ফ্রাইকেল
পনেরো-ষোলো বছর আগের ঘটনা। টায়ারপুরের এক সাইকেল দম্পতির ঘর আলো করে জন্ম নেয় এক সাইকেল ছেলে। মা শখ করে তার নাম দিলেন দুরন্ত এসআর-২৫। কিন্তু কয়েক বছর পর কোথায় গেল দুরন্তপনা! তাদের ছেলে তো চলতেই পারে না। টায়ারে সমস্যা, ব্যালান্সও হয় না। সারা শহর ঘুরে দুটো ট্রেনিং হুইল জোগাড় করলেন দুরন্তর বাবা। লাগিয়ে দিলেন পেছনের চাকার দুই পাশে। তাই লাগিয়ে কোনো রকমে চলতে শিখল দুরন্ত।
স্কুলে ভর্তি হলো দুরন্ত। যেখানে সবাই তার নাম দিল ‘ফ্রাই-সাইকেল’। তাদের যুক্তি সহজ, তিন চাকার সাইকেলকে ট্রাই-সাইকেল বলা হয়। তাই চার চাকারটা ফ্রাই-সাইকেল। দেখতে দেখতে নামটা ‘ফ্রাইকেল’ হয়ে ছড়িয়ে পড়ল পুরো শহরে। এমনকি তার মা-বাবাও তাকে ফ্রাইকেল বলে ডাকা শুরু করলেন।
দুই বছর ধরে ক্লাস এইটে পড়ে আছে ফ্রাইকেল। জেএসসি (জুনিয়র স্কিলড সাইকেল) পরীক্ষায় রেসিং দ্বিতীয় পত্রে গতবার ফেল করেছিল। এবার সে ভালোভাবে অনুশীলন করছে। যেভাবেই হোক পাস করতে হবে। তবে সে কোচিংয়ে যায় না। নিজেই করে অনুশীলন।
একদিন ফ্রাইকেল মাঠে স্পিড বাড়ানো প্র্যাকটিস করছিল। পাশ দিয়ে যাচ্ছিল ক্লাসের ফার্স্ট বয় ফিনিক্স অ্যাটম। সাধারণ ফার্স্ট বয়দের মতো সেও খুব অহংকারী। ২৬ ইঞ্চি অ্যালুমিনিয়াম বডি, ২৭টা গিয়ার, হাইড্রোলিক ব্রেক-ফার্স্ট ক্লাস মাউন্টেন বাইক।
ফ্রাইকেলকে দেখে ফিনিক্স বলল, যতই চেষ্টা করো, তোমাকে দিয়ে রেসিং হবে না।
কেন? জানতে চাইল ফ্রাইকেল।
কেন আবার? তুমি তো ঠিকমতো চলতেই পারো না। রেসিংয়ে পাস করবে কীভাবে? তা ছাড়া তুমি তো সত্যিকারের সাইকেলই না।
ফিনিক্স ভেবেছিল ফ্রাইকেল বুঝি মন খারাপ করবে। কিন্তু ফ্রাইকেলও কম যায় না। চটে গিয়ে বলল, তুমি নিজেকে সত্যিকারের সাইকেল মনে করো?
অবশ্যই। আমি জেলা পর্যায়ের চ্যাম্পিয়ন।
তাহলে আমাকে হারিয়ে দেখাও।
হা...হা...হা...তোমাকে হারানো কোনো ব্যাপার? আমি এক প্যাডেলেই তোমাকে হারাতে পারব।
তাহলে হারাও। বলো, কখন রেস করবে?
তুমি তো দেখি ভালোই জেদি। আচ্ছা তোমাকে এক সপ্তাহ সময় দিচ্ছি। এই বলে চলে গেল ফিনিক্স-অ্যাটম।
পরের দিন ফ্রাইকেলের বন্ধু হিরো ক্লাসিক তার কাছে এসে বলল, দোস্ত, এসব কী শুনি? তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে? তুই ফিনিক্সকে চ্যালেঞ্জ করেছিস!
হ্যাঁ। জিততে পারব না জানি। কিন্তু আমি হার মানব না।
এই রেসের কথা প্রচার হওয়ায় স্কুলে বেশ পপুলার হয়ে গেল ফ্রাইকেল। ট্রেনিং হুইলওয়ালা সাইকেল জেলা চ্যাম্পিয়নকে চ্যালেঞ্জ করেছে—ভাবা যায়!
৩.
অবশেষে রেসের দিন এল। স্টার্টিং লাইনে দাঁড়াল দুজন। সবাই ফ্রাইকেলকে সমর্থন করছে। অহংকারী ফিনিক্সকে যে কেউ পছন্দ করে না, তা সহজেই বোঝা গেল।
ফিনিক্স ফ্রাইকেলকে বলল, মনে রাখিস সাইকেল ফ্রাই, আজ এতজন তোকে সাপোর্ট করছে। হারলে কিন্তু কেউ তোকে মনে রাখবে না।
হয়তো। কিন্তু তুমি হারলে কেউ আমাকে ভুলতে দেবে না।
সে দেখা যাবে।
ফিনিক্সের চেহারাটা বাল্বের মতো ফিউজ হয়ে গেল।
১, ২, ৩ ... পোঁওওওও... রেস শুরু হলো।
ফ্রাইকেল যত জোরে পারে যেতে লাগল। মজা করার জন্য তার সঙ্গে ধীরে ধীরে চলতে লাগল ফিনিক্স। গানও ধরল একটা—
‘সাইকেল ফ্রাই, সাইকেল ফ্রাই, জিতবে না তুমি জানি যত করো ট্রাই’
হঠাৎ খরগোশ-কচ্ছপের গল্প মনে পড়ল ফিনিক্সের। সে ঠিক করলে খরগোশের মতো কোনো ঝুঁকি নেবে না। সঙ্গে সঙ্গে বাড়িয়ে দিল স্পিড। ফ্রাইকেলকে ছাড়িয়ে চলে যেতে লাগল দ্রুতই।
কিন্তু কথায় আছে আগে গেলে বাঘে খায়। গিয়ার মোড়ের কাছে একটা বড় স্পোক গাছ। এখানেই যেখানে নব্বই ডিগ্রি টার্ন নিতে হবে। স্পিড না কমিয়েই ব্রেক চেপে স্লাইড দিতে চাইল ফিনিক্স। কিন্তু হায়! ব্রেক ফেল করল। রাস্তার পাশে এক দোকানের শাটারে আছাড় খেল ফিনিক্স। ফেটে গেল তার টিউব। একটা প্যাডেল ভেঙে, গিয়ার নষ্ট হয়ে খুবই খারাপ অবস্থা। যদিও ফিনিশিং লাইন খুব দূরে নয়। কোনোমতে পেছনে ঠেলে ঠেলে এগোতে লাগল সে।
এদিকে ফ্রাইকেল তার যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর সে আহত ফিনিক্সের কাছে চলে এল। দেখে মাথা গরম হয়ে গেল ফিনিক্সের। একটা সামান্য ট্রেনিং হুইলওয়ালা সাইকেলের কাছে সে হারবে? না, এ কিছুতেই হতে পারে না।
ফ্রাইকেল যখন এগিয়ে যাবে তখন অনেক কষ্টে একটা হুইলি দিয়ে সামনের চাকাটা ফ্রাইকেলের ট্রেনিং হুইলের ওপর ল্যান্ড করাল ফিনিক্স। তারপর আবার। একের পর এক আঘাত চলতেই থাকল।
ফিনিশিং লাইন বেশি দূরে না। আর ৭-৮ গজ সামনেই একটা ঢালু রাস্তা। ফিনিক্সের অবস্থা খারাপ হলেও সেখানে পৌঁছালে বাকি রাস্তাটা আরামে গড়িয়ে যেতে পারবে।
সেটা দেখেই ফ্রাইকেলের ট্রেনিং হুইলে ক্রমাগত আঘাত করে চলেছে ফিনিক্স। একসময় ট্রেনিং হুইলটা খুলে ছিটকে আলাদা হয়ে গেল। টাল সামলাতে হিমশিম খাওয়া ফ্রাইকেলকে ধাক্কা দিয়ে সামনে এগিয়ে গেল ফিনিক্স। ঢালু রাস্তাটাতে পৌঁছেই তীব্র গতিতে গড়িয়ে যেতে লাগল ফিনিশিং লাইনের দিকে।
ফ্রাইকেল আর চলতেই পারছে না। কোনোমতে টেনে এল ঢালটাতে। সে যখন ঢালুতে ধীরে ধীরে গড়ানো শুরু করল, তখনই ফিনিশিং লাইন স্পর্শ করল ফিনিক্স।
বেচারা ফ্রাইকেল হার মেনে এগোতে লাগল সামনে। কিন্তু সে ফিনিশিং লাইনে পৌঁছাতেই তাকে জড়িয়ে ধরল সবাই। মাইকে শোনা গেল, রেসের বিজয়ী দুরন্ত এসআর-২৫ ওরফে ফ্রাইকেল।
তারপর অন্ধকার...
ফ্রাইকেল যখন চোখ খুলল তখন সে আর ফিনিক্স হাসপাতালের বেডে। আসলে হয়েছে কী, যে ট্রেনিং হুইলটা ভেঙে গিয়েছিল তা গড়িয়ে এসে ফিনিক্সের আগে ফিনিশিং লাইন টাচ করেছে। তাই নিয়ম অনুযায়ী রেসে জিতে গেছে ফ্রাইকেল!
রেসে জিতে আগের চেয়ে অনেক আত্মবিশ্বাসী হয়েছে ফ্রাইকেল। জেএসসিতেও ভালোভাবে পাস করেছে সে। এখন সে এসএসসি মানে সুপার স্ট্যান্ডিং সাইকেল পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে।