পেট ব্যথা করছে—এ কথা বলতে গিয়ে খিলখিল করে হেসে ফেলল সুজন। ম্যাথ টিচার আবুল হোসেন ধমক দিলেন, অ্যাই ছেলে, তুমি কি আমার সঙ্গে ফাইজলামি করতেছ?
সুজন দুহাতে কান ধরে জিবে কামড় দেওয়ার ভঙ্গি করে বলল, না স্যার...ফাইজলামি করব কেন? আমার সত্যি সত্যি পেট ব্যথা করছে। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে...বলেই আবার খিলখিল করে হেসে ফেলল সে।
আবুল হোসেন এবার জোরে ধমক দিলেন, অ্যাই, তুমি হাসতেছ কেন? পেটব্যথা কি কৌতুকজাতীয় কিছু...? হাসবা না। হাসি থামাও, থামাও বলতেছি...
সুজন অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে পেটব্যথা বোঝানোর জন্য ওরে বাবা রে...ওরে মারে...স্যার আমারে ছুটি দেন। বাসায় যাব...বলতে বলতে জোরে কাঁদতে গিয়ে আবারও খিলখিল করে হেসে ফেলল।
আবুল হোসেন এবার ধৈর্য ধরে রাখতে পারলেন না। আগের চেয়েও জোরে চিৎকার দিয়ে ক্লাসের অন্য ছাত্রের দিকে তাকিয়ে বললেন, অ্যাই, তোমাদের কি মনে হয়, ওর সত্যি সত্যি পেট ব্যথা করতেছে?
সুজন বাদে ক্লাসের সবাই সমস্বরে বলল, না।
তিনি প্রশ্ন করলেন, ও কি তাহলে মিথ্যা বলতেছে?
আবার সবাই সমস্বরে উত্তর দিল, হ্যাঁ।
সুজন এবার প্রতিবাদ করল। আবুল হোসেনের দিকে তাকিয়ে বলল, স্যার বিশ্বাস করেন আমার পেটব্যথা। বমি বমি লাগছে...বলেই বমি করার ভঙ্গি করতেই আবুল হোসেন ভয় পেয়ে বললেন, অ্যাই, তুমি সত্যি সত্যি ক্লাসের ভেতরে বমি করবে নাকি? তোমার কি সত্যি সত্যি পেট ব্যথা করতেছে?
সুজন শরীর বাকিয়ে আহারে...উহুরে করে বলল, আমার কথা বিশ্বাস করেন স্যার। আমি মিথ্যা বলছি না। আমার সত্যি সত্যি পেট ব্যথা করছে।
আবুল হোসেনের সন্দেহ যাচ্ছে না। তিনি নিশ্চিত সুজন মিথ্যা কথা বলছে।
সুজন এখন অবশ্য হাসছে না। বাইম মাছের মতো শরীর বাঁকাচ্ছে আর আহা রে...উহু রে করছে। তবু সুজনকে একটু বাজিয়ে দেখতে চাইলেন আবুল হোসেন। এমনও তো হতে পারে বাসা থেকে যে অঙ্কগুলো করে আনার জন্য বলা হয়েছিল অর্থাৎ ‘বাড়ির কাজ’ সেটা হয়তো করেনি। তাই ক্লাস থেকে চলে যাওয়ার পাঁয়তারা করছে। আবুল হোসেন বললেন, অ্যাই ছেলে, সোজা হয়ে দাঁড়াও...
সুজন আহা রে...উহু রে বলতে বলতে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল। আবুল হোসেন আবার ধমক দিলেন, তোমাকে না বললাম সোজা হয়ে দাঁড়াও...অ্যাটেনশন...
সুজন ধমক খেয়ে সোজা হলো। আবুল স্যার রাগী গলায় বললেন, তোমার কি সত্যিই পেট ব্যথা করতেছে?
হ্যাঁ।
পেটের কোন দিকে? ডাইনে না বাঁয়ে?
দুই দিকে...
ব্যথাটা কেমন? চিনচিনা না মিনমিনা? বোঝো নাই? ব্যথাটা খুব বেশি না কম?
