ভাড়া করা গাড়ি নিয়ে শহরের বাইরে অনেক দূরে গ্রামে বেড়াতে বেরিয়েছিল তিন গোয়েন্দা—কিশোর, মুসা, রবিন। সারা দিন কাটিয়ে সাঁঝের বেলা বাড়ি ফিরছে। আকাশে গোল চাঁদ। রাস্তার দুই পাশে ভুট্টাখেত ঝলমল করছে চাঁদের আলোয়। মনের আনন্দে গাড়ি চালাচ্ছিল মুসা, হঠাৎ ইঞ্জিনে গোলমাল।
থেমে গেল গাড়ি। টর্চের আলোয় ইঞ্জিনটা পরীক্ষা করে দেখল মুসা। ‘নাহ্, হবে না। মেকানিক দরকার।’ হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল সে। ‘বন্ধ হওয়ারও আর জায়গা পেল না! এখানে কাছাকাছি কোনো গ্যারেজ আছে বলে তো মনে হয় না।’
গাড়িটাকে ঠেলতে শুরু করল ওরা। কয়েক মিনিট ঠেলেই হাল ছেড়ে দিয়ে কিশোর বলল, ‘এভাবে হবে না। অন্য গাড়ির সাহায্যে টেনে নিতে হবে।’
‘কিন্তু কোথায় নেব? গ্যারেজ কই?’ রবিনের প্রশ্ন।
চারদিকে চোখ বোলাল মুসা। ভুট্টাখেতের দিকে তাকিয়ে উত্তেজিত গলায় বলে উঠল, ‘কিশোর, ওই দেখো, খেতের মধ্যে ও কে! মানুষই মনে হচ্ছে। গ্যারেজের কথা ওকে জিজ্ঞেস করা যেতে পারে।’
খেতের মাঝখানে লম্বা একটা মূর্তি দেখতে পেল কিশোরও। মানুষের মতো দাঁড়িয়ে আছে। দূর থেকে ভালো বোঝা যাচ্ছে না। ভুট্টাগাছের জন্য পুরো শরীরটাও চোখে পড়ছে না। তবে মানুষ হলে অনেক লম্বা মানুষই বলতে হবে।
‘চলো, ওর কাছে যাই,’ মুসা বলল।
রাস্তা পার হয়ে মাঠ নেমে পড়ল তিনজনে। এখানে ওখানে ইঁদুর আর খরগোশের বড় বড় গর্ত। হাঁটতে হাঁটতে খেতের মাঝখানে মূর্তিটার কাছে চলে এল ওরা।
ঠিক এই সময় চাঁদকে ঢেকে দিতে শুরু করল কালো মেঘ। তবে মূর্তিটাকে দেখতে অসুবিধে হলো না।
মূর্তিটার মাথায় উপুড় করা বালতির মতো হ্যাট, গায়ে পুরোনো কালো কোট, কালো প্যান্ট, পায়ে কালো জুতো। কালো চোখে কটমট করে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। মুখে হাসি। ব্যঙ্গ করছে যেন ওদেরকে। লম্বা, বাঁকানো নাক, মুখটা অস্বাভাবিক সাদা। হাত দুটো সামনে বাড়ানো, তাতে বাজপাখির নখের মতো বাঁকা আঙুল।
গা ছমছম করে উঠল মুসার। রবিন আর কিশোরেরও ভালো লাগল না দৃশ্যটা। পিছিয়ে গেল তিনজনেই।
চাঁদকে গ্রাস করল আবার কালো মেঘ। অন্ধকারে ঢেকে গেল। চোখ কুঁচকে মূর্তিটাকে দেখার চেষ্ট করল রবিন। অস্পষ্ট দেখাচ্ছে।
‘অদ্ভুত লোক!’ বিড়বিড় করল মুসা। ‘ভূতফূত না তো!’
‘এই আস্তে!’ ফিসফিস করে সাবধান করল কিশোর। ‘লোকটা শুনতে পাবে! অদ্ভুত লোক হলেও ওর কাছেই সাহায্য চাইতে হবে আমাদের।’
মূর্তিটার উদ্দেশে জোরে বলল রবিন, ‘এই যে স্যার, আমাদের গাড়িটা হঠাৎ নষ্ট হয়ে গেছে। ওটাকে গ্যারেজে নিতে হবে। আপনি কোনো সাহায্য করতে পারেন?’
জবাব নেই। অস্বস্তি বোধ করছে তিনজনেই।
‘চুপ করে আছে কেন?’ নিচু গলায় বলল মুসা। ‘ইংরেজি বুঝতে পারছে না? নাকি কোনো বদমতলব আছে?’
হঠাৎ আবার মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল চাঁদ। জ্যোৎস্নার আলোয় মূর্তিটাকে স্পষ্ট দেখা গেল আবার।
একটা কাঠের খুঁটিতে দাঁড়িয়ে আছে মূর্তিটা। হ্যাটের নিচ থেকে বেরোনো খড় দেখতে পেল মুসা। বাঁকানো আঙুলগুলো তারের তৈরি। সাদা মুখটা রং করা।
‘কাকতাড়ুয়া!’ কিশোর বলল। ‘একটা কাকতাড়ুয়াকে মানুষ ভেবে তার কাছে সাহায্য চাইতে এসেছি! হাহ্ হাহ্ হা!’
‘অত হেসো না! ওটা ভূতও হতে পারে!’ মুসা বলল। ‘অবিকল মানুষের মতো লাগছে, এত নিখুঁত করে বানানো। ভয়ে আমার জান ধুকপুক করছে!’
‘তবে কাকতাড়ুয়া যেহেতু আছে, কাছাকাছি খামারবাড়িও আছে,’ উৎসাহিত হয়ে উঠেছে কিশোর। ‘চলো, বাড়িটা কোথায়, খুঁজে দেখি।’
তিনজনে হাঁটা শুরু করেছে, এমন সময় জোরাল শব্দ তুলে বাতাস বয়ে গেল ভুট্টাখেতের ওপর দিয়ে। মনে হলো ফিসফিস করে কে যেন বলে উঠল, ‘বিপদ! বাঁচতে চাইলে এক্ষুনি পালাও!’
থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল মুসা। ‘শুনলে?’ কাকতাড়ুয়াটার দিকে ফিরে তাকাল।
তেমনিভাবে খুঁটির ওপর দাঁড়িয়ে আছে ওটা। বাতাসে কোট উড়ছে পতপত করে। মুখে বিদ্রূপের হাসি। আঙুলগুলো বাঁকা করে সামনে বাড়ানো রয়েছে যেন খামচি দিয়ে ধরার জন্য।
‘আমি যা শুনেছি তোমরাও কি তা-ই শুনেছ, কিশোর?’ কাঁপা গলায় প্রশ্ন করল মুসা।
‘আমি বাতাসের শব্দ শুনেছি,’ জবাব দিল কিশোর। ‘তুমি কী শুনেছ?’
‘কাকতাড়ুয়াটা সাবধান করেছে আমাদের। পালাতে বলেছে।’
‘কিন্তু কাকতাড়ুয়া কথা বলতে পারে না!’ জবাব দিল রবিন। ‘আমি তো কিছু শুনিনি।’
কাকতাড়ুয়াটাকে জিজ্ঞেস করল মুসা, ‘বিপদটা কী? কেন পালাব?’
জবাব দিল না কাকতাড়ুয়া। আগের মতোই তাকিয়ে রইল কালো চোখ দুটো।
এলোমেলো বাতাস বইছে ভুট্টাখেতের ওপরে। বাতাসের ঝাপটায় ফিসফিস, কানাকানি করছে যেন গাছগুলো।
‘অযথা সময় নষ্ট করছি, মুসা,’ বিড়বিড় করল কিশোর। ‘খড়ের তৈরি জিনিস কথা বলতে পারে না। চলো।’
‘কোন দিকে যাব?’
ভালো করে তাকাতে খেতের শেষ প্রান্তে বড় একটা বাড়ি চোখে পড়ল।
‘ওটা নিশ্চয়ই খামারবাড়ি,’ বলল কিশোর, ‘চলো। ওখানেই যাই।’
‘তা-ই ভালো।’ সায় দিল মুসা। ‘এই ভুতুড়ে জায়গা থেকে পালাতে পারলে বাঁচি।’
কাকতাড়ুয়াকে পেছনে রেখে বাড়িটার দিকে পা বাড়াল তিন গোয়েন্দা। মাঝে মাঝেই মেঘ চাঁদকে ঢেকে ফেলছে বলে চলার গতি মন্থর ওদের। আকাশে মেঘের লুকোচুরি, এলোমেলো বাতাস, বজ্রঝড়ের সংকেত দিচ্ছে।
অন্ধকারে গর্তে ভরা মাঠ দিয়ে হাঁটা কঠিন। বেমক্কা পা পড়লে গর্তে ঢুকে গিয়ে গোড়ালি মচকে যেতে পারে। তাহলে বিপদ বাড়বে।
পা প্রায় দিয়ে ফেলেছিল, শেষ মুহূর্তে লাফ দিয়ে একটা বড় গর্ত টপকাল মুসা।
হঠাৎ পায়ের শব্দ শোনা গেল। কেউ দৌড়ে আসছে ওদের পেছন পেছন।
কনুই দিয়ে কিশোরকে গুঁতো মারল মুসা। ফিসফিস করে বলল, ‘কেউ আমাদের পিছু নিয়েছে।’
‘বুঝতে পারছি,’ ফিসফিস করেই জবাব দিল কিশোর।
পেছন ফিরে দেখল না ওরা, গুনে গুনে দশ কদম এগোল। ভুট্টাগাছের ভেতর দিয়ে আসছে কেউ। শোনা যাচ্ছে পায়ের শব্দ। ঠিক দশ কদম যাওয়ার পরে ঘুরে দাঁড়াল তিন গোয়েন্দা। আত্মরক্ষার জন্য প্রস্তুত। তবে মেঘে ঢাকা চাঁদের আবছা আলোয় কাউকে দেখতে পেল না। পায়ের শব্দও থেমে গেল হঠাৎ।
ঠোঁট কামড়াল কিশোর। ‘আশ্চর্য তো! কে পিছু নিল আমাদের? থেমেই বা গেল কেন?’
‘এখন বুঝতে পারছ তো? কাকতাড়ুয়াটা ঠিকই সাবধান করেছিল আমাদের,’ মুসা বলল। ‘শুধু বাতাসের শব্দ নয়। পায়ের শব্দেই বোঝা গেল।’
মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল চাঁদ। কিছু দূরে চাঁদের আলোয় কাকতাড়ুয়াটাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। এদিক-ওদিক তাকিয়ে কী যেন খুঁজছে।
দৃশ্যটা দেখে পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইল তিন গোয়েন্দা। বস্ফািরিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ভুতুড়ে মূর্তিটার দিকে। কয়েক সেকেন্ড পর দুই হাতে ভুট্টাগাছ ঠেলে হাঁটতে শুরু করল মূর্তিটা। জোরে চিৎকার করে বলল, ‘এই, জলদি আয়! নইলে চাবকে ছাল ছাড়াব বলে দিলাম।’
তারপর উবু হয়ে বসে ভুট্টাগাছের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল মূর্তিটা।
সংবিৎ ফিরে পেল যেন কিশোর। মূর্তিটার কাছে দৌড়ে গেল। কিন্তু ওখানে পৌঁছে ভুট্টাগাছ সরিয়ে আর দেখতে পেল না ওটাকে।
মুসা আর রবিনও ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
‘চলো তো, দেখি,’ কিশোর বলল।
‘কী?’ রবিনের প্রশ্ন।
‘কাকতাড়ুয়াটা আছে নাকি?’
ইঁদুরের গর্তে পা পড়ার ঝুঁকি নিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে কাকতাড়ুয়াটাকে প্রথম যেখানে দেখেছে, সেখানে চলে এল ওরা।
কিন্তু আগের মতোই দাঁড়িয়ে আছে পুতুলটা। মুখে হাসি।
হতভম্ব হয়ে গেল তিন গোয়েন্দা। পরিশ্রমে হাঁপাচ্ছে।
‘কিশোর, সত্যি কি আমরা ভূত দেখলাম?’ কম্পিত কণ্ঠে বলল মুসা।
‘বুঝতে পারছি না,’ চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল কিশোর। ‘কিন্তু চোখের সামনে যা দেখলাম, তাকেই বা অবিশ্বাস করি কী করে?’
আবার খামারবাড়ির দিকে এগোল ওরা। হাঁটতে হাঁটতে কিশোর বলল, ‘খামারবাড়িতে কেউ থাকলে সে হয়তো এই কাকতাড়ুয়া-রহস্যের জবাব দিতে পারবে।’
খামারবাড়িটা বেশ বড়। গাছে ঘেরা কাঠের তৈরি একটা দোতল বাড়ি। তবে খুবই দৈন্যদশা। বাড়ির কোনো জানালায় আলো নেই।
সিঁড়ি বেয়ে বারান্দায় উঠল কিশোর। দরজার কলবেল টিপল। ভেতরে কোথাও তীক্ষ শব্দে বেজে উঠল বেল। কিন্তু কারও সাড়া মিলল না। আবার বেল বাজাল সে। এবারও কোনো সাড়া নেই।
‘মনে হয় বাড়িতে কেউ নেই,’ বলল কিশোর। ‘ঢুকে দেখা দরকার।’
‘পেছন দিকে কেউ থাকতে পারে,’ রবিন বলল। ‘চলো। ওদিকটা ঘুরে দেখি।’
বারান্দার সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এল ওরা। চক্কর দিল বাড়িটাকে ঘিরে। কিন্তু জীবনের চিহ্নমাত্র নেই কোথাও। বুনো লতায় পেঁচিয়ে যাচ্ছে পা, কাঁটাঝোপের কাঁটার খোঁচা লাগছে হাতে। সেই সঙ্গে কানের কাছে মশার ঘ্যানঘ্যানানি।
‘বহু বছর এভাবে পড়ে থাকলে এ রকম আগাছা জন্মায়,’ কিশোর বলল।
‘তার মানে বাড়িতে কেউ থাকে না,’ রবিন বলল। ‘পোড়ো বাড়ি।’
ঠিক এই সময় ভয়ংকর চিৎকার চমকে দিল ওদের।
‘খাইছে!’ কাঁপা গলায় বলল মুসা। ‘কিসের চিৎকার?’
‘বুঝতে পারছি না!’ বিড়বিড় করল রবিন।
‘আমি পারছি। ওটা শাকচুন্নি! আর এগিয়ো না। এক্ষুনি পালাই...’ বলতে গিয়ে থেমে গেল মুসা।
একটা গাছের ডালে ডানা ঝাপটানোর মতো শব্দ শোনা গেল।
‘বাপ রে! শাকচুন্নিটা উড়ে আসছে গো!’ বলেই পেছন ফিরে দৌড় দিতে গেল মুসা।
ডাল থেকে একটা প্যাঁচা উড়ল। গিয়ে বসল একটা ঝোপের ওপর। গোল, বড় বড় চোখ পাকিয়ে ওদের দিকে তাকাল। তারপর বুক হিম করা চিৎকার দিল আবার।
হেসে ফেলে কিশোর বলল, ‘মুসা, ফিরে এসো! মনে ভয় থাকলে যুক্তি কাজ করে না! ডাকল প্যাঁচা, তোমার কাছে মনে হলো শাকচুন্নি।’
বুকে ফুঁ দিতে দিতে ফিরে এল মুসা।
বাড়ি ঘিরে চক্কর দেওয়া শেষ। আবার বারান্দায় ফিরে এল ওরা।
বৃথা খোঁজাখুঁজি। মানুষজন নেই। চেঁচিয়ে ডাকাডাকি করল তিনজনে। কোনো জবাব এল না।
‘ফোন করা দরকার,’ বলল মুসা। ‘কোনো গ্যারেজে খবর না দিলেই নয়। কিন্তু বাড়ির ভেতরে ঢুকব কী করে? দরজায় ছিটকিনি দেওয়া।’
‘জানালা দিয়ে যে ঢুকব, তারও উপায় নেই,’ হতাশ শোনাল কিশোরের কণ্ঠ। ‘অনেক উঁচুতে জানালা!’
এদিক-ওদিক তাকিয়ে রবিনও কোনো উপায় বের করতে পারল না।
‘উপায় একটা আছে,’ মুসা বলল। ‘প্যাঁচাটা যে গাছ থেকে উড়ে এসেছে, লক্ষ করেছি ওটার একটা ডাল চিলেকোঠার জানাল ছুঁই ছুঁই করছে। গাছ বেয়ে উঠে জানালা খোলা পেলে ভেতরে ঢুকতে পারবে।’
গাছটার নিচে চলে এল ওরা। প্রথমে মুসা চড়ল গাছে। উঁচু ডালে দাঁড়িয়ে নিশ্চিত হয়ে নিল ওটা ওর ওজনের চাপে ভেঙে পড়বে কি না। ভাঙবে না বুঝে ওটা বেয়ে জানালার কাছে চলে এল। হাত বাড়িয়ে জানালার কাচ স্পর্শ করল। ধাক্কা দিল। ক্যাঁচ করে খুলে গেল জানালা।
কিশোর আর রবিনকে ডাকল মুসা। ‘জানালা খোলা। চলে এসো।’
গাছে উঠল কিশোর। তবে যে ডালটায় মুসা বসে আছে, সেটাতে উঠল না, ভেঙে পড়ার ভয়ে। রবিনও গাছে উঠল।
খোলা জানালা দিয়ে চিলেকোঠার ঘরে ঢুকল মুসা। তাকে অনুসরণ করল অন্য দুজন। ভেতরে ঢুকে পকেট থেকে পেনসিল টর্চ বের করল ওরা।
টর্চের আলোয় দেখল বেশ বড়সড় ঘর। খালি। মেঝের ওপর ধুলোর ঘন আস্তরণ।
‘মেঝেতে কারও পায়ের ছাপ দেখছি না,’ বলল কিশোর। ‘তার মানে অনেক দিন কেউ এ ঘরে ঢোকেনি।’
‘এ ঘরে ফোন নেই।’ চিলেকোঠার দরজায় টর্চের আলো ফেলল রবিন। ‘নিচে আছে কি না দেখতে হবে।’
দরজার দিকে পা বাড়িয়েছে ওরা, এমন সময় ছাদ থেকে কিচকিচ শব্দ ভেসে এল। কালো কালো কী যেন ছাদের কড়ি-বর্গা থেকে নেমে এসে উড়তে লাগল ওদের মাথার ওপর।
‘বাবা গো!’ বলে চিৎকার দিয়ে মেঝে লক্ষ্য করে ডাইভ দিল মুসা।
চমকে গিয়ে কিশোর আর রবিনও ঝাঁপ দিয়ে পড়ল মেঝেতে।
ভয় নেই বুঝতে পেরেই বোধ হয় এক চক্কর দিয়ে আবার ওপরে উঠে গেল প্রাণীগুলো। বর্গা ধরে মাথা নিচু করে ঝুলতে লাগল। সেই সঙ্গে অনবরত কিচকিচ শব্দ করেই চলল।
‘রক্তচোষা ভূত হতে পারে! বাদুড়ের রূপ ধরে আছে!’ কাঁপা গলায় বলল মুসা। ‘জলদি ভাগো!’
