চিঁচিঁ করে হাসতে হাসতে সামনের ছায়াটা বলল, ‘আমি হচ্ছি ভূতের বাচ্চা। আমার নাম খখখ।’ ভয়ে চোখ বড় বড় করে ফেলল বুবুন।
‘ওভাবে চোখ বড় বড় করে ফেললে কেন তুমি? বললাম না, আমি ভূতের বাচ্চা।’ খখখ বলল।
‘ভূতের বাচ্চা তুমি!’ চোখ দুটো আরও বড় বড় করে ফেলল বুবুন, ‘কিন্তু আমি তো তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না। আর এ রকম বিশ্রীভাবে চিঁচিঁ করে হাসছোই-বা কেন তুমি! এটা কোনো হাসি হলো, না কোনো কান্না হলো!’
‘তোমরা মানুষেরা কীভাবে হাসো?’
‘হিহি করে হাসি।’
‘তোমরা হিহি করে হাসো, আমরা চিঁচিঁ করে হাসি।’ ভূতের বাচ্চা খখখ চিঁচিঁ করেই আবার হেসে বলল, ‘তোমাদের কেউ কেউ আবার হো হো করে হাসে, আমাদেরও কেউ কেউ চো চো করে হাসে।’
‘তোমার নাম খখখ!’
‘হ্যাঁ।’
‘এটা কোনো নাম হলো!’ ঠোঁট উল্টিয়ে অবজ্ঞার স্বরে বলল বুবুন।
‘এই কথা তো আমিও বলতে পারি।’ খখখ গলাটা গম্ভীর করে বলল, ‘তোমার এক বন্ধু আছে না, ওই যে প্রদীপ নাম। প্রদীপ কোনো নাম হলো! প্রদীপ হচ্ছে সেই জিনিস, যার মাথায় আগুন জ্বালানো হয়।’ খখখ আবার হাসতে লাগল, ‘তোমার ওই বন্ধুর মাথায় কি আগুন জ্বালানো হয়?’
‘না।’
‘তাহলে ওর নাম প্রদীপ কেন?’
বুবুন মনে মনে ভেবে দেখল—তাই তো, মানুষের নাম প্রদীপ হবে কেন? মানুষের মাথায় তো আগুন জ্বালানো যায় না কখনো। মানুষের নাম হবে সুমন, ফাহাদ, রাকিব। এই যে তার নিজের নাম বুবুন, এই নামটাও ঠিক আছে। কিন্তু মানুষের নাম কখনো প্রদীপ হতে পারে না।
বুবুন গলার স্বরটা নিচু করে বলল, ‘সরি, তুমি ঠিক বলেছ খখখ।’
‘আসলে সবই ঠিক আছে। তোমাদের মানুষদের একধরনের নাম হয়, আমাদের ভূতদের আরেক ধরনের নাম হয়। যেমন আমাদের কারও কারও নাম—চচচ, পপপ, ককক।’
নামগুলো শুনে ভীষণ হাসি পাচ্ছিল বুবুনের, কিন্তু হাসল না সে। সামনের ছায়াটার দিকে ভালো করে তাকিয়ে বলল, ‘আচ্ছা, তোমরা দেখতে ছায়ার মতো কেন?’
‘না, আমরা কেবল ছায়ার মতো দেখতে না। আমরা মানুষের মতোও হতে পারি। তুমি ছোট মানুষ, আমিও ছোট। আমি যদি মানুষের মতো হই তাহলে তুমি আমাকে দেখে ভয় পেতে পারো।’
‘তোমাকে দেখে ভয় পাব কেন?’
‘তোমাদের যেমন দুটো করে চোখ, আমাদের তিনটা করে। দুপাশে দুটো আর কপালের মাঝখানে একটা। কপালের চোখটা বেশ বড়, আর সেই চোখ দিয়ে আগুন বের হয় মাঝে মাঝে।’
‘বলো কী!’ বুবুন চমকে ওঠা গলায় বলল, ‘আগুনে পুড়ে যায় না তোমাদের শরীর, ব্যথা লাগে না তোমাদের!’
