র‌্যাগ না বুলিং...?

অলংকরণ: তারিক সাইফুল্লাহ

রন্টু নতুন স্কুলে ভর্তি হয়েছে। বহু কাঠখড় পুড়িয়ে ভর্তি হতে হয়েছে তাকে। পরীক্ষা হয়েছে, ভাইভা হয়েছে। রন্টুর বাবা এখানে বদলি হয়ে এসেছেন। কাজেই নতুন জায়গায় নতুন স্কুল। সবই ঠিক ছিল। কিন্তু প্রথম দিন স্কুলে গিয়ে সে টের পেল কত ধানে কত ভুট্টা। কত ধানে কত চাল বলা যেত, কিন্তু অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে চাল না, এখানে মনে হয় ভুট্টাই হবে। অর্থাৎ এখানে নতুন ছাত্র এলেই তাকে র‌্যাগ দেওয়া হয়। রন্টু ভর্তি হয়েছে ক্লাস এইটে। সে একা না, তার সঙ্গে আরও দুজন ভর্তি হয়েছে, মোট তারা তিনজন। এখন মনে হচ্ছে তাদের তিনজনকে র‌্যাগ খেতে হবে। র‌্যাগ বিষয়টা রন্টু ভালোমতো জানত না। বুলিং শব্দটার সঙ্গে পরিচিত ছিল। ঢাকার কিছু স্কুলে বুলিং হয় বলে শুনেছে। তবে র‌্যাগ ব্যাপারটা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাগ যে এখন এই স্কুলে এসে পৌঁছেছে তা কে জানত!

প্রথম দিন টিফিনের শেষে তাদের ক্লাসে গায়ে-গতরে বেশ বড়সড় চার-পাঁচটা ছেলে এসে দাঁড়াল তাদের সামনে। কোমরে হাত দিয়ে বেশ মারকুটে ভিলেনের মতো।

—তোরা তিনটা নতুন এসেছিস?

—হুঁ

—আমাদের এই স্কুলের কিছু নিয়মকানুন আছে জানিস তো?

—কী নিয়ম? রন্টু জানতে চায়

—আমাদের সঙ্গে চল, দেখাচ্ছি কী নিয়ম।

তারা তিনজন একজন আরেকজনের দিকে তাকাল। যাকে বলে চোখে চোখে কথা। মানে যাওয়া উচিত কি উচিত না। কারণ, কী হতে যাচ্ছে তারা জানে না। ছোটখাটো কিন্তু গাট্টাগোট্টা মজিদ উঠে দাঁড়াল। সঙ্গে রন্টু আর সাদিক।

ওরা তাদের ডেকে নিয়ে গেল স্কুলের পেছনে। ওদের পেছনে পেছনে ক্লাসের অন্য ছেলেরাও বেশ কজন এসেছে মজা দেখতে।

ওরা তিনজন পাশাপাশি দাঁড়াল। মানে ওদের দাঁড় করানো হলো। রন্টু একপাশে, মাঝে মজিদ আর অন্য পাশে সাদিক। এর মধ্যে এই নতুন তিনজনের অবশ্য ভেতরে ভেতরে একটু খাতির হয়ে গেছে। মাঝের মজিদ ফিসফিস করে বলল,

—ওরা আমাদের র‌্যাগ দেবে। এই স্কুলের নাকি এটা নিয়ম, শুনেছি। আমরা একজোট থাকব, ঘাবড়ালে চলবে না। বুঝলে?

—ঠিক আছে, ফিসফিস করে বলল রন্টু। সাদিকও মাথা ঝাঁকায়!

এবার সবচেয়ে বড়সড় ছেলেটা সম্ভবত তার নাম বদরুল। সবাই বদি ডাকে। বলল,

—এই শোন, তোরা তিনটা ছাগল মফস্বল থেকে এসেছিস ঢাকা শহরে তাই না?

ওরা কিছু বলল না। ছেলেটা আবার বলল,

—এখন তোরা তিন ছাগল ঘাস খাবি।

রন্টু হতভম্ব হয়ে গেল। বলে কী? এভাবে কেউ কথা বলে? অপমানে তার দুটো কান ঝাঁ ঝাঁ করতে লাগল!

—কী হলো, কথা কানে যায় না?

—কানে গেছে। বলে মজিদ।

—তাহলে খাচ্ছিস না কেন?