‘ধ্যাত্তোরি! তোমার মাথায় ভূত ছাড়া আর কিছু নেই নাকি?’ কিশোর বলল।
মেঝে থেকে উঠে দরজার দিকে এগোল তিন গোয়েন্দা। পাল্লা খুলল। সামনে সিঁড়ি দেখা গেল।
সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় নামল ওরা। পাশে একটা দরজা দেখে ওটা খুলে একটা হলরুমে ঢুকল।
‘আমার কি মনে হয় জানো?’ বলল কিশোর। ‘যা বলেছিলাম, সেটাই ঠিক, বাড়িটা পরিত্যক্ত। মেঝেতে কার্পেট নেই, হলরুমে কোনো আসবাব নেই। ইলেকট্রিসিটি নেই...’
হঠাৎ হলরুমের শেষ মাথায় কিসের যেন শব্দ হলো। থেমে গেল কিশোর। দেয়ালের সঙ্গে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়াল। পা টিপে টিপে এগোল দরজার দিকে। দরজাটা ভেড়ানো। ধাক্কা মেরে দরজা খুলে ফেলল। টর্চের আলোয় দেখল এ ঘরও খালি।
মেঝেতে টর্চের আলো ফেলল সে। হাসতে লাগল। ‘ওই যে ভুতুড়ে শব্দের উৎস!’
একটা ইঁদুর দৌড়ে পালাল।
সব কটি ঘর পরীক্ষা করে দেখল ওরা।
‘দোতলায় কেউ নেই,’ মুসা বলল।
‘তাই তো দেখছি,’ মাথা ঝাঁকাল রবিন।
‘এবার নিচতলাটা দেখা দরকার,’ কিশোর বলল।
সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এল ওরা। ডাইনিংরুমে ঢুকল। অন্যান্য ঘরের মতো এটাও খালি এবং ধুলোয় ভর্তি। তবে এ ঘরে ধুলোর মধ্যে পায়ের ছাপ চোখে পড়ল ওদের।
‘দেখো!’ বলে উঠল উত্তেজিত রবিন।
‘কেউ এখানে ছিল!’ ফিসফিস করে বলল কিশোর।
‘একটু আগে!’ ঢোঁক গিলল মুসা।
‘কী জানি!’ কিশোর জবাব দিল। ‘অনেক দিন থেকেই ঘরটা ব্যবহার করা হয় না। পায়ের ছাপগুলো তাজা, না আগেকার, বুঝব কী করে?’
টর্চের আলোয় দেখল, এক সারি ছাপ খিড়কির দরজা পর্যন্ত চলে গেছে। ঠেলা দিতেই খুলে গেল পাল্লাটা। ওপাশে কিছু নেই। ঘাস জন্মে আছে মাটিতে। দরজার এপাশ থেকে আরেক সারি ছাপ ফিরে এসেছে ঘরের ভেতর।
‘তাজা হোক আর পুরোনো হোক, ছাপগুলো একজনেরই,’ মন্তব্য করল কিশোর। ‘খিড়কির দরজা দিয়ে ঢুকেছিল সে। বেরিয়েও গেছে ও পথেই।’
লিভিংরুমে ঢুকে মেঝেতে টর্চের আলো ফেলে আঁতকে উঠল মুসা। একটা খড়ের টুকরো পড়ে রয়েছে।
‘কাকতাড়ুয়াটা ঢুকেছিল এ ঘরে, ওর টুপির নিচ থেকে খড়ের টুকরোটা পড়েছে।’ গায়ে কাঁটা দিল মুসার। ‘কিন্তু গেল কোথায়? বেইসমেন্টে খুঁজব।’
‘হ্যাঁ,’ দৃঢ় কণ্ঠে বলল কিশোর। ‘না, দেখে যাব না।’
‘ঠিক বলেছ,’ রবিনও সায় দিল।
রান্নাঘরে ঢুকে দেখল আরও কিছু পায়ের ছাপ চলে গেছে বেইসমেন্টের, অর্থাৎ মাটির নিচের ঘরের দরজার দিকে। তারপর নেমে গেছে সিঁড়ি বেয়ে।
সিঁড়ির শেষ মাথায় নেমে দেখল, বেইসমেন্টও কেউ নেই। ধুলো জমেছে পুরু হয়ে। জানালায় মাকড়সার জাল। এখান থেকে উঠান বা বাগানে যাওয়ার কোনো দরজা চোখে পড়ল না।
পায়ের ছাপ চলে গেছে ফিউজ বক্সের ধারে। ফিউজ বক্স পরীক্ষা করল কিশোর। তার ছেঁড়া। বিদ্যুতের লাইন থাকলেও বাতি জ্বালানোর কোনো উপায় নেই। এখানে যে ঢুকেছিল, সে বোধ হয় ফিউজ ঠিক করে আলো জ্বালানোর চেষ্টা করেছিল।
আবার সিঁড়ি বেয়ে গ্রাউন্ড ফ্লোরে উঠে এল ওরা।
রবিন বলল, ‘টেলিফোন তো নেই। কাজেই আজ রাতে আর সাহায্য পাচ্ছি না আমরা।’
কাঁধ ঝাঁকাল কিশোর। ‘দুটো কাজ করতে পারি আমরা এখন। হয় গাড়িতে ফিরে যেতে পারি, নয়তো এখানেই রাত কাটাতে পারি। তবে এখানে রাত কাটানোই বোধ হয় ভালো হবে। মেঝেতে হাত-পা ছড়িয়ে শুতে পারব।’
হাই তুলল মুসা। ‘আমারও অসুবিধে নেই। ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। শোয়ার মতো জায়গা যখন আছেই, আর দেরি করি কেন?’