‘না। মাঝখানের চোখের আগুনে অনেক পোকামাকড় এসে জড়ো হয় আমাদের মুখের সামনে, আমরা তখন গপগপ করে ওই পোকাগুলো গিলে খাই।’ খখখ চিঁচিঁ করে হেসে বলল, ‘আমাদের প্রিয় খাদ্য কিন্তু ওইসব পোকামাকড়ই।’
‘পোকা আবার প্রিয় খাদ্য হয় কী করে?’ বুবুন অবাক হয়ে বলল।
‘তোমরা চিংড়ি নামে যে একটা মাছ খাও, ওটা কি মাছ? আসলে ওটা কিন্তু একধরনের পোকাই। ওই পোকাই তোমরা কত মজা করে খাও! আবার অনেক দেশের মানুষ ব্যাঙ খায়, সাপ খায়, গুবরেপোকা খায়, কেঁচো খায়—এসবকে কী বলবে তুমি?’
বুবুন একটু ভেবে বলল, ‘তুমি ঠিক বলেছ খখখ। একেক দেশের মানুষের যেমন একেক রকম খাবার, তোমাদেরও তেমন আলাদা আলাদা খাবার। তা তুমি কি এখন একটু মানুষের মতো হবে?’ ঘরের দরজা বন্ধ করল বুবুন, ‘এখানে আমি ছাড়া কেউ নেই। আমি তোমাকে দেখে ভয় পাব না। কারণ, তোমাকে আমার কেমন যেন বন্ধুর মতো মনে হচ্ছে।’
‘সত্যি!’ চিঁচিঁ করে অনেকক্ষণ হেসে নিল খখখ। তারপর আলতো করে একটা হাত রাখল বুবুনের হাতে। বুবুন টের পেল তা। ঝট করে সে তার নিজের হাতের দিকে তাকাল। ওই হাতের মাঝে একটা হাত দেখা যাচ্ছে। হাতটা আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে, তারপর আরেকটা হাত হলো, মাথা হলো, মুখ হলো, চোখ হলো, পা হলো, ধীরে ধীরে পূর্ণ একটা মানুষের মতো হয়ে গেল খখখ। কিন্তু মানুষ যেমন জামাকাপড় পরে থাকে, খখখ-এর সারা শরীর ধোঁয়ার মতো পাতলা কী দিয়ে যেন মোড়ানো। শার্ট-প্যান্টের মতোই দেখাচ্ছে তা, অনেকটা আলখাল্লার মতো।
বুবুন মুগ্ধ হয়ে গেল খখখকে দেখে। আনন্দে লাফ দিয়ে উঠল সে। তারপর খখখর দিকে দুই হাত বাড়িয়ে বলল, ‘আমি কি তোমাকে একটু জড়িয়ে ধরতে পারি খখখ?’
‘অবশ্যই।’ বলেই খখখও দুই হাত বাড়িয়ে দিল। তারপর দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে রাখল বেশ কিছুক্ষণ।
খখখ হঠাত্ চমকে উঠে বলল, ‘বুবুন, তুমি তো স্কুলের পড়া পড়ছিলে।’
‘হ্যাঁ।’
‘একটু পর তো স্কুলে যেতে হবে তোমাকে।’
‘হ্যাঁ।’
‘আমি আসায় তোমার ডিস্টার্ব হলো। স্কুলের পড়া পড়তে পারছ না তুমি!’ খখখ অপরাধী গলায় বলল।
‘সমস্যা নেই। এক দিন পড়া না শিখলে স্যাররা আমাকে কিছু বলবেন না।’
‘কেন কিছু বলবেন না?’
‘কারণ, প্রতিদিন পড়া করে স্কুলে যাই আমি।’
‘আমি জানি তো। কিন্তু আজও তুমি স্কুলে পড়া করে যাবে।’
‘না, আজ আর পড়তে ইচ্ছে করছে না।’
‘কিচ্ছু করতে হবে না তোমাকে। পড়াগুলো শুধু একবার রিডিং পড়বে তুমি, দেখবে তাতেই মুখস্থ হয়ে গেছে সব।’
‘একবার পড়লেই মুখস্থ হয়ে যাবে?’
