সেই আদ্যিকালের কথা। মোরগ-মুরগি তখন ছিল বনের বাসিন্দা। বুনো জীবজন্তু, পশুপাখির সঙ্গে তারা বসবাস করত জঙ্গলে। অন্য প্রাণীরা তাদের ভয় পেত ভীষণ। কেন, কী কারণে এই ভয় পাওয়া? কারণ, দুজনের মাথায়ই লাল রঙের ঝুঁটি আছে। এর মধ্যে মোরগের ঝুঁটি আকারে বড়। টকটকে লাল রঙের ঝুঁটি। তারা সবাইকে বলে বেড়াত যে এই ঝুঁটির ভেতরে আগুন আছে। সে কারণে রং লাল। ওই আগুনের ভয়ে কেউ পারতপক্ষে তাদের কাছ ঘেঁষত না।
সব জীবজন্তুই আগুনকে প্রচণ্ড ভয় পায়। লাল ঝুঁটির ভয় দেখিয়ে মোরগ-মুরগি বনে তাদের রাজত্ব কায়েম করেছে। একচেটিয়া কর্তৃত্ব। সবাই এই জুটিকে মান্য করে। ইজ্জত দেয়। তাদের নির্দেশমতো কাজ করে সব সময়। কেউ যদি উল্টাপাল্টা বা অন্য রকম কিছু করতে চায়, মোরগ তাকে শাসিয়ে বলে, দ্যাখো রে বাপু, আমার অবাধ্য হয়ো না। মহাবিপদে পড়বে তাহলে। আমার ঝুঁটিটার দিকে একটু তাকাও। কেমন আগুন রং, দেখতে পাচ্ছ? একদম পুড়িয়ে ছাই করে দেব, হ্যাঁ। তখন কিন্তু আফসোস করতে পারবে না।
এভাবেই চলছিল। একদিনের এক ঘটনায় সব কেমন যেন ওলটপালট হয়ে গেল। চিতা বাঘিনীর বাসায় ঘটনার সূত্রপাত। হয়েছে কী, চিতা বাঘের বউ রান্নাঘরে গিয়ে দেখে, আগুনের কোনো ব্যবস্থা নেই। চুলা ধরানো যাচ্ছে না সেই কারণে। রান্নাবান্না হবে কেমন করে? বড্ড ঝামেলায় পড়া গেল। বাঘিনীর ছোট বাচ্চাটা তখন গুহার এক কোণে আপনমনে খেলাধুলা করছিল। মা তাকে ডেকে বলে, যাও তো রে বাবা, এখুনি মোরগের বাসা থেকে একটু ঘুরে আসো তুমি। কয়েকটা জ্বলন্ত কয়লার টুকরা দরকার। তা দিয়ে চুলা ধরাতে হবে। মোরগকে গিয়ে সবিনয়ে বলবে, সে যেন কয়েক টুকরা জ্বলন্ত কয়লা তোমাকে দেয়। ওই আগুন দিয়ে রান্না করব।
বাচ্চাটা মায়ের কথা শোনে সব সময়। সে বাধ্য, নম্র স্বভাবের একটা বাচ্চা। খেলা ছেড়ে উঠে পড়ল সে। তারপর সোজা চলে গেল মোরগ কাকুর বাসায়। গিয়ে দেখে মোরগ-মুরগি অঘোরে ঘুমাচ্ছে। ওদের ডেকে তোলার সাহস হলো না চিতা বাঘের বাচ্চার। কে জানে বাপু, ঘুম ভাঙানো হলে যদি ওরা রেগে যায়! রেগেমেগে কঠিন কোনো শাস্তি দেয়? তাহলে তো কেলেঙ্কারির একশেষ হবে।
বাচ্চা ফিরে এল বাসায়। খালি হাতে। মা ওকে দেখে অবাক। বাচ্চা তার মাকে বলল সব কথা। চিতা বাঘিনী তার বাচ্চাকে বলে, হুম। বুঝলাম। তা এক কাজ করো বাছা। একটু পরে আবার যাও। সঙ্গে করে কিছু শুকনা ঘাস নিয়ে যাও তুমি। মোরগের ঝুঁটি থেকে ওই ঘাসে আগুন ধরিয়ে নিয়ে এসো। তা দিয়েই কাজ চলে যাবে।
ছোট বাচ্চা একলা একলা যেতে নারাজ। কেমন ভয় ভয় লাগছে তার। মা বাঘিনীকে সে ইনিয়ে–বিনিয়ে বলল, আমি একা একা আর যাব না। মা, তুমিও চলো আমার সঙ্গে।
বাঘিনী তার বাচ্চাসহ রওনা দেয়। কিছুক্ষণ পরই তারা গিয়ে পৌঁছায় সেখানে। দুজন হামাগুড়ি দিয়ে পৌঁছে গেল মোরগের বিছানার কাছে। কাজটা করতে হলো খুবই সাবধানে। নিঃশব্দে। মোগর-মুরগি টের পেয়ে গেলে বড্ড ঝামেলা পাকাবে। বাঘিনী মোরগের ঝুঁটির সঙ্গে শুকনা ঘাস–পাতাগুলো ছোঁয়াল। কিসের কী! কোথায় আগুন? কোনো কিচ্ছু নেই। বাঘিনী তার থাবা দিয়ে ঝুঁটিটা ছুঁয়ে দেখল। নাহ, আগুন টাগুন তো কিছু নেই। লালরঙা ঝুঁটি কেমন হিম হিম, ঠাণ্ডা।
চিতা বাঘিনী স্পষ্ট বুঝতে পারল, মোরগ-মুরগি এত দিন মিছে কথা বলে ঠকিয়েছে বনের সবাইকে। আগুন কোথায়? সব ধাপ্পাবাজি। তারা দীর্ঘদিন ধরে বনের সব জীবজন্তু, পশুপাখিকে ধোঁকা দিয়ে এসেছে। বোকার মতো সেসব হজম করেছে তারা। বাঘিনী রাগের চোটে গরগর করতে লাগল। তার গর্জনে ঘুম ভেঙে গেল মোরগ-মুরগির। চিতা বাঘিনী চোখ লাল করে বলে, ওহে ভণ্ড! তোমাদের বুজরুকি ধরা পড়ে গেছে। তোমরা আসলে মহা চালিয়াত। এক নম্বরের মিথ্যুক। মিছে কথা বলে এত দিন আমাদের ভয় দেখিয়ে এসেছ। এখন আমার কাছে সব চালাকি দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। আমি নিজে তোমাদের ঝুঁটি ছুঁয়ে দেখেছি। ওখানে আগুনের লেশমাত্র নেই। তোমরা যে প্রতারক, বনের সবাইকে আমি এই কথাটা বলে দেব। সবাই বুঝুক, তোমাদের চিনুক। আমি এখন সেই কাজেই যাচ্ছি। সবাই যখন তোমাদের ঠেঙাবে, তখন বুঝবে মজা!
