। ক্যারক্যারে কণ্ঠ শোনা গেল প্যাঁচার: ‘ধন্যবাদ!’ত
আকাশে টুং টুাং শব্দে বেজে উঠল ছোট্ট ঘণ্টা। তুমুল আকাশে তাকিয়ে দেখতে পেল হাসিমুখে এক হাতে ঘণ্টা বাজাচ্ছে সেই লোকটা।
‘যাত্রা শুরু হোক।’
কথাটা কে বলল তুমুল ঠিক বুঝতে পারল না, তবে তার পাশে বসা ছেলেটি যে বলেনি, সেটা নিশ্চিত। কারণ ছেলেটি তুমুলের মুখের দিকে হাসিভরা মুখে অপলক চেয়ে আছে। ছেলেটির মুখের দিকে চেয়ে তুমুলের মনে হচ্ছে, সে যেন আয়নায় নিজের মুখ দেখছে।
উড়ে উঠল প্যাঁচাটি। তুমুল ছেলেটির একটা হাত শক্ত করে চেপে ধরল। তার কানে কানে কে যেন বলল, ‘ভয় নাই। নিশ্চিন্তে বসে থাকো।’
প্যাঁচা আকাশের দিকে ঠোঁট বাগিয়ে উঠতে শুরু করল সোজা ওপরের দিকে। তার লেজের দিকটা ভীষণ ঢালু হয়ে গেল। কিন্তু তুমুল লক্ষ করল, সে বা তার বাম পাশে বসা ছেলেটি বা ডান পাশে বসা বিড়ালটি পিছলে নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে না। প্যাঁচা এবার ঊর্ধ্বমুখে ছুটতে শুরু করেছে উড়োজাহাজ নয়, রকেটের মতো তীব্র গতিতে। তবু পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আর বোধ হচ্ছে না তুমুলের।
অনেকক্ষণ ধরে অনেক ওপরে ওঠার পর প্যাঁচার পিঠখানা সমতল হয়ে এল। তুমুল নিচের দিকে চেয়ে দেখতে পেল বিন্দু বিন্দু আলো ফুটে রয়েছে তারার মতো।
তুমুল, এক দশাসই সাদা বিড়াল, আর ঠিক তুমুলের মতোই দেখতে এক অদ্ভুত ছেলেকে পিঠে নিয়ে গভীর রাতের শীতল বাতাস কেটে ছুটে চলেছে ঢাউস প্যাঁচাটি। তুমুল তার বাম পাশে বসা ছেলেটির মুখের দিকে চেয়ে বলল, ‘আমরা কোথায় যাচ্ছি?’
ছেলেটি কিছুই বলল না। শুধু মুখভরা হাসি নিয়ে চেয়ে রইল তুমুলের মুখের দিকে। ডান পাশে বসা সাদা বিড়ালটি এবার তুমুলের মুখের দিকে তাকাল। তুমুলের মনে হলো, বিড়ালটি যেন বিড়াল নয়, মানুষের ছদ্মবেশ।
‘যাচ্ছি একটা চক্কর মেরে আসতে।’
কী তাজ্জব! বিড়ালটি কথা বলে উঠল ঠিক মানুষেরই কণ্ঠে।
‘মানে?’ অবাক হয়ে জানতে চাইল তুমুল।
এবার ছেলেটি হেসে বলল, ‘বেড়াতে যাচ্ছি। বেড়াতে যাওয়াকে ও বলে চক্কর মারা।’
‘কিন্তু কোথায় বেড়াতে যাচ্ছি? এটা কি বেড়ানোর সময় হলো?’ বলল তুমুল।
এবার প্যাঁচার কণ্ঠ ভেসে এল, ‘বেড়াতে যাওয়ার আবার সময় কী? আমরা যখন ইচ্ছা তখন বেড়াতে যাই। আমাদের মনের খুশি।’
‘হ্যাঁ, আমরা চলি আমাদের মনের খুশিতে। সময়-অসময়ের ধার আমরা ধারি না।’ বলল বিড়াল।
তুমুল বলল, ‘কিন্তু এই রাতদুপুরে, ঘোর অন্ধকারে কোথায় বেড়াতে যাচ্ছি আমরা?’
বিড়াল বলল, ‘সেটা তুমি আর কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখতে পাবে।’
তুমুল বিরক্তির সঙ্গে বলল, ‘একটা জিনিস আমার মোটেই ভালো লাগছে না। সেই প্রথম থেকেই তোমরা শুধু রহস্য করছ। কোনো কিছুই খুলে বলছ না।’
ছেলেটি বলল, ‘খুলে বলার কিছুই নাই। আমরা যে কোথায় বেড়াতে যাচ্ছি তা আমরা নিজেরাই জানি না। যেদিকে দুচোখ যায়, উড়োজাহাজ সাহেব আমাদের সেদিকেই নিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের করার কিছুই নাই।’
তুমুল এবার প্যাঁচাকে উদ্দেশ করে বলল, ‘উড়োজাহাজ সাহেব, আপনি আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?’