খখখ লম্বা একটা হাসি দিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, মুখস্থ হয়ে যাবে।’
বুবুন দ্রুত পড়াগুলো একবার রিডিং পড়ে নিল। তারপর বই বন্ধ করে বুঝতে পারল সত্যি সত্যি সব পড়া মুখস্থ হয়ে গেছে তার। আনন্দে সে খখখর একটা হাত চেপে ধরে বলল, ‘এটা তুমি করেছ না?’
‘হ্যাঁ। ভূতেরা অনেক কিছু করতে পারে।’ বলেই হাত ধরে বুবুনকে জানালার পাশে আনল খখখ। বাইরে তাকিয়ে বলল, ‘ওই যে তোমাদের ছোট্ট একটা ফুলের বাগান, বেশ কিছু আগাছা জন্মেছে সেখানে। দু-এক দিনের মধ্যে তুমিই ওগুলো পরিষ্কার করতে, না?’
‘বাসার অনেক কাজ করতে ভালো লাগে আমার। মা-বাবাকেও সাহায্য করি আমি। বাগানের ঘাস পরিষ্কার করতেও খুব পছন্দ আমার।’
‘তোমার আর পরিষ্কার করতে হবে না।’
‘কেন?’
‘এখানে দাঁড়িয়েই আমি ওগুলো পরিষ্কার করে দিচ্ছি।’
খখখর সঙ্গে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বুবুন অবাক হয়ে দেখল—বাগানের আগাছাগুলো একা একাই মাটি থেকে উঠে যাচ্ছে, একা একাই জড়ো হয়ে যাচ্ছে বাগানের এক কোনায়! একটু পর বাগান একেবারে চমত্কারভাবে পরিষ্কার হয়ে গেল!
বুবুনের পড়ার টেবিলের কাছে ফিরে এল খখখ। টেবিলটা বেশ অগোছালো হয়ে আছে। হাতের আঙুল দিয়ে কেমন একটা তুড়ি বাজাল সে, সঙ্গে সঙ্গে টেবিলটা গোছানো হয়ে গেল। মনেই হচ্ছে না এই একটু আগে টেবিলটা নোংরা ছিল।
বিছানার চাদর, খাটের নিচের জুতো, ওয়ার্ডরোবের ড্রয়ারে রাখা এলোমেলো কাপড়—সব গুছিয়ে দিল খখখ ওই তুড়ি বাজিয়েই। এমনকি ঘরের ফ্যান আর সিলিংয়ে যে মাকড়সা জাল বুনেছিল অনেক, পরিষ্কার করে দিল সেগুলোও। সেদিন ছবি আঁকতে গিয়ে দেয়ালে বেশ কিছুটা রং লাগিয়ে ফেলেছিল বুবুন, ঝকঝকে তকতকে করে দিল সেই দেয়ালটাও।
চোখ-মুখ উজ্জ্বল করে বুবুন বলল, ‘থ্যাংক ইউ, খখখ।’
খখখ খুব স্মার্ট ভঙ্গিতে বলল, ‘ওয়েলকাম।’ তারপর গলাটা নিচু করে বলল, ‘আমি কি তোমার বন্ধু হতে পারব বুবুন?’
‘অবশ্যই।’
‘আমি তো মানুষের মতো না। তোমার যেমন পোষা একটা বিড়াল আছে, আমাকেও তেমন পোষা কিছু ভেবো। তারপর একজন বন্ধু ভেবো।’ খখখ অদ্ভুত একটা হাসি দিয়ে বলল, ‘আমি হচ্ছি তোমার পোষা ভূতের বাচ্চা বন্ধু।’
হেসে ফেলল বুবুন।
দরজায় নক করার শব্দ হলো হঠাত্। সঙ্গে সঙ্গে খখখর দিকে তাকাল বুবুন। চমকে উঠল সঙ্গে সঙ্গে। খখখ নেই। কেবল একটা ছায়া সরে যেতে দেখল পড়ার টেবিলের কোনার দিকে।
আম্মু ঢুকলেন ঘরে। ইস্তিরি করা স্কুলড্রেসটা বিছানার ওপরে রাখতে গিয়েই সোজা হয়ে দাঁড়ালেন তিনি। বুবুনের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘তুমি স্কুলে যাওয়ার পর আমি সাধারণত এই রুমের বিছানা ঠিক করি।’
‘তা তো জানি।’
‘কিন্তু আজ কে ঠিক করল? তুমি?’
মুচকি একটা হাসি দিল বুবুন। মায়ের দিকে একটু এগিয়ে গিয়ে বলল, ‘আমি কি বিছানা ঠিক করতে পারি, আম্মু?’
‘আমি জানি পারো না।’ আম্মু আবার বিছানার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তাহলে ঠিক করল কে?’
বুবুন রহস্যের একটা হাসি দিয়ে বলল, ‘কেউ না কেউ একজন তো করেছে, আম্মু।’
‘সেই কেউ একজনটা কে?’ কথা বলতে বলতে ঘরের চারপাশটা দেখতে লাগলেন আম্মু। তিনি আগের চেয়ে অবাক হয়ে বললেন, ‘রাতে শোয়ার আগেও তো তোমার পড়ার টেবিলটা অগোছালো দেখে গেছি, এটাও তুমি ওই স্কুলে যাওয়ার পর গুছিয়ে দিই আমি। আজ এটা একেবারে ফিটফাট দেখাচ্ছে।’
‘এটা গোছানো দেখে ভালো লাগছে না তোমার?’
‘তা লাগছে। কিন্তু গোছাল কে?’ খাটের নিচে তাকালেন আম্মু। চোখ বড় বড় করে বললেন, ‘জুতোগুলো সুন্দর করে সাজানো আছে!’ ওয়ার্ডরোবের একটা ড্রয়ার খোলা। আম্মু তার কাছে গিয়ে উঁকি দিয়ে দেখে বললেন, ‘ভেতরের কাপড়গুলো তো জড়োসড়ো করে রাখা হয়েছিল। ইস্তিরি ছাড়া ছিল ওগুলো। ড্রয়ারের ভেতর ভাঁজ করে সারিভাবে রাখাও দেখছি, ইস্তিরি করাও দেখছি। বুবুন—আম্মু বুবুনের একেবারে সামনে এসে দাঁড়ালেন, ‘আমি তো অবাক হয়ে যাচ্ছি, সকাল সকাল এসব কে করল, বলো তো!’
‘তোমার ভালো লেগেছে কি না, সেটা আগে বলো।’
‘ভালো লাগার ব্যাপারটা পরে আসবে। আগে বলো কাজগুলো কে করেছে?’ কথা বলতে বলতে আম্মু জানালার পাশে এসে দাঁড়ান। বাইরে তাকিয়ে বলেন, ‘আরে, বাগানের আগাছাগুলোও তো পরিষ্কার করা দেখছি। আশ্চর্য, তুমি তো এতক্ষণ পড়ছিলে। বাসার বাইরে যাওনি। এটা তাহলে কে করল?’
বুবুন আম্মুর কাছে গিয়ে একটা হাত চেপে ধরে বলল, ‘আম্মু, আগে তুমি শান্ত হয়ে বসো তো।’
ঘুরে তাকালেন আম্মু। সঙ্গে সঙ্গে দেয়ালের দিকে চোখ গেল তাঁর। দ্রুত সেটার কাছে গিয়ে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, ‘সেদিন ছবি আঁকতে গিয়ে এখানে রং লাগিয়ে ফেলেছিলে। এটা এখন একেবারে পরিষ্কার। কোনো রংমিস্ত্রি তো ডাকা হয়নি এ কয় দিন। এটা এমন করল কে?’
কিছুটা জোর করে আম্মুকে বিছানায় বসাল বুবুন। তারপর আম্মুর একটা হাত নিজের দুই হাত দিয়ে চেপে ধরে বলল, ‘অবাক হচ্ছো কেন আম্মু? বললাম না এই কাজগুলো কেউ না কেউ তো করেছে।’
‘সেই কেউটা কে?’ আম্মু অস্থির হয়ে বললেন।
‘খখখ।’
‘খখখ!’ কপাল কুঁচকে ফেলেন আম্মু, ‘এটা আবার কী?’
‘এটা একটি ভূতের বাচ্চা।’
‘কী!’ কিছুটা চিত্কার করে ওঠেন আম্মু, ‘বুবুন, তুমি তো কখনো মিথ্যা কথা বলতে না!’
‘হ্যাঁ, আমি তো কখনো মিথ্যা বলি না।’
‘আজ কেন মিথ্যা কথা বলছ!’
