পেশটিজ
‘ভাই, রসুনের বদলে পেঁয়াজ দিলে হবে না? রসুনের যা দাম। বাসায় একটাও নাই। কয়েকটা পেঁয়াজ আছে। ওইগুলা দিলে হবে?’
প্রশ্নটা আমার। কাতর জিজ্ঞাসু চোখে আমি তাকিয়ে আছি আমার বড় ভাই রনির দিকে। ওকে আমরা ডাকি রণভাই। মুন্নি আপাকে যেমন ডাকি মুনপা। আমাদের সবার ছোট সজীব আমাকে ডাকে রাজভা।
তো রণভাই একই সঙ্গে নানা বিষয়ে আমার গুরুও। এক বছর আমরা একই স্কুলে পড়েছি, ও ফাইভে আমি টুয়ে। স্কুলে সে-ই আমাকে নিয়ে যেত। ওর দায়িত্ব ছিল আমাকে ঠিকভাবে স্কুলে নিয়ে যাওয়া, আবার বাসায় ফিরিয়ে নিয়ে আসা।
দ্বিতীয় দায়িত্বটা নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছে ও। প্রথমটির ব্যাপারে নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছি না।
কারণ, স্কুলের উদ্দেশে বের হলে স্কুলেই যেতে হবে, এ রকম কোনো নিয়ম যে নেই, এটা প্রথম তার কাছে জেনেছি। বিশ্বজোড়া পাঠশালা ছিল ওর। যেমন ওর ব্যাগে ছিল ১০টা মারবেল। স্কুলে না গিয়ে শ্যামাসুন্দরী খালের পাশের জঙ্গলে আরও কয়েকজনের সঙ্গে খেলে ৫টা মারবেল জিতল ও। কত হলো? ১৫টা। কিপ্টা বুড়ার আতাগাছে ২০টা আতা ছিল। ও গাছে টপাটপ উঠে পেড়ে ফেলল ১৮টা আতা। থাকল কয়টা? একেবারেই কাঁচা, খাওয়াই যাবে না এমন দুইটা আতা।
কত সহজেই কত কিছু শেখা যায়, তা-ই না? স্কুলে কেন যেতে হবে?
পিঠাপিঠি দুই ভাই হলেও আমাদের চরিত্র একেবারেই ভিন্ন রকম। ও বরাবরই সাহসী, অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়। তাই স্কুল ফাঁকি দেয়। আমি ভিতু এবং সিরিয়াস টাইপ ছাত্র।
রণভাই আমার সঙ্গে এরপর আর কখনো পড়েনি। তবে কখনো কখনো পরীক্ষার রেজাল্টশিটে আব্বার সিগনেচার লাগলে ওর দ্বারস্থ হতে হয়েছে। আব্বার সিগনেচারটা ও খুবই ভালো দিতে পারত। আব্বার চেয়েও ভালো!
রণভাই আসলে স্কুল ছেড়েছিল কিছুদিনের মধ্যেই। আমরা চার ভাইবোনের মধ্যে কেবল আমিই পড়াশোনা করতাম। বাকিরা কেউ স্কুলে যেত না। আব্বা কী একটা দুর্ঘটনায় পড়ে ব্যবসায় প্রচুর টাকা লস করে ফেললেন। সবার পড়ানোর খরচ আব্বার নেই। বাড়িভাড়া বাকি, অনেক দিন সকালে নাশতাও জোটে না; আর স্কুল!
ভাইবোনদের মধ্যে আমি যেহেতু কিছুটা ভালো ছাত্র হিসেবে পরিচিত, ঠিক করা হলো, আমিই পড়ব আপাতত। বাকিদের স্কুলে যেতে হবে না।
গরিব হয়ে যাওয়ার এই একটা অসাধারণ সুবিধা দ্রুত আবিষ্কার করে ফেলল রণভাই। গরিব হয়ে গেলে আর স্কুলে যেতে হয় না!
তবে গরিব হওয়ায় সুবিধার চেয়ে অসুবিধাই বেশি। আমরা দুজনই অন্তত একটা কারণে বড়লোক হতে চাইতাম। রংপুরে দুইটা বাড়ি থাকবে আমাদের। দুইটা বাড়ি থাকলে বেশি বেশি ঘুড়ি এসে পড়বে আমাদের বাড়িতে। শ্যালো মার্কেটের পেছনের ভাড়া বাসাটায় আমাদের একটা বড় লম্বা গাছ ছিল। যেটায় প্রায় দিনই আটকে যেত ভোকাট্টা ঘুড়ি।
মাসে অন্তত ১০টা ঘুড়ি তো হবেই। দুটো বাড়ি থাকলে মাসে ২০টা করে ঘুড়ি থাকত আমাদের কাছে।
এই সহজ হিসাব বুঝিয়ে দিয়ে রণভাই আমাকে এ-ও বলেছিল, পড়াশোনা করতে স্কুলে যেতেই হবে, এমন কোনো কথা নেই!
