নিতাইবাবুর ময়না

অলংকরণ: রেহনুমা প্রসূন

নিতাইবাবুর অনেক দিনের শখ একটা ময়না কেনার। তার বন্ধু শশাঙ্ক সেনের বাড়িতে একটা ময়না আছে। সেটা হেন বাংলা কথা নেই যে বলে না। তার কথা শুনতেই নিতাইবাবু মাসে অন্তত তিনবার করে শশাঙ্কবাবুর বাড়িতে যান। সেদিন তো শশাঙ্কবাবুর বৈঠকখানায় ঢুকতেই নিতাইবাবু শুনলেন, ময়না বারান্দা থেকে বলে উঠল, ‘আসুন, বসুন।’

একেবারে মানুষের গলা। কেবল একটু খোনা, যেমন সর্দি হলে হয়। চার বছর ধরে ময়নাকে কথা বলতে শিখিয়েছেন শশাঙ্ক সেন। তার ছেলে আর গিন্নিও বাদ যাননি। সুতরাং, পাখির কথার স্টক এখন বিশাল। নিতাইবাবু মুগ্ধ হয়ে শোনেন আর মনে মনে ভাবেন, এমন একটা পাখি থাকলে নিরানন্দ সন্ধ্যাগুলি চমৎকার কেটে যায়। শশাঙ্কবাবু বন্ধুকে দোকানের সন্ধানও দিয়ে দিয়েছেন। ‘নিউমার্কেটে পাখির সেকশন জানো তো? সেখানে গিয়ে লতিফের দোকানে খোঁজ করবে। আমার এই ময়নাও লতিফের দোকান থেকে কেনা।’

নিতাইবাবু ন্যাশনাল ইনস্যুরেন্স কোম্পানিতে অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্টে কাজ করেন। বিয়ে করেননি। থাকেন ভবানীপুরে বেণীনন্দন স্ট্রিটের একটা ফ্ল্যাটে। অফিসটাইমে মার্কেট যাওয়ার উপায় নেই; অফিসফেরতও যাওয়া হয় না; কারণ, মার্কেট বন্ধ হয়ে যায়। তাই গুড ফ্রাইডের ছুটিতে সকাল দশটায় নিতাইবাবু মার্কেটে গিয়ে হাজির হলেন। পাখির বাজার কোথায় জানাই ছিল, সেখানে গিয়ে লতিফের কথা জিজ্ঞেস করতেই এক ভদ্রলোক এগিয়ে এসে বললেন, ‘কেন স্যার? লতিফ কেন? আপনার পাখি চাই তো?’ নিতাইবাবু হ্যাঁ বলতে ভদ্রলোক বললেন, ‘তা আমার দোকানে আসুন না। আমার স্টক কারুর থেকে কম না।’

দোকানটা বড়, তাতে সন্দেহ নেই আর পাখিতে বোঝাই। কিচিরমিচির শব্দে কান পাতা যায় না।

‘কী পাখি খুঁজছেন?’ জিজ্ঞেস করলেন ভদ্রলোক।

‘ময়না।’

‘তা কটা চাই আপনার? এই দেখুন খাঁচার সারি। সব কটা ময়না।’

‘কথা বলে?’

‘ময়না কথা বলবে না? শিখিয়ে নিলেই বলবে। টকিং বার্ডের মধ্যে ময়নার পজিশন অ্যাগবারে টপে। তবে একটা কথা, ময়না কিন্তু দুরকমের হয়। নেপালি আর আসামি।’

‘দুটোয় তফাত কী?’

‘আসামির দাম বেশি; কারণ, কথা বলে বেশি ভালো।’

কিছু দরাদরির পর তিন শ টাকায় রফা হলো—পাখি দু শ কুড়ি আর খাঁচা আশি। নিতাইবাবু খাঁচাসমেত পাখি নিয়ে নিউমার্কেটের সামনে দাঁড়ানো একটা ট্যাক্সিতে চড়ে বাড়িমুখো রওনা দিলেন

নিতাইবাবু মনে মনে আসামি ময়না নেওয়াই স্থির করে ঘুরে ঘুরে পাখি দেখতে লাগলেন।

‘আমার নামটা মনে রাখবেন স্যার’, বললেন দোকানের মালিক মণিলাল কর্মকার। ‘ছাপ্পান্ন বছরের ব্যবসা আমাদের। গ্র্যান্ডফাদার এস্টার্ট করেন।’

‘খাঁচাসমেত ময়না পাওয়া যাবে তো?’

‘নিশ্চয়ই। তবে খাঁচার দাম আলাদা। আপনি আগে চয়েস করুন না! এইগুলো আসামি, আর এইগুলো নেপালি।’

নিতাইবাবু আর সময় নষ্ট না করে একটা আসামি ময়নার দিকে দেখিয়ে বললেন, ‘এইটে আমি নেব।’

কিছু দরাদরির পর তিন শ টাকায় রফা হলো—পাখি দু শ কুড়ি আর খাঁচা আশি। নিতাইবাবু খাঁচাসমেত পাখি নিয়ে নিউমার্কেটের সামনে দাঁড়ানো একটা ট্যাক্সিতে চড়ে বাড়িমুখো রওনা দিলেন।

ছোট ফ্ল্যাট। দুখানা ঘর আর একটা অপরিসর বারান্দা। একা মানুষের পক্ষে যথেষ্ট। চাকর গণশার হাতে খাঁচাটা চালান দিয়ে নিতাইবাবু বললেন, ‘এটাকে বারান্দায় টাঙিয়ে রাখার ব্যবস্থা কর।’

পাখিকে কী খেতে দিতে হবে, সেটা বলে দিয়েছিলেন মণিলাল কর্মকার। সে ব্যাপারেও চাকরকে নির্দেশ দিয়ে দিলেন নিতাইবাবু।

‘বল দেখি রাধাকেষ্ট!’

নিতাইবাবুর তর সইছিল না। নাওয়া-খাওয়া হয়নি, তা–ও পাখির বাক্‌শক্তি পরীক্ষা না করে তার সোয়াস্তি নেই।

‘রাধাকেষ্ট, রাধাকেষ্ট। বল দেখি রাধাকেষ্ট।’ খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে পাখির দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আবার বললেন নিতাইবাবু।

এরপর ময়না ঘাড়টা একটু নাড়ল। তারপর পরিষ্কার গলায় কথা এল, ‘হ্যালো, গুড মর্নিং।’

‘সে কী! পাখি যে ইংরিজি বলে!’

নিতাইবাবুর বিস্ময় কাটার আগেই পাখি আবার কথা বলল। ‘ইউ রাসক্যাল!’ আর পরক্ষণেই কণ্ঠস্বরে বেশ বিরক্তি এনে পাখি বলে উঠল, ‘শাট আপ! শাট আপ!’

নিতাইবাবু চমৎকৃত হলেও তার মনটা কেমন যেন ভারী হয়ে উঠল। মণিলাল কর্মকার এমন ভুল করল কী করে? এ ময়না যে সাহেববাড়িতে ছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। পাখির কথা থেকে সাহেব যে কেমন লোক, সেটাও খানিকটা আঁচ করতে পারলেন নিতাইবাবু। খিটখিটে মেজাজ, বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। সম্ভবত দো-আঁশলা, অর্থাৎ ফিরিঙ্গি। এ ময়না কি বাংলা শিখবে কোনো দিন, নাকি তিনি এখনই গিয়ে এটাকে বদলে অন্য ময়না নিয়ে আসবেন?

অনেক ভেবে নিতাইবাবু একটা সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছলেন। কটা দিন দেখাই যাক না! এই ময়না শশাঙ্ক সেনের ময়নার চেয়েও বেশি স্পষ্ট কথা বলে। অর্থাৎ, এটা যে বাক্‌শক্তির বিচারে অতি উঁচু দরের ময়না, তাতে সন্দেহ নেই। এ কত রকম ইংরিজি কথা বলতে পারে, সেটা সম্বন্ধেও কৌতূহল হলো নিতাইবাবুর।

‘নাহ্‌, এটা থাক কিছুদিন। আর ময়না তো ইংরিজি বাংলায় তফাত করতে পারে না, কানে যা শোনে, তা–ই বলে। এটা এত দিন ইংরিজি শিখেছে, এবার বাংলা শিখবে।’

তিন দিনেই নিতাইবাবু আবিষ্কার করলেন যে ময়নার ইংরিজি কথার পুঁজি অফুরন্ত। আর সেই সব কথার বেশির ভাগই গালাগালি আর ধমকানি। স্টুপিড, ফুল, সিলি অ্যাস, ইউ ইডিয়ট, ড্যাম ইট, শাট আপ, গেট আউট—এই জাতীয় কথাই বেশি। আর এই সব কথা শুনলে মনে হয় ময়নারই মেজাজ যেন তিরিক্ষি।

এদিকে বাংলা শেখানোর চেষ্টাতেও বিরতি নেই। রাধাকেষ্ট, জয় মা তারা, দুর্গা, ঠাকুর ভাত দাও, আসুন, নমস্কার, কেমন আছেন—এই সব এবং আরও অনেক ছোট-বড় কথা নিতাইবাবু সকালে অফিসে যাওয়ার আগে এবং সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে তার ময়নাকে শেখাতে চেষ্টা করেন। আধঘণ্টার চেষ্টার পর ময়না যখন তীক্ষ্ণ স্বরে ‘স্টপ ইট, স্টপ ইট’ বলে ওঠে, তখন হতাশায় নিতাইবাবুর বুকটা ভরে ওঠে। পাখি জিব দিয়ে কথা বলে কি না, সেটা নিতাইবাবু জানেন না, কিন্তু তা–ই যদি হয়, তাহলে এ পাখির জিব যে ইংরিজি বলার জন্যই তৈরি, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

দুমাস চেষ্টার পর নিতাইবাবু হাল ছেড়ে দিতে বাধ্য হলেন। তবে ময়নার শখ এখনো মেটেনি! তাই তিনি স্থির করলেন যে মণিলালের দোকানে গিয়ে এই ময়না ফেরত দিয়ে অন্য ময়না নিয়ে আসবেন আর আনার আগে পরীক্ষা করে নেবেন, সে ময়না বাংলা না বলে অন্য কোনো ভাষা বলে কি না।

সামনে ছুটি নেই, তাই একদিন অসুস্থতার অজুহাতে আপিস কামাই করে নিতাইবাবু ময়নাসমেত নিউমার্কেটে গিয়ে হাজির হলেন।

মণিলালের দোকানে গিয়ে ঢুকতেই কর্মকার মশাই চোখ কপালে তুলে বলেন, ‘এ কী, আপনি? এ যে আশ্চর্য ব্যাপার মশাই!’

দোকানে যে আরেকজন খদ্দের রয়েছে, সেটা নিতাইবাবু ঢুকেই লক্ষ করেছিলেন। মণিলালবাবু এবার বললেন, ‘কী কেলেঙ্কারি মশাই, ভুল করে ফেরিস সাহেবের ময়না আপনাকে বেচে দিয়েছিলাম। এখন সাহেব এখানে এসেছেন সেই ময়নার খোঁজে। না পেয়ে আমায় এই মারে তো সেই মারে!’

ফেরিস সাহেবকে দেখেই নিতাইবাবুর মনে হয়েছিল যে তার অনুমান মিথ্যে হয়নি। এ লোক যে অত্যন্ত বদমেজাজের লোক, সেটা তাকে দেখেই বোঝা যায়। সাহেব নিতাইবাবুর হাতের খাঁচাটা দেখেই চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘হোয়াই, দ্যাটস মাই মাইনা!’ নিতাইবাবু ভাঙা ভাঙা ইংরিজির সঙ্গে হিন্দি মিশিয়ে বুঝিয়ে দিলেন যে তিনি ময়নাটা ফেরত দিতে এসেছেন, কাজেই সেটা নিতে পারেন। সাহেব তাতে যে ঘটনাটা বললেন তা হলো এই, একটা বিশেষ কাজে তাকে হঠাৎ অস্ট্রেলিয়া চলে যেতে হয় তিন মাসের জন্য। সেই ফাঁকে তার হতচ্ছাড়া জুয়াড়ি ছেলেটির হঠাৎ কিছু ক্যাশের দরকার পড়ায় সে তার বাপের ময়নাটি বেচে দেয়। ‘হি ইজ এ স্কাউন্ড্রেল!’ চোখ পাকিয়ে বললেন ফেরিস সাহেব। ‘আমি গতকাল ফিরে এসে ময়না নেই দেখে মহা খাপ্পা হয়ে উঠেছিলাম, তখন পিটার বলল যে মণিলালের দোকানে সে ময়নাটা বেচেছিল, সেটা এখনো সেখানে থাকতে পারে। তখন আমি হন্তদন্ত হয়ে এখানে এসে দেখি যে দিজ ফুল ম্যানিলাল হ্যাজ সোলড ইট টু আ বেঙ্গলি কাস্টমার। আমি তো মাথার চুল ছিঁড়তে বাকি রেখেছিলাম। তা তুমি ময়নাটা ফেরত দিচ্ছ তো?’

মণিলাল কর্মকার নিতাইবাবুর দিকে ফিরে বললেন, ‘তাহলে আপনি কি অন্য একটা ময়না নেবেন? আমার কাছে একটা ফাস্টকেলাস নতুন আসামি ময়না এসেছে, চোস্ত বাংলা বলে।’

নিতাইবাবু বললেন, ‘ইয়েস, আই শ্যাল বাই অ্যানাদার ওয়ান।’

‘ভেরি গুড। কিন্তু তোমার কি এ ময়নাটা পছন্দ হয়নি?’

‘না, সাহেব। খুব চতুর পাখি, কিন্তু ও ইংরিজি ছাড়া কিছু বলে না। দুমাস চেষ্টা করেও আমি ওকে বাংলা শেখাতে পারিনি।’

মণিলাল কর্মকার নিতাইবাবুর দিকে ফিরে বললেন, ‘তাহলে আপনি কি অন্য একটা ময়না নেবেন? আমার কাছে একটা ফাস্টকেলাস নতুন আসামি ময়না এসেছে, চোস্ত বাংলা বলে।’

‘কই, দেখি।’

মণিলাল একটা খাঁচার সামনে গিয়ে বললেন, ‘এই সেই ময়না।’

নিতাইবাবু খাঁচার দিকে ঝুঁকে পড়তেই ময়না বলে উঠল, ‘চিন্তামণি, চিন্তামণি!’

নিতাইবাবু আর দ্বিধা না করে বললেন, ‘এই পাখিটাই আমি নেব।’

‘তুমি আমার ময়নাটা কত দিয়ে কিনেছিলে?’ নিতাইবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন ফেরিস সাহেব।

‘খাঁচাসমেত তিন শ টাকা’, বললেন নিতাইবাবু।

ফেরিস সাহেব মানিব্যাগ বার করে তার থেকে তিনটে এক শ টাকার নোট বার করে নিতাইবাবুকে দিয়ে বললেন, ‘আমার গুণধর পুত্রটির জন্য আমার নিজের পাখি আমাকে দ্বিতীয়বার পয়সা দিয়ে নিতে হলো। অ্যানিওয়ে, অলস ওয়েল দ্যাট এভস ওয়েল। আশা করি এই দুমাসে আমার পাখি ইংরিজি ভুলে যায়নি।’

সাহেবের মুখে এই প্রথম হাসি দেখা দিল।

নিতাইবাবু এবার ফেরিসের কাছ থেকে পাওয়া তিন শ টাকা মণিলালবাবুর হাতে তুলে দিলেন। মণিলালবাবু বাংলায় ফিসফিস করে বললেন, ‘পাখি নেই দেখে সাহেব আমাকে যা গাল দিলেন, আমার কান এখনো ভোঁ ভোঁ করছে।’

ফেরিস সাহেব এবার তার হাতের ময়নাটার দিকে চেয়ে বললেন, ‘টুটসি—সে হ্যালো গুড মর্নিং, সে হ্যালো গুড মর্নিং।’

খাঁচার পাখি কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে নাকিসুরে প্রায় মানুষের গলায় পরিষ্কার উচ্চারণে বলল, ‘রাধাকেষ্ট। ঠাকুর ভাত দাও। দুর্গা দুর্গা।’