খুব বেশি।
সকালে বাসায় কী খাইছ?
পরোটা, মাংস, ডিমভাজি আর আমের জুস...
সুজনের কথা শুনে আবুল হোসেন গবেষণায় নেমে গেলেন। তার কেন যেন মনে হলো সুজনের যদি সত্যি সত্যি পেটব্যথা হয়ে থাকে, তাহলে হয় মুরগির মাংস না হয় আমের জুসের জন্য হয়েছে। এই দুই খাবারে নিশ্চয়ই ঝামেলা ছিল। সুজনকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করতে গিয়ে চমকে উঠলেন আবুল হোসেন। সুজন এবার চিংড়ি মাছের মতো লাফাচ্ছে আর খিলখিল করে হাসছে। ক্লাসের অন্য ছেলেরাও সুজনকে দেখে হাসি থামাতে পারছে না। ক্লাসজুড়ে যেন হাসির ফোয়ারা ছুটছে। আবুল হোসেন টেবিলে ডাস্টার ঠুকে চিৎকার দিলেন কোয়ায়েট...কোয়ায়েট প্লিজ...
ছেলেরা ম্যাথ টিচারের শাস্তির ভয়ে হাসি থামিয়েছে। কিন্তু সুজনের পরিবর্তন নেই। সে ক্ষণে ক্ষণে জ্যান্ত চিংড়ি মাছের মতো লাফ দিচ্ছে আর খিলখিল করে হাসছে। আবুল হোসেন এবার আর চিৎকার দিলেন না। সুজনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সন্দেহভরা চোখে প্রশ্ন করলেন অ্যাই ছেলে, তুমি আমার একটা প্রশ্নের জবাব দাও তো...
সুজন চিংড়ি মাছের মতো লাফাতে লাফাতে বলল, স্যার...কী প্রশ্ন বলেন...?
তুমি আগে লাফালাফি থামাও।
সুজন লাফাতে লাফাতে বলল, স্যার পারব না।
কেন পারবে না?
আমার দুই পায়ে কে যেন সুড়সুড়ি দিতেছে...
আবারও রেগে উঠলেন আবুল হোসেন, তুমি কি সত্যি সত্যি ফাইজলামি করতেছ? জানো, তোমার এই বেয়াদবির ভবিষ্যৎ কী?
সুজন লাফাতে লাফাতেই বলল, জানি স্যার। কলমের এক খোঁচায় আমাকে স্কুল থেকে বের করে দিতে পারেন।
তারপরও তুমি বেয়াদবি করতেছ কেন? লাফালাফি থামাও...থামাও বলতেছি...
স্যারের ধমক খেয়েও সুজন লাফালাফি থামাল না। বরং লাফালাফি বাড়িয়ে দিয়ে বলল, স্যার আমি এটা পারব না। কেউ আমার দুই পায়ে সুড়সুড়ি দিতেছে...
সুজনের পায়ে কেউ সুড়সুড়ি দিচ্ছে এ কথা শুনে ক্লাসের সবার মধ্যে কৌতূহল ছড়িয়ে পড়েছে। এখন আর কেউ হাসছে না। বরং কৌতূহলী চোখে সুজনকে দেখছে। ফিসফিস করে ইশারায় কথা বলছে তারা।
ম্যাথ টিচারও কৌতূহলী হয়ে উঠেছেন। বসার জায়গা থেকে সুজনকে উঠিয়ে সবার সামনে এনে দাঁড় করালেন। সুজন হাসতে হাসতে লাফাতে লাফাতে সবার সামনে এসে দাঁড়াল। আবুল হোসেন সুজনকে ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। যাতে সে না লাফায়। কিন্তু কাজ হচ্ছে না। সুজন আরও বেশি লাফাচ্ছে আর খিলখিল করে হাসছে।
আবুল হোসেন সুজনকে প্রশ্ন করলেন, তোমার ধারণা কেউ তোমার পায়ে সুড়সুড়ি দিচ্ছে...
জি স্যার...নরম হাত...তুলার মতো...
পায়ের জুতা খোলো।
জি স্যার?
বুঝতে পারো নাই? দুই পায়ের জুতা খোলো। আমি দেখব কে তোমার পায়ে সুড়সুড়ি দিচ্ছে...
সুজন দুই পায়ের জুতা খুলল।
আবুল হোসেন বললেন, পায়ের মোজা খোলো...
সুজন দুই পায়ের মোজা খুলল।
ক্লাসসুদ্ধ একটা রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতি। সুজনের জুতা-মোজা খোলা শেষে আবুল হোসেন প্রশ্ন করলেন, এখন কি কেউ সুড়সুড়ি দিচ্ছে?
সুজন ভেবে বলল, না।
আবুল হোসেন কয়েক সেকেন্ড কী যেন ভাবলেন। তারপর সুজনের চোখের দিকে তাকিয়ে নিচু স্বরে বললেন, তুমি হাঁটো ডালে ডালে...আর আমি হাঁটি পাতায় পাতায়...জুতা-মোজা পরো। আর ‘বাড়ির কাজ’ দেখাও। বলেই ক্লাসের ছাত্রদের দিকে তাকালেন আবুল হোসেন। সবাইকে টেবিলে বাড়ির কাজ জমা দেওয়ার জন্য তাড়া দিলেন।
মহাবিপদে পড়ল সুজন। বাড়ির কাজ আনেনি সে। সে জন্যই পেটব্যথার নাটক করেছিল। কিন্তু দুই পায়ে সুড়সুড়ির ব্যাপারটা নাটক নয়। ব্যাপারটা সত্যি।
জুতা-মোজা পরে বসার জায়গায় এল সুজন। সে ছাড়া ক্লাসের সবাই বাড়ির কাজ জমা দিয়েছে। স্যার সেটা বুঝতে পেরে সুজনের সামনে গেলেন। ভাবটা এমন এক্ষুনি সুজনকে ক্লাস থেকে বের করে দেবেন।
সুজনকে প্রশ্ন করলেন আবুল হোসেন, তোমার পায়ে সত্যি সত্যি কেউ সুড়সুড়ি দিচ্ছিল...
জি...
নরম হাত, তুলার মতো...
জি...
পেটব্যথা কি সেরে গেছে?
জি...
এখন কি কেউ পায়ে সুড়সুড়ি দিচ্ছে?
জি না।
তাহলে বাড়ির কাজ দেখাও...বলতে বলতে আবুল হোসেন হঠাৎ যেন একটু অন্যমনস্ক হয়ে উঠলেন। বারবার নাকে আর দুই কানে হাত দিচ্ছেন। হঠাৎ কী যে হলো কখনো পিঠে কখনো বুকে কখনো দুই পায়ে হাত দিয়ে শরীর চুলকাতে শুরু করলেন। একপর্যায়ে বাইম মাছের মতো শরীর বাঁকিয়ে খিলখিল করে হাসতে থাকলেন আবুল হোসেন। এই নিয়ে প্রথমে সারা ক্লাসে পরে সারা স্কুলে হইচই পড়ে গেল।
বিষয়টা মাথা থেকে সরাতে পারছে না সুজন। এখনো বুঝে উঠতে পারছে না ক্লাসে তার দুই পায়ে সুড়সুড়ির ব্যাপারটা কীভাবে ঘটল? কই এখন তো কেউ সুড়সুড়ি দিচ্ছে না। তাহলে ক্লাসে ঘটনাটা ঘটল কীভাবে? ঘটনা তো একটা নয়। দুইটা। ম্যাথ টিচারের ঘটনাটাও তো অবাক করার মতো। তিনি হঠাৎ ক্লাসে বাইম মাছের মতো শরীর বাঁকাচ্ছিলেন কেন? কাল স্কুলে গিয়ে ম্যাথ টিচারের কাছ থেকে ঘটনাটা জানতে হবে।
পাশের ঘরে প্রাইভেট টিউটর অপেক্ষা করছেন। খবরটা ইতিমধ্যে দুবার দিয়ে গেছে মকবুল ভাই। এই বাসায় কাজের লোকের সংখ্যা ছয়। মকবুল ভাই সবার সিনিয়র। তাই সে সব সময় অর্ডার করার ভঙ্গিতে কথা বলে। বিশেষ করে সুজনের সঙ্গে কথা বলার সময় তার এই প্রবণতা বেড়ে যায়। তবে সুজন মোটেই গুরুত্ব দেয় না। এই যেমন এখন মকবুল ভাই তাড়া দিচ্ছে ছোট ভাই হাশেম স্যার অনেকক্ষণ হইল বইস্যা আছে। যান...পড়তে যান। কী হইল? আমার কথা কি শুনতেছেন? তাড়াতাড়ি করেন...খাবার নিয়া এসব কী করতেছেন? বলতে বলতে সুজনের সামনে এসে দাঁড়াল মকবুল। নুডলসও ভর্তি খাবারের থালায় সস, পেয়ারা, কমলালেবুর কোয়া, আপেলের টুকরা, কলা, চানাচুর, মুরগির মাংসের ঝোল সঙ্গে আমের আচার মেখে একধরনের ককটেল বানিয়েছে সুজন। মকবুলকে কাছে পেয়ে বলল, একটু খেয়ে দ্যাখো তো রেসিপিটা কেমন হলো?