ফলে গরিব হয়ে যাওয়া নিয়ে সে রকম কোনো মনোবেদনা নেই ওর। শুধু বছরে বিশেষ একটা সময়ে এ নিয়ে তাকে হা-হুতাশ করতে দেখা যায়। তত দিনে সে আরেকটু বড় হয়ে গেছে। আদর্শ স্কুলে ঠিকমতো বেতনটা দিতে পারলে এত দিনে ও হয়তো নাইনে পড়ত। আমি রংপুর জিলা স্কুলে সিক্সে উঠে গেছি।
এই বয়সটাতেই বোধ হয় ছেলেদের মধ্যে মান-সম্মানবোধ প্রবল হতে শুরু করে। আমরা অবশ্য ব্যাপারটাকে তখন বলতাম ‘পেসটিজ’।
তো এখন এই প্রেসটিজ নিয়েই আমরা দুজন বিশেষ চিন্তিত। এ কারণেই আমার রসুনের সন্ধান করা।
নিয়মিত ছাত্র থাকার সময় অদ্ভুত উপায়ে প্রায় দিনই শরীরে জ্বর বাধিয়ে ফেলতে পারত রণভাই। এ ছিল তার প্রায় অলৌকিক এক ক্ষমতা। ইচ্ছাজ্বর যেন। চাইলেই জ্বর হয়ে যায়। তখন স্কুলে যেতে হয় না।
স্কুল এড়ানোর সেই ঝামেলা থেকে পুরোপুরি মুক্ত হলেও ইচ্ছাজ্বর ক্ষমতা সে ত্যাগ করেনি। এটা আসলে বিশেষ এক টেকনিক। রসুন থেঁতলে নিয়ে সেগুলো বগলের তলায় রেখে দিলে নাকি কিছুক্ষণের মধ্যে জ্বর আসে। আগামীকাল আমাদের দুজনেরই জ্বর নিয়ে আসা জরুরি। প্রেসটিজ বাঁচানোর এই একটা উপায়ই আমাদের হাতে আছে।
আমি রান্নাঘরে তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি। রসুন নেই। রসুন আমাদের রান্নাঘরে থাকে না। যেসব জিনিস রান্না করতে রসুন খুব লাগে, যেমন মাছ-মাংস; সেসবের সুবাস ছড়ায় না আমাদের রান্নাঘর থেকে। তবে পেঁয়াজ আছে। পেঁয়াজ ছাড়া রান্না আসলেই অসম্ভব। নাহলে পেঁয়াজও হয়তো থাকত না।
আমি প্রমাণ সাইজের দুটো পেঁয়াজ নিয়ে এসেছি। আমার একটাই প্রশ্ন, রসুনের বদলে থেঁতলানো পেঁয়াজ বগলের তলায় রেখে দিলে কি জ্বর আসে?
না, এটা স্কুল এড়ানো-সংক্রান্ত ঝামেলা নয়। স্কুল বন্ধ হয়েছে বেশ কিছুদিন হলো। রমজান মাসটা এই জন্য আমাদের কাছে বড় ভালো লাগত। অনেক দিন স্কুলে যেতে হয় না। আমাকে নিয়ে রণভাই রংপুরের বিভিন্ন মসজিদে যেত। কোন কোন মসজিদে ভালো ইফতার হয়, এটা ওর চেয়ে ভালো জানত খুব কম লোকই।
রমজানের একটা মাস অবশ্য পার হয়ে যেত দ্রুতই। আসত চাঁদরাত। সেই রাতটা আমাদের জন্য ছিল বিরাট হাসির। তবে রামসন্যা না কে যেন বলে গেছেন, হাসির পরে কান্না!
সেই হাসির অংশটা পেরিয়ে আমরা দুই ভাই এখন কান্নার অংশটায় ঢুকতে যাচ্ছি। দুটো রসুন পাওয়া গেলে অবশ্য এই বিপদ থেকে কিছুটা মুক্তি পাওয়া যেত!
