পরীক্ষা দিতে তোমাদের একেবারেই ভালো লাগে না তো? নাকি লাগে? আমাদের কিন্তু লাগত না। পড়াশোনা তো ভালোই, তবে পরীক্ষার কথা ভাবলেই হাত-পা কেমন ঠান্ডা হয়ে যেত আমাদের। দুঃস্বপ্ন যেন।
অথচ সেই আমাদের ছোট্ট স্কুলে দু-একবার এমনই হলো যে পরীক্ষাটাও হয়ে উঠল বেশ একটা মজার ব্যাপার।
কীভাবে জানো?
হেডমাস্টার মশাই একবার ক্লাসে এসে বললেন, ‘একটা জিনিস কখনো কি ভেবে দেখেছ তোমরা? এই যে পরীক্ষার সময়ে হলঘরে মাস্টারমশাইরা ঘুরে বেড়ান গার্ড হয়ে, তোমাদের পক্ষে এটা খুব লজ্জার কথা নয়?’
লজ্জা? লজ্জা কেন? হেডমাস্টার মশাই কি ভয়টাকেই ভুল করে লজ্জা বলছেন? খসখস করে লিখে চলেছে সবাই খাতার পাতায়, আর মাস্টারমশাইরা নিজেদের মধ্যে গুনগুন করতে করতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ঘরে কিংবা বসে আছেন চেয়ারে, আর মাঝেমধ্যে হেঁকে উঠছেন, ‘নো হামিং, নো হামিং’—ভাবলেই বেশ ভয় হয় না? মাঝেমধ্যে মনে হয়, ওখান থেকেই তো আসছে ‘হামিং’, আমরা আর করছি কতটুকু? কিন্তু সে কথা সাহস করে আর বলে কে! ঘাড় নিচু করে লিখতে লিখতে হয়তো টের পাচ্ছি যে ঠিক পেছনেই দাঁড়িয়ে আছেন একজন, পড়ে যাচ্ছেন আমার লেখা, তখন কি লিখতে আর কলম সরে? লজ্জার কথা মনে হয়নি কখনো। মাস্টারমশাইরা পাহারাদার হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন পরীক্ষার ঘরে, এ ছবিটা ভাবলে কেবল ভয়েরই কথা মনে হতো আমাদের।
কিন্তু হেডমাস্টার মশাই আমাদের বোঝালেন যে ভয় নয়, এর মধ্যে আছে একটা লজ্জা। ‘কেন তোমাদের পাহারা দিতে হবে? ঘরে যদি কেউ না থাকে, তাহলেই কি তোমরা এ ওর দেখে লিখবে? বই খুলে লিখবে? মাস্টারমশাইরা কি কেবল সেইটে ঠেকাবার জন্য বসে থাকবেন ঘরে পুলিশ হয়ে? পরীক্ষার ঘর কি তবে একটা চোর-পুলিশের খেলা? দেখো তো ভেবে? তোমাদের কি এইটুকুও বিশ্বাস করা যাবে না? শুধু সন্দেহই করতে হবে?’
এ রকম করে ভাবিনি বটে আগে। কিন্তু এ-ও তো সত্যি যে আমাদের মধ্যে কেউ কেউ নানা রকম ফন্দি করেই পরীক্ষা দিতে চাইত। টুকরা টুকরা কাগজ বার করত পকেট বা জামার হাতা থেকে, ঝুঁকে পড়ত এ ওর খাতায়। সেইসব ঠেকাবার জন্যই তো ঘুরে বেড়াতে হতো মাস্টারমশাইদের!
হেডমাস্টার মশাই বললেন, ‘তাই ঠিক করেছি যে তোমাদের পরীক্ষার ঘরে পাহারার জন্য পাঠাব না আর কাউকে। খাতা আর প্রশ্নপত্র দিয়ে চলে যাবেন মাস্টারমশাই, ঘরের দরজা বন্ধ করে নিজেরাই লিখবে তোমরা, লেখা শেষ হলে জমা দিয়ে যাবে খাতা।’
বিহ্বল একটি ছেলে বলে উঠল হঠাৎ, ‘কিন্তু কেউ যদি নকল করে সত্যি সত্যি?’
‘কেন করবে? আর যদিই-বা করে, তাকে কি ভয় দেখিয়ে ঠেকাতে হবে? যদি ধরো তোমাদের ভার তোমাদেরই ওপর ছেড়ে দিতে চাই, নেবে না সে ভার? কাজটা যে ভালো নয়, এটা যদি তোমরা বুঝতে পারো, সে কাজ নিশ্চয় নিজে থেকেই বন্ধ করবে তোমরা? আর ভালো নয় বুঝেও কাজটা যদি করে কেউ, তাহলে সে তা করবে। পুলিশি করে ঠেকাতে চাই না তা। কী, রাজি তো সবাই? নিজের ভার নিজে নিতে?’
কী আশ্চর্য, আমরা কেন রাজি থাকব না? ঘরে থাকবেন না কেউ আর আমরা দেব পরীক্ষা, আমাদের এতে অরাজি হওয়ার তো কথাই ওঠে না। কিন্তু মাস্টারমশাইরা রাজি হবেন তো?
ফুর্তির একটা ঢেউ উঠল স্কুলজুড়ে। ইনভেজিলেটর থাকবেন না কেউ, পরীক্ষা দেব নিজেরা নিজেরা! আহ্, ভারী একটা নতুন রকমের কাণ্ড হবে।
তারপর একদিন এসে গেল সেই পরীক্ষা। ভিন্ন রকম একটা উত্তেজনা হচ্ছে আমাদের। আমাদের বিশ্বাস করা হচ্ছে, আমাদের দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে; সেই বিশ্বাসের, সেই দায়িত্বের একটা মর্যাদা দিতে হবে—অন্য মাস্টারমশাইরাও কদিন ধরে বুঝিয়ে বলছেন সেই কথা। মর্যাদা দেওয়ারই ভঙ্গি নিয়ে ক্লাসঘরে গিয়ে বসেছি আমরা, খাতা-প্রশ্ন দিয়ে চলে গেছেন মাস্টারমশাই, কলম খুলে শুরু করেছি লেখা।
স্কুলের মধ্যে সবচেয়ে ডানপিটে যে ছেলেটি, সবচেয়ে না-পড়ুয়া, দুষ্টুবুদ্ধিতে ভরাট—ধরা যাক ‘হৃদয়’ তার নাম—সে বসেছে একেবারে পেছনের বেঞ্চে। তার বসা দেখে সবাই বুঝে নিয়েছে যে নিরিবিলি আপনমনে তার নকল করা আজ ঠেকাতে পারবে না নেউ। কিন্তু হেডমাস্টার মশাই তো বলেই দিয়েছেন যে চানও না তিনি ঠেকাতে, নকল যদি কেউ করতে চায় তো করুক, সে তার নিজের দায়িত্ব। তাই ও নিয়ে আর ভাবছিলাম না আমরা। আত্মমর্যাদায় গরীয়ান হয়ে লিখে যাচ্ছিলাম সবাই।
কেটে গেছে বেশ খানিকটা সময়। হঠাৎ চমকে উঠি পেছন থেকে একটা তর্জন শুনে, ‘অ্যাই, ঘাড় ঘোরাচ্ছিস কেন? লিখে যা নিজের মতো! ইহ্, ঘাড় ঘোরাচ্ছে!’
সবাই একসঙ্গে পেছন ফিরে দেখি, কথাটা বলছে হূদয়। বলছে, ‘ভেবেছিস তোদের দেখবার কেউ নেই? আমি আছি। আমি তো আর লিখতে পারব না কিছু, পড়ে তো আসিনি, তাই আমিই তোদের দেখব। লেখ মন দিয়ে...।’
ঘাড় যে ঘোরাচ্ছিল, তার কোনো অভিসন্ধি ছিল না, একটু হেসে সে আবার শুরু করল লেখা, শুরু করলাম আমরাও। ঘণ্টা পড়ে গেলে সবার সঙ্গে সঙ্গে হূদয়ও জমা দিল তার ফাঁকা খাতা। কিন্তু সেই ফাঁকা খাতা, সেই শূন্য খাতাই সেদিন যেন হয়ে উঠল হেডমাস্টারম শাইয়ের মস্ত এক জয়তিলক, আমাদেরও।
না বললেও চলে, বুঝতেই পারছ, সেই ছোট পরীক্ষাটায় পাস করেনি হূদয়। কিন্তু, অল্প কিছুদিন পড়াশোনা করে, বেশ ভালোভাবেই সে পটকে গেল স্কুলের শেষ পরীক্ষা। আমাদের সেই শেষ পরীক্ষা দিতে হয়েছিল অন্য এক শহরে গিয়ে, নাটোরে। পরীক্ষায় পাহারা দিতে দিতে সেখানকার শিক্ষকপ্রহরীরা যখন বলছিলেন, ‘এ ঘরে তো না থাকলেও চলে দেখি, এরা তো মুখও তোলে না’, স্কুলের ছেলেরা তখন পরস্পরের দিকে তাকিয়েছিল মর্যাদাভরা খুশিতে, সেই আমাদের ছোট স্কুলের ছোট একটা মর্যাদায়।