‘আমি তো মিথ্যা কথা বলছি না, আম্মু। এসব খখখই করেছে। খখখ হচ্ছে ওই ভূতের বাচ্চার নাম। আমার নতুন বন্ধু।’
‘আমি আর ভাবতে পারছি না, বুবুন। তুমি সত্যি কথাটা বলে ফেলো।’
আম্মুর হাত দুটো আরও একটু চেপে ধরে বুবুন বলল, ‘আমি সত্যি কথাই বলছি আম্মু।’
‘ভূত বলে কিছু আছে নাকি! ভূতের বাচ্চাই-বা তুমি পাবে কীভাবে!’ রুমের দরজার দিকে তাকালেন আম্মু, ‘বুবুনের বাবা, এদিকে আসো তো।’
স্যুট-টাই পরে অফিসে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন বুবুনের বাবা। দ্রুত তিনি বুবুনের রুমে ঢুকলেন। কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন, ‘কী হয়েছে? চিত্কার করে ডাকলে যে! কোনো সমস্যা?’
‘তোমার ছেলে কী বলে শোনো।’ বুবুনের দিকে তাকালেন আম্মু, ‘ওর নাকি একটা বন্ধু হয়েছে, সে আবার ভূতের বাচ্চা। তার নাম খখখ।’
‘বুঝতে পারলাম না ব্যাপারটা।’ চোখ বড় বড় করে ফেললেন বুবুনের বাবা। বুবুনের মুখের দিকে তাকালেন তিনি।
‘বুঝতে পারছ না!’ বিছানা থেকে কিছুটা লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন আম্মু। বুবুনের বাবার কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘বিছানা দেখেছ? টানটান করা চাদর। খাটের নিচে জুতো গোছানো। ওয়ার্ডরোবের কাপড় সাজানো আছে থাক থাক করে। ওগুলো ইস্তিরি করা ছিল না, ইস্তিরিও করা হয়েছে ওগুলো। আর দেখ—বুবুনের আব্বুর একটা হাত টেনে জানালার কাছে নিয়ে গেলেন বুবুনের আম্মু, ‘বাগানের যত আগাছা ছিল সব পরিষ্কার করা হয়েছে।’
‘এসব কে করেছে?’ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন বুবুনের আব্বু।
‘বুবুনের ওই বন্ধু, খখখ না ককক নাম!’ আম্মু ঘরের দেয়ালের দিকে তাকালেন, ‘দুই দিন আগে তুমি বললে না ছবি আঁকতে গিয়ে দেয়ালটা কেমন বিশ্রী করে ফেলেছে বুবুন, রংমিস্ত্রি ডাকতে হবে। তার আর প্রয়োজন হবে না। দেখো, এটা এখন পরিষ্কার। এটাও নাকি ওই ভূতের বাচ্চাটা করেছে!’
আব্বু এগিয়ে গেলেন বুবুনের দিকে। আদর করে মাথায় হাত দিয়ে বললেন, ‘বুবুন, আমার গুডবয়, তুমি তো কখনো মিথ্যা কথা বলো না। আজ কেন বলছ?’
‘আমি তো আজও মিথ্যা কথা বলছি না, আব্বু।’
‘এগুলো কি তাহলে ওই ভূতের বাচ্চাই করেছে?’
‘জি, আব্বু। ওর নাম খখখ।’
‘ও দেখতে কেমন?’
‘আমাদের দুটো চোখ, ওর তিনটা। দুপাশে দুটো, কপালের মাঝখানে একটা।’ বুবুন খুব আনন্দ নিয়ে বলল।
‘ও এখন কোথায় আছে?’
ঝট করে বুবুন পড়ার টেবিলের কোনার দিকে তাকাল। ছায়ার মতো দেখা যাচ্ছে ওখানে এখনো। বুবুন উত্ফুল্ল হয়ে বলল, ‘ওই যে, ওখানে।’
আব্বু একটু এগিয়ে গিয়ে বললেন, ‘কই?’
‘ওখানেই আছে। তুমি দেখতে পাচ্ছো না!’
কিছুটা রেগে গেলেন আব্বু, ‘ছিঃ বুবুন, তুমি শেষ পর্যন্ত মিথ্যা কথা বলা শিখেছ। আমি খুব কষ্ট পেলাম।’
‘না আংকেল, বুবুন মিথ্যা কথা বলেনি।’ পড়ার টেবিলের কোনা থেকে একটা ছায়া নড়ে উঠল হঠাত্। বুবুনের আব্বু আর আম্মু দেখলেন—ছায়াটা আস্তে আস্তে কেমন যেন মানুষের রূপ নিচ্ছে। ধোঁয়ার মতো একটা আবরণ ঘিরে রেখেছে তাকে। আস্তে আস্তে ওটা এগিয়ে আসছে সামনের দিকে। একসময় সেটা অনেকটা মানুষের মতো হয়ে গেল। বুবুনের আব্বু আর আম্মুর চোখ বড় হয়ে গেছে। কোনো কথা বলতে পারছেন না তাঁরা। বুবুনের উচ্চতার একটা অবয়ব দাঁড়িয়ে আছে তাঁদের সামনে। তিন-তিনটা চোখ ওটার। মাথায় কোনো চুল নেই, ন্যাড়ার মতো।
চিঁচিঁ করে হাসতে হাসতে খখখ বলল, ‘আংকেল-আন্টি, আমার নাম খখখ, আমিই ভূতের বাচ্চা। বুবুনের কোনো ক্ষতি করতে আসিনি আমি। অন্য একটা কারণে ওর কাছে এসেছি।’
বুবুনের আম্মু ভয় ভয় গলায় বললেন, ‘কী জন্য এসেছ তুমি!’
‘সীতাকুণ্ডে ওই যে বড় বড় পাহাড় আছে, আমরা ওই পাহাড়ে থাকি। সারা দিন পাহাড়ের গর্তে ঘুমাই, রাতে বের হই। আমাদের সমাজে একটা নিয়ম আছে—প্রতিদিন একটা করে ভূতের বাচ্চাকে একটা করে মানুষের বাচ্চার কাছে পাঠানো হয়। তবে যেই সেই মানুষের বাচ্চার কাছে না, খুব ভালো মানুষের বাচ্চার কাছে। যে তার বাবা-মায়ের কথা শোনে, মিথ্যা বলে না, ঠিকমতো লেখাপড়া করে, তার কাছে।’ বুবুনের দিকে তাকিয়ে খখখ বলল, ‘বুবুন হচ্ছে সে রকম একজন ভালো ছেলে।’
‘ঘরের এত সব কাজ তাহলে তুমি করে দিয়েছ?’
‘জি।’
‘এত কাজ তুমি এত তাড়াতাড়ি করলে কী করে?’
‘ভূত কিংবা ভূতের বাচ্চারা অনেক তাড়াতাড়ি কাজ করতে পারে। তারা মানুষের অনেক গোপন খবরও বলতে পারে। যেমন: আপনাদের বাসায় আমার আর বুবুনের বয়সী একটা মেয়ে কাজ করে না, আপনারা অনেক ভালোবাসেন ওকে। কয় দিন পর ঈদ, আপনারা ওর জন্য সুন্দর একটা জামা আর জুতো এনেছেন। কিন্তু ওকে ওগুলো এখনো দেখাননি। ঈদের আগের দিন ওকে দেখিয়ে চমকে দেবেন।’ চিঁচিঁ করে আবার হাসতে থাকে খখখ, ‘কী, আমি কি ঠিক বললাম?’
‘হ্যাঁ, তুমি ঠিক বলেছ খখখ।’ বুবুনের আব্বু বললেন।
‘ওই চার রাস্তার মোড়ে গরিব বাচ্চাদের একটা স্কুল আছে, আপনারা দুজন চুপিচুপি ওই স্কুলে প্রতি মাসে বেশ কিছু টাকা দান করেন। এটা কিন্তু বুবুনও জানে না।’ খখখ আবার হেসে ওঠে, ‘আমি কিন্তু জানি।’
‘আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি।’ চোখ বড় বড় করে বুবুনের আব্বু বললেন।
‘অবাক হওয়ার কিছু নেই আংকেল। আমি বললাম না ভূতরা অনেক কিছু জানে। বুবুন এবারও পরীক্ষায় ভালো করলে ওকে নিয়ে আপনারা কক্সবাজার যাবেন, এই প্রথম আপনারা ওকে সমুদ্র দেখাবেন। এটাও কিন্তু বুবুন জানে না।’ বুবুনের দিকে তাকাল খখখ, ‘বুবুন তুমি কি জানো ব্যাপারটা?’
‘না, আমি জানি না তো!’
‘আব্বু-আম্মু তোমাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য গোপন রেখেছেন এটা।’ চিঁচিঁ করে আবার হেসে ওঠে খখখ, ‘আমার সময় শেষ, আমার এখন চলে যেতে হবে। একটা ভালো ছেলের সঙ্গে কিছুক্ষণ সময় কাটানোর সুযোগ দেওয়া হয়েছিল, আমি খুব খুশি যে বুবুনের মতো একটা ছেলে আমাকে বন্ধু বলেছে।’
‘তুমি এখন চলে যাবে!’ বুবুন কষ্ট কষ্ট গলায় বলল।
‘আমাকে যেতে হবে যে।’
‘তুমি আর কখনো আসবে না!’
‘আমি যদি ভালো ভালো কাজ করি, তাহলে আমাকে আরও অনেকবার মানুষের সঙ্গে মেশার সুযোগ দেওয়া হবে।’ বুবুনের দিকে এগিয়ে যায় খখখ, ‘আমি এখন থেকে বেশি বেশি ভালো কাজ করব, বুবুন। আমি আবার তোমার কাছে আসব। এখন আসি, ওকে?’
বুবুন হঠাত্ কেঁদে উঠল, ‘না, তোমাকে যেতে দেব না আমি।’
‘কিন্তু আমাকে যে যেতেই হবে বন্ধু।’
‘আরও কিছুক্ষণ থাকো না, প্লিজ!’
‘আমার যে সময় নেই। তোমার যেমন খারাপ লাগছে, আমারও তেমন লাগছে বন্ধু।’ বুবুনের একটা হাত ছুঁয়েই চলে যাচ্ছিল খখখ। হঠাত্ পেছনে তাকাল সে। বুবুন দৌড়ে গিয়ে ওর আম্মুকে জাপটে ধরেছে। কান্না শুরু করে দিয়েছে জোরে জোরে।
ঘুরে দাঁড়াল খখখ। একটু এগিয়ে গেল বুবুনের আম্মুর দিকে। গলাটা নিচু করে বলল, ‘আন্টি, আমার যখন ছয় মাস বয়স, তখন আমার বাবা-মা দুজনই মারা যান। আমি শুনেছি, মায়েদের আদর নাকি অনেক মজার। আপনি কি বুবুনের মতো আমাকেও একটু জড়িয়ে ধরবেন?’
হাত বাড়ালেন বুবুনের আম্মু। কিছুটা দৌড়ে গিয়ে খখখ ধরে ফেলল বুবুনের আম্মুর হাতটা। তারপর বুবুনের মতো মাথাটা ঠেকিয়ে দিল ডান হাতের ওপরে। খখখ একটু পর আয়েশ করে বলল, ‘আহ্, মায়ের আদরে এত মজা!’ তারপর বুজে ফেলল তিনটা চোখই।
বুবুন হঠাৎ শব্দ করে বলল, ‘আম্মু, খখখ নেই!’
আম্মু গলাটা ভারী করে বললেন, ‘ও চলে গেছে।’
বুবুন হঠাৎ ওর আম্মুর হাতের দিকে তাকাল। জেলির মতো দেখতে নীল কী যেন লেগে আছে আম্মুর হাতে। আম্মুও দেখলেন। তারপর কষ্ট কষ্ট গলায় বললেন, ‘সম্ভবত এটা ভূতদের কান্নার জল। মানুষের চোখের জলের কোনো রং নেই, ভূতদের আছে। মানুষের চোখের জল গরম, ভূতদের ঠান্ডা, বরফের মতো ঠান্ডা।’
আম্মু আর কিছু বললেন না। আঁচল দিয়ে মুখ ঢাকলেন নিজের। বুবুন টের পেল—আম্মুও কাঁদছেন, আব্বুর চোখও টলমল করছে!
অলংকরণ : আবু হাসান