রণভাই বলল, ‘নাহ, পেঁয়াজ দিয়া হবে না রে। তুই এক কাজ কর। পাপ্পুর বাড়িত যা। যায়া বল, আমি রসুন চাইছি।’
রণভাই আমাকে কিছু করতে বলেছে আর আমি করিনি, এমনটা হয়নি। আমি পাপ্পু ভাইদের বাসার দিকে রওনা দিলাম। দুটো বাসা পরেই থাকেন পাপ্পু ভাইয়েরা। পাপ্পু ভাই আমাদের পাড়ার সবচেয়ে জ্ঞানী মানুষ। বিশেষ জ্ঞানী, মানে বিজ্ঞানী।
এবারের চাঁদরাতের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ‘টাইম বোমা’ জিনিসটা তিনিই আবিষ্কার করেছেন। ঈদের চাঁদ দেখা গেলে আমরা বুড়িমার পটকা ফাটাতাম। চকলেটের মতো রাংতা কাগজে মোড়ানো থাকত বলে ওটার আরেকটা নাম ছিল চকলেট বোম। ছোট্ট একটা সলতে থাকত। সলতের মাথায় আগুন লাগিয়ে হয় হাত দিয়ে ছুড়ে মারতে হতো শূন্যে, নয়তো কোথাও রেখে পালিয়ে যেতে হতো। ৫ সেকেন্ডের মধ্যে ফটাস করে ফুটত বোমাটা। মাত্র ৫ সেকেন্ড, কী এক রোমাঞ্চ!
পাপ্পু ভাই আবিষ্কার করলেন, এই ৫ সেকেন্ড ব্যাপারটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। মশার কয়েল টুকরো টুকরো করে ভাঙতে হবে নানা সাইজে। কোন সাইজের টুকরা কত মিনিট ধরে জ্বলে তা নিজে মেপে বের করেছেন পাপ্পু ভাই। সেই কয়েলের টুকরার এক এক মাথায় চকলেট বোমার সলতে লাগিয়ে দিতে হবে। কয়েল পুড়তে পুড়তে সেই জায়গায় গেলে সলতেয় আগুন ধরে যাবে। তখনই ফাটবে চকলেট বোমটা।
এই বোমার সুবিধা হলো, পাড়ায় আমাদের যারা সব সময় দৌড়ের ওপর রাখতেন, যেমন কিপ্টা বুড়া, এঁদের জব্দ করা যাবে বেশ। তাঁরা টেরও পাবেন না কাজটা কার।
কিপ্টা বুড়ার নিজস্ব চলাচলের জন্য একটা রিকশা ছিল। চাঁদরাতে তিনি নিজে বের হন লাচ্ছা-সেমাইয়ের বাজার-সদাই করতে। আমরা সেই রিকশায় চোখে পড়ে না এমন জায়গায় তিনটা চকলেট বোম ফিট করেছি।
চকলেট বোমের সুবিধা হলো, এতে শুধু শব্দ হয়, আর কোনো ক্ষতি হয় না। মানুষকে ভয় দেখানোই আমাদের উদ্দেশ্য, শারীরিক আঘাত নয়। তা-ও সবাইকে না। পাষাণ হূদয়ের সেই সব মানুষ, যারা আমাদের নানা সময়ে ভুগিয়েছে, তাদের। কিপ্টা বুড়ার বাড়িতে যতবার আমাদের বল পড়েছে, ততবার সেগুলো কেটে ফেলা হয়েছে বঁটি দিয়ে।
নাহলে হয়তো বাংলাদেশ জাতীয় দলের পেসার হতে পারতেন আমাদের পাপ্পু ভাই। পেসারের বদলে শেষ পর্যন্ত হয়েছেন প্রেশার মাপা ডাক্তার। যাঁর কারণে এই দুর্গতি, তাঁদের ওপর কিশোরসমাজ প্রতিশোধ তো নেবেই।
তবে এটাও সত্যি, অন্যের জন্য খাল কাটলে সেই খালে নিজেকেও পড়তে হয়। সেই রাতেই এমন শিক্ষা হয়েছিল আমাদের। আশপাশে টাইম বোমা সেট করে আমরা বিনিময় স্টোরের টঙের ওপর বসে আড্ডা দিচ্ছি। আর ঘড়ি দেখছি। একটার পর একটা চকলেট বোম ফুটছে অবিশ্বাস্য সব জায়গা থেকে।
রাশেদ চাচার পানের কৌটার মধ্যে কে জানি সেট করে রেখেছিল একটা। পাঞ্জাবির পকেটে ফটাস করে ফুটল। ধপাস করে পড়েই গেলেন রাশেদ চাচা।
ভালোই হয়েছে। সেদিন তাঁর বাসায় পড়া ভোকাট্টা ঘুড়িটা আনতে গিয়েছে বলে কী মারটাই না মারলেন আমাদের আজহার ভাইকে। একবারও ভাবলেন না, এ তো পাড়ার ছোট ছেলে। ঘুড়ি আনতে ঢুকেছে, চুরি করতে ঢোকেনি। এখনো কালসিটে পড়ে আছে আজহার ভাইয়ের গালে, হাতে। উচিত শিক্ষা হয়েছে রাশেদ চাচার। উনি বাবা রে, মা রে বলে পাগলের মতো দৌড়াচ্ছেন।
আর আমরা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছি। হাসিতে আমাদের পেটে বোমা পড়ার দশা, এখনই ফেটে যাবে যাবে অবস্থা। হঠাত্ দড়াম-ফটাস!
টং থেকে ঠং করে ছিটকে পড়ে গেলাম আমরা সবাই। ভুলেই গিয়েছিলাম, বিনিময় স্টোর সেবার আমাদের বাকিতে ব্যাডমিন্টন খেলার কর্ক দেয়নি বলে এখানেই প্রথমে তিন তিনটি টাইম বোম সেট করা ছিল। আর সেখানেই কি না এসে বসেছি আমরা!
সেগুলোই ফুটেছে একসঙ্গে। অন্যের জন্য কাটা খালে নিজেরাই পড়ে নিজেদের দুর্দশায় হাসলাম কিছুক্ষণ। আমাদের শৈশবে বোমা ব্যাপারটা হাসি-তামাশারই ছিল। আর এখন সেটি হয়ে গেছে মানুষ মারার ব্যাপার-স্যাপার!
আমাদের শৈশবে ঈদ ব্যাপারটাও ছিল অন্য রকম আনন্দের। তবে ঈদের কষ্টকর দিকটা এখনো অনেকের কাছে বোধ হয় একই রকম আছে। যেমন যাদের বাবা-মা নতুন জামা কিনে দিতে পারে না।
বন্ধুবান্ধবের সবার পরনে থাকে নতুন জামা। যে ঈদে নতুন জামা পায় না, তার জন্য কষ্টটা দ্বিগুণ। একে তো জামা পায়নি, তার ওপর জামা পায়নি সেই লজ্জায় বাসায় লুকিয়ে থাকতে হয়, বন্ধুদের সঙ্গে ঘোরাঘুরি করা যায় না। নতুন জামার ভিড়ে পুরোনো জামাটা যে বেশি করে চোখে লাগে। অনেকে প্রশ্ন করে, তোমার নতুন জামা কই? আজকেও এমন ময়লা, রং জ্বলে যাওয়া জামা পরে বের হয়েছে কেন?
মানুষ বিগ ব্যাংয়ের উত্তর পেয়ে গেছে, কিন্তু এর উত্তর আবিষ্কার আজও হয়নি। একটা কিশোর মনের অপমানবোধের ওপর এ যে কত বড় আঘাত, যে এই অভিজ্ঞতার ভেতরে পড়েনি, সে কিছুতেই বুঝতে পারবে না।
সেই প্রেশটিজ সংকটে পড়েই আমি আর রণভাই এখন বুদ্ধি খুঁজছি কী করা যায়। পাপ্পু ভাইদের বাসা থেকে খালি হাতে ফিরেছি। তাঁদের রসুন নিশ্চয়ই আছে, তবে বাসায় পাপ্পু ভাইয়েরা কেউ নেই। শেষ মুহূর্তের কেনাকাটা করতে মার্কেটে গেছে। ঈদের চাঁদরাতে রংপুরের মার্কেটগুলোতে সে কী যে উপচে পড়া ভিড়! পুরো শহরটাই যেন ছুটে আসে মার্কেটে।
না, পুরো শহরটা আসে না। সেই সৌভাগ্য হয় না শহরের কিছু হতভাগ্য মানুষের। ঈদের নতুন জামা-জুতা লুকিয়ে রাখা, চুপিচুপি বের করে দেখা জামার রংটা, ডিজাইনটা। প্যাকেটের ভেতর থেকেই নতুন জামার ঘ্রাণ নিয়ে আবার সেটি লুকিয়ে রাখা...এই রোমাঞ্চ অনুভব করার সৌভাগ্য আসলেই অনেকের হয় না।
চাঁদরাতের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তারা আশায় থাকে, যদি কিছু একটা ঘটে! যদি শেষ পর্যন্ত মার্কেটে যাওয়া হয়! সেই চাপা সম্ভাবনার বুক জ্বলুনি অপেক্ষা নিয়ে জাগতে জাগতে তারা ঘুমিয়ে পড়ে। কেউ জানে না, কেন তাদের বালিশের একটা পাশ ভিজে থাকে এভাবে।
সকালে ঈদের নামাজ শেষে কোলাকুলির আগেই তারা দ্রুত বাড়িতে ঢোকে। রসুন খোঁজে। জ্বর আনতে পারলে যে বন্ধুদের বলা যাবে, ‘আজ ঘুরতে পারব না রে। জ্বর আসছে। তোরা ঘোরাঘুরি কর।’ বন্ধুরা আফসোস করবে, ‘ঈদের দিন জ্বর বাধাইলি, আর কাম পাইলি না গাধা।’ একটা বোকা বোকা এক্সপ্রেশন দিতে হয় তখন। গরিব হওয়ার বদৌলতে আরেকটা গুণ পাওয়া যায়—নিখুঁত অভিনয় করার ক্ষমতা।
রণভাই আর আমি অবশ্য ঘোরতর সংকটে আছি। কোনো অবস্থাতেই রসুন জোগাড় করতে পারিনি। জ্বর নিয়ে আসার উপায় নেই। রণভাই অবশ্য তার নিখুঁত অভিনয় ক্ষমতা দিয়ে পেটব্যথার ভান করে বিছানায় পড়ে আছে। আমি কী করব বুঝতে পারছি না। সব শঙ্কা সত্যি করে দিয়ে বাড়ির গেটে বন্ধুদের আওয়াজ পাচ্ছি। ওরা চলে এসেছে!
আমার বন্ধু আদনান, রকেট, অয়ন, রাহাত। রণভাইয়ের বন্ধু পাপ্পু ভাই, আজহার ভাই। এখনই ওরা জোরাজুরি করবে। একসঙ্গে ঘুরতে যেতে হবে। কী করে যাব, আমাদের যে...।
সবাই হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে পড়ল। মুনপা বলল, ‘তোমরা বসো। আমি লাচ্ছা-সেমাই দিতেছি।’
সবাই একসঙ্গে ‘না’ ‘না’ করে উঠল, ‘খাব না, আপু। বাসায় পেট ভরে খেয়ে মাত্র বাইর হইলাম। এখন আর একটুও পেটে ঢুকবে না।’
ভাগ্যিস ওরা ‘না’ বলল। এবার ঈদে আমাদের বাড়িতে সেমাইও রান্না হয়নি।
তখনই আমি খেয়াল করলাম ব্যাপারটা। কারও পরনে নতুন জামা নেই! সবাই পুরোনো জামা পরেই এসেছে! কেন এল? কেউ নতুন জামা পরল না কেন? আমি জানি, প্রত্যেকেই এবার নতুন জামা কিনেছে। না কেনার কোনো কারণই নেই। তবু কেন পুরোনো জামা পরে এল সবাই?
আমার ছোট মাথায় ব্যাপারটা ঢুকল না। তবে রণভাই বুদ্ধিমান। ও নিশ্চয়ই সব বুঝে গেল সব। কারণ, আমি দেখলাম, ওর পেটব্যথা সেরে গেছে। নিজের পুরোনো জামাটা পরে নিচ্ছে ও। এখন আর বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে সমস্যা হবে না। আমিও আমার পুরোনো গেঞ্জির মধ্যে যেটার চেহারা সবচেয়ে ভালো, সেটা পরে নিলাম। থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্টটাও। প্যান্টের বিশেষ জায়গায় একটা ফুটো আছে, ওঠা-বসার সময় সতর্ক থাকলেই হবে।
হইহই করে বের হলাম আমরা সবাই। কী একটা সাধারণ দুষ্টুমিতে সবাই হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়লাম।
কিপ্টা বুড়া তাঁর রিকশায় চেপে কোথায় যেন যাচ্ছেন। আমাদের পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় তাঁর চোখ রসগোল্লার মতো ইয়া বড় হয়ে গেল। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, তিনি বিস্মিত। ব্যাপার কী। এই বান্দরের দলের সবার গায়ে কেন পুরোনো জামা?
কিপ্টা বুড়ার মনটা উদার হলে দেখতে পেতেন, বিবর্ণ জামাতেই সেদিনের কিশোরের দলকে সবচেয়ে উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল!