বন্ধুর পাশে
পরীক্ষা শেষ। এবার দুই মাস ছুটি। বাড়ি ফিরেই বন্ধুদের খোঁজ নিল সে। রিমির ফোন বন্ধ। মনে হয় ঘুমাচ্ছে। ফাইয়াজও ধরল না। শেষে মুকুলকেই ফোন করল জিনিয়া। ওপাশ থেকে ফোনটা ধরলেন ওর বোন—হ্যালো।
—আপা, আমি জিনিয়া। মুকুল কোথায়? ফেরেনি এখনো?
আপার গলাটা কেমন ভারী শোনায়—তুমি জানো না? মুকুল তো পরীক্ষা দিতে পারেনি। আবার অসুস্থ হয়ে পড়েছে। হাসপাতালে।
—সেকি?
জিনিয়া অবাক হয়। কয়েক দিন ধরে দেখা হয়নি, এটা ঠিক। কারও সঙ্গেই দেখা হয়নি আসলে। কিন্তু মুকুল আবার অসুস্থ? হলো কী ছেলেটার?
মনটাই খারাপ হয়ে গেল জিনিয়ার। ওরা এইচএসসি পরীক্ষার্থী। কদিন পর কে যে কোথায় চলে যাবে! মাঝখানের এই ছুটিটা দারুণ উপভোগ্য হতো। কিন্তু মুকুলটা অসুস্থ হয়ে সব বারোটা বাজিয়ে দিল। বেশ কয়েক মাস ধরেই স্বাস্থ্যটা ভেঙে পড়েছে মুকুলের। একেবারে হাড় বসে গেছে। কিছুদিন পরপরই জ্বর, কাশি। গত চার মাসে দুবার হাসপাতাল ঘুরে এসেছে। ডাক্তার বলেছেন নিউমোনিয়া। কিন্তু বারবার নিউমোনিয়া হবে কেন?
বিকেলে রিমি আর ফাইয়াজ এলে ঠিক করল কাল মুকুলকে দেখতে যাবে ওরা। মুকুল পরীক্ষা দিতে পারেনি! মানে ওদের থেকে পিছিয়ে পড়ল সে। ওরা যখন যে যার মতো এগিয়ে যাবে, তখন মুকুল সামনের বছর আবার বসবে পরীক্ষা দিতে!
কিন্তু একটা ছেলের বারবার কাশি-জ্বর হচ্ছে কেন?—বলল ফাইয়াজ। মুকুলের ক্যানসার-ট্যানসার হয়নি তো?
বাজে কথা বলিস না। জিনিয়া চেঁচিয়ে ওঠে।—চল কাল ওকে দেখে আসি।
পরদিন ক্লিনিকে গিয়ে ওরা শোনে, ডাক্তাররা ভালো বুঝতে পারছেন না বলে মুকুলকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে রেফার করেছেন। বিশাল হাসপাতালে মুকুলকে খুঁজে বের করতে গিয়ে গলদঘর্ম হয়ে গেল ওরা। হাসপাতালে প্রচণ্ড ভিড়। রোগী, রোগীর আত্মীয়স্বজন, চিকিৎসা, ছাত্রছাত্রী—গিজগিজ করছে। দেখেশুনে মন খারাপ হয়ে গেল জিনিয়ার। একসময় সে ভাবত বড় হয়ে চিকিৎসা হবে। কিন্তু ইদানীং হাসপাতালের পরিবেশ, গন্ধ, ভিড় ইত্যাদি কেন যেন তার সহ্য হতে চায় না। বুক ধড়ফড় করতে শুরু করে। এই সমস্যা শুরু হয়েছে তার বাবার হার্ট অ্যাটাক হওয়ার পর। হাসপাতালের গুমোট-বিষণ্ন পরিবেশ ওকে আক্রান্ত করেছিল তখন।
দীর্ঘ লাইন পেরিয়ে মেডিসিন বিভাগের ওয়ার্ডে এসে ওদের চক্ষু চড়কগাছ। কোনার দিকে বেডটাতে যে হাড্ডিসার কঙ্কালের মতো ছেলেটা মরার মতো শুয়ে আছে, সে-ই কি মুকুল? জিনিয়ার বুক ধক করে উঠল। মুকুলের ক্যানসার হয়নি তো?
মুকুলের বেডের পাশে মুখ বেজার করে তার বড় বোন বসে আছেন। ওদের দেখে ম্লান হাসি হাসলেন—ও তোমরা। এসেছ? মুকুলের নাকি যক্ষ্মা হয়েছে। খারাপ ধরনের। কোনো ওষুধে কাজ হচ্ছে না।
রিমি গাধাটা বেডের পাশে দাঁড়িয়ে ফ্যাচ ফ্যাচ করে কাঁদতে শুরু করে দিয়েছে। ফাইয়াজ ওকে ধমকে দিল—এই চুপ কর! ও ভালো হয়ে যাবে। তাই না, আপা?