—আগে কখনো ঘাস খাইনি তো, মনে হয় তোমরা নিয়মিত খাও! আগে তোমরা একটু ঘাস খেয়ে দেখাও কীভাবে খেতে হয়।

মজিদের কথা শুনে পেছনে দাঁড়ানো সাধারণ ছাত্ররা সব হি হি করে হেসে উঠল।

পাঁচজনের র‌্যাগ দেওয়া এই দলটার লিডার সম্ভবত বদরুল। ছেলেটা লম্বা-ফরসা তার মুখটা লাল হয়ে গেল। সে খপ করে মজিদের কলার চেপে ধরল,

—কী কইলি?

—বললাম আমরা যে স্কুল থেকে এসেছি, সেখানে নতুন-পুরোনো কোনো ছাত্রকেই ঘাস খেতে হয় না। তোমাদের এখানে মনে হয় খেতে হয়। তোমরা হয়তো খাও। তাই বলছিলাম একটু খেয়ে দেখালে বুঝতাম আরকি।

পেছনের দর্শক ছাত্রসমাজ আবার হি হি করে হেসে উঠল। ফরসা বদরুল যেন আরও লাল হয়ে উঠল। পেছন ফিরে এবার সে একটা হুংকার দিল সাধারণ ছাত্রদের দিকে ‘ওই তোরা গেলি?’ ওরা অবশ্য কেউ গেল না, মজা দেখার জন্য দাঁড়িয়ে রইল। রন্টুর মনে হলো ওর কিছু বলা দরকার। মজিদের কথাবার্তায় তার সাহস ফিরে এসেছে। সে বলল,

—তুমি ওর কলার ধরেছ কেন? কলার ছাড়ো।

—হ্যাঁ, কলার ছাড়ো ওর। ওপাশ থেকে সাদিকও বলল ঠান্ডা স্বরে।

এ সময় পেছনে দাঁড়ানো দর্শক ছাত্ররা একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল কোরাসের মতো করে ‘হ্যাঁ কলার ছাড়ো ওর...কলার ছাড়ো ওর...কলার ছাড়ো ওর...!’ এবং চেঁচাতেই থাকল।

র‌্যাগ দেওয়া পাঁচজন কেমন যেন হকচকিয়ে গেল। পরিস্থিতি অন্য রকম! বদরুল ছেলেটা কলার ছেড়ে দিল। তাকে ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। তারা পাঁচজন চোখে চোখে কথা বলল। আর ঠিক তখনই ঘণ্টা বেজে উঠল। বদরুল দাঁতে দাঁত ঘষে ফিসফিস করে বলল, ‘এখন ছেড়ে দিলাম, ছুটির পরে ফয়সালা হবে।’

শেষ ক্লাসটা ইংরেজি ট্রান্সলেশনের। রন্টুর দল ইতিমধ্যে টের পেয়েছে ক্লাসে দুটো ভাগ হয়ে গেছে, এক দল রন্টুদের দিকে, এক দল র‌্যাগ দেওয়া দলটার দিকে (অবশ্য মাঝখানেও একটা দল আছে, এরা কোনো দিকেই নেই)। এর মধ্যে একজন ফিসফিস করে রন্টুর কানে কানে বলল, ‘আমরা তোমাদের সাথে আছি।’ রন্টু ভেতরে ভেতরে সাহস পেল।

স্যার বই খুলে সবাইকে ট্রান্সলেশন ধরছিলেন।

কেউ পারছিল কেউ পারছিল না। যারা পারছিল না বা ভুল করছিল তারা দাঁড়িয়ে আছে। এই করতে করতে একসময় স্যার বদরুলকে ধরলেন, ‘বল, গরু ঘাস খায়’ বলতেই ক্লাসসুদ্ধ সবাই হো হো করে হেসে উঠল। স্যার খেপে গেলেন। এই গরুর দল হাসিস কেন? বদরুল মুখ লাল করে দাঁড়িয়ে রইল। হাসার কারণ যে টিফিন পিরিয়ডে র‌্যাগ ঘাস খাওয়ার ঘটনা এটা তো সবাই বুঝলেও স্যার তো আর বুঝলেন না। স্যার হুংকার দিলেন, ‘শাট আপ, হাসির কী হলো? সাইলেন্ট সাইলেন্ট!!’ সবাই চুপ করে গেল। এর মধ্যে ফিসফিস করে কে যেন বলল, ‘বদি ঘাস খায়!’

