মিস মার্পল টেলস আ স্টোরি

অলংকরণ: তুলি

বিচিত্র একটা ঘটনা ঘটেছিল কয়েক বছর আগে। প্রিয় রেমন্ড, প্রিয় জয়েস, গল্পটা তোমাদের শুনিয়েছি বলে মনে পড়ছে না। নিজেকে নিয়ে বড়াই করতে চাই না। তা ছাড়া, তোমাদের মতো তরুণদের তুলনায় আমার মাথায়ও বুদ্ধিশুদ্ধি একেবারেই কম। রেমন্ড তো দারুণ সব বই-ই লিখে ফেলে! আর জয়েসও দারুণ সব ছবি আঁকো। রেমন্ড অবশ্য ঠিকই বলে, আমি বড্ড সেকেলে মানুষ। অবশ্য সেকেলে ব্যাপারস্যাপারই আমার বেশি পছন্দ। যাহোক, কী যেন বলছিলাম? হ্যাঁ, বুদ্ধি আমার বেশি নেই। তবে দারুণ জটিল একটা রহস্যের সমাধান করেছিলাম সেবার। আমার বিশ্বাস, সত্যিকারের বুদ্ধিমান লোকের মাথাও ঘুরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা ছিল রহস্যটার।

বেশ, পুরো ঘটনাটা তাহলে খুলেই বলি। তোমরা যেন ভেবো না যে বড়াই করছি আমি। সেদিন এক চরম বিপদগ্রস্ত, অসহায় মানুষকে সাহায্য করেছিল তোমাদের মার্পল ফুপু।

একদিন রাত ৯টার দিকে আমার কাজের মেয়ে গোয়েন এসে জানাল, মি. পেথেরিক আর একজন ভদ্রলোক এসেছেন আমার সঙ্গে দেখা করতে। অতিথিদের ড্রয়িংরুমে বসাল ও।

গোয়েনকে পানীয় আর গ্লাস নিয়ে আসতে বলে দ্রুত ড্রয়িংরুমে গেলাম। মি. পেথেরিকের কথা মনে আছে তোমাদের? দুই বছর আগে মারা গেছেন ভদ্রলোক। আমার খুব ভালো বন্ধু এবং আইনি পরামর্শদাতা ছিলেন উনি। দারুণ বুদ্ধিমান লোক, দক্ষ আইনজীবী। আজকাল তার ছেলেই আমার আইনি কাজকর্ম সামলায়। চমৎকার ছেলে। কিন্তু মি. পেথেরিকের মতো ভরসা করতে পারি না ওর ওপর।

যাহোক, মি. পেথেরিক আর তার বন্ধুকে নিয়ে ডাইনিংরুমে এসে বসলাম। ওর বন্ধুর নাম মি. রোডস। বছর ৪০ বয়স। লোকটাকে একনজর দেখেই বুঝলাম, কোথাও একটা ঘাপলা আছে। তার আচরণ কেমন যেন অদ্ভুত ঠেকল আমার কাছে। স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম, বেশ টানাপোড়েনের মধ্যে আছেন।

ডাইনিংরুমে বসার পর আমার সঙ্গে দেখা করতে আসার কারণ জানালেন মি. পেথেরিক। ‘মিস মার্পল, আপনার কাছ থেকে একটা পরামর্শ নেওয়ার জন্য এসেছি।’

‘আমার কাছ থেকে আর কী পরামর্শ নেবেন...’ কথা শেষ করলাম না।

শুকনা হাসি দিলেন মি. রোডস। বললেন, ‘কয়েক মাসের মধ্যেই বোধ হয় ফাঁসির দড়িতে ঝুলব আমি।’

এবার একটু একটু করে বুঝতে শুরু করলাম ব্যাপারটা। সম্প্রতি বার্নচেস্টারে হওয়া খুনটার ব্যাপারে কথা বলতে এসেছেন তারা। শহরটা আমাদের গ্রাম থেকে মাইল বিশেক দূরে। ঘটনাটার ব্যাপারে আগে শুনলেও অত গুরুত্ব দিইনি। আবছা আবছা মনে পড়ল, একটি হোটেলে থাকার সময় ছুরি মেরে হত্যা করা হয়েছে এক মহিলাকে। তার নামটা মনে পড়ছিল না।

এখন বোঝা গেল, মিসেস রোডসই সেই মহিলা। তার চেয়েও খারাপ ব্যাপার হচ্ছে, এই হত্যাকাণ্ডের প্রধান সন্দেহভাজনের নাম মি. রোডস।