মকবুল খাবারের থালার দিকে তাকিয়ে বলল, খাবার নিয়া এসব কী শুরু করতেছেন? দেশের অনেক মানুষ খাবার পায় না, আর আপনি খাবার নিয়া...মকবুলের কথা কেড়ে নিল সুজন। বলল, আমি তো খাবার নিয়া এক্সপেরিমেন্ট করছি। এক্সিপেরিমেন্ট মানে বোঝো? গবেষণা...শোনো, ভাতের সঙ্গে মুড়ি, গরুর মাংসের ঝোল, চানাচুর আর মিষ্টি দই মেখে একবার খেয়ে দেখো...দারুণ খাবার...
সুজনের কথায় গুরুত্ব দিল না মকবুল। প্রাইভেট মাস্টারের কথা আবার স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলল, ভাইজান, শিক্ষক হইল অনেক শ্রদ্ধার মানুষ। তাকে এভাবে বসাইয়া রাখা ঠিক না। খাবার নিয়া আর ঘাঁটাঘাঁটি কইরেন না। যান...পড়তে যান...
সুজনের মন চাইছে আজ সে প্রাইভেট মাস্টারের কাছে পড়বে না। স্কুলের মতো একটা ফাঁকিজুকির রাস্তা বের করবে। কিন্তু সেটা কী। আবার পেটব্যথা? না পেটব্যথার কথা বলা যাবে না। এক সপ্তাহে দুবার পেটব্যথার কথা বলে হাশেম স্যারকে ভাগিয়ে দিয়েছে। আজ পেটব্যথার কথা বললে মোটেও বিশ্বাস করবে না। বরং সন্দেহ করবে। তাহলে কী করা যায়? একটা উপায় তো বের করতে হবে...
মকবুল তাড়া দিয়েই যাচ্ছে, ছোট ভাই, স্যার আপনাকে ডাকতেছেন। তাড়াতাড়ি যান...
পেটব্যথা নয়। আজ মাথাব্যথার কথা বলতে হবে। এ জন্য অভিনয়টা কেমন হবে মনে মনে তার মহড়া দিয়ে পাশের ঘরে ঢুকল সুজন।
হাশেম স্যার গম্ভীর হয়ে চেয়ারে বসেছিলেন। সুজনকে দেখে বিরক্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, আজ কি পেটব্যথা না মাথাব্যথা?
সুজন তাৎক্ষণিকভাবে তার সিদ্ধান্ত পাল্টে বলল, না স্যার, আজ আমার কোনো ব্যথাট্যথা নেই। সব ঠিক আছে...
তাহলে আসতে দেরি করলে কেন? তুমি জানো না আমি এক ঘণ্টা আগে এসেছি?
সুজন কী বলবে ভেবে পেল না। তার কেন যেন মনে হলো মাথাব্যথা অথবা পেটব্যথা টাইপের কিছু একটা বললেই ভালো হতো। আজ কিছুতেই পড়াশোনায় মন বসবে না। স্কুলের ক্লাসে দুই পায়ে সুড়সুড়ির সেই ব্যাপারটা বারবার মনে পড়ছে। অবাক কাণ্ড। জুতা পরা অবস্থায় দুই পায়ে সুড়সুড়ি অনুভব করছিল সুজন। তা-ও আবার ছোটখাটো সুড়সুড়ি নয়। মনে হচ্ছিল কেউ রেগে গিয়ে সুজনের পায়ে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। ব্যাপারটা নিয়ে হাশেম স্যারের সঙ্গে কথা বললে কেমন হয়? সব শুনে হাশেম স্যার যদি আলোচনাটায় জমে যান তাহলে আজ আর পড়াশোনার ঝামেলা পোহাতে হবে না। হাশেম স্যারের মুখের দিকে তাকাল সুজন, স্যার, আপনাকে একটা ঘটনা বলব বলে আসতে দেরি হলো।
হাশেম স্যার অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন, ঘটনা মানে? কী...
তার আগে বলেন, আপনি কি ভূতটুতে বিশ্বাস করেন?
মানে? বিরক্তি প্রকাশ করলেন হাশেম স্যার।
সুজন বলল, আমার কথা বুঝতে পারেননি? ভূত...ভূতে বিশ্বাস করেন?
হঠাৎ ভূতের ব্যাপারে জানতে চাইছ কেন?
আহ্ হা বলেন না, ভূতে বিশ্বাস করেন কি না?
স্যার আরও বিরক্ত হয়ে বললেন, শোনো, বিজ্ঞানের এই যুগে ভূত বলে কিছু নেই। খাতা নাও...আজ আমরা ইংরেজি কিছু ট্রান্সলেশন করব। ইংরেজিতে ট্রান্সলেশনের ব্যাপারটা খুবই জটিল মনে হয় সুজনের। মাঝেমধ্যে মনের ভেতর একটা প্রশ্ন জাগে, গোটা পৃথিবীতে যদি একটাই ভাষা থাকত তাহলে এই ট্রান্সলেশনের ঝামেলাটা থাকত না। কী যে মজা হতো। ইংল্যান্ডের মানুষ যে ভাষায় কথা বলছে বাংলাদেশের মানুষও সেই ভাষায় কথা বলছে। চায়নিজদের যে ভাষা, বাংলাদেশের মানুষেরও সেই ভাষা।
হাশেম স্যার আবার তাড়া দিলেন, কই খাতা নিচ্ছ না যে...প্রথমে লেখো...প্রশ্ন নম্বর এক. পৃথিবীতে ভূত বলে কিছু নেই...
সুজন প্রতিবাদের সুরে বলল, আপনার কথা ভুল স্যার। পৃথিবীতে ভূত আছে...
আমি বলতেছি নাই। হাশেম স্যার রেগে উঠলেন।
সুজন বোঝানোর ভঙ্গি করে বলল, ভূত আছে স্যার...
হাশেম স্যার এবার সুজনকে ধমক দিলেন। মুখের ওপর তর্ক কোরো না। বিজ্ঞানের এই যুগে পৃথিবীতে ভূত বলে কিছু নাই। প্রশ্নটা লিখেছ...? পৃথিবীতে ভূত বলে কিছু নাই...
সুজন হাশেম স্যারের কথায় গুরুত্ব না দিয়ে বলল, স্যার, আপনার কথা আমি মানতে পারছি না। ভূত না থাকলে ভূতের সিনেমা হয় কী করে? ভূত নিয়ে গল্প আছে, উপন্যাস আছে। পড়বেন?
স্যার ধমক দিয়ে বললেন, যা বলেছি তাই করো। তা না হলে তোমার মায়ের সঙ্গে কথা বলতে হবে। পড়াশোনায় তোমার মোটেই মনোযোগ নেই এটা তাকে জানাতে হবে। ডাকব তোমার মাকে...? বলতে বলতে সুজনের মুখের দিকে তাকালেন হাশেম স্যার।
সুজন হঠাৎ কেঁদে ফেলল।
হাশেম স্যার সন্দেহজনক দৃষ্টিতে বললেন, কী হলো মাথাব্যথা নাকি পেটব্যথা?
