তোমার মা কেমন আছে?

অলংকরণ: তুলি

বাড়ির দ্বিতীয় শোবার ঘরটার খোলা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে হামফ্রে প্যাট্রিস। খালি বিছানাটার দিকে তাকানোমাত্র মুচকি হাসি খেলে গেল ওর মুখে।

‘আম্মু, চিঠি এসেছে। আর কিছু না।’ সিঁড়ির নিচ থেকে হাঁক ছাড়ল হামফ্রে। খোলা সদর দরজার ভেতরের পাশে দাঁড়িয়ে আছে ও, ওপাশে দেখা যাচ্ছে গ্রামের পোস্টম্যানকে।

‘আপনার নামে একটা প্যাকেজ এসেছে, মি. প্যাট্রিস।’ বলল রেজ কাটার, সেই সঙ্গে ঘরের ভেতরে উঁকিও দিল। ‘একটা নার্সারি থেকে। সম্ভবত গোলাপ পাঠিয়েছে ওরা।’

‘হুম, আসার কথা ছিল।’ বলেই দরজা আটকে দিতে চাইল প্যাট্রিস।

‘নভেম্বরই তো গোলাপের চারা লাগানোর উপযুক্ত সময়, তাই না?’

‘হ্যাঁ।’

‘আপনার মা কেমন আছেন?’ যাওয়ার কোনো লক্ষণই নেই রেজের মধ্যে।

‘ভালোই।’

‘তার নামে কখনো চিঠি আসে না, তাই না?’

‘বয়স তো আর কম হলো না। চিঠি লিখবে কে ওকে? বন্ধুবান্ধব কেউ বেঁচে নেই।’

‘কত হলো তার বয়স?’

‘এই জুলাইয়ে ছিয়াশি পূর্ণ হয়েছে।’

‘অনেক দিন বাঁচলেন। বাইরেও বেরোতে দেখি না ভদ্রমহিলাকে!’

‘একদম বেরোন না, হাঁটাচলায় অসুবিধে হয়। যদি কিছু মনে না করেন, এবার আসুন। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। ট্রেন ধরতে হবে।’

দরজা বন্ধ করে হাঁক ছাড়ল প্যাট্রিস। ‘আম্মু, অফিসে গেলাম।’

স্টেশনে যাওয়ার পথে খবরের কাগজ কেনার জন্য একবার থামতে হলো প্যাট্রিসকে।

‘শুভসকাল,’ দোকানমালিক মি. ডেন্টন বললেন। ‘আপনার মা কেমন আছেন?’

‘বয়সের তুলনায় তো ভালোই।’

‘ভালো কথা, মি. প্যাট্রিস,’ বললেন মিসেস ডেন্টন। ‘রবিবার গ্রামের হলে একটা আলোচনা সভা আছে। বিষয় হলো...’

‘মাফ চাই, মিসেস ডেন্টন। সপ্তাহান্তের দিনগুলোতে আম্মুর কাছে থাকতে ভালো লাগে আমার। সারা সপ্তাহ তো অফিসের জ্বালায় সময় দেওয়া যায় না তাকে।’ বলে দ্রুত চলে গেল যুবক।

‘মায়ের জন্য বাঁচে ছেলেটা।’ বললেন মি. ডেন্টন।

‘হুম,’ বললেন তাঁর স্ত্রী। ‘আমার মনে হয় না মহিলা আর বেশি দিন বাঁচবেন। এখানে আসার পর থেকে তিনি শয্যাশায়ী হয়ে আছেন। কত দিন আগের কথা যেন? তিন বছর?’

‘ও রকমই, তিন বা চার।’

‘মহিলা মারা গেলে প্যাট্রিস কী নিয়ে থাকবে?’

‘শুনলাম, সে নাকি কানাডা যেতে চায়।’

‘হুম, যেতেও পারে। মায়ের কাছ থেকে কিছু টাকাপয়সা পাবে বলেই তো মনে হয়।’

মিসেস ডেন্টনের যেটা মনে হয়, সেটা রাষ্ট্র হতে সময় লাগে না!

সেদিন বিকেলে, অফিস থেকে বেরোনোর প্রস্তুতি নিচ্ছে প্যাট্রিস। এমন সময় বেজে উঠল ফোন। মি. ব্রাউনলো ওকে তার কামরায় যেতে বলেছেন! একছুটে বসের কামরায় চলে গেল সে।

‘হামফ্রে! এসো, বসো।’

একটা চেয়ারের একদম ধারে বসল প্যাট্রিস, আজ আর ট্রেন ধরতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। মি. ব্রাউনলো বললেন, ‘তুমি জানো তো আমার সামনের হপ্তায় মিটিংয়ের জন্য অ্যান্টওয়ার্পে যাওয়ার কথা ছিল?’