জ্যাকেট খুলে ভাঁজ করল সে। তারপর মাথার নিচে দিল। বালিশের কাজ দেবে জ্যাকেটটা। রবিন আর কিশোরও তা-ই করল।
শোয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ল ওরা।
ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখল কিশোর। দেখল গাড়িতে করে একটা বাড়ি খুঁজে বেড়াচ্ছে ওরা। মুসা গাড়ি চালাচ্ছে। কিন্তু রাস্তা হারিয়ে ফেলেছে বলে খুঁজে পাচ্ছে না বাড়িটা। লোকজনকে জিজ্ঞেস করেও লাভ হচ্ছে না। বদমেজাজি লোকগুলো প্রশ্নের জবাব দিচ্ছে না। হঠাৎ পেছন থেকে অদ্ভুত গলায় কে যেন বলে উঠল, ‘যে বাড়িটা তোমরা খুঁজছ, ওটা ডান দিকে। মোড় ঘোরো। মোড় ঘুরে নাক বরাবর চলে যাও। বাড়িটা দেখতে পাবে।’
ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল কিশোর। দেখল পেছনের সিটে বসে আছে সেই কাকতাড়ুয়াটা।
ভুতুড়ে মূর্তিটা ওদের দিকে তাকিয়ে খনখনে গলায় হেসে উঠল। উপুড় করা বালতির মতো টুপির ডগায় টোকা মেরে বলল, ‘কাউকে জিজ্ঞেস করার দরকার নেই। আমি তোমাদের বলে দিচ্ছি কীভাবে যেতে হবে। ডান দিকে গাড়ি ঘোরাও।’
মুসা জানে ডান দিকে খাড়া খাদ। সে বাম দিকে হুইল ঘোরাল। তবু ডান দিকেই ঘুরে গেল গাড়ি। গতি কমাতে ব্রেক চেপে ধরল। কমার বদলে বেড়ে গেল স্পিড। আতঙ্কিত হয়ে দেখল সোজা খাদের দিকে এগিয়ে চলেছে গাড়ি। গতি ক্রমে বেড়েই চলেছে।
পেছনের সিটে বসা কাকতাড়ুয়াটা হেসে উঠল ভয়ংকরভাবে। খাদের কিনার লক্ষ্য করে ছুটে গেল গাড়ি। পরক্ষণে ডিগবাজি খেয়ে শূন্যে উঠে পড়ল, শাঁ শাঁ করে নিচে পড়তে শুরু করল, নেমে যেতে থাকল খাদের অতল অন্ধকারের দিকে। পড়ছে তো পড়ছেই! প্রতি সেকেন্ডে খাদের বিকট হাঁ বড় হয়ে উঠছে।
বিজয় উল্লাসে চিৎকার করে উঠল কাকতাড়ুয়াটা। কানে হাত চাপা দিল কিশোর। খাদের পাথরের ওপর আছড়ে পড়ে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে ওদের গাড়ি। মারা যাবে ওরা।
ঘুম ভেঙে গেল কিশোরের। কোথায় আছে বুঝতে সময় লাগল।
ভয়ানক দুঃস্বপ্ন! ভাবল সে। কাকতাড়ুয়ার ভয় আমার মগজটাকেও গ্রাস করেছে।
হঠাৎ বারান্দার কাঠের মেঝেতে ক্যাঁচকোঁচ শব্দ হলো। কে যেন হেঁটে আসছে সামনের জানালার দিকে। উঠে বসল কিশোর।
জানালার ওপাশে দেখা গেল কাকতাড়ুয়ার মাথাটা!
‘এখনো কি স্বপ্ন দেখছি?’ ঢোঁক গিলল কিশোর। ‘নাকি সত্যিই ঘটছে এসব?’
কর্কশ কণ্ঠে বলল ভয়ংকর মূর্তিটা। ‘এক্ষুনি বাড়ি যা! নইলে চাবকাব বলে দিলাম!’
একটা কুকুরের কুঁই কুঁই শব্দ শোনা গেল। মনে হলো, কাকতাড়ুয়াটাকে দেখে ভয় পেয়ে পালিয়েছে।
জানালা থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল কাকতাড়ুয়ার মুখ।
লাফ দিয়ে উঠে বসল কিশোর। দৌড়ে চলে এল দরজার কাছে। জং ধরা ছিটকিনি খুলতে সময় লাগল। এক ছুটে বারান্দায় বেরিয়ে এল। চারপাশে তাকাতে লাগল।
দরজা খোলার শব্দে ঘুম ভেঙে গেছে মুসা আর রবিনেরও। ওরাও চলে এসেছে। চোখ ডলতে ডলতে জিজ্ঞেস করল মুসা, ‘কী হয়েছে?’
ঘটনাটা খুলে বলল কিশোর। ‘কাকতাড়ুয়াটা হঠাৎ কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল বুঝলাম না।’
‘ওই তো!’ হাত তুলে দেখাল মুসা।
মেঘে ঢাকা চাঁদের আলোয় অস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে ভুট্টাখেতের মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলে যাচ্ছে ওটা।
‘এসো আমার সঙ্গে!’ চিৎকার করে বলল কিশোর। ‘ওকে ধরতে হবে। নইলে এসব রহস্যময় কাণ্ডর কোনো সদুত্তর মিলবে না।’
কাকতাড়ুয়াটাকে লক্ষ্য করে দৌড় দিল ওরা।
রাতের আকাশে কালো মেঘের আনাগোনা আরও বেড়েছে। ঝড় আসার সময় হয়ে গেছে। গাছের চূড়ায় হাওয়ার মাতম।
ভুট্টাখেতে ঢুকে পড়ল ওরা। কাকতাড়ুয়াটা আবার গায়েব।
হতাশ ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকাল কিশোর। ‘কাকতাড়ুয়া কোথায় গেছে তাই জানি না। কোথায় খুঁজব ওকে?’
‘ভূতের মতোই আসছে, যাচ্ছে, এই আছে, এই নেই। ওটা ভূত ছাড়া আর কী?’ মুসা বলল।
‘ভূত হোক আর যা-ই হোক, ওকে খুঁজে বের করতেই হবে আমাদের। এক কাজ করি—তিনজন তিন দিকে যাই। কারও চোখে কিছু পড়লেই চিৎর করে জানাব। অন্য দুজন ছুটে যাব তখন তার দিকে। কী বলো?’
‘ঠিক আছে,’ সায় দিল মুসা আর রবিন।
ডান দিকে মোড় নিল কিশোর, ভুট্টাখেতের আরও গভীরে ঢুকে পড়ল। রবিন গেল আরেক দিকে।
সাবধানে হাঁটছে মুসা। দুহাতে গাছ ঠেলে সরাতে সরাতে তীক্ষ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে চারপাশে।
দূরে কড়াৎ করে বাজ পড়ল, আকাশ ঝলসে দিল যেন বিদ্যুতের আলো। মেঘের আড়াল থেকে সামান্যই মুখ দেখানোর সুযোগ পাচ্ছে এখন চাঁদ। ছায়া ছায়া অন্ধকার ভুট্টাখেতে। মুসার কাছে সব কেমন অপার্থিব, ভুতুড়ে লাগছে। শিরশির করে উঠল গা। ভূতদের ঘুরে বেড়ানোর জন্য আদর্শ একটি রাত, মনে হলো তার।
কাকতাড়ুয়া ভূতটা হয়তো খেতের মধ্যে কোথাও ঘাপটি মেরে আছে। লাফ দিয়ে ঘাড়ে পড়বে। কথাটা ভাবতেই বুক ঢিবঢিব শুরু হয়ে গেল তার। তবে থামল না সে। এগিয়ে চলল। বারবার ডানে-বামে তাকাচ্ছে। হাত দুটো সামনে বাড়ানো। সম্ভাব্য হামলার জন্য প্রস্তুত। ভূত-প্রেতের বিরুদ্ধে কুংফু-কারাতে কতটুকু কাজে লাগবে বুঝতে পারছে না।
বেশ খানিকটা পরেও কিছু ঘটল না দেখে মুসা ধারণা করল কাকতাড়ুয়াটা বোধ হয় এ তল্লাটে নেই। ঠিক তখনই ওর সামনে খচমচ করে একটা শব্দ হলো। শস্যের ডগা দুলছে। কিছু একটা এগিয়ে আসছে ওর দিকে।
পাঁজরের গায়ে দমাদম পিটাতে শুরু করল হূিপণ্ডটা, বেড়ে গেছে হার্টবিট। দাঁড়িয়ে পড়ল মুসা। অপেক্ষা করছে। কাকতাড়ুয়াকে দেখামাত্র চিৎকার করে জানাবে কিশোর আর রবিনকে।
খচমচ শব্দটা কাছে এল। চিৎকার দিতে যাবে মুসা, এই সময় ভুট্টাগাছের ফাঁক দিয়ে ওর সামনে লাফিয়ে পড়ল একটা খরগোশ। পেছনে ধেয়ে এল একটা শিয়াল। দুটো প্রাণীই ঝড়ের বেগে ছুটে গেল তার সামনে দিয়ে।
ঝাঁপ দিয়ে একটা গর্তের মধ্যে ঢুকে পড়ল খরগোশটা। পরমুহূর্তেই গর্তের কাছে হাজির হলো শিয়ালটা। শিকার হারিয়েছে বোঝার পর পরই চোখে পড়ল মুসাকে। ভয় পেয়ে এক লাফ দিয়ে ঘুরে গিয়ে, ঝেড়ে দিল দৌড়।
ওটার ভঙ্গি দেখে হেসে ফেলল মুসা। চমকের পর চমক। আর ভূত ভেবে অকারণ ভয় পাচ্ছে বলে নিজের ওপরই বিরক্ত হলো মুসা। আবার কাকতাড়ুয়ার খোঁজে পা বাড়াল।
ওদিকে ভুট্টাখেতের মাঝ দিয়ে নিঃশব্দে এগোচ্ছে কিশোর। প্রতিটি পা ফেলছে সাবধানে। গর্তে যাতে না পড়ে, সতর্ক রইল।
অন্ধকারে হঠাৎ একটা লম্বা ছায়ামূর্তি চোখে পড়ল তার। নিশ্চয় কাকতাড়ুয়া। পা টিপে টিপে এগিয়ে আচমকা পেছন থেকে জাপটে ধরল। কাকতাড়ুয়াও ছাড়ার পাত্র নয়। সে-ও ছোটার চেষ্টা করতে লাগল। শুরু হলো ধস্তাধস্তি। লড়াইয়ের একপর্যায়ে দুজনেই কুস্তির প্যাঁচ মেরে নিজেদের ছাড়িয়ে নিল। আবার পরস্পরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছে, তখুনি চাঁদ বেরিয়ে এল মেঘের আড়াল থেকে। ধস্তাধস্তির শব্দ শুনে রবিনও এসে দাঁড়াল ওখানে। হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল একটা মুহূর্ত। পরক্ষণে চিৎকার করে উঠল, ‘আরে কী করছ তোমরা? পাগল হয়ে গেছ নাকি? নিজেরা নিজেরা মারামারি!’
‘আমি ওকে কাকতাড়ুয়া ভেবেছিলাম!’ ঢোঁক গিলল মুসা।
‘আমিও তো তোমাকে কাকতাড়ুয়া ভেবেছি!’ হাঁপাচ্ছে কিশোর।
হাসতে শুরু করল রবিন।
হাসিটা সংক্রামিত হলো অন্য দুজনের মাঝেও।
‘নাহ্, আর আলাদা হব না, একসঙ্গে থেকেই খুঁজব,’ কিশোর বলল।
আপত্তি করল না কেউ। কিন্তু ব্যর্থ হলো অভিযান। সচল কাকতাড়ুয়ার দেখা মিলল না আর। তবে খেতের মাঝখানে পুতুল কাকতাড়ুয়াটাকে আগের মতোই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল।
‘দেখো, কেমন ভাব করে আছে, যেন ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানে না,’ বিড়বিড় করল মুসা।