সঙ্গে সঙ্গে আবার হাসি।

স্যার এবার উঠে দাঁড়িয়ে ডাস্টার দিয়ে টেবিলে বাড়ি দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘খবরদার, একদম চুপ...চুপ!!’

সবাই চুপ করে গেল। বদরুল তখনো মুখচোখ লাল করে দাঁড়িয়ে আছে। স্যার হুংকার দিলেন, ‘কিরে বদরুল, হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ট্রান্সলেশন কর গরু ঘাস খায়।’ বদরুল কোনোমতে বলল ‘কাউ ইট গ্রাস’।

—‘কাউ ইট গ্রাস? এই শিখেছিস? ইট এর পরে এসটা কে বলবে? তোর ঘাস খাওয়া গরু এসে বলে যাবে? যা তুই একটু ঘাস খেয়ে আয়...’

সঙ্গে সঙ্গে সবাই আবার হো হো করে হেসে উঠল। তখনই ঢং ঢং করে ঘণ্টা বেজে উঠল। রন্টু খেয়াল করল বদির গ্রুপটা তীব্র দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে, যেন সমস্ত ব্যাপারটার জন্য তারা তিনজনই দায়ী। স্যার চলে গেছেন, সবাই বই গোছাচ্ছে। এই সময় একটা ছেলে ওদের কাছে এসে গলা নামিয়ে বলল, ‘তোমরা মেইন গেট দিয়ে বের হয়ো না। পেছনে জামগাছের কাছে একটা ভাঙা দেয়াল আছে, ওদিক দিয়ে বের হও। ওরা কিন্তু ঝামেলা করবে। কী খেপেছে দেখেছ?’

অলংকরণ: তারিক সাইফুল্লাহ

মজিদ বলল, ‘আমরা তিনজন একসাথে থাকব সব সময়। তাহলে ওরা কিছু করতে পারবে না।’

—ঠিক সায় দিল রন্টু আর সাদিক।

ওরা ভাঙা দেয়াল দিয়েই বের হলো। বের হতেই দেখে ওদের এক স্যার,

—তোরা এদিক দিয়ে বের হলি কেন?

—ইয়ে স্যার, আমরা নতুন ভর্তি হয়েছি তো গেটটা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আমতা আমতা করে বলল মজিদ। স্যার গোল গোল চোখে তাকিয়ে রইলেন। কিছু বললেন না।

রন্টু বুঝল মজিদ ছেলেটা যথেষ্ট বুদ্ধিমান। সাদিকও টের পেল। উপস্থিত বুদ্ধি তার ভালোই আছে!

পরদিন যথারীতি প্রথম চার পিরিয়ড হলো নির্বিঘ্নে। টিফিনে ওই পাঁচজন মারকুটে এসে ওদের তিনজনকে বলল, চল।

—কোথায়? নিরীহ ভঙ্গিতে বলল মজিদ।

—ক্যানটিনে।

—কেন?

—সেটা গেলেই বুঝবি।

—আর যদি আমরা না যাই?

—আপসে না গেলে কীভাবে নিতে হয় সেটাও জানা আছে আমাদের। পেছন থেকে হোঁতকা টাইপ রুবেল বলল। ও সম্ভবত বদির ডান হাত।

—বেশ চল।

ক্যানটিনে গিয়ে দেখে ক্যানটিন প্রায় ফাঁকা। দু-একজন ছিল কিন্তু ওদের পাঁচজনকে দেখে এখানে কিছু একটা গোলমেলে ব্যাপার হবে বুঝতে পেরে আস্তে করে কেটে পড়ল। ক্যানটিন বয়টা আছে শুধু। আর ওরা পাঁচজন।

—তোরা আমাদের খাওয়াবি।

—কিন্তু আমাদের কাছে তো টাকা নেই।

—সেটা জানি না। টাকা বাসা থেকে নিয়ে আয় তোদের কেউ একজন। তোর বাসা কোথায়? রন্টুকে বদি জিজ্ঞেস করে।

তখন মজিদ বলল, ‘ঠিক আছে, আমার বাসা সবচেয়ে কাছে, আমি এক দৌড়ে টাকা নিয়ে আসছি।’

—ঠিক আছে যা, পাঁচ মিনিট টাইম দিলাম। এর মধ্যে যদি না আসিস তাহলে কিন্তু অন্য সিস্টেম হবে।

—পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আসব।

—যা দৌড়া।

মজিদ ছুটে বের হয়ে গেল। রন্টুর বুকটা ঢিব ঢিব করছে। ওরা কী খেতে চাইবে কে জানে। তারপর নিশ্চয়ই ওদের অন্য কোনো প্ল্যান আছে। কী সেটা?

মজিদ সাড়ে তিন মিনিটের মাথায় এসে হাজির হলো। বলল, কী খাবে তোমরা?

—জিজ্ঞেস করে দেখ কী আছে।

রন্টুই গেল ক্যানটিনের লোকটাকে জিজ্ঞেস করতে। ‘কী আছে?’

—খোক আর খেক ছাড়া কিছু নাই। এত বিপদের মধ্যেও হাসি পেল রন্টুর। ক্যানটিন বয়টার বাড়ি নিশ্চয়ই সিলেটে। তাই কোক আর কেককে বলছে খোক আর খেক!

শেষ পর্যন্ত পাঁচটা খোক আর খেক মানে পাঁচটা কোক আর কেক নিতে বলল বদি। অবশ্য এই ক্যানটিনে কোক, কেক আর চা ছাড়া কিছু থাকে না। মাঝে মাঝে শিঙাড়া, সমুচা পাওয়া যায়, আজ নেই।

—বেশ। মজিদ নিজেই এগিয়ে গেল। ক্যানটিনের বয়টা কেক বের করতে গেল। বদি হুকুম দিল। সবকিছু ওরা করবে। ওরা তিনজনই মিলে পাঁচটা প্লেটে কেক সাজিয়ে দিল। মজিদ কেস থেকে পাঁচটা কোক নিল।

—কোক গ্লাসে ঢেলে দে। হুকুম দিল বদি।

—গ্লাসগুলো ধুয়ে নিস কিন্তু পাঁচজনের আরেকজন বলে, আমি ধুইয়া দেই, ক্যানটিন বয়টা এগিয়ে আসে।

—না, তুই না, ওরা ধুবে।

—আচ্ছা আমিই ধুচ্ছি...। মজিদ বাধ্য ছেলের মতো গ্লাস ধুয়ে কোক ঢালল আলাদা আলাদা গ্লাসে। তবে রন্টু খেয়াল করল। মজিদের ঠোঁটে কেমন চিকন রহস্যময় একটা হাসি। একটা ট্রেতে পাঁচ গ্লাস কোক সাজিয়ে মজিদ ওদের দিল। ওরা ততক্ষণে কেক খেয়ে শেষ করে কোকের গ্লাস তুলে নিয়েছে। ক্যানটিনের বয় ছেলেটা অবাক হয়ে ওদের কাণ্ডকারখানা দেখছে। কোকের গ্লাস হাতে নিয়ে তিনজনই ঢক ঢক করে খেয়ে ফেলল।

তারপর মারকুটে পাঁচজন পাঁচ রকম ঢেকুর তুলল যেন। এবার বদির ডান হাত হোঁতকা টাইপ রুবেল বলল, ঠিক আছে তোরা এখন খাওয়ালি। ছুটির পর আমরা তোদের খাওয়াব।

—কী খাওয়াবে?

—সেটা ছুটি হলেই টের পাবি।

—আবার সেই ঘাস?

—না, ঘাস না। অন্য কিছু...

তখনই টিফিন শেষের ঘণ্টা বেজে উঠল। ওরা ক্যানটিনের বিল দিল। বিল হয়েছে ষাট টাকা। মজিদই দিল। তবে রন্টু আর সাদিক বলল, কাল তারা টাকা নিয়ে আসবে। বিলটা শেয়ার করবে। মজিদ মুচকি হেসে বলল। ‘দরকার নেই, চল তো ক্লাসে। একটু পর সার্কাস দেখবি।’

—সার্কাস?

—হ্যাঁ, সার্কাস

—কী সার্কাস?

—জাটরোফা কার্কাস দিয়ে সার্কাস!

—মানে? মজিদ কিছু বলল না। শুধু ভ্রু নাচাল।ত

শেষ পিরিয়ডে ইংরেজি ব্যাকরণ ক্লাস। স্যার ক্লাসে ঢুকেই রচনা লিখতে দিলেন ‘জার্নি বাই বোট’। সবাই লিখতে শুরু করল। রন্টু খেয়াল করল। বদি উঠে দাঁড়িয়েছে।

—কী হলো? স্যার জানতে চান।

—স্যার, একটু বাথরুমে যাব।

স্যার দাঁত খিঁচুনি দিয়ে বললেন। ‘কেন, টিফিন পিরিয়ডে কী করেছিলে? ঘাস কেটেছিলে?’ সবাই হো হো করে হেসে উঠল। আসলে ওই ঘটনার পর ঘাস শব্দটাই যেন হাসির মূলমন্ত্র হয়ে গেছে। বদি পেটে চেপে ধরে কোনোমতে বলল, স্যার, পে-পেট ব্যথা করছে। তার মুখচোখ লাল।

স্যার বেত দিয়ে টেবিলের ওপর সপাং করে বাড়ি দিয়ে বললেন ‘নো’।

বদি বসে পড়ল। রন্টু খেয়াল করল। ওরা পাঁচজনই কেমন উসখুস করছে। পাঁচজনই পেট চেপে ধরে আছে। রন্টু মজিদের দিকে তাকিয়ে দেখে সে গভীর মনোযোগ দিয়ে রচনা লিখছে। মনে হচ্ছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ রচনাটাই সে আজ লিখবে। এবার হোঁতকা টাইপ রুবেল উঠে দাঁড়াল।

—কী হলো? স্যার জানতে চান।

—স্যার, একটু বাথরুমে যাব...পেট...

স্যার আবার একটা দাঁত খিঁচুনি দিয়ে বললেন। ‘কেন টিফিন পিরিয়ডে কী করেছিলে? বদির সঙ্গে ঘাস কাটতে গিয়েছিলে?’ আবার একটা হাসির রোল উঠতে গিয়েও যেন উঠল না। স্যার হুংকার দিয়ে উঠলেন। ‘বসে রচনা লিখে শেষ করে তারপর যাবি’। সাদাত পেট চেপে ধরে দাঁড়িয়েই আছে। স্যার সেকেন্ড হুংকার দিলেন, বসতে বললাম না?

অলংকরণ: তারিক সাইফুল্লাহ

হোঁতকা রুবেল এবার বসে পড়ল।

রন্টু খেয়াল করল বাকি তিনজনেরই একই অবস্থা। তারা তিনজনই আসলে রচনা লিখতে পারছে না। পেট ধরে আইঢাই করছে। হঠাৎ সবাইকে অবাক করে দিয়ে বদি ক্লাস থেকে ছুটে বের হয়ে গেল। স্যার হতভম্ব! স্যার বেত নিয়ে ছুটে বের হলেন ওর পিছু পিছু। স্যার বেরিয়ে যেতেই বাকি চারজনও ছুটে বের হয়ে গেল।

আর ক্লাসসুদ্ধ সবাই হো হো করে হেসে উঠল। অন্য রকম এক সার্কাস শুরু হয়েছে যেন আজ ক্লাসে! শুধু হাসল না তিনজন মজিদ, রন্টু আর সাদিক।

বাকি চারজন বের হওয়ামাত্র ক্লাসের সবাই বের হলো। ঘটনা বুঝতে রন্টু আর সাদিকও বের হলো। বের হলো না মজিদ। সে তখনো গভীর মনোযোগে রচনা লিখেই চলেছে। তার মানে, রন্টু ভাবল মজিদই একমাত্র জানে ওদের পাঁচজনের কী হয়েছে। তাই সে নির্বিকার। একটু পরেই স্যার এলেন। স্যার এসে যা বললেন তাতে সবাই কাঁদবে না হাসবে বুঝতে পারল না। স্যার জানালেন, ওরা পাঁচজনই নাকি টয়লেট বন্ধ করে বসে আছে।

—টয়লেট থেকে বের হোক, কত ধানে কত চাল আজ বুঝবে বাছাধনেরা। স্যার দাঁত কিড়মিড় করেন। ‘দুজন দপ্তরিকে ওখানে দাঁড় করিয়ে রেখেছি বেরোনোমাত্র ক্যাক করে ধরবে সব কটাকে। বাথরুমে লুকানো বের করছি...’

তারপর স্যার দ্বিতীয় হুংকার দিলেন।

—রচনা কার কার শেষ হয়েছে?

—হাত তুলল মজিদ।

—খাতা নিয়ে আয়। মজিদ গেল। স্যার বললেন ‘পড়ে শোনা’ মজিদ পড়া শুরু করল—

Once I was afraid of boats. But one day...