প্যাঁচা তুমুলের কথার উত্তর দিল না।
তুমুল তাকে বলল, ‘একটা কথার উত্তর দাও তো। তুমি কেন দেখতে হুবহু আমার মতো? মনে হচ্ছে, ঠিক যেন আমার ডুপ্লিকেট!’
ছেলেটি হেসে বলল, ‘উল্টা কথা বললে তুমি। আমি তোমার মতো নই, বরং তুমিই আমার মতো।’
তুমুল বলল, ‘বললেই হলো? আমার নাম তুমুল, তোমার নাম কী?’
ছেলেটি বলল, ‘আমার কোনো নাম নাই। শুধু একটা নম্বর আছে।’
‘মানে?’ অবাক হয়ে বলল তুমুল।
এবার প্যাঁচা বলল, ‘ওর নম্বর শূন্য শূন্য দুই।’
ছেলেটি মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, শূন্য শূন্য দুই। কিন্তু ওরা আমাকে ডাকে দ্বিতীয় বলে।’
বিড়াল বলল, ‘আর আমার নাম হলো প্যাঁচা।’
‘ধ্যাৎ, তোমাদের মাথা খারাপ হয়ে গেছে,’ বলল তুমুল, ‘আস্ত একটা বিড়াল হয়ে বলছ তোমার নাম প্যাঁচা।’
‘নিশ্চয়ই আমার নাম প্যাঁচা। আর যাকে আমরা এখন উড়োজাহাজ বানিয়ে চক্কর মারতে বের হয়েছি, তার নাম বিড়াল।’
‘আজব কাণ্ড!’ হাসতে হাসতে বলল তুমুল, ‘কী আজব কাণ্ডকীর্তি! বিড়ালের নাম প্যাঁচা আর প্যাঁচার নাম বিড়াল! হা হা হা!’
বিড়াল বলল, ‘হ্যাঁ, সব ঠিক আছে। শূন্য শূন্য দুই, মানে দ্বিতীয়, আমি পেঁচা আর ও বিড়াল, আর আকাশে যাকে দেখলে, হেসে হেসে ঘণ্টা বাজাচ্ছিল, সে আমাদের সবার প্রিয় ডমরুধর। আমরা তাকে ডমরুভাই বলে ডাকি। ডমরুভাই নস্যি নিতে খুব ভালোবাসে। তার জন্য বিশুদ্ধ নস্যি আমদানি করতে বিড়ালকে উড়ে যেতে হয় নেপালে। নেপালি নস্যি ছাড়া ডমরুধরের একদমই চলে না। কিন্তু প্রফেসর বলেছেন, নস্যি বেশি খাওয়া ভালো না। ডমরুধরের নস্যি খাওয়া যেন সীমা ছাড়িয়ে না যায়, সেটা আমাদের দেখতে হবে। প্রফেসর এই বিষয়ে খুবই সিরিয়াস।’
‘কিন্তু প্রফেসরটা কে?’ বলল তুমুল।
‘কী বললে? প্রফেসরটা?’ হুংকার দিয়ে উঠল প্যাঁচা নামের সাদা বিড়াল। তার গায়ের সব লোম খাড়া হয়ে উঠল। সে আরও বলল, ‘প্রফেসর কি কোনো বস্তু? কোনো পদার্থ? আঁ?’ বিড়াল তুমুলের পাশে বসা ছেলেটির দিকে তাকিয়ে চোখের মণি দুটো চরকির মতো ঘোরাতে ঘোরাতে বলে, ‘ওকে কি আমাদেরই বুঝিয়ে বলতে হবে যে প্রফেসর কোনো বস্তু নন, একজন মহাজ্ঞানী ব্যক্তি? আমাদেরই কি এটা ব্যাখ্যা করে বলতে হবে যে মানব সভ্যতার ছয় হাজার বছরের ইতিহাসের সমস্ত জ্ঞান ও বিদ্যা প্রফেসরের আছে এবং এসব জ্ঞান-বিদ্যার বাইরের আরও অনেক প্রজ্ঞার অধিকারী আমাদের প্রফেসর? বলতে হবে? আমাদেরই কি ব্যাখ্যা করে বলতে হবে যে আর্থার সি ক্লার্ক, কার্ল সাগান, স্টিফেন হকিংসহ আজকের পৃথিবীর সমস্ত বিজ্ঞানীর জ্ঞানবুদ্ধি একসঙ্গে যোগ করলে যা ওজন হবে, আমাদের প্রফেসরের একলার জ্ঞানবুদ্ধির কাছে তা কিছুই না?’
‘কোনো দরকার নাই। তুমি চুপ করো।’ গম্ভীর কণ্ঠে বিড়ালকে আদেশ দিল শূন্য শূন্য দুই ওরফে দ্বিতীয় নামের ছেলেটি।
শন শন বাতাসের মধ্যে ভেসে এল প্যাঁচার কণ্ঠস্বর, ‘প্যাঁচাটা ইদানীং বড্ড বেশি বকে!’
‘ইউ শাট আপ!’ চিৎকার করে উঠল প্যাঁচা নামের সাদা বিড়ালটি।
তুমুলের বেশ মজা লাগছে। সে নিচের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল নিকষ কালো অন্ধকার। ঢাকা মহানগরের এক বিন্দু আলোও আর দেখা যাচ্ছে না। সে মুখ তুলে ওপরের দিকে তাকাল। দেখতে পেল, মিট মিট করে জ্বলছে কয়েকটি তারা।
ছেলেটি তুমুলের দিকে চেয়ে বলল, ‘আমি শূন্য শূন্য দুই। সংক্ষেপে আমাকে ডাকা হয় দ্বিতীয় বলে। তার মানে, শূন্য শূন্য এক নম্বরেরও একজন নিশ্চয় আছে। লজিক ঠিক আছে?’
তুমুল বলল, ‘হ্যাঁ। আমিও এটাই ভাবছিলাম। কিন্তু শূন্য শূূন্য একটা কে?’
দ্বিতীয় নামের ছেলেটি বলল, ‘আমরা তো তাকেই খুঁজছি।’
ঘন কালো অন্ধকার আকাশের বুক চিরে ছুটে চলল ঢাউস প্যাঁচা। তুমুল সামনের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল, বিপরীত দিক থেকে ছুটে আসছে বিশাল এক পাখি, তার বিশাল দুটি ডানা দুই দিকে প্রসারিত, আর তার পিঠের ওপর বসে আছে অবিকল একই রকম দেখতে দুটি ছেলে আর তাদের পাশে একটা সাদা বিড়াল। তুমুলের মনে হলো, সে যেন আয়নার ভেতরে নিজেদেরই দেখতে পাচ্ছে।
চার
কাকের চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেল তুমুলের। সে চোখ মেলে দেখতে পেল জানালার বাইরে ভোরের আলো। রাস্তায় বিদ্যুতের তারে বসে তারস্বরে চিত্কার করছে তিনটি কাক। ভীষণ গর্জন করে ছুটে গেল একটা ট্রাক, তারপর টুং টাং বেল বাজিয়ে চলে গেল একটি খালি রিকশা। তুমুল বিছানা থেকে নেমে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। সকালের নির্মল বাতাসে বুকভরে নিঃশ্বাস নিল সে। হঠাত্ সে শুনতে পেল মায়ের কণ্ঠ: ‘তুমুল, দেরি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু!’
তুমুল বারান্দা থেকে ফিরে এল। নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে বাথরুমের দিকে পা বাড়াতেই সে দেখতে পেল মা আর তুয়াকে। তুয়ার পিঠে স্কুলের ব্যাগ, মা তুয়ার একটি হাত ধরে আছেন, তাঁর পায়ের কাছে তুমুলের স্কুলব্যাগ। মা চেয়ে আছেন বাথরুমের দিকে, তাঁর চোখে-মুখে ভীষণ বিরক্তি। তুমুল থমকে দাঁড়াল, তাকাল বাথরুমের দরজার দিকে।
‘তুমুল, বাথরুমে বসে বসে কি ঘুমাচ্ছ তুমি?’
মায়ের কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাথরুমের দরজা খুলে বের হয়ে এল সেই ছেলেটি, যে দেখতে ঠিক তুমুলেরই মতো। এখন তার পরনে স্কুলের পোশাক। সে তাড়াতাড়ি মা ও তুয়ার দিকে এগিয়ে গেল, মায়ের পাশ থেকে স্কুলব্যাগটি তুলে নিজের পিঠে নিয়ে দরজার দিকে পা বাড়াল।
তুমুল এবার চিৎকার করে উঠল, ‘মা!’
কিন্তু মা বা তুয়া তুমুলের কণ্ঠ শুনতে পেল বলে তার মনে হলো না।
তুমুল আবার চিৎকার করে বলল, ‘মা, ওইটা তুমুল না, ওইটা তোমার ছেলে না, মা..’
কিন্তু মা ফিরেও তাকালেন না। দরজা খুলে তুয়া আর ওই ছেলেটিকে নিয়ে বের হয়ে গেলেন। তারপর বাইরে থেকে তালা লক করলেন। তুমুল দৌড়ে গিয়ে দরজায় জোরে জোরে ঘুষি মারতে মারতে বলল, ‘মা, ওইটা নকল তুমুল।’
কিন্তু কোনো ফল হলো না। সিঁড়িতে মা, তুয়া আর ওই ছেলেটির পায়ের শব্দ ধীরে ধীরে দূরে চলে গেল। তুমুল হতাশ হয়ে বসে পড়ল দরজার কাছে মেঝেতে। এখন তার কাঁদতে ইচ্ছা করছে।
হঠাৎ সে দেখতে পেল তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে সেই সাদা বিড়াল। গোঁফ নাচিয়ে চোখ ছোট ছোট করে হাসছে ওর মুখের দিকে চেয়ে। তারপর তুমুল দেখতে পেল, সোফার এক কোণে ঘাপটি মেরে বসে আছে সেই ঢাউস প্যাঁচা। তার চোখের বড় বড় মণি দুটো চরকির মতো ঘুরছে।
তুমুল চিৎকার করে উঠল, ‘কী হচ্ছে এসব?’
বিড়াল আর প্যাঁচা পরস্পরের মুখের দিকে চেয়ে হাসতে লাগল।