সুজন শরীর বাঁকিয়ে বলল, স্যার, সত্যি সত্যি আমার মাথাব্যথা করছে। সামনের দিকটা ছিঁড়ে যাচ্ছে।
তাহলে তোমার মাকে ডাকি?
ডাকেন? বলে হঠাৎ খিলখিল করে হেসে ফেলল।
হাশেম স্যার অবাক হয়ে সুজনকে ধমক দিলেন
অ্যাই, তুমি হাসতেছ কেন? তোমার না মাথাব্যথা?
সুজন মাথাব্যথার ভঙ্গি করে হাসতে হাসতেই বলল, স্যার, সত্যি সত্যি আমার মাথাব্যথা করছে...
হাশেম স্যার জোরে ধমক দিলেন, অ্যাই, থামো...থামো বলতেছি...একদম নড়াচড়া করবে না। থামো থামো বলতেছি...
সুজনের কোনো পরিবর্তন দেখা গেল না। আগের চেয়ে আরও জোরে হাসতে হাসতেই বোঝাতে চাইল তার প্রচণ্ড মাথাব্যথা হচ্ছে।
হাশেম স্যার এবার সুজনের মুখোমুখি দাঁড়ালেন। তার চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, তোমার কি সত্যি সত্যি মাথাব্যথা করছে?
হ্যাঁ।
মাথাব্যথা করলে কেউ এভাবে হাসে?
না।
তাহলে তুমি হাসতেছ কেন?
আমার দুই পায়ে কে যেন সুড়সুড়ি দিতেছে...
মানে? কী বলতেছ তুমি? কে সুড়সুড়ি দিতেছে?
কই তোমার পায়ের কাছে তো কেউ নাই। হাসি থামাও, থামাও বলতেছি...সুজন...কথা শোনো...
সুজন বলল, স্যার, হাসি থামানো সম্ভব না। আগে আস্তে আস্তে সুড়সুড়ি দিয়েছে। এখন জোরে জোরে সুড়সুড়ি দিচ্ছে...
হাশেম স্যার ধমক দিয়ে বললেন, তুমি কী বলতেছ এইসব? কে সুড়সুড়ি দিচ্ছে?
ভূত। ভূত সুড়সুড়ি দিচ্ছে...
হাশেম স্যার যারপরনাই রেগে গিয়ে বললেন, ভূত তোমার পায়ে সুড়সুড়ি দিচ্ছে? মিথ্যা বলার জায়গা পাচ্ছ না? অ্যাই, সোজা হয়ে দাঁড়াও। সুজন...আমি তোমাকে সোজা হয়ে দাঁড়াতে বলছি...বলতে বলতে হাশেম স্যার হঠাৎ নিজেই সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। নাক, মুখ কুচকে নিশ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করছেন। পরপর দুবার জোরে হাঁচি দিলেন। দুই হাত দিয়ে নাক-মুখ ঢাকার চেষ্টা করেও পারছেন না। মনে হলো তাঁর নাক ও মুখের সামনে সুড়সুড়ি দেওয়ার মতো কিছু একটা ঘটছে। সে কারণে বারবার হাঁচি দিচ্ছেন তিনি। একবার জোরে হাঁচি দিয়ে দুই হাতে টাইট করে মুখ ঢাকলেন। এবার বাইম মাছের মতো শরীর বাঁকাচ্ছেন হাশেম স্যার।
সুজন চোখেমুখে আতঙ্ক নিয়ে প্রশ্ন করল, স্যার, আপনি এমন করছেন কেন? স্যার...ও স্যার...সুজন জোরে ডাক দিতেই মুখের সামনে থেকে দুই হাত সরিয়ে একটু যেন স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলেন হাশেম স্যার। সুজন জিজ্ঞেস করল, স্যার, আপনি এমন করছেন কেন? কোনো সমস্যা?
সুজনের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখলেন হাশেম স্যার। তারপর বললেন, না, কোনো সমস্যা নাই। আচ্ছা তুমি যেন ভূতের ব্যাপারে কী বলতে চেয়েছিলে?
সুজন খুশি হয়ে বলল, তার মানে আপনি ভূতে বিশ্বাস করছেন?
হাশেম স্যার ধীর গলায় বললেন, না, আমি ভূতটুতে মোটেই বিশ্বাস করি না। পৃথিবীতে ভূত বলে কিছু নাই। শোনো, আমার শরীর ভালো লাগছে না। আজ বরং আমি আসি...বলেই ধীর পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন হাশেম স্যার। সুজন আনন্দে নাচতে শুরু করেছে। হঠাৎ মনে হলো কে যেন তার ডান হাত ধরে টানতে টানতে বাড়ির ছাদের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। একসময় ছাদে উঠল সুজন। একি! তাকে ছাদ থেকে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে কে? সুজন ভয়ে চিৎকার দিতে চাচ্ছে। কিন্তু তার গলা থেকে আওয়াজ বের হচ্ছে না।
খসখসে একটা শব্দ শুনে চমক ভাঙল সুজনের। একি! বাড়ির সামনে লম্বা তালগাছটার পাতায় বসে আছে সে। নিচে তাকাতেই বুক ছ্যাঁৎ করে উঠল। এখান থেকে পড়ে গেলে নির্ঘাত মৃত্যু। কিন্তু তালগাছের মাথায় সে এল কী করে? নামবেই বা কীভাবে? ভয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে চাইছে সে। কিন্তু মুখ থেকে শব্দ বের হচ্ছে না। হঠাৎ তার সামনে তালগাছের আরেকটা পাতায় সমবয়সী এক কিশোরকে দেখে আঁতকে উঠল সুজন। কিশোরের ন্যাড়া মাথা, খালি গা। পরনে হাফপ্যান্ট। সুজনের দিকে পিটপিট করে তাকাচ্ছে। সুজনকে জিজ্ঞেস করল, ভয় পাচ্ছ?
সুজন আড়চোখে নিচে একবার দেখে বলল, হ্যাঁ।
তুমি তো খুব সাহসী ছেলে ভয় পাচ্ছ কেন?
সুজন ভয়ে ভয়ে বলল, এর আগে এভাবে তালগাছে উঠিনি তো তাই...
সুজনের কথা শেষ হতে না হতেই সামনের পাতায় বসা ন্যাড়া মাথার ছেলেটি হাত-পা ছাড়িয়ে তালগাছে একটা ঝাঁকুনি দিল। ভয়ে সুজন হাউমাউ করে বলল, অ্যাই, করছ কী! পড়ে যাব তো...অ্যাই...
ন্যাড়া মাথার ছেলেটি পিটপিটে চোখে হাসতে হাসতে বলল, ভয় পেয়ো না। আমি থাকতে তুমি তালগাছ থেকে পড়ে যাবে না।
তুমি কে? তোমার নাম কী? প্রশ্ন করল সুজন।
ন্যাড়া মাথা বলল, আমার নাম বল্টু।
বল্টু...? মানে...তোমার কোনো পদবি নাই? এই যেমন আমার নাম মীর্জা সুজন হায়দার...মীর্জা আমাদের বংশের পদবি।
আগে ছিল। বল্টু চৌধুরী। এখন হয়েছে বল্টু ভূত!
ভয়ে আঁতকে উঠল সুজন, তার মানে তুমি কী ভূত!
হ্যাঁ। অদ্ভুত শব্দ করে হেসে ফেলল বল্টু ভূত।
সুজন ভয়ে ভয়ে বলল, তুমি এভাবে হাসছ কেন?
বল্টু ভূত বলল, হাশেম স্যারের কাণ্ড দেখে হাসছি।
মানে? তুমি কি এখন হাশেম স্যারকে দেখতে পাচ্ছ?
হ্যাঁ।
তিনি এখন কোথায়?
তোমাদের ড্রয়িংরুমে। তোমার মায়ের সঙ্গে কথা বলছেন।
তার মানে আমার বিরুদ্ধে মাকে নালিশ দিচ্ছেন?
না, আমাকে নিয়ে গল্প বলছেন। মানে ভূতের গল্প বলছেন...খুউব ভয় পেয়েছেন।
তুমি কি দৃশ্যটা দেখতে পাচ্ছ?
হ্যাঁ।
আমাকে একটু দেখাও না।
না। এই দৃশ্য তোমার দেখার সুযোগ নাই। তবে আমার কথামতো চললে ভবিষ্যতে তুমি এ রকম অনেক দৃশ্য দূর থেকে দেখতে পারবে।
তোমার কথামতো চলব মানে? অবাক কণ্ঠে প্রশ্ন করল সুজন।
বল্টু ভূত বলল, হ্যাঁ, আজ থেকে তোমাকে আমার কথামতো চলতে হবে।
হোয়াট? কী বলতে চাচ্ছ তুমি? আমি তোমার কথামতো চলব কেন?
বল্টু ভূত মৃদু হেসে বলল, উত্তেজিত হয়ো না। আমি তোমার ক্ষতি করব না। তোমার ভালোর জন্যই আমি ভূতরাজ্য থেকে এসেছি।
ভূতরাজ্য? সেটা কোথায়?
অনেক দূরে। সময়-সুযোগ পেলে একদিন তোমাকে আমাদের ভূতরাজ্য সম্পর্কে বলব। এখন আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনো...
বলো।
তোমাকে এখানে কেন এনেছি বলো তো!
কী করে বলব? তোমার নিশ্চয়ই কোনো মতলব আছে। আমাকে ভয় দেখানোর মতলব। যাতে আমি তোমার কথা শুনি।
বল্টু ভূত মৃদু হেসে বলল, তোমার ধারণা ভুল। আমি কোনো মতলব নিয়ে পৃথিবীতে আসি নাই। তবে হ্যাঁ আমার একটা উদ্দেশ্য আছে।
বল্টু ভূত সুজনের পাশে এসে দাঁড়াল। দূরে এক বাড়ি দেখিয়ে বলল, তোমাকে একটা জিনিস দেখাই।
জিনিস? কী!
আহ্হা এসো না। ওই দ্যাখো।
সুজন দূরে একটা বাড়ির আঙিনায় তাকাল।
আবুল স্যারকে দেখা যাচ্ছে। তিনি পায়চারি করছেন। বল্টু ভূত বলল, লোকটিকে চিনতে পারছ?
হ্যাঁ, আমাদের ম্যাথ টিচার।
চলো, তাঁর সঙ্গে দেখা করে আসি।
কেন?
স্কুলের ঘটনাটার পর তিনি ভয় পেয়েছেন।
তার মানে স্কুলে তুমিই আমার পায়ে সুড়সুড়ি দিয়েছিলে?
হ্যাঁ।
আবুল স্যারকে তুমিই ভয় দেখিয়েছ?
হ্যাঁ। তবে আমি ঠিক ভয় দেখাতে চাইনি। তিনি তোমার কথা বিশ্বাস করছিলেন না। সে কারণে...
সুজন বলল, তোমাকে একটা প্রশ্ন করতে পারি?
করো।
তুমি আমার পায়ে সুড়সুড়ি দিচ্ছিলে কেন? পেটব্যথা বলতে বলতে কেউ যদি খিলখিল করে হাসে, তাহলে পরিস্থিতি কেমন দাঁড়ায় বলো! তুমি এমনভাবে পায়ে সুড়সুড়ি দিচ্ছিলে যে না হেসে পারছিলাম না। বলো, আমার পায়ে সুড়সুড়ি দিচ্ছিলে কেন?
বল্টু ভূত ভেবে নিয়ে বলল, এ কথা তোমাকে পরে বলব। এখন চলো। তোমার আবুল স্যারের বাসা থেকে ঘুরে আসি। বেচারা খুব ভয় পেয়েছেন।
বলেই তালগাছের মাথা থেকে ঝাঁপ দিল বল্টু ভূত। সে হাওয়ায় উড়ছে। সুজনের মনে হলো কে যেন তাকেও ধাক্কা দিল। সেও হাওয়ায় উড়ছে। আহ! মেঘের ভেলা ছুঁয়ে ছুঁয়ে বল্টু ভূতের পিছু পিছু যাচ্ছে সুজন। যাচ্ছে তো যাচ্ছেই...