মজিদ আসলেই চমৎকার একটা রচনা লিখেছে যার বাংলাটা এমন ‘সে সব সময় নৌকায় উঠতে ভয় পেত। কিন্তু একবার তার নানাবাড়িতে বেড়াতে গিয়ে বাধ্য হয়ে নৌকায় উঠতেই হলো তাকে। নৌকাটা ছিল একটা ছৈ দেওয়া সাম্পান নৌকা। তারপর সেই নৌকায় ভ্রমণ করে তার এত ভালো লেগে গেল...’ তারপর মজিদ সুন্দর একটা বর্ণনা দিল...নদীর দুই পাশের প্রকৃতির বর্ণনা...ভূ-পর্যটক ইবনে বতুতাও বোধ হয় এত সুন্দর বর্ণনা দেন নাই...রন্টুর তাই মনে হলো! ক্লাসের অন্য সবাই সত্যিই মুগ্ধ হয়ে গেল, রন্টু আর সাদিক হলো সবচেয়ে বেশি। ছোট ছোট সহজ শব্দ দিয়ে এত সহজ করেও ইংরেজি লেখা যায়(দু-একটা ছোটখাটো ভুল অবশ্য ছিল, সে তো চাঁদেরও কলঙ্ক থাকে)! মেজাজ খারাপ স্যারের মুড পর্যন্ত ভালো হয়ে গেল। স্যার পর্যন্ত চেঁচিয়ে উঠলেন ‘শাবাশ’।

—তুই কোন স্কুল থেকে এসেছিস?

—স্যার কুমিল্লা ফরিদা বিদ্যায়তন স্কুল।

—ওখানে তোদের ইংরেজি পড়াত কে?

—ঢালি স্যার।

—আবদুল আউয়াল ঢালি?

—জি স্যার, আপনি চেনেন?

—চিনব কিরে সে তো আমার স্কুল-কলেজ জীবনের সেরা বন্ধু।

স্যার হঠাৎ উঠে মজিদকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন। ‘তুই ঢালির ছাত্র আগে বলবি না...’। ক্লাসে একটা বেদনাবিধুর পরিবেশ তৈরি হলো। ছাত্রদের মধ্যেও দু-একজন চোখের পানি ফেলে দিল। এই সময় দুজন দপ্তরি বদিসহ চারজনকে ধরে এনেছে। ‘স্যার একটা পলাইছে’ রন্টু দেখল বদি আর তার তিন শাগরেদ ভীত চোখে মজিদের দিকে তাকিয়ে আছে। স্যার তখনো মজিদকে জড়িয়ে ধরে আছেন। স্যার এবার মজিদকে ছাড়লেন আর শুধু বললেন, ‘তোর কোনো সমস্যা হলে আমাকে বলবি।’ এবার ফিরলেন ওই চারজনের দিকে। এই সময় এক দপ্তরি গলা নামিয়ে বলল। ‘স্যার এরা মনে হয় টিফিনের সময় উল্ডা-পাল্ডা কিছু খাইছে...চাইরটারই পেট নাইমা গেছে...একটা অবশ্য পলাইছে সবগুলার সমানে খালিদাস্ত হইতাছে’

স্যার হুংকার দিলেন

—পেট নামছে? আরও অনেক কিছুই নামবে। চল হেড স্যারের রুমে।

স্যার দুই দপ্তরির সহযোগিতায় ওদের মোটামুটি চ্যাংদোলা করে নিয়ে রওনা হলেন হেড স্যারের রুমের দিকে।

এই সময়ই ছুটির ঘণ্টা পড়ল। এদিকে এক রচনা লিখেই মজিদ হিরো হয়ে গেছে। ক্লাসের অন্য ছেলেরা তার রচনাটা আরেকবার পড়ে দেখতে চায়। মজিদ খাতাটা ওদের দিয়ে দিল। কেউ কেউ ফটোকপি করার ইচ্ছে প্রকাশ করল।

ছুটির পরে বাড়ি যাওয়ার পথে রন্টু আর সাদিক ধরল মজিদকে।

—আচ্ছা, ওদের এমন হলো কেন? তুমি কিছু করেছিলে?

—অবশ্যই, নইলে এত আগ্রহ করে টাকা আনতে বাড়ি গেলাম কেন? টাকা কিন্তু আমার কাছে ছিলই।

—কী করেছিলে?