অল্প কথায় সবকিছু খোলাসা করে বললেন মি. পেথেরিক। করোনারদের জুরি রায় দিয়েছেন, অজ্ঞাতপরিচয় এক বা একাধিক ব্যক্তির হাতে খুন হয়েছেন মিসেস রোডস। মি. রোডসের বিশ্বাস, দু-এক দিনের মধ্যে গ্রেপ্তার হবেন তিনি। তাই মি. পেথেরিকের কাছে ছুটে এসেছেন সাহায্যের জন্য। আসন্ন মামলায় মি. রোডসের পক্ষে লড়বেন স্যার ম্যালকম ওল্ড।

স্যার ম্যালকম ঝানু উকিল। কেসটিতে বেশ কিছু ফাঁকফোকর খুঁজে বের করেছেন তিনি। ওগুলো ব্যবহার করে মি. রোডসকে বাঁচানো যাবে। তা সত্ত্বেও পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারছেন না মি. পেথেরিক। তাঁর ধারণা, কেসটায় মি. রোডসের ফেঁসে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। তাই এসেছেন আমার থেকে পরামর্শ নিতে। এরপর তিনি ঘটনাটা খুলে বলার অনুমতি চাইলেন। সব শুনে আমি যদি রহস্যটার একটা সমাধান দিতে পারি, তাহলে খুব ভালো হয়।

বুঝতে পারছিলাম, আমার যোগ্যতা সম্পর্কে বেশ সন্দিহান মি. রোডস। বন্ধুর জোরাজুরিতে এসেছেন এখানে, নইলে আসতেন না। তাকে পাত্তা না দিয়ে মার্চের ৮ তারিখ, অর্থাৎ ঘটনার রাতে কী হয়েছিল, তা বলতে শুরু করলেন মি. পেথেরিক।

বার্নচেস্টারের ক্রাউন হোটেলে ছিলেন রোডস দম্পতি। অনেক দিন থেকেই বিষণ্নতায় ভুগছিলেন মিসেস রোডস। ঘটনার রাতে খাওয়া সেরেই শুতে চলে যান উনি।

পাশাপাশি দুটি কামরায় উঠেছিলেন রোডস দম্পতি। কামরা দুটির মাঝে একটা সংযোগ রক্ষাকারী দরজা আছে। ওই দরজা দিয়ে এক ঘর থেকে আরেক ঘরে যাওয়া যায়। মি. রোডস প্রাচীন শিলার ওপর বই লিখছেন। পাশের রুমে সেই কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি।

রাত ১১টায় কাগজপত্র গুছিয়ে শুতে যাওয়ার জন্য তৈরি হলেন ভদ্রলোক। এর আগে স্ত্রীর কক্ষে উঁকি দেন, কিছু লাগবে কি না জানতে। তখনই দেখেন, ঘরের বাতি জ্বলছে...আর বুকে ছুরিবিদ্ধ পড়ে আছেন তাঁর স্ত্রী। কমপক্ষে এক ঘণ্টা আগে খুন হয়েছেন ভদ্রমহিলা, বেশিও হতে পারে।

আরেকটা ব্যাপার, আরও একটা দরজা আছে মিসেস রোডসের ঘরে। ওটা দিয়ে করিডরে যাওয়া যায়। দরজাটায় ভেতর থেকে খিল আঁটা ছিল। কামরার একমাত্র জানালারও ছিটকিনি লাগানো ছিল ভেতর থেকে। মি. রোডসের ভাষ্যমতে, গরম পানি দিতে আসা এক চেম্বারমেইড ছাড়া আর কেউ তার ঘরের ভেতর দিয়ে মিসেস রোডসের ঘরে যাননি। খুন করা হয়েছে একটা স্টিলেটো ড্যাগার দিয়ে। জিনিসটা মিসেস রোডস কাগজ কাটার জন্য ব্যবহার করতেন। ছোরাটা সব সময় ড্রেসিং টেবিলের ওপরই পড়ে থাকত। ওতে কারও আঙুলের ছাপ পাওয়া যায়নি।

সমস্যাটা জটিল হয়ে উঠল, যখন দেখা গেল মি. রোডস আর ওই চেম্বারমেইড ছাড়া অন্য কেউ ভিকটিমের ঘরে ঢোকেননি। এই চেম্বারমেইড সম্পর্কে জানতে চাইলাম আমি।

‘তাকে দিয়েই তদন্ত শুরু করেছি,’ মি. পেথেরিক বললেন। ‘তার নাম মেরি হিল। স্থানীয় মহিলা। ১০ বছর ধরে কাজ করছেন ক্রাউনে। খামোখা হোটেলের অতিথির ওপর হামলা করার কোনো কারণ নেই তার। মহিলা খুব বোকাসোকা। জেরা করার সময় বারবার একই কথা বলেছেন। গরম পানির বোতল নিয়ে গিয়ে সে দেখেছে মিসেস রোডস ঝিমোচ্ছেন, এক্ষুনি ঘুমিয়ে পড়বেন। মেরি হিল খুন করতে পারেন, এ কথা আমার নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছে না। কোনো জুরিও কথাটা বিশ্বাস করবেন না।’

আরও কিছু খুঁটিনাটি তথ্য দিলেন মি. পেথেরিক। হোটেলে সিঁড়ির এক মাথায় একটা ছোটখাটো লাউঞ্জ আছে। অতিথিরা মাঝেমধ্যে সেখানে বসেন, কফি খান। লাউঞ্জ থেকে ডান দিকে একটা প্যাসেজ চলে গেছে। ওটার শেষ প্রান্তের দরজাটা মি. রোডসের কামরার। এরপর প্যাসেজটা আরেকবার ডানে বাঁক নিয়েছে। মোড় নেওয়ার পর প্রথম দরজাটাই মিসেস রোডসের। লাউঞ্জ থেকে দুটি দরজাই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলেন সাক্ষীরা।

প্রথমটা, অর্থাৎ মি. রোডসের ঘরের দরজাটাকে বোঝানোর সুবিধার্থে ‘ক’ দরজা বলছি। ওই দরজা দেখেছেন চারজনে। দুজন পর্যটক আর এক বয়স্ক দম্পতি। তারা লাউঞ্জে বসে কফি খাচ্ছিলেন। তারা সাক্ষ্য দিয়েছেন, ‘ক’ দরজা দিয়ে চেম্বারমেইড আর মি. রোডস ছাড়া অন্য কেউ ঢোকেননি বা বের হননি। বাঁকের ওপাশের দ্বিতীয়, অর্থাৎ মিসেস রোডসের ঘরের দরজাটাকে ‘খ’ দরজা ধরলাম। ওটার সামনে কাজ করছিলেন এক ইলেকট্রিশিয়ান। সে কিরা কেটে বলেছে, চেম্বারমেইড ছাড়া আর কাউকে সে ওই দরজা দিয়ে ঢুকতে বা বের হতে দেখেনি।

কেসটা ভারি ইন্টারেস্টিং। আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছে, মি. রোডসই স্ত্রীকে খুন করেছেন। কিন্তু মি. পেথেরিক তা মানতে নারাজ। মক্কেলের ওপর তার অবিচল আস্থা। মি. পেথেরিক বিচক্ষণ মানুষ, তার বিচার-বিবেচনা ফেলে দেওয়া যায় না।

কেসটা ভারি ইন্টারেস্টিং। আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছে, মি. রোডসই স্ত্রীকে খুন করেছেন। কিন্তু মি. পেথেরিক তা মানতে নারাজ। মক্কেলের ওপর তার অবিচল আস্থা। মি. পেথেরিক বিচক্ষণ মানুষ, তার বিচার-বিবেচনা ফেলে দেওয়া যায় না।

ইনকোয়েস্টে মি. রোডস খুব অগোছালো আর খাপছাড়া একটা গল্প শোনান। এক মহিলা নাকি তার স্ত্রীকে হুমকি দিয়ে চিঠি লিখতেন। বলা বাহুল্য, তার গল্প বিশ্বাস করেননি বিচারক।

পেথেরিকের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে মি. রোডস নিজেই বললেন, ‘সত্যি বলতে কি, আমি নিজেই অ্যামির কথা বিশ্বাস করিনি। ভেবেছিলাম, চিঠির ব্যাপারটা ও বানিয়ে বলছে।’