‘আমার ধারণা, এটা আমাদের সেই কাকতাড়ুয়া নয়, যেটাকে আমরা খুঁজছি।’ ঠোঁট কামড়াল কিশোর। ‘চলো, খামারবাড়িতে ফিরে যাই। ওখানে বসে ঠিক করব, এরপর কী করা যায়।’
ভুট্টাখেতের কিনারে চলে এসেছে ওরা, এই সময় আকাশজুড়ে লকলকিয়ে উঠল বিদ্যুৎ। তীব্র আলোয় সাদা হয়ে গেল পুরো এলাকা।
পরক্ষণে বিকট শব্দে বাজ পড়ল পুরানো খামারবাড়িটার একেবারে মাথার ওপর। বিস্ফোরিত হলো চিলেকোঠা। জ্বলে উঠল আগুন। লেলিহান শিখা এক লাফে উঠে গেল আকাশে।
দৃশ্যটা আতঙ্কিত করে তুলল গোয়েন্দাদের। তবু বাড়ি লক্ষ্য করে ছুটল ওরা। বাড়ির কাছে এসে দেখল ওটা জ্বলন্ত চুল্লিতে পরিণত হয়েছে। ধসে পড়েছে ছাদ, কড়ি-বর্গা। দাউ দাউ করে জ্বলছে। জ্বলন্ত তক্তা ধুড়ুম-ধাড়ুম শব্দে ছিটকে পড়ছে মাটিতে।
আগাছায় ভরা ড্রাইভওয়েতে থমকে দাঁড়াল ওরা। আগুনের ভীষণ তেজ। কাছে যাওয়া যায় না।
‘আমাদের কিছু করার নেই আর,’ বিড়বিড় করল মুসা। ‘বাড়িটা গেছে।’
‘ভাগ্যিস বাজ পড়ার সময় বাড়ির ভেতরে ছিলাম না।’ শিউরে উঠল কিশোর। ‘কাকতাড়ুয়ার পিছু না নিলে এতক্ষণে পুড়ে কাবাব হয়ে যেতাম।’
‘বাড়িটার শেষ পরিণতি তাহলে এভাবেই ঘটল,’ কে যেন বলে উঠল পেছন থেকে।
চট করে ঘুরল ওরা। ভীষণ চমকে গিয়ে দেখল, একটা পিকআপের জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখছে কাকতাড়ুয়াটা। বাড়ি ধসে পড়ার শব্দে গাড়ি আসার শব্দ শুনতে পায়নি ওরা।
পিকআপ থেকে বেরিয়ে এলেন কাকতাড়ুয়ার পোশাক পরা একজন লোক। কিংবা বলা যায়, খেতের মাঝে যে কাকতাড়ুয়া পুতুলটা দাঁড়িয়ে আছে, ওটার মতো একই রঙের কালো কোট-প্যান্ট পরা, মাথায় উপুড় করা বালতি আকৃতির হ্যাট।
‘আমি হ্যারি হ্যারিসন,’ নিজের পরিচয় দিলেন তিনি। পোড়া খামারবাড়িটা দেখিয়ে বললেন, ‘এই বাড়িটা আমার ছিল। ফায়ার ডিপার্টমেন্টকে ফোন করেই দৌড় দিয়েছি। এখুনি চলে আসবে। কিন্তু তোমরা কারা?’
নিজেদের পরিচয় দিল তিন গোয়েন্দা। জানাল, ওদের গাড়িটা নষ্ট হয়ে পড়ে আছে রাস্তার ধারে।
‘পোড়োবাড়িটাতে ঢুকেছিলাম ফোন করার আশায়। গ্যারেজে গাড়িটা নেওয়ার জন্য সাহায্য দরকার,’ কিশোর বলল। ‘কিন্তু বাড়িতে ঢুকে কাউকে দেখলাম না।’
কাঁধ ঝাঁকালেন মিস্টার হ্যারিসন। ‘কেউ ঢোকে না ওখানে। বহুকাল খালি পড়ে ছিল। ভাড়াও দিতে পারছিলাম না। কে জানি গুজব ছড়িয়েছে, ভূত আছে বাড়িটাতে। কিছুতেই ভাড়া হলো না। শেষে বিক্রি করে দিতে চেয়েছিলাম। ভুতুড়ে বাড়ি কেউ কিনল না। পুড়ে গিয়ে বরং ভালোই হলো। এখন জায়গাটা অন্তত বিক্রি করতে পারব। খালি জায়গাকে নিশ্চয় কেউ ভুতুড়ে ভাববে না।’
কুকুরের ডাক শোনা গেল। ফিরে তাকিয়ে তিন গোয়েন্দা দেখে গাড়ির জানালা দিয়ে মুখ বের করে আছে একটা কুকুর।
ধমকে উঠলেন মি. হ্যারিসন, ‘এই চুপ! ধরে চাবকাব...!’
কিশোর জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি থাকেন কোথায়?’
‘কাছেই,’ হাত তুলে দেখালেন মি. হ্যারিসন। ‘ওই গাছপালার পেছনে আরেকটা খামারবাড়ি আছে আমার। নতুন।’
‘এই ভুট্টাখেতের মালিকও নিশ্চয় আপনি?’ জিজ্ঞেস করল কিশোর।
‘হ্যাঁ।’
সকাল হয়ে এসেছে। বজ্রপাতে পোড়া খামারবাড়িটা এখন ছাই আর কয়লার স্তূপ। পোড়া আবর্জনার ফাঁকে এখনো লকলকে জিব বের করছে আগুন। ইতিমধ্যে দমকলের একটা গাড়ি চলে এসেছে। কী ঘটেছে অল্প কথায় দমকল আফিসারকে জানিয়ে দিলেন মি. হ্যারিসন। তারপর ফিরলেন তিন গোয়েন্দার দিকে।
‘এখানে আর কিছু করার নেই আমাদের। আমার বাড়িতে চলো। নাশতা খাবে।’
মুচকি হাসল মুসা, ‘নাশতা পেলে মন্দ হয় না।’ রবিনের দিকে তাকাল। ‘কী বলো?’
নীরবে ঘাড় কাত করে সায় জানাল রবিন। মুখে হাসি।
কিশোর বলল, ‘খিদেয় আমারও পেট চোঁ-চোঁ করছে। সারাটা রাত ভুট্টাখেতে যেভাবে দৌড়ে বেড়ালাম।’
মি. হ্যারিসন ওদের নিয়ে পিকআপে উঠলেন। সামনে জায়গা হলো না চারজনের। রবিন বসল সামনে। কিশোর আর মুসা পেছনের খোলা জায়গায়।
ড্রাইভিং সিট থেকে মুখ বের করে পেছনে তাকিয়ে মি. হ্যারিসন বললেন, ‘নাশতা খেয়ে তোমাদের গাড়ি গ্যারেজে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেব।’
শুনে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল তিন গোয়েন্দা।
মিসেস হ্যারিসন তাঁর স্বামীর মতোই ভালো মানুষ। উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেন গোয়েন্দাদের। প্রচুর খাওয়ালেন। রকি বিচ চেনেন তিনি। ছোটবেলায় বহু বছর থেকেছেন। সেসব নিয়ে গল্প করলেন ওদের সঙ্গে।
নাশতা খেয়ে মিসেস হ্যারিসনকে ধন্যবাদ দিয়ে বাড়ি থেকে বেরোল ওরা। মি. হ্যারিসন আবার গোয়েন্দাদের নিয়ে এলেন ওদের গাড়ির কাছে।
স্পোর্টস সেডানটা আগের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে খাদের পাশে। গাড়ির সামনের বাম্পারে একটা রশির এক প্রান্ত বাঁধলেন মি. হ্যারিসন। রশির অন্য প্রান্ত বাঁধলেন নিজের গাড়ির পেছনে। নিজেদের গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসল মুসা, হুইল ধরে গাড়িটাকে ঠিক রাখার জন্য। কিশোর আর রবিন উঠল পিকআপের পেছনে। গাড়িটাকে টেনে নিয়ে গ্যারেজে রওনা হলেন মি. হ্যারিসন। দুই পাশের চমৎকার প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে চলল কিশোর।
মাইল দশেক যাওয়ার পরে গ্যারেজের দেখা মিলল।
কিশোরদের ভাড়া করা গাড়িটা পরীক্ষা করে দেখল গ্যারেজের মেকানিক। সমস্যাটা ফুয়েল পাম্পে।
মেকানিক যখন পাম্প মেরামত করছে, কিশোর এই সুযোগে মি. হ্যারিসনকে বলল, ‘কয়েকটা প্রশ্ন মনের মধ্যে খচখচ করছে, মি. হ্যারিসন। যেমন, জানতে ইচ্ছে করছে, শেষ কবে আপনার পোড়া খামারবাড়িটাতে ঢুকেছিলেন?’
‘গতকালই তো ঢুকেছি। বেসমেন্ট থেকে একটা জিনিস ছিল, সেটা আনতে গিয়েছিলাম। কেন?’
‘না, ধুলোর মধ্যে পায়ের ছাপ দেখেছি তো, তাই। যাক, একটা রহস্যের সমাধান হলো।’
‘লিভিংরুমে খড় পড়ে থাকতে দেখেছি,’ মুসা যোগ করল।
‘মাঠে গিয়েছিলাম,’ জানালেন মি. হ্যারিসন। ‘জুতায় খড় লেগে গিয়েছিল বোধ হয়। ঘরের মধ্যে গিয়ে পড়েছে।’
‘কাল রাতে ভুট্টাখেতে কারও চিৎকার শুনেছি,’ রবিন বলল। ‘কে যেন বলছিল, ‘‘এই, জলদি আয়! নইলে চাবকে ছাল ছাড়াব বলে দিলাম?”’
‘আমার চিৎকারই শুনেছ,’ মি. হ্যারিসন বললেন। ‘রাতে সুযোগ পেলেই ঘর থেকে বেরিয়ে যায় আমাদের কুকুরটা, খরগোশ তাড়া করার লোভে। কালও গিয়েছিল। খেতের মধ্যে না পেয়ে খুঁজতে খুঁজতে গিয়ে খামারবাড়িতে পেয়েছি ওটাকে।
‘মাঠের কাকতাড়ুয়াটা আপনিই বসিয়েছেন, না?’ কিশোর বলল।
হেসে উঠলেন মি. হ্যারিসন। ‘কেউ ভয় পায় না। এমনকি কাকেরাও না।’
‘কাকতাড়ুয়ার পোশাকটা কিন্তু অদ্ভুত,’ হেসে বলল রবিন।
‘মজা করার জন্য পরিয়েছি,’ মি. হ্যারিসন বললেন। ‘কোট-প্যান্ট-জুতাগুলো আমারই ছিল, পুরোনো হয়ে যাওয়ায় পুতুলটাকে পরিয়ে দিয়েছি।’
মি. হ্যারিসনের পরনের পোশাকগুলোর দিকে তাকাল কিশোর। ‘আপনি কালো রং খুব পছন্দ করেন। আর বালতি-হ্যাট।’
হা হা করে হাসলেন মি. হ্যারিসন। ‘বালতি-হ্যাট, ভালোই নাম দিয়েছ, যা হোক। হাহ্ হাহ্ হা! ভাঁড়ের মতো লাগছে তো? এ জন্যই কাকেরা পুতুলটাকে ভয় পায় না।’
‘তবে আমরা পেয়েছি,’ মুসা বলল। ‘কাল রাতে খেতের মধ্যে আপনাকে দেখে ভূত ভেবে ভয়ে প্রায় মারা পড়েছিলাম!’
‘আমি দুঃখিত,’ হাসিমুখে বললেন মি. হ্যারিসন। হঠাৎ সচকিত হয়ে উঠলেন। ‘ওহেহা, আমাকে এখন যেতে হবে। জরুরি কাজ আছে।’
সহযোগিতার জন্য তাঁকে বারবার ধন্যবাদ দিল তিন গোয়েন্দা। নাশতা আর গাড়ির পেট্রল খরচ করার জন্য টাকা সাধল। কিন্তু নিলেন না মি. হ্যারিসন। বললেন, ওদের সাহায্য করতে পেরে তিনি খুশি। তারপর পিকআপ নিয়ে রওনা হয়ে গেলেন।
ত্রুটিটা সারিয়ে দিল মেকানিক। চালু হলো ইঞ্জিন। গাড়িতে উঠে পড়ল তিন গোয়েন্দা। আবার ড্রাইভিং সিটে বসল মুসা। গাড়ি ছাড়ল। বাইরের দিকে তাকিয়ে গত রাতের কথা ভাবতে লাগল রবিন। দিনের আলোয় বিশ্বাসই করা কঠিন, রাতে একটা সাধারণ কাকতাড়ুয়াকে এত ভয় পেয়েছে।
আবার সেই ভুট্টাখেতের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কাকতাড়ুয়াটাকে কাঠের খুঁটিতে আগের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল ওরা। তবে হাসিটাকে এখন আর ব্যঙ্গের হাসি মনে হচ্ছে না, বরং কেমন বোকা বোকা হাসি।
‘যা-ই বলো,’ রাস্তার দিকে তাকিয়ে বলল মুসা, ‘ওই কাকতাড়ুয়াটা কাল আমাদের প্রাণ বাঁচিয়েছে। জানালায় ওটার মুখ দেখা না গেলে আমরা বেরোতামও না, বজ্রপাতের আগুনে পুড়ে মারা পড়তাম।’
‘পুতুলটার মুখ দেখিনি,’ গম্ভীর স্বরে বলল কিশোর। ‘দেখেছি মি. হ্যারিসনের মুখ। তিনিই তো জ্যান্ত কাকতাড়ুয়া সেজে থাকেন।’