খুবই সিম্পল। বললাম না সার্কাস হবে। জাটরোফা কার্কাস দিয়ে সার্কাস...

—মানে?

—মানে জামাল গোটা! ওদের কোকের গ্লাসে একটা করে জামাল গোটা দিয়ে দিয়েছিলাম। আমাদের এই নতুন বাসায় জামাল গোটার গাছ আছে। ওটা পেটে গেলে পেট খারাপ হতে বাধ্য। দেখলেই তো ওদের অবস্থা! হা হা হা...

—কিন্তু তুমি যে বললে সার্কাস।

—জামাল গোটার বৈজ্ঞানিক নাম জাটরোফা কার্কাস...মানে তাই বললাম কার্কাস দিয়ে সার্কাস, যা আজ ক্লাসে হলো। তবে এই জাটরোফা কার্কাস এটা আসলে আমাদের দেশের খুবই কাজের একটা উদ্ভিদ। এর বিচি থেকে খুবই উন্নতমানের তেল হয়। যে তেল ডিজেল ইঞ্জিনে ব্যবহার করা যায়। এই তেলের আগুনে ধোঁয়া পর্যন্ত হয় না এত ভালো তেল

—তুমি এত কিছু জানলে কীভাবে?

—বাবার কাছ থেকে। আমার বাবা কৃষি কর্মকর্তা না? তা ছাড়া বড়দের যাদের টয়লেট সমস্যা আছে তারা এটা খেলে ভালো হয়ে যায়। বাবারও এ সমস্যা ছিল।

—মনে হচ্ছে খুবই কাজের এই জাট...কী যেন নামটা...?

—জাটরোফা কার্কাস...হ্যাঁ, খুবই কাজের। স্কুল-কলেজ ভার্সিটিতে কেউ র‌্যাগ দিতে এলে সার্কাস করা যায়...

মজিদের বলার ভঙ্গিতে ওরা তিনজনই একসঙ্গে হেসে ওঠে।

পরবর্তী দুদিন ওই পাঁচজন ক্লাসে এল না। হেড স্যারের রুমে ওদের কী হয়েছিল তা অবশ্য জানা সম্ভব হয়নি। তবে দুদিন পর যখন ওরা আবার ক্লাসে এল তখন। তাদের অবস্থা কেমন জবুথবু। গ্যাং লিডার বদির চোখের নিচে কালি। মজিদই এগিয়ে গিয়ে বলল,

—কিরে, দুদিন এলি না যে তোরা? ওরা কেমন অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইল মজিদের দিকে। মজিদ তুই তুই করে বলছে সেই জন্য? নাকি অন্য কোনো কারণ? মজিদ ফের বলল, ‘কী যেন খাওয়াবি আমাদের সেদিন বললি না? সেটা কি আজকে হবে?’ ওরা পাঁচজন ফ্যাকাশে চোখে তাকিয়ে রইল মজিদের দিকে। কোনো কথা বলল না।

আশ্চর্য ব্যাপার, এরপর থেকে ওরা পাঁচজন একদম সোজা হয়ে গেল। একদম টিভির বিজ্ঞাপনের পিভিসি পাইপের মতো স্ট্রেট। আর তার চেয়েও আশ্চর্য ব্যাপার, মাঝখান দিয়ে মজিদ হয়ে উঠল ক্লাসের অঘোষিত লিডার, কি পড়াশোনায় কি অন্যান্য কর্মকাণ্ডে। সবাই তাকে যেকোনো ব্যাপারে মানে। স্যাররা পর্যন্ত মাঝেমধ্যে তার পরামর্শ নেয়। আর বলাই বাহুল্য, রন্টু আর সাদিক মজিদের বেস্ট ফ্রেন্ড। সে হিসেবে এই নতুন স্কুলের নতুন ক্লাসে তাদেরও ভাব কম না।

তবে একটা বিষয় ভেবে রন্টুর বেশ একা একাই হাসি পায়। সেটা হচ্ছে যারা তাদের র‌্যাগ (কিংবা বুলিং) দিতে এসেছিল আয়োজন করে, উল্টো তারাই র‌্যাগ খেয়ে গেল। তাহলে উল্টো তারা তিনজন মিলে তাদের কী দিল? এটাকে কি বলবে বা বলা যায়? র‌্যাগ? না বুলিং? নাকি অন্য কিছু...?