আমার ধারণা, মিসেস রোডস ছিলেন কল্পনাবিলাসী মানুষ। যেকোনো ঘটনা রং চড়িয়ে বলতে পছন্দ করতেন। কলার খোসায় পা পিছলে আছাড় খেলে বলে বেড়াতেন যে মরতে মরতে বেঁচে গেছেন। ল্যাম্পশেডে আগুন ধরলে বলে বেড়াতেন, একটা জ্বলন্ত বাড়ির ভেতর থেকে কোনোমতে জানে বেঁচে ফিরেছেন। তার এ ধরনের রং চড়ানো কথাবার্তা কানে তোলার অভ্যাস করে নিয়েছিলেন স্বামী বেচারা।

এ কারণেই মাস কয়েক আগে মিসেস রোডস যখন বললেন, উনি একটা বাচ্চাকে গাড়িচাপা দিয়ে আহত করেছেন, আর বাচ্চাটার মা প্রতিশোধ নেওয়ার হুমকি দিচ্ছেন তাকে, তখন কথাগুলো কানে তোলেননি মি. রোডস। ঘটনাটা নাকি তাদের বিয়ের আগেকার। মিসেস রোডস মাঝে মাঝে আজেবাজে ভাষায় লেখা চিঠি পড়ে শোনাতেন তাকে। ভদ্রলোকের সন্দেহ ছিল, চিঠিগুলো তার স্ত্রী নিজেই বানিয়ে লিখতেন। কারণ, এর আগেও দু-একবার এ রকম কাজ করেছেন তিনি। জীবনে সামান্য উত্তেজনার জন্য রীতিমতো তড়পাতেন ভদ্রমহিলা।

এমন স্বভাবের মহিলা আগেও দেখেছি আমাদের গ্রামে। এদের অবস্থা হয় ওই রাখাল ছেলের মতো। বারবার মিথ্যা বলায় তার ওপর থেকে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলল সবাই। অথচ যখন সত্যিই বিপদ এল, কেউ বিশ্বাস করল না তার কথা। তবে পুলিশ মি. রোডসের কথা বিশ্বাস করেনি। তাদের ধারণা, বানোয়াট গল্প ফেঁদে নিজেকে বাঁচাতে চাইছেন তিনি।

আমি জানতে চাইলাম, হোটেলে ওই সময় আর কোনো মহিলা ছিলেন কি না। ‘হ্যাঁ, দুজন মহিলা ছিলেন। মিসেস গ্র্যানবি নামে এক অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান বিধবা আর মিস কারুথার্স নামে একজন অবিবাহিত মহিলা। পরেরজন আবার “গ” উচ্চারণ করতে পারেন না।’ মি. পেথেরিক আরও জানালেন, বিস্তর জিজ্ঞাসাবাদের পরও এই দুজনকে খুনের সঙ্গে জড়ানো যায়নি। ঘটনাস্থলের ধারেকাছেই যাননি তাঁরা।

জানতে চাইলাম, মহিলা দুজন দেখতে কেমন। মিসেস গ্র্যানবির মাথা ঝাঁকড়া লাল চুল। ফ্যাকাশে মুখ, বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। দেশি রেশমের তৈরি দামি পোশাক পরেন। মিস কারুথার্সের চল্লিশের মতো। চোখে ডাঁটিবিহীন প্যান্সনেজ চশমা পরেন। চুল ছেলেদের মতো ছোট করে ছাঁটা। পুরুষালি কোট আর স্কার্ট পরেন।

‘আহ-হা!’ বললাম আমি। ‘খুব জটিল হয়ে গেল ব্যাপারটা!’

মি. পেথেরিক আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন। তবে তাকে কিছু ব্যাখ্যা করতে গেলাম না। তার বদলে স্যার ম্যালকম কেসের ব্যাপারে কী বলেছেন, তা জানতে চাইলাম।

মি. পেথেরিকের কথা থেকে বুঝতে পারলাম, ঘটনাটাকে আত্মহত্যা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছেন স্যার ম্যালকম। কিন্তু ডাক্তারি আলামতগুলো একেবারেই তার উল্টো। ছুরিতে মিসেস রোডসের আঙুলের ছাপ পাওয়া যায়নি। তবে স্যার ম্যালকম নাকি নিশ্চিত, এই আলামতগুলো তিনি আদালতে বাতিল করতে পারবেন। আপাতত উনি আঙুলের ছাপের সমস্যাটা সমাধান করার উপায় খুঁজছেন।

মি. রোডসকে জিজ্ঞেস করলাম, আত্মহত্যার ব্যাপারে তার কী মত। উনি মাথা নেড়ে ধারণাটা বাতিল করে দিলেন। বললেন, ‘অ্যামি আত্মহত্যা করার মতো মানুষই না।’

