অনেক অনেক দিন আগের কথা। এক দেশে এক রাজা ছিলেন। তাঁর ছিল বিশাল বড় সাম্রাজ্য। সাম্রাজ্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছিল একটা বড় মন। দেশের মানুষ অনেক সুখে-শান্তিতে বসবাস করছিল। কিন্তু হঠাৎ একদিন রাজার মাথায় এল অদ্ভুত এক ভাবনা। রাজা ঠিক করলেন ভূত ধরবেন। যেই ভাবা সেই কাজ। মন্ত্রীকে ডেকে সঙ্গে সঙ্গে হুকুম দিলেন রাজ্য থেকে একটা ভূত ধরে তাঁর সামনে হাজির করতে। মন্ত্রী থতমত খেয়ে গেল। আমতা আমতা করে বলল, না মানে, মহারাজা, ভূত বলে তো কিছু নেই।
কে বলল ভূত বলে কিছু নেই? গর্জন করলেন রাজা। মন্ত্রী কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ইয়ে মহারাজ, সবাই তো এটা জানে।
সবাই কীভাবে জানল? আবার হুংকার দিলেন রাজা।
মন্ত্রী আবার আমতা আমতা করে কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু রাজা সুযোগ দিলেন না। সাফ বলে দিলেন, হয় মন্ত্রীকে ভূত ধরে আনতে হবে, নয়তো উপযুক্ত প্রমাণ পেশ করতে হবে যে ভূত নেই। না হলে গর্দান যাবে।
কেন, কোন দুঃখে এই চাকরি নিয়েছিল, সেটা ভেবে মাথার চুল ছিঁড়তে ছিঁড়তে বাড়ির পথ ধরল মন্ত্রী।
তবে হাল ছাড়ল না। হাল ছাড়বেই বা কী করে, হাল ছাড়লে যে প্রাণ যাবে। রাজা ঢোল পিটিয়ে ভূত ঘোষণা দিয়েছেন, যে ভূত ধরে আনবে, তার জন্য বিরাট পুরস্কার। সভাসদেরা গভীর আলোচনায় বসল। ভূতের আশায় নদী ছেড়ে গাছে গাছে জাল ফেলতে লাগল জেলেরা। মোটামুটি একটা শোরগোল চারপাশে।
এদিকে রাজপ্রাসাদের পেছনের তেঁতুলগাছে যে পেতনি তার নাতিকে নিয়ে থাকত, সে এসব দেখে বেশ চিন্তায় পড়ল। ব্যাটা মন্ত্রী যা শুরু করেছে, ধরা পড়ে গেলে তো সর্বনাশ। তার ওপর সে থাকেই রাজপ্রাসাদের মাথার ওপর। ধরা পড়তে কতক্ষণ! নানির এই আশঙ্কা অবশ্য হেসেই উড়িয়ে দিল নাতি। দূর! ওরা কীভাবে ভূত ধরার চেষ্টা করছে জানো না? জাল দিয়ে! হি হি হি! ভূত কি টাকি মাছ নাকি?
নানির দুশ্চিন্তা তবু গেল না। তাই এক ফন্দি আঁটল বুড়ি পেতনি। সে ঠিক করল গভীর রাতে রাজার কাছে যাবে। তার চেহারা যদিও অনেক সুন্দর, কিন্তু কেন জানি মানুষ তাকে দেখে ভয় পায়। রাজাও নিশ্চয়ই পাবেন। তখন একটু হুমকি-ধমকি দিলে রাজা ভয়েই এই উপদ্রব বন্ধ করবেন। যেই ভাবা সেই কাজ।
পরদিন বেশ রাতে রাজপ্রাসাদে হানা দিল পেতনি। তার বয়স হয়েছে। চোখে ভালো দেখতে পায় না আজকাল। তাই ভুল করে রাজার ঘরে না ঢুকে ভুলে ঢুকে পড়ল ছোট্ট রাজপুত্রের ঘরে। ঢুকেই খ্যাক খ্যাক করে বিকট হাসি শুরু করল সে। রাজপুত্র টেবিলে বসে ছবি আঁকছিল। চমকে পেছনে তাকিয়ে পেতনিকে দেখে অবাক গলায় বলল, তুমি কে?
রাজার বদলে রাজপুত্রকে দেখে হাসি গিলে ফেলে চোখ পিটপিট করে তাকাল পেতনি।
ইয়ে, এটা রাজার ঘর না? উনি কোথায়?
রাজপুত্র এবার দাঁড়িয়ে গেছে, ভালো করে পেতনিকে দেখছে। তার চোখমুখে কৌতূহল। বলল, না, এটা আমার ঘর। আমি রাজার ছেলে।
ও, আচ্ছা, আচ্ছা!
কী করা উচিত বুঝতে না পেরে পেতনি এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল। জানালা দিয়ে সটকে পড়বে? না এই পিচ্চিটাকেই ভয় দেখাবে? ফিরে যাওয়ার মানে হয় না। আবারও খ্যা খ্যা করে হাসি শুরু করল সে। রাজপুত্র বিস্মিত গলায় বলল, হাসছ কেন? আমাকে দেখে কি হাসি পাচ্ছে? পেতনি অপ্রস্তুত হয়ে আবার চুপ মেরে গেল।
রাজপুত্র বলল, তুমি কে?
আমি ওই আরকি, পেতনি!
এখানে আসলে কীভাবে?