—কী জানি! আপাকে কেমন অনিশ্চিত দেখায়—সব বড় ডাক্তার দেখছেন। কিন্তু কেউ তো ভরসা দিতে পারছেন না।
এ সময় একজন তরুণ চিকিৎসক এলেন। ওদের দেখে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি ওর বন্ধু?
ওরা মাথা নাড়ল। তিনি বললেন, তোমরা কি একটু আসবে?
ডাক্তারের সঙ্গে তাঁর পেছন পেছন গেল ওরা। একটা ছোট ঘরে ওদের বসিয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি ওর খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু?
ওরা আবার মাথা নাড়ল।
—তোমাদের কিছু প্রশ্ন করতে চাই আমি। ঠিকঠাক উত্তর দেবে। এর সঙ্গে কিন্তু তোমাদের বন্ধুর জীবন জড়িত।
জিনিয়া একটু নার্ভাস বোধ করলেও উত্তরটা সে-ই দিল, নিশ্চয়।
—আমাকে বলো তো, মুকুল কি নেশাটেশা করত? সিরিঞ্জ বা সুই দিয়ে কোনো ড্রাগস ব্যবহার করত কি?
ওরা অবাক হয়ে পরস্পরের দিকে তাকাল। মুকুল? না তো? কখনো না।
—ঠিক জানো তো? ধরো, তোমাদের সার্কেলের বাইরে ওর কোনো বন্ধুবান্ধব ছিল কি? যারা নেশাটেশা করত?
ঠোঁট শুকিয়ে এল জিনিয়ার—না। যত দূর জানি ছিল না। ও খুব চুপচাপ ধরনের ছেলে। আমাদের সঙ্গে মেশে। ছবি আঁকে।
ফাইয়াজও মাথা নাড়ল—এমন হলে অন্তত আমি বুঝতে পারতাম।
ডাক্তার স্থির দৃষ্টিতে জিনিয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন, থ্যাংক ইউ। তোমরা ভালো। মুুকুলও ভালো ছেলে। কিন্তু অনেক সময় ছোট ভুলের জন্য ভুগতে হয়।
এসব কেন বলছেন?—ফাইয়াজ কাঁদো গলায় বলে, মুকুলের কী হয়েছে?
—সেটা মুকুলের অনুমতি ছাড়া বলতে পারব না। তবে তোমরা মাঝে মাঝে মুকুলকে দেখতে আসবে। ওকে সাহস দেবে। ঠিক আছে?
বাড়ি ফিরে খুব অস্থির লাগল জিনিয়ার। মুকুলের নিশ্চয় সাংঘাতিক কিছু হয়েছে।
দুই দিন পর মুকুলের জন্য একটা ছবি আঁকার খাতা আর স্কেচ পেনসিল কিনল সে। তারপর ফোন করল বন্ধুদের। শুনে রিমি কেমন যেন মিইয়ে গেল—আমি যাব না রে। তুই যা।
—কেন?
—মা নিষেধ করেছেন।
জিনিয়া ফাইয়াজকে ফোন করল। ফাইয়াজের কণ্ঠও কেমন যেন—যাবি আসলে? কী হবে গিয়ে?
—কী হবে মানে? জিনিয়ার গলায় ঝাঁজ—মুকুল খুশি হবে।
—মানে শুনলি না সেদিন ডাক্তার কী সব জিজ্ঞেস করছিল। নিশ্চয় মুকুল খারাপ কিছু করেছে। পরে সবাই আমাদেরও খারাপ ভাববে।
—ভাবলেই কেউ খারাপ হয়? সে অসুস্থ। এ সময় বন্ধুরা পাশে থাকব না?
শেষে একাই রওনা হলো জিনিয়া। এবার ওয়ার্ডটা খুঁজে পেতে তেমন বেগ পেতে হলো না। ওকে দেখে মুকুল দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে নিল। জিনিয়া ডাকল—এই মুকুল। তোর জন্য ছবি আঁকার খাতা এনেছি। হাসপাতালে শুয়ে স্কেচ আঁকবি।
মুকুলের চোখে পানি। জিনিয়া ধমকে দিল—ছি। কাঁদছিস কেন ছাগল? তুই ভালো হয়ে যাবি।
মুকুল অনেক কষ্টে উঠে বসল। জিনিয়া সাহায্য করল ওকে। মুকুল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল—আমি আর ভালো হব না রে। আমার ভয়ংকর অসুখ হয়েছে।
—কী অসুখ? যক্ষ্মা তো দ্রুতই ভালো হয়ে যায়। ঠোঁট উল্টে বলে জিনিয়া।
—না জিনি—মুকুল চোখ তুলে তাকায়—আমি এইচআইভি পজিটিভ।
—কী? তুই? তুই... জিনিয়ার কথা আটকে যায়।
মুকুল ওর হাত ধরে—আমাকে ঘেন্না করিস না। বিশ্বাস কর, আমি খারাপ ছেলে নই। তুই আমার ছোটবেলার বন্ধু বলে বলছি। সত্যি জানি না এসব কী করে হলো।—পানি পড়তে লাগল মুকুলের চোখ বেয়ে।
ডাক্তারের রুমে বসে কাঁদছিল জিনিয়া। মুকুল! সেই মুকুল, যার সঙ্গে ছোটবেলায় টিফিন ভাগ করে খেয়েছে, পেনসিল ভেঙে ঝগড়া করেছে; যে মুকুল ওকে সাইকেল চালাতে শিখিয়েছে, অঙ্ক ভুল হলে গাধা বলে গালি দিয়েছে—সেই মুকুল কবে এত অচেনা হয়ে গেল?
দেখো জিনিয়া—ডাক্তার বলেন—জন্মসূত্রেই ভাইরাসটা এসেছে ওর ভেতরে। যতদূর জানি, দীর্ঘদিন ধরেই বিদেশে ছিলেন মুকুলের বাবা। সেখানেই কোনোভাবে ভাইরাসটা প্রবেশ করে তাঁর মধ্যে। তিনি টের পাননি। টের পাননি মুকুলের মা-ও। মুকুলের জন্মের সময়ই বিষয়টা প্রথম জানেন তাঁরা। কিন্তু সমাজের কথা ভেবে কাউকেই বলেননি কিছু, এমনকি মুকুলের বোনকেও না। ভাইরাস নিয়েই বেড়ে উঠেছে মুকুল। বাবা-মা দুজনকেই হারিয়ে বোনের কাছে বড় হয়েছে সে। আর সবার মতো মুকুলও জানত ক্যানসারে মারা গেছেন বাবা-মা। আসল সত্যটা জানল এখন। আসলে এইচআইভি ভাইরাস শরীরে রক্ত বা রক্তের মতো তরল উপাদানের মাধ্যমে ছড়ায়। কেউ যদি সিরিঞ্জের মাধ্যমে নেশা করে, অনিরাপদ রক্ত গ্রহণ করে বা অনিরাপদভাবে শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে, তবে ভাইরাস তার শরীরে ঢুকতে পারে। প্রথমে কিছুই বোঝা যায় না। কিন্তু ধীরে ধীরে এই জীবাণু শরীরের রোগ প্রতিরোধ সিস্টেমটাকে নষ্ট করে ফেলে। ফলে নানা ধরনের সংক্রমণ বারবার হতে থাকে, আর আক্রান্ত ব্যক্তি চিকিৎসা নিলেও ভালো হয় না। আবার সংক্রমণ হয়।
—মুকুল কি মারা যাবে?
—এইচআইভি পজিটিভ হলেই যে কেউ মারা যাবে, তা নয়—বললেন ডাক্তার—তা শরীরে কতটা প্রভাব ফেলেছে, সেটা আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে বোঝা যাবে। যখন সমস্যা অনেকটাই জটিল হয়ে যায়, তখনই রোগটাকে আমরা এইডস বলি। এর কার্যকর চিকিৎসা এখনো ঠিক আবিষ্কৃত হয়নি। এ রোগ থেকে বাঁচার জন্য সবচেয়ে আগে চাই সচেতনতা। বিশেষ করে তোমাদের মতো বয়সীদের।
জিনিয়া মন দিয়ে শোনে। ডাক্তার বলে চলেন—কখনোই ব্যবহৃত সুই, সিরিঞ্জ, রেজর, ব্লেড ইত্যাদি ব্যবহার করা যাবে না। কোনো কারণে রক্ত নেওয়ার দরকার হলে ঠিকমতো স্ক্রিনিং করে নেওয়া চাই। কেনা রক্ত তো নেওয়া যাবেই না। বন্ধু বা বান্ধবীর সঙ্গে মেলামেশার সময় সাবধান হতে হবে, সেটা যেন নিরাপদ হয়। তবে এটা একটা রোগ। রোগকে এড়িয়ে যাবে। কিন্তু রোগীকে ঘৃণা করবে না। তুমি মুকুলকে সাহস দিচ্ছ দেখে আমি খুব খুশি। ওর এখন এটাই দরকার।
জিনিয়া মুকুলের বিছানার কাছে এসে দেখে মুকুল এরই মধ্যে ওয়ার্ডের দুটো রোগীর চেহারা এঁকে ফেলেছে। একজনকে দেখাচ্ছে কার্টুনের মতো। দেখে হেসে ফেলল জিনিয়া। মুকুলও হাসল ওর দিকে তাকিয়ে। হাসপাতালের সানশেডের ওপর তখন খেলা করছে কয়েকটি কবুতর। সেদিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল জিনিয়া। একদিন নিশ্চয় এ রোগের চিকিৎসা আবিষ্কৃত হয়ে যাবে। আর তার ছোটবেলার বন্ধু মুকুল তখন ভালো হয়ে উঠবে। রিমি, ফাইয়াজ—সবাই মিলে আবারও আড্ডা দেবে প্রাণ খুলে। বড় শিল্পী হবে মুকুল। জিনিয়া কী হবে জানে না; তবে মুকুলের বন্ধুই থাকবে, এ কথা নিশ্চিত।