কথাটা বিশ্বাস করলাম। কারণ, হিস্টিরিয়ার রোগীরা সাধারণত আত্মহত্যা করে না।

মিনিটখানেক ভাবলাম ব্যাপারটা নিয়ে। তারপর মি. রোডসকে জিজ্ঞেস করলাম, তার স্ত্রীর কামরা থেকে বেরিয়েই করিডরে যাওয়া যায় কি না। তিনি বললেন, না, একটা ছোট হলওয়ে আছে, বাথরুমসহ। বেডরুম থেকে হলওয়েতে যাওয়ার দরজাটা ভেতর থেকে আটকানো ছিল।

‘তাহলে তো ব্যাপারটা এক্কেবারে পানির মতো পরিষ্কার হয়ে গেল,’ মন্তব্য করলাম আমি।

সত্যিই, এর চেয়ে সহজ রহস্য আর হয় না। কিন্তু এভাবে কেউ ভেবেই দেখেনি! মি. পেথেরিক আর মি. রোডস ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন আমার দিকে। ওদের চাউনি দেখে লজ্জা পেয়ে গেলাম।

মি. রোডস বললেন, ‘মিস মার্পল বোধ হয় সমস্যাটা ঠিকমতো বুঝতে পারেননি।’

‘খুব বুঝেছি,’ জবাব দিলাম। ‘চারটা সম্ভাবনা আছে। আপনার স্ত্রী আত্মহত্যা করেছেন, কিংবা চেম্বারমেইড বা আপনার হাতে খুন হয়েছেন। অথবা বাইরের কেউ খুন করেছে তাকে, যাকে কেউ আসতে বা বের হতে দেখেনি।’

‘অসম্ভব!’ প্রতিবাদ করলেন ভদ্রলোক। ‘আমার চোখ এড়িয়ে কারও পক্ষে আমার ঘরে ঢোকা সম্ভব ছিল না। কেউ যদি ঢুকেও পড়ে, আমার স্ত্রীকে খুন করে ভেতর থেকে দরজা আটকে সে বের হবে কী করে? ইলেকট্রিশিয়ানের চোখে পড়ে যাবে না?’

‘হ্যাঁ, কীভাবে ঢুকবে, মিস মার্পল?’ উৎসাহ জোগানোর ভঙ্গিতে বললেন মি. পেথেরিক।

‘তার আগে একটা প্রশ্ন করি,’ বললাম আমি। ‘চেম্বারমেইড দেখতে কেমন ছিলেন?’

ভদ্রলোক ঠিকমতো বলতে পারলেন না। তার যদ্দুর মনে পড়ে, মহিলা একটু লম্বামতো ছিলেন। গায়ের রং ফরসা নাকি চাপা, তা মনে করতে পারলেন না। মি. পেথেরিকের দিকে ফিরে একই প্রশ্ন করলাম।

তিনি জানালেন, মহিলার উচ্চতা মাঝারি। মাথায় সোনালি চুল, চোখের রং নীল।

‘আপনার নজর আমার চেয়ে তীক্ষ্ণ, পেথেরিক,’ মন্তব্য করলেন মি. রোডস।

মাথা নেড়ে দ্বিমত জানালাম তার কথায়। তারপর মি. রোডসকে জিজ্ঞাস করলাম, আমার কাজের মেয়েটার চেহারার বর্ণনা পারবেন কি না। পারলেন না মি. রোডস। মি. পেথেরিকও ব্যর্থ হলেন।

‘ব্যাপারটার মানে বুঝতে পারছেন?’ বললাম আমি। ‘আপনারা এখানে নিজেদের কাজে এসেছেন। দরজা খুলে মানুষটা আপনাদের ঢুকতে দিয়েছে, সে সামান্য একজন পারলারমেইড। চাকরবাকরের দিকে কেউই কখনো মনোযোগ দিয়ে তাকায় না। একই কথা খাটে হোটেলের বেলায়ও। মি. রোডস ওখানে স্রেফ একজন চেম্বারমেইডকে দেখেছেন। মানে, তার পোশাক আর অ্যাপ্রোন দেখেছেন, চেহারার দিকে তাকানোর প্রয়োজন বোধ করেননি। তা ছাড়া উনি তখন কাজে ডুবে ছিলেন। ডানে-বাঁয়ে তাকানোর খেয়াল ছিল না। কিন্তু মি. পেথেরিক ওই একই মহিলাকে সম্পূর্ণ জেরা করতে গিয়েছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিস্থিতিতে। তাই তাকে একজন স্বতন্ত্র ব্যক্তি হিসেবে দেখেছেন উনি। চাকর হিসেবে দেখেননি। এই ব্যাপারটাই কাজে লাগিয়েছেন মহিলা, অর্থাৎ খুনি।’