উড়ে এসেছি, পেতনি গাল চুলকাতে চুলকাতে বলল।
উড়ে এসেছ? রাজপুত্র চোখ বড় করে বলল, তুমি উড়তে পারো?
পারব না কেন? সব ভূতেরাই উড়তে পারে?
তুমি থাকো কোথায়? এত দিন তো দেখিনি, হঠাত্ ওড়াউড়ি শুরু করলে যে!
এত দিন দেখা দিইনি, তাই দেখোনি, পেতনি বিরক্ত গলায় বলল। আমি থাকি ওই পেছনের তেঁতুলগাছটায়।
তুমি কি আমাকে উড়তে শেখাবে? হঠাৎ রাজপুত্র খুশি খুশি গলায় বলে উঠল।
পেতনি বিরক্ত গলায় বলল, উড়তে শেখানো যায় না। ওটা আপনা-আপনি শিখে ফেলতে হয়। মানুষের কর্ম না। যা-ই হোক, আমি যাচ্ছি। সময়টা নষ্ট হলো। তোমার বাবাকে বলবে, এই ভূত ধরাধরির চেষ্টা বন্ধ রাখতে। বলবে, তুমি ভূত দেখেছ, ভয় পেয়েছ। ভূত মানুষ পেলে চিবিয়ে খায়। তাই ভূত ধরার দরকার নেই। বুঝেছ?
রাজপুত্র চোখ গোল গোল করে শুনছিল। পেতনি যাওয়ার উপক্রম করতেই রাজপুত্র বলল, তোমার যাওয়া চলবে না! উড়তে শেখাতে হবে!
মানুষ উড়তে পারে না, শেখাব কীভাবে? পেতনি দাঁত খিঁচিয়ে বলল।
না, হবে না! রাজপুত্র গোঁ ধরল। যদি আমাকে উড়তে না শেখাও, তাহলে কিন্তু বাবাকে বলে ওই তেঁতুলগাছে জাল ফেলব।
এ তো মহা ধড়িবাজ ছেলে! পেতনি চোখ পাকিয়ে বলল, এই শোনো...।
রাজপুত্র আর পেতনি যখন তুমুল ঝগড়ায় ব্যস্ত, তখন রানি দুধের গ্লাস হাতে রাজপুত্রের ঘরে ঢুকলেন। রাজপুত্র আর পেতনি রানির দিকে তাকাল। রানিও তাকালেন তাদের দিকে। ঠিক দুই সেকেন্ড নীরবতার পর বিকট চিৎকার দিয়ে হাত থেকে গ্লাস ফেলে দিলেন রানি। ঘর ফাটিয়ে চিৎকার করতে করতে লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে ছুটলেন তিনি।
ও মাগো! ভূত...পেতনি...বাঁচাও...আঁ...আঁ...আঁ...আঁ...’
অবস্থা দেখে জানালা দিয়ে পালাল পেতনি। রাজপুত্র হতভম্ব। রানি অজ্ঞান। কিছুক্ষণ পর একটু সুস্থ হয়ে উঠলে রেগেমেগে রাজার কাছে গেলেন তিনি। ভূত-পেতনির এই উপদ্রবের জন্য যে রাজার বোকামোই দায়ী সেই ব্যাপারে তাঁর কোনো সন্দেহ নেই। রাজপুত্রকেও ডাকা হলো।
রানি আর রাজপুত্রের কথা শুনে রাজা তৎক্ষণাৎ মন্ত্রীকে ডেকে অভিযান বন্ধ করার নির্দেশ দিলেন। বিনা দোষে ভূত-পেতনির হাতে বেঘোরে প্রাণ দেওয়ার দরকার কী। রানির মুখে পেতনির ভয়াবহ বর্ণনা শুনে তাঁর ভূত দেখার শখ মিটে গেছে। রাজপুত্র যদিও কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তিনি আমলে নিলেন না।
ওদিকে দ্রুত তেঁতুলগাছে পৌঁছেই তড়িঘড়ি করে তল্পিতল্পা গুছিয়ে নাতিকে নিয়ে পালাল পেতনি। এখানে আর না। রানিকে ভয় দেখিয়েছে সে। এখন নিশ্চয়ই রাজা রেগেমেগে সব ভূতকে পাকড়াও করবেন। তার চেয়ে পালানোই ভালো। যাওয়ার পথে যতজনকে পারে সংক্ষেপে ঘটনা বলে যেতে লাগল পেতনি। দ্রুতই ভূতসমাজ জেনে গেল, রাজা ভীষণ খেপে তাদের পেছনে লেগেছে। এবার আর নিস্তার নেই। সব ভূত, পেতনি, দৈত্য পড়িমরি করে রাজ্য ছেড়ে পালাতে লাগল। দুই দিনের মধ্যেই রাজ্য থেকে সব ভূত গায়েব।
বুড়ি পেতনি তার নাতিকে নিয়ে পাশের রাজ্যের নদীর ধারের এক অশ্বত্থগাছে আস্তানা গাড়ল। রাজার পাগলামি শেষ হওয়ায় মন্ত্রীও বাঁচল। রাজপুত্রও কয়েক দিনের মধ্যে উড়তে শিখতে না পারার দুঃখ ভুলে গুলতি নিয়ে মেতে উঠল। এরপর থেকে সেই রাজ্যের রাজা-রানি, ভূতসমাজ, মানবসমাজ—সবাই যে যার মতো সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে লাগল।