পড়ুয়া

অলংকরণ: তুলি

সকালবেলা উঠেই আজ গোসল করে নিয়েছে আনু। বাবা আজ তাকে স্কুলে ভর্তি করে দেবেন।

আনুর খুব খুশি লাগছে। এখানে বাবা বদলি হয়ে এসেছেন অবধি একটা বন্ধুও তার হয়নি। বড় একা দিন কাটছিল আনুর—পড়ার জন্য যতটা নয়, তার চেয়ে বেশি বন্ধু পাওয়ার লোভে। স্কুলে ভর্তি হওয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছে সে।

মাকে বারবার তাগাদা দিচ্ছে ভাতের জন্য।

‘মা, শিগগির ভাত দাও। দশটা বেজে গেছে।’

‘কোথায় তোর দশটা?’

মা বিরক্ত হয়ে ডালের পাতিলে ঘুঁটনি ঘোরাতে ঘোরাতে বলেন।

‘হ্যাঁ, তুমি জানো! কত দেরি হয়ে গেল।’ আনু অভিমান করে রান্নাঘরের দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকে।

বড় আপা তরকারি কুটছিলেন। তিনি মুখ তুলে বলেন, ‘এখন তো মোটে সাড়ে আটটা রে! স্কুলে যাওয়ার এত শখ।’ বলে হাসেন আর ঘ্যাস ঘ্যাস করে তরকারি কোটেন।

আনু যে কেন অস্থির হয়েছে স্কুলে যাওয়ার জন্য, তা কাউকে বলা যাবে না। কথাটা লুকোনোর জন্য খুব মেজাজ করে আনু। বলে, ‘তোমার মতো নাকি? খালি বাড়িতে বসে থাকব! লেখাপড়া করতে হবে না?’

এবার হেসে ফেলেন মা। মেয়েকে বলেন, ‘আনুর আজকাল খুব মন হয়েছে লেখাপড়ায়।’

‘হবে না?’ বড় আপা আবার হাসেন। বলেন, ‘জানো মা, আনু আমাকে বলেছে ও নাকি রেলের গার্ড হবে। তাই বোধ হয় এত পড়ার ধুম।’

‘বলেছে তোমাকে? না মা, মিথ্যে কথা। আমি বলিনি।’ বলেই দৌড়ে পালিয়ে যায় আনু। রাগ হয় তার বড় আপার ওপর। কী যে! সব কথা মাকে বলতে হয় নাকি? এই জন্য বুঝি সে রাতে চুপিচুপি তাকে বলেছিল?

এই জন্য একেক সময় দেখতে ইচ্ছে করে না বড় আপাকে। শুধু কথা লাগাবে! বেশ, আমি গার্ড হব, তাতে ওর কী? গার্ডের চাকরি বুঝি সবাইকে দেয় রেলের লোক? গার্ড হতে হলে কত বুদ্ধি, আর কত সাহস, লেখাপড়া লাগে তার কী জানে বড় আপা?

সত্যি, মন্দ হয় না গার্ড হলে। কত দেশ ঘোরা যায়। আর কী মজার কাজ। হাতে লাল আর সবুজ নিশান, মুখে বাঁশি, সাদা ধবধবে প্যান্ট, কোট, পিতলের বোতাম লাগানো, পকেটে ঢাকনা, মাথায় চকচকে বারান্দাওয়ালা টুপি। ফুরুর্র্ করে গার্ড বাঁশিতে ফুঁ না দিলে ড্রাইভারের কোনো ক্ষমতাই নেই গাড়ি চালায়—তার কাছে ইঞ্জিন থাকলে কী হবে? সারা দিন তাকে তার ইঞ্জিনসুদ্ধ স্টেশনে ঠায় বসিয়ে রাখতে পারে গার্ড। আবার চলতে চলতে যদি লাল নিশান দেখায় তবে থামাতে হবে গাড়ি। গার্ডের চাকরি কি সোজা!