কথাটা ধরতে পারলেন না মি. পেথেরিক ও রোডস। তাই ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করতে হলো আমাকে।

বললাম, ‘আমার ধারণা, ঘটনা ঘটেছে অনেকটা এভাবে। চেম্বারমেইড “ক” দরজা দিয়ে মি. রোডসের কামরায় ঢুকেছে। মিসেস রোডসের ঘরে গরম পানির বোতল দিয়ে “খ” দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেছে প্যাসেজে। আর “এক্স’’ অর্থাৎ খুনি “খ” দরজা দিয়ে আগেই কামরার ছোট্ট হলওয়েতে ঢুকেছিল। আসল চেম্বারমেইড না বেরিয়ে যাওয়া পর্যন্ত কোথাও লুকিয়ে থেকেছে। তারপর সে মিসেস রোডসের ঘরে ঢোকে। ড্রেসিং টেবিল থেকে ছোরাটা তুলে নিয়ে বসিয়ে নেয় তার বুকে। নিশ্চয়ই সে এর আগে একবার কামরায় ঢুকে সব দেখে গিয়েছিল। যাহোক, কাজ সেরে ছুরির হাতল থেকে আঙুলের ছাপ মুছে ফেলে সযত্নে। এরপর ভেতর থেকে দরজার ছিটকিনি আটকায়। সবশেষে মি. রোডসের ঘর হয়ে “ক” দরজা দিয়ে বেরিয়ে যায়।’

মি. রোডস চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘তাহলে তো আমি তাকে দেখতাম। ইলেকট্রিশিয়ানও দেখত।’

‘না,’ জবাব দিলাম আমি। ‘ভুলটা তো এখানেই করছেন। খুনি এসেছিল চেম্বারমেইড সেজে, সে জন্য ব্যাপারটা আপনি খেয়াল করেননি। কাজে ডুবে ছিলেন আপনি। কাজ করতে করতে দেখেছেন, চেম্বারমেইড এসে আপনার স্ত্রীর রুমে ঢুকেছে, বেরিয়েও গেছে। হ্যাঁ, দুজনের পরনেই চেম্বারমেইডের ইউনিফর্ম ছিল, কিন্তু মানুষ ছিল আলাদা। একই ব্যাপার ঘটেছে লাউঞ্জে বসা অতিথি আর করিডরে কাজ করতে আসা ইলেকট্রিশিয়ানের বেলায়ও। তারা দেখেছেন, মেইড এসেছে, আবার বের হয়ে গেছে। কেউই চেম্বারমেইডের চেহারা খেয়াল করেননি। নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, চেম্বারমেইড যদি খুব সুন্দরী হতো, পুরুষেরা তাকে মন দিয়েই দেখত। কিন্তু যদি সে মধ্যবয়স্ক সাধারণ কোনো মহিলা হয়, তাহলে তারা শুধু পোশাক দেখবেন, চেহারা নয়।’

‘কে এই মহিলা?’ চেঁচিয়ে উঠলেন মি. রোডস।

‘বলা একটু কঠিনই। মিসেস গ্র্যানবি অথবা মিসেস কারুথার্স, এদের যেকোনো একজন। বর্ণনা শুনে মনে হচ্ছে, মিসেস গ্র্যানবি পরচুলা পরেন। উনি যদি মেইড সাজেন, তাহলে হয়তো পরচুলা খুলে আসল চুলে গেছেন। অন্যদিকে মিসেস কারুথার্সের চুল ছোট করে ছাঁটা। তাই উনি হয়তো পরচুলা পরে মেইড সাজবেন। এই সূত্র ধরে সহজেই অপরাধীকে ধরা যায়। ব্যক্তিগতভাবে আমার ধারণা, কাজটা মিসেস কারুথার্সেরই।’

গল্প এখানেই শেষ। আমার ধারণাই সত্যি প্রমাণিত হয়েছে। কারুথার্স নামটা ভুয়া, তবে এই মহিলাই খুনি। এদের পরিবারে পাগলামির রোগ আছে। মিসেস রোডস খুবই বিপজ্জনক আর উচ্ছৃঙ্খল ড্রাইভার ছিলেন। কারুথার্সের ছোট্ট মেয়েটাকে গাড়িচাপা দেন তিনি। এ ঘটনায় সন্তান হারিয়ে বেচারি মা পুরোপুরি উন্মাদ হয়ে যান। মিসেস রোডসের কাছে হুমকি দিয়ে চিঠি লিখতে শুরু করেন। তবে এ ছাড়া খুব সতর্কতায় নিজের উন্মাদনা লুকিয়ে রাখেন মিসেস কারুথার্স। নিয়মিত অনুসরণ করতেন মিসেস রোডসকে। পাগল হলেও মহিলা খুব চালাক। বেশ মাথা খাটিয়ে ফাঁদ পাতেন মিসেস রোডসের জন্য। লাগেজে করে পরচুলাসহ ছদ্মবেশ নেওয়ার কাপড়চোপড় নিয়ে এসেছিলেন। খুন করার পরদিন সকালেই সেসব পার্সেল করে ফেলে পাঠিয়ে দেন। গ্রেপ্তার করার পর জেরার সময় যখন দেখলেন সব ফাঁস হয়ে গেছে, তখন ভেঙে পড়লেন তিনি। খুনের দায় স্বীকার করে নিলেন। বেচারা এখন ব্রডমুরের মানসিক হাসপাতালে, বদ্ধ উন্মাদ। কিন্তু খুনটা তিনি করেছিলেন ঠান্ডা মাথায়!

কদিন পর মি. পেথেরিক আবার এসেছিলেন আমার সঙ্গে দেখা করতে। সঙ্গে মি. রোডসের একটা চিঠি। সেই চিঠিতে উনি এত প্রশংসা করেছেন যে লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছিলাম।

মি. পেথেরিক জানতে চাইলেন, ‘একটা প্রশ্ন করব আপনাকে। গ্র্যানবির বদলে কারুথার্সকে সন্দেহ করলেন কেন? আপনি তো তাদের কাউকেই দেখেননি!’

‘আপনারা বলেছিলেন, মহিলা “গ” উচ্চারণ করতে পারেন না,’ জবাব দিলাম। ‘বয়স ষাট-সত্তর হলে কথা এভাবে জড়িয়ে যেতে পারে। কিন্তু ৪০ বছর বয়সী একজন মানুষের কেন এভাবে কথা জড়াবে? আমার মনে হচ্ছিল, মহিলা অভিনয় করছেন। আর “গ” উচ্চারণ করতে না পারাটা ছিল অতি-অভিনয়।’

উত্তরে মি. পেথেরিক কী বলেছিলেন, সেটা তোমাদের বলব না। তবে তার প্রশংসায় বেশ গর্ব হয়েছিল নিজেকে নিয়ে। মি. রোডস পরে আবার বিয়ে করেছেন। তার দ্বিতীয় স্ত্রী বেশ শান্তশিষ্ট। ফুটফুটে মিষ্টি একটা বাচ্চাও হয়েছে ওদের। আমাকে অনুরোধ করেছেন বাচ্চাটার ধর্মমাতা হতে। খুব ভালো মানুষ ওরা, তা–ই না?

যাকগে, আজ এটুকুই থাক। আশা করি, তোমাদের খুব বেশি সময় নষ্ট করিনি। ভালো থেকো তোমরা।

আগাথা ক্রিস্টি: ব্রিটিশ লেখক আগাথা ক্রিস্টি বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী রহস্য ঔপন্যাসিকদের মধ্যে একজন। ১৮৯০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ইংল্যান্ডের বিত্তশালী এক পরিবারে জন্ম আগাথা ক্রিস্টির। ১৮ বছর বয়সে প্রথম গল্প লেখেন ক্রিস্টি। তারপর টানা লিখে গেছেন একের পর এক পাঠকপ্রিয় গল্প। সব মিলিয়ে ৬৬টি রহস্য উপন্যাস লিখেছেন ক্রিস্টি। ছোটগল্পের সংকলন রয়েছে ১৪টি। এরকুল পোয়েরো, মিস মার্পল তাঁর সবচেয়ে জনপ্রিয় দুটি চরিত্র। ১৯৭৬ সালের ১২ জানুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন এই কিংবদন্তি।