চাষি ও তার পরিবারের লোকজন মোরগ-মুরগিকে পেয়ে অত্যন্ত খুশি। মুরগি ডিম দেয়। খেতে ভারি স্বাদ সেই ডিম
জারিজুরি সব ফাঁস হয়ে গেছে। প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেছে মোরগ আর মুরগি। যত দ্রুত সম্ভব পালাতে হবে এখান থেকে। সব চাতুরি ধরা পড়ে গেছে চিতা বাঘিনীর কাছে। সবাই এখন ছি ছি করবে। লজ্জা দেবে। শুধু কী তা–ই? বলা যায় না, হামলাও করে ফেলতে পারে কেউ কেউ। তখন জীবন বাঁচানোই কঠিন হয়ে পড়বে। অতএব পালাও। এক্ষুনি পালাও। আর দেরি নয়। এক মিনিটও নয়।
খুবই অল্প সময়ের মধ্যে বন ছেড়ে পালিয়ে গেল তারা। তাড়াহুড়া করে সংসারের জিনিসপত্র যা যা নেওয়া সম্ভব, ভরা হলো কয়েকটি পোঁটলায়। সব কি আর সঙ্গে নেওয়া যায়? নাহ। কিছু কিছু জিনিস ফেলে যেতে হলো। মায়া করে লাভ নেই। দেরি হলে জান খোয়াতে হবে। অতএব দাও চম্পট।
বন থেকে দৌড়ে সোজা গ্রামে চলে গেল মোরগ-মুরগি। গেরস্তবাড়িতে গিয়ে ঠাঁই নিল। লোকজন তাদের আশ্রয় দিল হাসিমুখে। আহা রে। বিপদে পড়েছে। থাকতে চাইলে থাকুক ওরা। ক্ষতি কী? চাষির সংসারের সদস্য বনে গেল তারা। উফ! আরেকটু হলে দুজনেরই দফারফা হয়ে যেত।
সেই থেকে গৃহপালিত পাখি হয়ে গেছে মোরগ আর মুরগি। জঙ্গলে নিজেদের আস্তানায় ফেরত যাওয়ার কথা আর কোনো দিন ভাবেনি তারা। চাষি ও তার পরিবারের লোকজন মোরগ-মুরগিকে পেয়ে অত্যন্ত খুশি। মুরগি ডিম দেয়। খেতে ভারি স্বাদ সেই ডিম। এরা লক্ষ্মী। ভাগ্য নিয়ে এসেছে। তাদের যত্নআত্তি করা দরকার। ওরা ভালোমতো যাতে থাকতে পারে, সে জন্য বাহারি, চটকদার খোঁয়াড় বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। ভারি মজবুত সেই আস্তানা। ঝানু একজন কাঠমিস্ত্রিকে খবর দিয়ে আনা হয়েছে। সে এসে কয়েক দিন ধরে খুটখাট করে সুন্দর ছোট্ট একটা ঘর তৈরি করে দিল। কাঠের ঘর। দরজা–জানালাও আছে সেই ঘরের। রাতে সেই ঘরের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়। ছোট্ট ঘরটি বেশ নিরাপদ। রাতবিরাতে নানা জাতের বন্য জন্তু এই ঘরের আশপাশে ঘুরঘুর করলেও মোরগ-মুরগি নিরাপদে থাকে। মজবুত দরজা ভাঙার সাধ্যি কারও নেই।
চিতা বাঘিনী ওই প্রতারণার কথা ভুলতে পারেনি। সে তক্কে তক্কে থাকে। ভাগ্যের জোরে কোনো দিন যদি মোরগ-মুরগির নাগাল পায়, তাহলে শোধ তুলবে। মুহূর্তের মধ্যে টুঁটি টিপে ধরবে ওদের। তারপর ভূরিভোজ করবে।
কিন্তু সেটি হওয়ার নয়। মোরগ-মুরগি আর বনের প্রাণী নয়। তারা লোকালয়ে গেরস্তবাড়ির অংশ হয়ে গেছে।