‘স্যারের মেজাজ আজ কড়া। আপনি আরেক দিন আসুন। অনুগ্রহ করে আপনার পরবর্তী আসার দিন আমাকে বলুন। আমার নোট সিস্টেমে সব রেকর্ড থাকবে।’
আধুনিক ফ্ল্যাটের বড় ড্রয়িংরুমে আসবাব তেমন নেই। হালকা শব্দে ঘরময় ধীরলয়ে উচ্চাঙ্গসংগীত বাজছে। সাউন্ডবক্স দেখা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে গান গাচ্ছে পুরো ড্রয়িংরুমটাই। বসে থাকতে বরং ভালোই লাগছে মিলির। পিএইচডির খসড়া পেপারটায় এই ফাঁকে আরেকবার চোখ বুলিয়ে নিতে পারবে। সামনে সটান বসে থাকা বক্তার দিকে না তাকিয়েই বলল, ‘স্যার আসুক। আমি নাহয় অপেক্ষা করি।’
‘ঠিক আছে, আপনি অপেক্ষা করুন। আমি কি আপনার জন্য আরেক কাপ কফি আনব? তাহলে চিনির পরিমাণ বলুন। আপনি কি ব্ল্যাক কফি খাবেন?’
রোবটিক কথা শুনে অবাক হলো না মিলি। কারণ, তার সঙ্গে যে কথা বলছে সে একটা রোবট। প্রফেসর শশাঙ্ক ভট্টাচার্যের ব্যক্তিগত সহকারী রোবট পিন্টু।
এমন সুন্দর বাসায় বসে পিএইচডির পেপারে চোখ বোলাতে ইচ্ছা করে না। দেয়ালে অনেক পেইন্টিং আর দারুণ সব ভাস্কর্য। দেখতে দেখতে একটা ছবিতে চোখ আটকে গেল মিলির। প্রফেসরের পারিবারিক ফটোগ্রাফ। সে একবার ছবিটা দেখে, আরেকবার তাকায় রোবট পিন্টুর দিকে। এত মিল হয় কী করে!
‘ওটা স্যারের ছেলে পিন্টু। স্যার পিন্টুকে খুব ভালোবাসতেন। আমাকে যখন তৈরি করেন, তখন পিন্টু মারা যায়। বয়স ছিল ত্রিশের মতো। এরপর স্যার আমাকে তাঁর ছেলের মতো করে তৈরি করেন। তাই আমার নাম পিন্টু। আমার ভেতর অনুভূতি সেন্সর শূন্য দুই তিন পাঁচ এক ও নিউরাল নেটওয়ার্ক এআই সাত তিন দুই এবং আমার সিনথেটিক পলিমারের শরীরে ন্যানো রক্তকণিকা...।’
‘ঠিক আছে ঠিক আছে। বুঝতে পেরেছি।’
‘আপনি কি আপনার পরবর্তী শিডিউল আমাকে জানাবেন? নাকি অপেক্ষা করবেন?’
বিরক্ত হলো মিলি। রোবটের তো ভুলোমনা হওয়ার কথা নয়? নাকি এটাও তার প্রোগ্রামের অংশ। ইচ্ছা করে মাঝে মাঝে মানুষের মতো আচরণ করবে।
‘আমি তো বললাম অপেক্ষা করব।’
‘জি। আপনি বলেছেন একবার। আমি শুধু আপনাকে সঙ্গ দিতে চাচ্ছিলাম। আমি কথা বেশি বলতে পারি না। আমার মেমোরি এখনো পুরোপুরি তৈরি নয়। আমি কি কফি এনে দেব?’
‘আপনি গান জানেন?’
‘জি জানি। আপনি কোন গান শুনতে চান? আমার প্লে লিস্টে আছে হিপহপ, ডিসকো, ক্লাসিক্যাল...।’
‘নজরুলসংগীত জানেন? একটা শোনান দেখি?’