‘জি।’

‘এইমাত্র খবর পেলাম, পার্সনস অসুস্থ হয়ে পড়েছে। সে জন্য কাল আমাকে যেতে হচ্ছে রোমে। তাই সামনের সোমবার তোমাকে যেতে হবে অ্যান্টওয়ার্পে।’

‘আমাকে? আমি কেন? মি. পটার আছেন তো। আমার চাইতে তাঁর পদ এই কোম্পানিতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ...’

‘ও খুব ব্যস্ত। তা ছাড়া অভিজ্ঞতাটা তোমার কাজে আসবে। সেক্রেটারিকে বলে দিচ্ছি, টিকেটের ব্যবস্থা করে দেবে।’

‘আসলে...মি. ব্রাউনলো, আমি যেতে পারব না।’

‘কেন? কী সমস্যা?’

‘আমার আম্মু...বৃদ্ধা আর শয্যাশায়ী! তার খেয়াল রাখার মতো আর কেউ নেই।’

‘দেখো, হামফ্রে, মাত্র তিন দিনের জন্য যেতে হবে তোমাকে। আর মিটিংটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।’

‘আমি দুঃখিত, কিন্তু সম্ভব না আমার পক্ষে। আম্মু...’ বসের বিরক্ত চেহারা দেখে থেমে গেল ও।

‘ঠিক আছে তাহলে। না গেলেও চলবে। এবার যাও, নইলে ট্রেন মিস করতে পারো।’

ঘড়ির দিকে তাকাল প্যাট্রিস। ‘তাড়াতাড়ি করলে এখনো ধরতে পারব।’

‘তাহলে তো আর কথাই নেই!’ মি. ব্রাউনলো শীতল হাসি দিলেন।

‘আম্মু, এসে পড়েছি। ঠিক ৬টা ৩৫ বাজে এখন। ট্রেন ধরতে শেষ খানিকটা পথ দৌড়াতে হয়েছে বটে, কিন্তু মিস করিনি!’

দ্রুত ওপরের তলায় চলে এল হামফ্রে প্যাট্রিস। নিজের শোবার ঘর পার হয়ে চলে এল দ্বিতীয়টায়। খালি বিছানা দেখে হাসি ফুটে উঠল ওর মুখে।

সোমবার সকালে নাশতা বানানোতে ব্যস্ত প্যাট্রিস, কুকার চালু করে ডিম সেদ্ধ করছে। বয়স কম হয়নি কুকারের, তবে এখনো কাজ করে।

জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল ও, তৃপ্তিতে ভরে গেল মন। ছুটির এই কয়দিন বাগানে সব কটি গোলাপের চারা লাগিয়ে ফেলেছে।

‘আমার মনে হয় না মহিলা আর বেশি দিন বাঁচবেন। এখানে আসার পর থেকে তিনি শয্যাশায়ী হয়ে আছেন। কত দিন আগের কথা যেন? তিন বছর?’

আচমকা বেজে উঠল ঘণ্টি। রেজ কার্টার, মানে পোস্টম্যান এসেছে। হাতে একটা বড় প্যাকেজ।

‘অনেক চেষ্টা করেও দরজার ছোট্ট ফুটো দিয়ে ঢোকানো গেল না।’

কানাডা নিয়ে পড়াশোনা করছে প্যাট্রিস। সে–সংক্রান্ত বই আছে ওই প্যাকেজে। ভালোই হলো, ট্রেনে বসে পড়া যাবে।

‘সেই সঙ্গে এই চিঠিও এসেছে। তবে আপনার আম্মুর নামে কিছু আসেনি। তিনি ভালো আছেন?’

‘হ্যাঁ, একদম ঠিক আছেন।’ বলেই দরজা বন্ধ করে দিল প্যাট্রিস। প্রথমেই খুলল চিঠি।

লেখা পড়ামাত্র ধপ করে বসে পড়ল ওখানেই! দুর্বল লাগছে নিজেকে! এক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিল, সেটার ফলাফল। বিশাল অঙ্কের টাকা পুরস্কার পেয়েছে ও!

‘আমার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলে নাকি, প্যাট্রিস?’

‘জি, মি. ব্রাউনলো।’

‘তাড়াতাড়ি বলো কী বলবে, এই মাত্র রোম থেকে ফিরলাম।’

‘আপনাকে জানাতে এসেছি যে আমি চলে যাচ্ছি।’

‘চলে যাচ্ছ মানে? চাকরি ছেড়ে দিচ্ছ? এমন আচমকা?’

‘বিদেশে যাচ্ছি...কানাডায়...আম্মুর সঙ্গে।’

‘তাহলে এক মাসের নোটিশ তো অন্তত দিতে হবে, তা–ই না?’

‘তার আগে ছাড়া যাবে না?’

আর সহ্য হলো না মি. ব্রাউনলোর। ‘যাবে, আগে মানে এখুনি যাবে...আজ থেকেই তোমার চাকরি নট!’

লাঞ্চের আগেই ফিরে এল প্যাট্রিস। এক দালালের সঙ্গে কথা হয়েছে, বাড়িটা বিক্রি করে দেবে। কানাডায় বসবাসের জন্য যেসব কাগজ পূরণ করা দরকার, সেগুলো করেও ফেলেছে। সদর দরজা খুলে বলল, ‘আম্মু, আমি এসে পড়েছি।’

পরক্ষণেই থমকে গেল। রেজ কার্টার বেরিয়ে আসছে ওর রান্নাঘর থেকে! ‘হায় ঈশ্বর, আপনি এখানে কী করছেন?’

‘পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম, আচমকা ধোঁয়া নজরে পড়ল।’

‘ভেতরে এলেন কীভাবে?’

‘জানালা ভেঙে, পুলিশকেও ফোন দিয়েছিলাম। সার্জেন্ট ওয়ালেসকে সব বলেছি।’

সাদা হয়ে গিয়েছে প্যাট্রিসের চেহারা। ‘সব বলতে?’

‘আগুনের ব্যাপারে সব। আপনার রান্নাঘরে আগুন লেগেছিল। কুকার চালু রেখে গিয়েছিলেন, সেখান থেকে পর্দায় আগুন ধরে। আপনার মায়ের কথা ভেবেই ঢুকেছি। তিনি তো শয্যাশায়ী, তাই আগুন নেভালাম।’

‘ওহ, অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।’

‘তারপর ভাবলাম, ভদ্রমহিলার খোঁজখবর নেওয়া যাক। ওপরের তলায় গেলাম, কিন্তু সব কটি দরজা বন্ধ ছিল। একটা খুলে দেখি ওটা আপনার কামরা। তারপর আরেকটা খুললাম। ভেতরে বিছানা ছিল একটা, কিন্তু কোনো মানুষ ছিল না!’

‘হুম, থাকার কথাও নয়।’

‘পুরো বাড়িতে আর কেউ ছিল না।’

‘বুঝলাম।’

চুপচাপ দাঁড়িয়ে ওকে কিছুক্ষণ দেখল রেজ। ‘ব্যাপারটা অদ্ভুত, মি. প্যাট্রিস। আপনি না সব সময় বলেন যে আপনার সঙ্গে আপনার আম্মুও থাকেন?’

‘থাকেন...মানে থাকতেন। তিনি মারা গেছেন।’

‘তাই নাকি? কখন? আজ সকালেও তো দেখা হলো আমাদের, তখন তো কিছু বলেননি...’

‘দুই দিন আগে মারা গেছেন,’ লাল হয়ে গিয়েছে ওর চেহারা। ‘কিছু মনে করবেন না, আমি ঠান্ডা মাথায় ভাবতে পারছি না। তার মৃত্যু...নাড়া দিয়ে গিয়েছে আমাকে।’

‘বুঝতে পারছি,’ শুধু এতটুকুই বলল কার্টার। ‘বেশ, তাহলে। আমি এবার আসি।’

অগ্নিকাণ্ডের এক সপ্তাহ পরের কথা। রেজ কার্টার অবশ্য প্যাট্রিসের বাড়ি থেকে বেরিয়েই সব শুনিয়ে এসেছে মি. এবং মিসেস ডেন্টনকে। তাঁদের মুখ থেকে গ্রামের সবার শুনতে দেরি হয়নি।

সার্জেন্ট ওয়ালেস, গ্রামের আইনরক্ষক হামফ্রে প্যাট্রিসের ব্যাপারে অনেক অদ্ভুত গল্প শুনেছেন। তাই সিদ্ধান্ত নিলেন যে এবার নিজেই কথা বলতে যাবেন।

ধীরে ধীরে দরজা খুলল প্যাট্রিস, সার্জেন্ট সরাসরি চলে এলেন বসার কামরায়। বাক্সে ভর্তি জায়গাটা।

‘জিনিসপত্র প্যাক করছেন দেখি, মি. প্যাট্রিস। কানাডা যাচ্ছেন কবে?’

‘এক মাস পর।’

‘ওখানে বাড়ি কিনবেন নিশ্চয়ই?’

‘হ্যাঁ।’

‘একাই যাচ্ছেন? আপনার আম্মুর কী অবস্থা?’

‘তিনি...তিনি মারা গিয়েছেন।’

‘হুম, সে প্রসