নতুন সূর্য
রন্টুদের পাড়ার সবাই চলে গেছে। শুধু রন্টুরা আর অনিলরা এখনো আছে। আর আছে নসু পাগলা। সে পাগল বলেই তার ভয়ভীতি নেই। দিব্যি সারা শহরে ঘুরে বেড়ায়, মিলিটারিরাও কিছু বলে না। পাগলের কাণ্ডকারখানা দেখে তারাও হাসে।
তবে রন্টুরা আর অনিলরা যাবে, আজ ভোররাতেই যাবে, ঠিক চারটায়। আরও আগেই যেত, অনিলের বোন উমার হঠাৎ জ্বর হলো বলে দেরি না করে উপায় ছিল না। অনিলের বাবা একটা ভক্সওয়াগন গাড়ি জোগাড় করেছেন। বাসার পেছনে সেটা লতাপাতা দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে আপাতত। সেই গাড়িতে করে দুই পরিবার একসঙ্গে পালাবে। এক গাড়িতে একটু চাপাচাপি হবে, তাতে কী? এ ছাড়া উপায়ও নেই। যেকোনো সময় মিলিটারি আসতে পারে এ পাড়ায়। চারদিকে থমথমে একটা ভাব। মাঝে মাঝে ঠাস ঠাস গুলির আওয়াজ শোনা যায়। তখন বুক কেঁপে ওঠে রন্টুর। অনিল বলে, এটা থ্রি নট থ্রি রাইফেলের গুলি।
‘তুই জানলি কীভাবে?’ প্রশ্ন করে রন্টু।
‘আমি জানি।’ সবজান্তার মতো মাথা নাড়ে অনিল। এটা অবশ্য ঠিক। অনিল যেকোনো গুলির শব্দে বুঝে ফেলে কোনটা কিসের শব্দ। যেমন মাঝখানে একসময় মুক্তিবাহিনী দূরে কোথায় যেন অ্যাম্বুশ করেছিল। গুম গুম শব্দ হচ্ছিল তখন। অনিল বলল, এটা ফিল্ডগানের শব্দ! তিন ইঞ্চি মর্টারের শব্দ হলেও অনিল বুঝে ফেলে!
‘তুই কি সব গুছিয়েছিস?’ ফিসফিস করে বলে রন্টু।
কাঁধ ঝাঁকায় অনিল। ‘আর কী গোছাব? মা বলেছে, ভারী কিছু নেওয়া যাবে না। নইলে আমার সবগুলো বই নিতাম। তা ছাড়া গাড়ির ডিকিতে খুব বেশি জায়গাও নেই।’
—আমারও একই অবস্থা। তবে একটা বই আমি নেবই নেব।
—কোনটা?
—‘হাকল বেরি ফিন’ বইটা।
‘আমার মন খারাপ হচ্ছে বল্লার চাকটার জন্য। ওদের ঘর বানানো আর দেখতে পারব না।’ মন খারাপ করে বলল অনিল।
—দেখতে পারবি না কেন? আমরা ফিরে এলে পর দেখবি ওদের চাকটা আরও কত বড় হবে!
—তা ঠিক।
অনিলদের বাসার বারান্দার কোনায় ওপরের দিকে বিশাল একটা বল্লার চাক। প্রতিদিন ঝাঁকে ঝাঁকে বল্লারা ঢোকে। আবার বের হয়ে যায়। মজার একটা দৃশ্য।
ফিসফাস গল্পে গল্পে চারটার মতো বেজে গেল। ওরা ফিরে চলল। আরও কিছু গোছানোর বাকি আছে। তা ছাড়া এখন বাইরে ঘোরাঘুরি একদম বন্ধ। কার কখন বিপদ হয়, বলা মুশকিল। ওদের দুজনের বাসা পাশাপাশি। হাতের টেনিস বলটা দু–একবার লোফালোফি করে পকেটে ঢুকাল রন্টু। সে ভেবেছিল, দু–এক দান ক্যাচ ক্যাচ খেলবে দুজন মিলে।
ওরা ঘুরে দাঁড়িয়ে পা বাড়িয়েছে মাত্র, ঠিক তখনই তীব্র হুইসেল বেজে উঠল। থমকে দাঁড়াল দুজনই। একজন রাজাকার আর দুজন মিলিটারি ঠিক ওদের পেছনে দাঁড়িয়ে।
‘এই ছোড়া, দাঁড়া।’ চেঁচিয়ে উঠল রাজাকারটা। এই রাজাকারটাকে চেনে ওরা। চুন্নু রাজাকার। তার হাতে একটা হুইসেল টাইপের বাঁশি, আর একটা থ্রি নট থ্রি রাইফেল। কোমরে আবার ঝুলছে একটা রামদা। দাঁড়াল ওরা। মিলিটারি দুজনও চুন্নু রাজাকারের দুপাশে এসে দাঁড়াল।
‘ইহাঁ পার হিন্দু ফ্যামিলি হ্যায়?’ উর্দু বলতে পারে না চুন্নু রাজাকার। তারপর আরও কী সব যেন বলল, বুঝল না রন্টু আর অনিল। রন্টুর বুকটা ধক করে উঠল। নিশ্চয়ই খবর পেয়েই এসেছে ওরা। অনিলরা হিন্দু। অনিল ঠোঁট চেটে রন্টুর দিকে তাকাল। রন্টু কী বলবে বুঝতে পারছে না। এই সময় রাজাকারটা ফিসফিস করে কী যেন বলল মিলিটারি দুজনকে। একটা মিলিটারি চেঁচিয়ে উঠল।
‘অমল কুমার দাস কৌন হ্যায়? উসকা ঘর কাহাঁ?’ রন্টুর শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। এখন কী হবে? ঠিক তখনই অনিলদের বাসার দরজায় দেখা গেল অনিলের বাবাকে।
‘আমি অমল কুমার দাস।’ বললেন অনিলের বাবা। মিলিটারি আর রাজাকারের দলটা এবার ওদের ফেলে এগিয়ে গেল অনিলের বাবার দিকে। ইশ! উনি কেন নামটা বললেন! আতঙ্কিত হয়ে ভাবল রন্টু। মিলিটারিটা হাসি হাসি মুখে কী সব বলল, তার সবটা বুঝতে পারল না রন্টু আর অনিল। তবে যতটুকু বুঝল, তার মানে দাঁড়ায় এ রকম— ‘তুমি হিন্দু লোক ইন্ডিয়ায় না পালিয়ে এখানে কী করছ?’ এ কথা বলে অমল কাকাকে নিয়ে একরকম ঠেলে ওদের বাসার ভেতর ঢুকে গেল মিলিটারি আর চুন্নু রাজাকার। রন্টু আর অনিলও ঢুকল পেছন পেছন। কী হবে এখন? মিলিটারিটা তখনো উর্দুতে কী সব বলে যাচ্ছে। আর ওর হাতের ভারী অস্ত্রটা অমল কাকার বুকে ঠেকিয়ে রেখেছে, যেন এখনই গুলি করবে। চুন্নু রাজাকার বলল, ‘আভি গোলি কর দেঙ্গা স্যার?’ তখনই অনিলের মা আর্তনাদ করে ছুটে এলেন। পেছন পেছন এলেন রন্টুর মা। মা তাহলে এখানেই ছিলেন। ভাবল রন্টু। নিশ্চয়ই দুজন মিলে ব্যাগট্যাগ গোছাচ্ছিলেন! অনিলের ছোট বোন উমাকে দেখা গেল বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছে, মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে, এখনই চিৎকার করে কেঁদে উঠবে। কিন্তু না, উমা নয়, চেঁচিয়ে কেঁদে উঠল অনিল। ‘ওরা বাবাকে মেরে ফেলবে!’ অনিলের চিৎকারে রন্টু কেমন ঘোর লাগা চোখে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। এসব কী হচ্ছে! একটা মিলিটারি তখন ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে অনিলের মাকে। আর তার ভারী অস্ত্রের নলটা এবার চেপে ধরেছে অমল কাকার মাথায়। আর ঠিক তখনই রন্টুর চোখ গেল ঠিক ওদের পেছনে, বল্লার চাকটার দিকে। কিলবিল করছে বল্লাগুলো। তার মানে এখনই ঝাঁক বেঁধে ঘরে ঢুকেছে ওরা। ছোট্ট প্রাণীগুলো জানেও না, এখানে কী ভয়ংকর একটা ঘটনা ঘটতে চলেছে। আচমকা এক সেকেন্ডের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিল রন্টু, পকেট থেকে কাঁপা হাতে বের করল টেনিস বলটা। তারপর আচমকা সর্বশক্তি দিয়ে টেনিস বলটা ছুড়ে দিল বল্লার চাকটার দিকে। যেন পিন খুলে একটা গ্রেনেড ছুড়ল সে!
শোঁওওও করে কেমন একটা শব্দ হলো হঠাৎ। তারপর বিকট স্বরে ‘মারডালা! মারডালা!’ বলে চেঁচিয়ে উঠল মিলিটারি দুজন, ঝনঝন করে তাদের অস্ত্র দুটো ছিটকে পড়ল হাত থেকে। আর রাজাকারটা ‘উফ! উফ!’ বলে লাফাতে লাগল পাগলের মতো। তার রাইফেলটাও আর হাতে নেই। ব্যাপারটা বুঝতে একটু সময় লাগল সবার, বল্লার চাকটা ভেঙে মাটিতে পড়েছে আর ঝাঁকে ঝাঁকে হলুদ রঙের বল্লার দল ছুটে এসে ছেঁকে ধরেছে ওদের। সেই সুযোগে অমল কাকা চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘তোমরা সবাই গাড়িতে ওঠো! জলদি, এখনই!’
সবাই ছুটে এসে গাড়িতে উঠল। অমল কাকা চেঁচালেন, ‘আমাদের এখনই সরে পড়তে হবে। রন্টু তোমার বাবা কোথায়?’ হায় হায়! বাবাকে দেখা যাচ্ছে না। ভয় পেয়ে গেল রন্টু।
ঠিক তখনই রন্টুর বাবাকে দেখা গেল। তিনি গিয়েছিলেন গাড়ির পেট্রল কিনতে, অমল কাকাই বাবাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন। কী ঘটেছে, কিছুই বুঝতে পারলেন না রন্টুর বাবা। শুধু দেখলেন দুটো মিলিটারি ‘মারডালা! মারডালা!’ বলে মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে... ভয়ানক কিছু একটা ঘটেছে সেটা টের পেলেন তিনি। ছুটে এসে যে-ই না গাড়িতে উঠতে যাবেন, তখনই চুন্নু রাজাকার বাবার সামনে এসে দাঁড়াল। তার চোখমুখ ফুলে গেছে বল্লার কামড়ে, চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে তার যথেষ্ট যন্ত্রণা হচ্ছে। কিন্তু চোখের সামনে দিয়ে রন্টুরা চলে যাবে, এটা সে কিছুতেই হতে দেবে না। তার হাতে এখন কোমরে ঝোলানো রামদাটা। বাবার এক হাতে পেট্রলের একটা কনটেইনার আরেক হাতে বাজারের ব্যাগ। রাজাকারটা দুই হাতে দাটা ধরে এক পা এক পা করে দাঁতে দাঁত ঘষে এগিয়ে আসছে... সময় যেন ফ্রিজ হয়ে গেছে, রন্টুর মা আর্তনাদ করে উঠলেন আতঙ্কে। চোখ বন্ধ করে ফেলল রন্টু। ঠিক তখনই দুম করে একটা গুলির শব্দ হলো। মুখ থুবড়ে পড়ল রাজাকারটা। সবাই অবাক হয়ে দেখল, রাইফেল হাতে হাসি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে নসু পাগলা। সে কখন এল এখানে! রাজাকারের রাইফেলটা তার হাতে গেল কী করে!
ওদের গাড়ি তখন ছুটতে শুরু করেছে। ওরা পেছন ফিরে দেখল, নসু পাগলা রাইফেলটা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে পাকিস্তানি মিলিটারিদের দিকে। একটা মিলিটারি তখন কোনোমতে উঠে দাঁড়িয়েছে, চোখমুখ ফুলে গেছে; বিকৃত মুখে তার অস্ত্রটা খুঁজছে। দুম করে দ্বিতীয় আরও একটা গুলির শব্দ শোনা গেল! তারপর আরও একটা... দুম!
রাত বারোটা নাগাদ ওরা গাড়ি ফেলে যখন নৌকায় তুরাগ নদ পার হয়ে মোটামুটি একটা নিরাপদ জায়গায় পৌঁছাল, তখন টের পেল, বল্লা শুধু মিলিটারি আর রাজাকারটাকে কামড়ায়নি। ওদেরও কামড়েছে। কিন্তু প্রচণ্ড দুশ্চিন্তায় কেউ যেন টেরই পায়নি বল্লার কামড়ের যন্ত্রণা। তবে কামড়ানোর জায়গাগুলো বেশ ফুলে উঠেছে।
তারও অনেক পরে যখন দেশ স্বাধীন হলো, স্বাধীন দেশের নীল আকাশে জ্বলজ্বল করতে লাগল নতুন একটা সূর্য। রন্টু আর অনিলরা ফিরে এল যার যার বাসায়। ওরা অবাক হয়ে দেখে, ওই বল্লার বাসাটা আবার ওরা নতুন করে তৈরি করেছে। আগের মতোই ওরা ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে আসছে, আবার যাচ্ছে। আহা, ওরা কি জানে কীভাবে বিপদের সময় বাঁচিয়েছিল রন্টুদের? আমাদের প্রিয় দেশটা যে স্বাধীন হয়েছে, সে খবরও তারা রাখে না। নসু পাগলার খবরও নিশ্চয়ই রাখে না তারা। শুধু ওই নতুন সূর্যটা সব জানে... সব জানে!