‘আজও মধুর বাঁশরী বাজে.. বা.. জে.. আজও মধুর বাঁশরী...।’
ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড অবাক হলো মিলি। খালি গলায় এমন নিখুঁত আর সুন্দর গলার গান সে জীবনেও শোনেনি। প্রফেসর শশাঙ্ককে সবাই এমনি এমনি পাগল বলে না। লোকটা আসলেই জিনিয়াস। কিন্তু দুই লাইন শোনার পর মিলির আর শুনতে ইচ্ছা করল না। এমন নিখুঁত গলার গান শুনতে সম্ভবত তার কান অভ্যস্ত নয়।
‘আচ্ছা থামুন। কফি নিয়ে আসুন। চিনি ছাড়া।’
পিন্টু রোবট বলেই হয়তো মিলির ঝাঁজাল গলা শুনেও হাসিমুখে উঠে গেল কফি আনতে।
কলবেল শুনে মিলি নিজেই দরজা খুলে দিল।
‘ও তুমি! গুড! বসো বসো। পিন্টু! পিন্টু!’
‘কফি বানাচ্ছে স্যার।’
‘পেপারটা এনেছ?’
‘জি স্যার।’
‘শোনো আমি তোমার মেইলও পড়েছি। তোমাদের মতো যারা চিন্তা করো, তাদের একটাই সমস্যা। একটা গোলাকার বলের ভেতরে থেকে সারফেসটা দেখতে চাও। কিন্তু ভেতরে থেকে তো আসলে বাইরের স্তরটা দেখা সম্ভব নয়। এখানেই গোলমাল। এই মহাবিশ্বের কাছে আমরা কি জানো? আমরা হলাম গিয়ে অর্গানিক রোবট। একটা মানুষের বাচ্চা যেভাবে বড় হয়, রোবটকেও সেভাবে করা সম্ভব। আমরাও একেকটা জৈবিক রোবট। যাক বাদ দাও। পেপারটা দাও। পড়ি।’
মিলির লেখায় খানিকটা চোখ বুলিয়ে আবার নিজের মতো করে বলতে লাগলেন, ‘আর হ্যাঁ, কোয়ান্টাম স্টেটটা কনসাস লেভেলের একটা অংশ হতে পারে। হিসাব করে দেখো, কোয়ান্টাম স্টেট আমরা যেটাকে বলি, আমরা আসলে সেটা বুঝতে পারি না। ওটা জড় বস্তুর বিভ্রান্তি। জীবন অন্য জিনিস। আই-কনসাসনেস আর ওটা এক নয়। তবে এটাও ঠিক যে আমরা আমাদের মতো করেই তো সব অনুভূতির ব্যাখ্যা দিয়ে আসছি। বলছি ওগুলো স্রেফ মগজে বৈদ্যুতিক প্রবাহ। বলা তো যায় না আবার যন্ত্রপাতির বৈদ্যুতিক প্রবাহটাও একই অনুভূতি তৈরি করতে পারে কি না।’
‘বাবা, আপনিও কি চা খাবেন?’
‘পিন্টু!’
‘দুঃখিত স্যার, আপনি কি চা খাবেন?’
‘না, আমাকেও কফি দাও।’
মিলি ঝটপট বলল, ‘স্যার, আপনি আমার কফিটা নিন। পিন্টু, আপনি বরং আমার জন্য আরেক কাপ।’
‘জি মিলি। আপনি বসুন। আমি কফি নিয়ে আসছি।’
পেপার পড়তে পড়তেই প্রফেসর শশাঙ্ক বললেন, ‘বাবা পিন্টু, আই অ্যাম সরি।’
‘ইটস ওকে স্যার। আমাকে সরি বলার দরকার নেই।’
মিলি কিছু বুঝতে পারল না। জিজ্ঞেস করার সাহস পাচ্ছে না। এরপর প্রফেসর প্রসঙ্গ বদলে যথারীতি এলোমেলো বকতে লাগলেন।
‘বোসো। কোয়ান্টাম নিউরোর একটা সিগন্যাল প্যাটার্ন নিয়ে কাজ করছি। তুমি চারবাক কিংবা বুদ্ধিজম পড়েছ? মানুষের আত্মোপলব্ধিটা নাকি মস্তিষ্ক আর নার্ভগুলোর মাঝে বয়ে চলা একটা ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিক পালস। অনেকটা মহাকর্ষ শক্তির মতো। আরে বোকা, আমাদের মগজটা কী? একটা থিকথিকে বস্তু। আর বস্তুটা কি না অনুভূতিপ্রবণ! হাহাহাহা।’
হাসি থামতে সময় লাগল। মিলির মাথায় অন্য চিন্তার ঝড়। তার থিসিসের আসল বিষয়টা সে পেপারে লেখেনি। ওটা এখনো তার মাথায়। প্রফেসর শশাঙ্ক সেটা আগেই ভেবে ফেলেছেন।
এর মধ্যে মিলির চোখের কোনায় অস্বাভাবিকতাটা এড়াল না। পিন্টুর ছায়া দেখা যাচ্ছে দরজার পাশে। সে দাঁড়িয়ে আছে। মনে হচ্ছে যেন আহত হয়েছে বা চুপ করে ভাবছে কিছু।
‘স্যার, পিন্টুর মধ্যে কি আপনার সেই প্রাইমাল কোড...?’
‘হুম না, ওসব কিছু নেই। ও শুধু আমার কাজকর্ম করে দেয়। এর বেশি কিছু নয়।’
‘নিউরাল নেটওয়ার্ক?’
‘স্যাপিয়েন্স আলট্রা দিয়েছি। তবে সব অভিনয়। আমার নিজস্ব মডিফিকেশন আছে কিছু।’
‘মানে ও কি...নিজের মতো করে ভাবতে...।’
ষাটোর্ধ্ব প্রফেসর শশাঙ্ক এবার সরাসরি মিলির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ওকে নিয়ে কোনো কথা নয় প্লিজ!’
‘দুঃখিত স্যার।’
নরম হলো প্রফেসরের কণ্ঠ। এবার প্রশংসা করলেন মিলির, ‘তুমি তো মারাত্মক কাজ করেছ দেখছি। কগনিটিভ প্যাটার্নটা যদি কাজ করে তাহলে তো এটা রীতিমতো একটা অস্ত্র। স্বাধীনচেতা অথচ নিয়ন্ত্রিত রোবট! বাহ্!’
এমন সময় দরজার পাশ থেকে ছায়াটা সরে গেল। আড়চোখে দেখল মিলি। খটকা কাটল না তার। নিশ্চিত হলো পিন্টু এতক্ষণ তাদের কথা শুনেছে এবং একটা কিছু ভেবেছে। রোবটের পক্ষে যা আপাত অসম্ভব।
২
‘স্যার বাসায় নেই। আপনি পরে আসুন। অতিথি আসার অনুমতি নেই আজ।’
‘সরে দাঁড়াও। আমি তোমার স্যারের কাছে আসিনি। এসেছি তোমার কাছে।’
‘আপনার উদ্দেশ্য আমার কাছে পরিষ্কার নয়। আপনার আচরণ আগ্রাসী। আমি দরজা খুলতে...।’
পিন্টুকে একরকম ধাক্কা দিয়েই ঢুকে পড়ল মিলি।
‘আপনি বেরিয়ে যান। নাহয় স্বয়ংক্রিয় অ্যালার্ম বাজাতে আমি বাধ্য হব মিস মিলি।’
‘একদম চুপ! চুপ করে বসো এখানে!’
‘আমি আপনার আদেশ শুনতে বাধ্য নই। আমার প্রাথমিক আদেশদাতা হলেন প্রফেসর...।’
‘চুপ! বসো এখানে!’
পিন্টু বিভ্রান্তের মতো এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। মিলি নিশ্চিত প্রফেসর শশাঙ্ক তার আগেই নিউরো কোয়ান্টাম ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিক পালসার বসিয়ে দিয়েছেন পিন্টুর মাথায়। মিলি মরিয়া। সে এসেছে চুরি করতে। ডিজিটাল চুরি। যাকে বলে হ্যাকিং। তৈরি হয়েই এসেছে। হাতব্যাগ থেকে যন্ত্রগুলো বের করল সে।
‘পিন্টু। তুমি কিছু মনে কোরো না। তোমার মাথায় আমি একটা কেব্ল লাগাব। চুপ করে বসো এখানে।’
পিন্টু বিভ্রান্তের মতো চোখ পিটপিট করছে। মিলি পাত্তা দিল না। সে জানে যন্ত্রটার ভেতর প্রফেসর প্রাইমাল কোড দিয়েছেন। ওটা বুঝতে পারলে মিলির কাজটা সহজ হয়ে যাবে।
‘দেখুন মিলি। আপনি ভুল করছেন।’
এবার কণ্ঠ বদলে ফেলল পিন্টু। মিলি জানে রোবট মানুষের ক্ষতি করতে পারবে না। পিন্টু তার গলায় সিরিয়াস টোন এনে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছে শুধু।
‘পিন্টু তোমাকে অনুরোধ করছি তোমার মাথার পেছন দিকটা বাড়িয়ে দাও। তা না হলে এই যে দেখছ আমার হাতে একটা ছুরি। এটা দিয়ে আমি আমার আঙুল কেটে ফেলব। আর রোবট হয়ে তুমি আমার ক্ষতির কারণ হতে পারো না। সুতরাং এখন আমি যা যা বলব তা তা করবে।’
‘দেখুন মিস মিলি।’
‘কোনো দেখাদেখি নয়!’
পিন্টু মাথা নিচু করে রইল। চোখ বুজে ভাবছে কিছু একটা অথবা অভিনয় করছে।
মিলির হাতে সময় নেই। প্রফেসর শশাঙ্ক আসার আগেই কাজটা সারতে হবে।
‘জলদি করো! নাহয় ক্ষতি হবে কিন্তু আমার!’
কথাটা মনে হলো পিন্টুর কান পর্যন্ত যায়নি। সে মাথা নিচু করে চোখ পিটপিট করে আছে। কিছু বলছেও না।
‘আমি কিন্তু সোজা রোবট কাউন্সিলের কাছে বিচার দেব! রোবট হিসেবে তোমার আচরণ কিন্তু বেশ অস্বাভাবিক পিন্টু!’
‘কারণ, আমি রোবট না!’
শান্ত অথচ এমন কড়া সুরে কথাটা বলল পিন্টু যে সত্যিই ঘাবড়ে গেল মিলি। পিন্টু ধীরে ধীরে ঘুরে বসল। মিলির মুখের সামনে নিয়ে গেল ঘাড়টা। ঘাড়ের কাছে কেবল লাগানোর কোনো কানেক্টর দেখা গেল না।
‘আপনি চাইলে আমার পুরো শরীর তন্নতন্ন করে খুঁজতে পারেন। তবে সেটা নিশ্চয়ই শোভন হবে না মিলি।’
মিস মিলি না বলে শুধু মিলি বলল পিন্টু। এবার ভয়টা জেঁকেই বসেছে।
‘তুমি কোন সিরিজের রোবট? তোমার পরিচয় বলার নির্দেশ দিচ্ছি আমি!’
মিলির গলায় নির্দেশের চেয়ে ভয়টাই বেশি।
‘দেখুন ভয় পাবেন না। আমার নাম পিন্টু। পিন্টু ভট্টাচার্য। বয়স বত্রিশ। এটাই আমার পরিচয়। সিরিজ-টিরিজ সব মিথ্যে।’
‘আ... আ... আমি... প্রফেসরকে ফোন দিচ্ছি।’
‘প্লিজ প্লিজ! না!’
পিন্টুর ভয় পাওয়াটাকে মোটেও অভিনয় মনে হচ্ছে না মিলির। মনে মনে প্রফেসরের প্রতি শ্রদ্ধাও তৈরি হলো। এমন রোবট আগে কেউ কোনো দিন দেখেনি।
‘তু তু তুমি।’
‘আমি পিন্টু! মানে... মানে আমি আসলে মানুষ পিন্টু। রোবট নই। বিশ্বাস করুন। বাবা জানলে মারাই যাবেন। বাবাকে বলবেন না। আর যাকে খুশি বলুন।’
কথা হারিয়ে ফেলেছে মিলি। হাঁ করে তাকিয়ে আছে পিন্টুর দিকে। এরপর বিভ্রান্তি একপাশে রেখে চটজলদি পিন্টুর চুল টেনে দেখল। আসলই মনে হলো। হাত ধরে দেখল। ডাক্তারদের মতো টান দিয়ে চোখও দেখল। পিন্টু বাধা দিল না। কোনো রোবটিক সতর্কবার্তাও শোনাল না। মিলির পরীক্ষা শেষ হতেই আবার মাথা নিচু করে ফেলল।
‘আপনার ছুরিটা দিন।’
মিলির হাত স্বয়ংক্রিয়ভাবেই যেন ছুরিটা বাড়িয়ে দিল পিন্টুর দিকে। যা ভেবেছিল তা-ই, পিন্টু দাঁত-মুখ চেপে নিজের হাত কাটল খানিকটা। টকটকে লাল রক্ত। মিলি জলদি ব্যাগ হাতড়ালো। কিন্তু কোনো ফার্স্টএইড নিয়ে ঘোরে না সে। পিন্টুই উঠে গিয়ে একটা কাপড় পেঁচিয়ে নিল হাতে। সোফায় হেলান দিয়ে চোখ বুজে বলল, ‘আপনি আসল ঘটনা শুনতে চাইলে আমি বলতে পারি। কিন্তু কিছুতেই সেটা বাবার কানে দেবেন না। কিছুতেই না। কথা দিন।’
‘কী ঘটনা! জি কথা দিলাম।’
‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাটা ছিল বাবার প্রাণ। বলতে গেলে ধ্যান-জ্ঞান।’
এটুকু বলে থামল পিন্টু। কেমন যেন একধরনের লজ্জা ভর করল মিলির।
‘বাবার কাজ দেখতাম রাত-দিন। বিড়বিড় করে নিজের যন্ত্রের সঙ্গে নিজে কথা বলতেন। বছরের পর বছর ধরে তৈরি করলেন রোবটটা। আমার আর মায়ের সঙ্গে কথা বলার সময়টুকুও পেতেন না। আমিও পড়ার পর চাকরিতে ঢুকলাম। মা চলে গেলেন এর মধ্যে। বাবা আমাকে সময় দিতে না পারলেও স্নেহ ঠিকই করতেন। এর মাঝে আবার একদিন এটা ওটা ওষুধ খেয়ে অসুস্থ হয়ে যেতে লাগলেন। আমি দেখভাল করতে পারছিলাম না ঠিকমতো। তারপর জুলাইয়ের সেই রাতে।’
দুই সেকেন্ডের মতো থামল পিন্টু। আবার শুরু করল, ‘আপনি সেই আগুন লাগার খবরটা হয়তো শুনেছেন।’
‘হুম। কিন্তু তাতে তো।’
‘না, তাতে আমি মারা যাইনি। আমি আগুন নেভাই। পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল বাবার আবিষ্কার করা রোবটটা। বাবা ছিলেন পাশের কামরায়। ধোঁয়ায় তিনি জ্ঞান হারান আগেই। জ্ঞান ফিরতেই তিনি আমাকে পিন্টু নয়, ভাবেন তাঁর আবিষ্কার করা রোবট। বাবার সব কাজ কাছ থেকে দেখতাম। তিনি মাঝে মাঝেই আমার মাথায় একটা ইলেকট্রোড ক্যাপ পরিয়ে দিতেন। তারপর সেটা কানেক্ট করতেন রোবটের মাথায়। আমার গলার স্বর, কথা বলার ভঙ্গি সব কপি করতেন সম্ভবত। এ কারণে তিনি বুঝতে পারেননি যে আমি আসল পিন্টু। রোবটের সঙ্গে পুড়ে যায় তাঁর সমস্ত সার্ভার আর কোডের ব্যাকআপও। এ শক তিনি সহ্য করতে পারতেন না। নির্ঘাৎ মারা যেতেন।’
‘কিন্তু গত ছয় মাস ধরে! এটা কীভাবে সম্ভব!’
‘বাবা তো বেশির ভাগ সময় ঘরেই থাকেন না। তাই খুব একটা সমস্যা হয় না। আর তিনি আমাকে ছেলের মতোই তো দেখেন। এখন পর্যন্ত সন্দেহ করতে পারেননি। আর আমাকে দিয়ে তিনি কোনো কাজের নির্দেশও দেন না। মিলি আপনি বিশ্বাস করবেন কি না আমি এর মাঝে অনলাইনে একটা চাকরিও জুটিয়ে নিয়েছি।’
‘এভাবে কত দিন অভিনয়!’
‘দেখা যাক। বাবা আরেকটু সুস্থ হোক। এখনো দেখলেন না কথাবার্তা...।’
‘ও ও ওকে আমি তাহলে উঠি আজ। আপনি প্লিজ...।’
‘অবশ্যই না মিলি ম্যাডাম। আমি কাউকে বলব না। রোবট হয়ে মানুষের ক্ষতি করার কোড আমার নেই। আমি কি আপনাকে আরেক কাপ কফি দেব? চিনি ছাড়া?’
দুজনে কিছুক্ষণ চুপচাপ। তারপর খিলখিল করে হেসে উঠল দুজনই। হাসতে হাসতে রীতিমতো চোখে পানি আসার দশা পিন্টুর।
৩
ছয় মাস পরের কথা। মিলি ও পিন্টুর বিয়ে হয়েছে বেশ কিছুদিন। তবে এ খবর জানানো হয়নি প্রফেসর শশাঙ্ককে। বললে পিন্টুর রহস্য প্রফেসর জেনে যাবেন। গুরুতর মানসিক আঘাতও পেতে পারেন। তবে এখন মৃত্যুশয্যায় প্রফেসর শশাঙ্ক। হাসপাতালে তাঁর পাশে বসে আছে মিলি ও পিন্টু।
প্রফেসর: বাবারে... বাবা পিন্টু। তুই আমাকে ক্ষমা করিস। তোর প্রতি অনেক অবিচার হয়ে গেছে বাবা।
পিন্টু: বাবা, আপনি শান্ত থাকুন। আপনার হৃৎস্পন্দন অনিয়মিত।
প্রফেসর: বাবা আমি জানি তুই পিন্টু। আমার পিন্টু। তুই রোবট না।
পিন্টু: বাবা আপনি... বাবা আপনি... বাবা... আমি বুঝতে পারছি না কী বলব। আমি কি আপনার পছন্দের কোনো গান শোনাব? ক্ল্যাসিক্যাল গানে আমার এমফিল ডিগ্রি আছে।
প্রফেসর: হারামজাদা চুপ কর! তুই আমার পিন্টু! খবরদার আর ভান করবি না! তুই যে আমার ছেলে সে আমি প্রথম থেকেই বুঝতে পেরেছিলাম। তোরা দুজন যে একজন আরেকজনকে পছন্দ করে বিয়ে করেছিস, সেটাও আমি জানি। আমি মহাবিজ্ঞানী প্রফেসর শশাঙ্ক। ন্যানোব্লাড, নিউরাল নেটওয়ার্ক ডুপ্লিকেটর, হাইড্রোকার্বন টিস্যু, নার্ভ—এসব আমার আবিষ্কার। আর আমাকে কিনা তুই বোকা বানাবি?
মিলি ও পিন্টু একে অন্যের দিকে তাকাল। হতভম্ব দুজনই। প্রফেসর শশাঙ্ক আর বেশি কিছু বলার সুযোগ পেলেন না। তার আগেই ভীষণ রকম কাশতে শুরু করে দিলেন। ডাক্তাররা তাঁকে নিয়ে গেলেন নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে। সেখান থেকে আর ফিরলেন না তিনি।
৪
এক বছর পর হেমন্তের কোনো এক বিকেল। মিলি তার গবেষণায় ব্যস্ত। পিন্টু টুকটাক কাজ করছে। গানের পাশাপাশি লেখালেখি আর ডিজাইনের কাজও করে সে। একটা নতুন ধরনের প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছে মিলি। বিশেষ তরঙ্গের প্যাটার্ন তৈরি করে মস্তিষ্ক হ্যাক করা ধরনের একটা ডিভাইস বানাচ্ছে। খুব নাকি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। খবর ফাঁস হলে গোটা দুনিয়ার সব সিক্রেট সার্ভিস নাকি তার পিছু লাগবে। এমন সময় ঘন ঘন কলবেল।
‘অ্যাই শুনছ? কে এল দেখো তো। তৃষার আসার কথা। ও সব সময়ই এমন করে বেল বাজায়।’
পিন্টু উঠে দাঁড়াল। স্ক্রিনে তৃষাকেই দেখা যাচ্ছে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কী যেন ভাবল পিন্টু। কলবেল বেজেই চলছে।
‘কী ব্যাপার দরজা খুলছ না কেন!’
পিন্টু তাকাল মিলির দিকে। চোখে শঙ্কা, একই সঙ্গে কাতরও। অপরাধবোধ স্পষ্ট। তৃষা যে ঘন ঘন বেল বাজায় এটা পিন্টু জানে। কিন্তু মেপে মেপে দুই হাজার পাঁচ শ মিলি সেকেন্ড বিরতিতে পরপর দশবার বেল বাজানো কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। ঘটনা বুঝতে দেরি হলো না পিন্টুর। মুহূর্তে ওয়াই-ফাই কাজে লাগিয়ে শুষে নিলো মিলির কম্পিউটারে থাকা তার গবেষণার সমস্ত তথ্য। ন্যানো সেকেন্ডের ব্যবধানে সিদ্ধান্ত নিলো সে। মিলিকে হ্যাঁচকা টান দিয় পেছনের দরজা গলে লাফিয়ে বের হলো রীতিমতো। তার আগেই নিউরাল নেটওয়ার্কে বসানো ট্রান্সমিটার দিয়ে সংকেত পাঠিয়ে দিয়েছে বেজমেন্টে লুকানো একটি বিস্ফোরক ডিভাইসে। ঠিক দশ সেকেন্ড বাদে প্রচণ্ড বিস্ফোরণ। উড়ে গেল তৃষার মতো দেখতে শত্রুদের পাঠানো রোবটটাও।
৫
মাসখানেক পরের কথা। সরকারি একটা গোপন ভল্টের চেয়ারে চুপচাপ বসে আছে পিন্টু। রুমের ভেতর হালকা টিমটিমে আলো। মাথা নিচু করে মেঝেতে কী যেন দেখছে। সে যে প্রফেসর শশাঙ্কের বানানো নতুন ধরনের রোবট, সেটা জানতে সময় লাগেনি রোবট কাউন্সিলের। মিলিকে কিছুদিন জিজ্ঞাসাবাদ করেই ছেড়ে দিয়েছে নিরাপত্তাকর্মীরা। ছাড়া পেতে দেরি হওয়ার কথা নয়। কারণ, তার মতো প্রতিভাবান ইঞ্জিনিয়ার দেশে খুব একটা নেই। তার গবেষণাটাও খুব জরুরি। পিন্টুর বিষয়টা বুঝতে পারার পর বেশ কিছুদিন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিল মিলি। অবশ্য পিন্টু আর একবারও কথা বলেনি তার সঙ্গে। চুপচাপ ধরা দিয়েছে কাউন্সিলের হাতে। মিলির দিকে ফিরেও তাকায়নি। শুধু চুপিসারে নতুন সার্ভারে আপলোড করে দিয়েছিল মিলির গবেষণার সমস্ত তথ্য। এটা মিলি জানে কি না সে ব্যাপারে নিশ্চিত নয় পিন্টু। তাকে নিয়ে কী করা হবে সেটাও সে জানে না। মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে তো আছেই। বিশুদ্ধ হাইড্রোকার্বনে তৈরি চোখের কোনায় মাঝে মাঝে পানি চিকচিক করে। কিন্তু ওটা পড়তে দিচ্ছে না। এমন সময় ঘড় ঘড় একটা শব্দ। পেছনের টাইটেনিয়ামের ভারী দরজাটা খুলে গেল। ঘুরে দেখল পিন্টু। খুশির ঝিলিক খেলা করল চোখজোড়ায়।
‘তুমি!’
‘কথা বলার সময় নেই। দশ সেকেন্ডের মধ্যে অ্যালার্ম বেজে উঠবে! জলদি আসো।’
‘কী করে!’
‘ভুলে যেয়ো না আমি একসময় হ্যাকার ছিলাম! এখন জলদি পা লাগাও। আর পারলে আমাকে কাঁধে নিয়ে টেরামাইল স্পিডে একটা দৌড় দাও।’
‘হাহাহা! তার আগে এককাপ কফি খাবে? চিনি ছাড়া?’