হঠাৎ মন খারাপ হয়ে যায় আনুর। বড় হতে এখনো কত দেরি। গার্ড হতে তার দশ-বিশ বছর লেগে যাবে। তত দিন তো আর কিছু করার উপায় নেই। তত দিন চুপ করেই থাকতে হবে আর সহ্য করতে হবে ওদের ঠাট্টা, হাসি।

বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে আনু রাস্তায় দাঁড়ায়। দাঁড়িয়ে থেকে মানুষ দেখে। দেখে, গরুর গাড়ি ক্যাঁঁচোর ক্যাঁচোর করতে করতে বাজারের দিকে চলেছে। আবার উল্টো দিকে ট্রেন ধরার জন্য উলিপুরের বাসটা ঝরঝর করে ছুটে চলেছে স্টেশনের দিকে। তাহলে তো এখন নয়টা বাজে! নয়টার সময় রোজ উলিপুরের বাসটা প্যাসেঞ্জার নিয়ে তাদের বাসার সামনে দিয়ে যায়।

তাড়াতাড়ি বাসার ভেতরে আসে আনু। কিন্তু আর রান্নাঘরে গিয়ে মাকে তাগাদা করতে সাহস হয় না তার। কেমন লজ্জাও করে। অথচ তার কী ভীষণ ইচ্ছে করছে এখনই এক ছুটে সে স্কুলে গিয়ে বসে।

নিজের ছোট্ট স্যুটকেসটা খুলে ধোয়া প্যান্ট আর নতুন জামাটা বের করে আনু। জামাটা গেল সপ্তায় কিনে দিয়েছিলেন বাবা। নীল সরু ডোরাকাটা টেনিস কফ শার্ট। কলারে এখনো কাগজের লেবেল সুতো দিয়ে ঢাকা। লেবেলটা ছিঁড়ে ফেলে আনু শার্টটা গায়ে দিল। কাপড়ের নতুন গন্ধ ভুরভুর করে বের হচ্ছে। ভারি মিষ্টি লাগছে। আর ইস্তিরি করায় এত মসৃণ লাগছে যে হাতের তেলো পিছলে যেতে চায়।

এমন সময় বড় আপা ডাকলেন, ‘আনু, ও আনু, খাবি আয়।’

মা আজ ফেনা ফেনা ভাত রেঁধেছেন। আনুর জন্য আলমারি থেকে বের করেছেন ফুলতোলা কাচের প্লেট। আনুর আজ খাতির আলাদা। আজ সে স্কুলে যাবে। প্লেটে ভাত বেড়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভাতের মিষ্টি গন্ধে আর ধোঁয়ায় ভরে গেল তার মুখ। বড় আপা চামচে করে ঘি এনে ছড়িয়ে দিলেন ভাতের ওপর। মা শিল-আলুর ভর্তা করেছেন, এক দলা পাতে দিলেন তার। গরমে হাত দেওয়া যাচ্ছে না। মা এক হাতে আঁচল দিয়ে বাতাস করতে লাগলেন। আনু ফুঁ দিয়ে দিয়ে মাখাতে লাগল আলুর সঙ্গে ভাত। এক গ্রাস মুখে তুলল। মধুর মতো লাগল।

বড় আপা বললেন, ‘আস্তে খা আনু। এখনো দেরি আছে। পেট ভরে খাবি।’

‘দূর!’ আনু আস্তে বলে। খেতে বসে দেখে তার বিশেষ খিদে নেই। আর গলার কাছে কেমন সব আটকে যাচ্ছে।

‘পেট ভরে না খেলে দেখবি হেডমাস্টারের সামনে গিয়ে সব হজম হয়ে গেছে ভয়ে।’

‘যাহ্, আমার ভয় করে না।’

‘পড়া ধরবে যে। পারবি?’

‘ধরুক না। যা ইচ্ছে ধরুক, আমি সব উত্তর দিয়ে দিব।’

মা খুশি হয়ে একবার আনুর দিকে, একবার মেয়ের দিকে তাকান। বলেন, ‘না, আনু আমার পড়ায় কত ভালো।’

বড় আপা পাবদা মাছের ঝোল বেড়ে দিলেন কাঁসার বাটিতে। নিজের হাতে তুলে দিলেন আনুর পাতে। কুচি কুচি করে কাটা পিঁয়াজ দিয়ে রাঁধা সোনার মতো হলুদ রং হয়েছে। ঝাল-ঝাল গন্ধ বের হচ্ছে। জিভেয় পানি এসে যাচ্ছে তার। আনু ঢকঢক করে এক গ্লাস পানি খেল।

বাইরে তখন বাবার গলা শোনা গেল। বাবা সেই সকালে অফিসে গিয়েছিলেন। দশটার সময় আনুকে নিতে আসবেন বলেছেন। সেই এসেছেন।

বড় আপা তাড়াতাড়ি বাইরে গিয়ে বললেন, ‘আনু খেতে বসেছে বাবা।’

বাবার গলা শুনতে পায় আনু। ‘তাড়াতাড়ি করতে বল। ওকে স্কুলে দিয়ে আমি আবার অফিসে যাব।’

বাবার গলা শুনে আর এক মুঠো ভাতও যেন গলা গিয়ে নামতে চায় না আনুর। বুকটা ধুঁক ধুঁক করে ওঠে। কী এক চিৎকার করে ওঠেন, ‘ও কী! তোর খাওয়া হয়ে গেল?’

‘আর খাব না।’ বলতে বলতে আনু উঠে দাঁড়ায়। বেরিয়ে এসে দেখে, বাবা সাইকেল হাতে উঠানে দাঁড়িয়ে আছে তার জন্য।

আনু এক দৌড়ে ঘরের ভেতরে গিয়ে মুখ মোছে, খাতা আর ইংরেজি, বাংলা বই নেয়, চট করে একবার আয়নায় মুখ দেখে, তারপর বেরিয়ে আসে। বাবা বলেন, ‘বাহ্, জামাটা আনুর গায়ে খুব মানিয়েছে তো! ভাত খেয়েছিস?’

‘হ্যাঁ।’

‘মাকে সালাম করলি না?’

আনুর লজ্জা করে এখন। ধ্যাৎ! স্কুলে ভর্তি হতে গেলেই বুঝি মাকে সালাম করতে হবে! মহা সংকটে পড়ে সে দাঁড়িয়ে থাকে চুপ করে।

তখন লজ্জা থেকে মা-ই আনুকে বাঁচিয়ে দেন। ঘোমটা টেনে কাছে এসে আনুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন, ‘ভালো করে লেখাপড়া কোরো। কারও সঙ্গে মারামারি কোরো না, কেমন?’

আনু মাথা নেড়ে নীরবে সায় দিয়ে বাবার পেছনে বেরিয়ে আসে। সাইকেলের সামনে উঠে বসে এক লাফে। বাবা সাইকেল চালাতে থাকেন। আনু একবার পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখে, দরজা ধরে মা আর বড় আপা দাঁড়িয়ে আছেন।

দুটো টানা লম্বা ঘর। ব্যস, এই হচ্ছে স্কুল। মহিমপুর বয়েজ মাইনর স্কুল। সামনে সবুজ ঘাসে ভরা বিরাট মাঠ, আর দুই দিকে দুটো গোলপোস্ট রোদে-বৃষ্টিতে ভিজে-পুড়ে কেমন কালো আর এবড়োখেবড়ো হয়ে গেছে। স্কুলঘরের মাথার ওপর জামরুল, আমলকী আর লিচুগাছের বড় বড় ডাল নেমে এসেছে রাশি রাশি পাতাপত্তর নিয়ে। ছাদ একেবারে ছেয়ে গেছে ডালে—টিনগুলোয় সবুজ স্যাতলা পড়ে গেছে। আনু হাঁ করে তাকিয়ে দেখে—এই ইশকুল!

ক্লাস বসে গেছে। বড় বড় জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে ছেলেদের সার সার মাথা। কেউ নিচু হয়ে বই দেখছে, লিখছে, কেউ সামনে তাকিয়ে আছে, আবার কেউ ফিসফিস করে কথা বলছে লুকিয়ে লুকিয়ে।

মাঠের ওপর বসে বাবা নেমে পড়লেন সাইকেল থেকে। আনুও নামল। বাবা বললেন, ‘অঙ্ক-টঙ্ক সব ভালো করে মনে করে এসেছিস তো?’

বুকের মধ্যে ঢিব ঢিব করে ওঠে আনুর। ঘাড় কাত করে জানায়

—হ্যাঁ। বাবা সাইকেলটা বারান্দায় ঠেস দিয়ে রাখেন।

আগে বাবা ঢোকেন হেডমাস্টারের ঘরে। আনু মাথা নিচু করে তাঁর পেছনে পেছনে আসে। দরজার ভেতরে পা দিয়েই এক হাত তুলে সালাম করে সে ভীত চোখ তুলে, তারপর কাঠের মতো দাঁড়িয়ে থাকে।

মাথায় টাক, গাল তোবড়ানো, জ্বলজ্বলে একজোড়া চোখ আর গায়ে ছাইরঙা চাপকান—এ ছাড়া হেডমাস্টারের আর কিছুই চোখে পড়েনি আনুর। দেখেই কেমন ভয় করে। মনে হয়, এখনই ধমক লাগাবেন। কেমন গম্ভীর আর রেগে টং হয়ে আছেন যেন।

আনু ভয়ে ভয়ে আবার চোখ তোলে। দেয়ালে পৃথিবীর ম্যাপ ঝোলানো। আলমারিতে খাতাপত্র-বই সার সার সাজানো। ময়লা কাচের ভেতর দিয়েও দেখা যাচ্ছে। আবার দুটো কাচ ভাঙা, সেখানে পিচবোর্ড কেটে লাগিয়ে দেওয়া। একদিকে একটা লম্বা টেবিলের চারদিকে কয়েকটা হাতাওয়ালা চেয়ার। টেবিলের ওপর চক-ন্যাকড়া আর একগোছা বেত রাখা। আমলকীর ডাল ভেঙে একটা বেত করা হয়েছে। লিকলিক করছে। ইশ্, এইটে দিয়ে মারে নাকি! যা লাগবে!

হেডমাস্টারের ভারী গলার আওয়াজ শুনে চমকেই উঠেছিল আনু। ‘কাম হিয়ার, মাই বয়।’

এক পা এক পা করে টেবিলের কাছে এসে দাঁড়াল আনু। একবার তাকিয়ে দেখল বাবা হাসিমুখে তাকিয়ে আছেন তার দিকে। বাবা হেডমাস্টারকে কী বলতে লাগলেন তার এক বর্ণও কানে গেল না আনুর। সে ঘামতে লাগল। বাব্বা, ইংরেজিতে পড়া ধরবে নাকি?

হেডমাস্টার আস্তে আস্তে থেমে থেমে জিজ্ঞেস করলেন,

‘হোয়াট ইজ ইওর নেম?’

‘মাই নেম ইজ আনোয়ার হোসেন।’

‘হোয়াট ইজ ইওর ফাদারস নেম?’

‘মাই ফাদারস নেম ইজ মৌলবি গোলাম হোসেন।’

‘ভেরি গুড।’

আনুর ভেতরটা যেন হঠাৎ হালকা হয়ে গেল। না, সে একটিও ভুল করেনি। বাবা বললেন, ওকে আমি নিজেই পড়াই দুই বেলা। হঠাৎ বদলি হয়ে এলাম এখানে। এখন ভর্তি না হলে স্কুলে যাওয়ার অভ্যেসটাই ছুটে যাবে। ওখানে ফোরে পড়ত।

হেডমাস্টার হঠাৎ আনুকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এক মণ চালের দাম ৩৫ টাকা হলে আট সেরের দাম কত?’

আনু বিড়বিড় করে হিসাব করতে লাগল মনে মনে। কী যে নিয়মটা ছিল, কিছুতেই মনে পড়তে চাইছে না তার। ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল, পিপাসা পেয়ে গেল খুব, তবুও মনে পড়ল না। মাথা নিচু করে সে দাঁড়িয়ে রইল। বাবার দিকে একবার তাকাল। বাবাও তাকিয়ে আছেন তার দিকে।

হেডমাস্টার আবারও জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী এক মণ চালের দাম ৩৫ টাকা হলে আট সেরের দাম কত হয়?’

কিছুতেই অঙ্কটা না পেরে পা দিয়ে মেঝে খুঁটতে লাগল আনু। বাবা হেসে বললেন, ‘অঙ্কে ও বরাবরই একটু কাঁচা।’ তারপর আনুকে বললেন, ‘কিরে আনু? ৩৫ টাকা মণ—এক সেরের দাম কত হয়? —তাকে আট দিয়ে গুণ দিলেই বেরিয়ে আসবে।’

‘এক সেরের দাম?’ আনু ঢোক গিলে বলে।

‘হ্যাঁ।’

‘আচ্ছা, থাক।’ হেডমাস্টারই বাঁচিয়ে দিলেন তাকে। বললেন, ‘এই কবিতাটা পড়ো দেখি।’

আনুকে একটা বই খুলে দিলেন তিনি। আনু অঙ্কের হাত থেকে বেঁচে গিয়ে অঙ্ক না পারার লজ্জা ঢাকার জন্য খুবই মন দিয়ে পড়তে লাগল জোরে জোরে—

‘ধনধান্য পুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা

তাহার মাঝে আছে দেশ এক সকল দেশের সেরা

ও সে স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সে যে স্মৃতি দিয়ে ঘেরা\

এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি।

সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি\

চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা কোথায় উজল এমন ধারা

কোথায় এমন খেলে তড়িৎ এমন কালো মেঘে

তারা পাখির ডাকে ঘুমিয়ে পড়ে পাখির ডাকে জাগে\

এমন স্নিগ্ধ নদী কাহার কোথায় এমন ধূম্র পাহাড়

কোথায় এমন হরিৎ-ক্ষেত্র আকাশ তলে মেশে

এমন ধানের ওপর ঢেউ খেলে যায় বাতাস কাহার দেশে\’

হেডমাস্টার হাত তুলে বললেন, ‘থাক থাক।’

আনু তাকিয়ে দেখে বাবা খুব খুশি হয়েছেন! আনু অবাক হয়ে দেখে, বাবার চোখে পানি এসে গিয়েছে। চকচক করছে। বড় দেখাচ্ছে তার চোখের কালো তারা। আনু তখন বিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, বইটা মুড়ে বুকের কাছে ধরে।

‘হরিৎ-ক্ষেত্র মানে কী? হেডমাস্টার আবার জিজ্ঞেস করলেন।

‘হরিৎ-ক্ষেত্র?’

আনু আবার অস্বস্তিবোধ করতে থাকে।‘হরিৎ’-এর অর্থ তার জানা নেই। মনে মনে কবিতার লাইনটি আওড়ায়। আকাশ তলে মেশে-কী? কী মিশতে পারে? ‘ক্ষেত্র’ মানে মাঠ। ‘হরিৎ-ক্ষেত্র’ তাহলে কী? হঠাৎ তার মনে পড়ে যায় পরের লাইনে ধানের কথা আছে। সে তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, ‘হরিৎ-ক্ষেত্র মানে ধানের খেত।’

সঙ্গে সঙ্গে বাবার মুখের হাসিটা নিভে যায়। আনু বুঝতে পারে, অর্থটা সে ঠিক বলতে পারেনি। সে মাথা নিচু করে নেয়।

হেডমাস্টার আশ্বাস দেন তাকে। বলেন, ‘তুমি খানিকটা ঠিক বলেছ। হরিৎ মানে সবুজ, শ্যাম। ধানের খেতও সবুজ। তবে হরিৎ-ক্ষেত্র মানে সবুজ মাঠ। যখনই কোনো নতুন শব্দ পাবে, আর দেখবে তার মানে জানো না, তখন বাবাকে বা স্কুলে মাস্টার সাহেবকে জিজ্ঞেস করো। জিজ্ঞেস করে মানেটা বারবার মুখস্থ করে রাখবে। বুঝলে?’

‘জি।’

‘আর বানানটা খাতায় দশবার করে লিখে শিখে রাখবে।’

আনু ঘাড় কাত করে সায় দেয়। হেডমাস্টার বইটা ফেরত নেয়। বাবাকে তিনি বলেন, ‘আচ্ছা। আনোয়ার হোসেন এখন ফোরেই ক্লাস করতে থাকুক। পরে দেখা যাবে কী হয়। এমনিতে বেশ চটপটে মনে হচ্ছে।’

আনু বুঝতে পারে তার প্রশংসা হচ্ছে। তার লজ্জা হয়, অঙ্কটা পারা উচিত ছিল। হঠাৎ অঙ্কের নিয়মটা মনে পড়ে যায়। আরে তাই তো। ৩৫ টাকা মণ হলে এক সেরের দাম হয় চৌদ্দ আনা—আট সেরের দাম সাত টাকা। কিন্তু উত্তরটা সে বলতে পারে না। সংকোচ হয়। ঘন ঘন চারদিকে তাকায় সে। বলবে? না, থাক ইশ্, তখন মনেই পড়ছিল না। বাবা খামোখাই বলেন, অঙ্কে সে কাঁচা। বাসায় গিয়ে বলবে বাবাকে, আট সেরের দাম সাত টাকা।

হঠাৎ হেডমাস্টার চিৎকার করে ডাক দেন। ‘বিল্টু, বিল্টু।’

কিছুক্ষণের মধ্যেই স্কুলের দারোয়ান এসে ঘরের মধ্যে দাঁড়ায়। আনুর হাসি পায় খুব। দারোয়ানের নাম বিল্টু নাকি? ভারি মজার তো!

হেডমাস্টার বিল্টুকে বলেন, ‘একে ক্লাস ফোরে নিয়ে বসিয়ে দাওগে।’

বাবাকে ছেড়ে যেতে ভারি মন খারাপ হয়ে যায় আনুর। বাবা উঠে দাঁড়ান। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘ছুটির পরে একা আসতে পারবি বাসায়? না, ইয়াসিনকে পাঠিয়ে দেব?’

আনু প্রবল বেগে মাথা নাড়ে। না, সে একাই যেতে পারবে।

বিল্টু, বড় বড় পা ফেলে ক্লাসঘরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আনু তাল মিলিয়ে চলতে পারে না। কিছু দূর গিয়ে পেছন ফিরে দেখে, বাবা তখনো দাঁড়িয়ে আছেন। ঠিক মা আর বড় আপা বাসার দরজায় যেমন দাঁড়িয়ে ছিলেন। বাবার চোখ ভারি উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। আনুর দুঃখ হয়, মাকে আসার সময় সালাম করে এলেই পারত সে। আনু মনে মনে যেন মায়ের কথার উত্তর দেয়—মা, আমি মন দিয়ে পড়ব। কারও সঙ্গে মারামারি করব না।

আনু ক্লাসের দরজায় পা দিয়ে আবার পেছন ফিরে দেখে, বাবা হাসছেন।

তখন আনুও হাসে।

বিল্টু তাকে ক্লাস মাস্টারের কাছে নিয়ে দাঁড় করিয়ে দেয়।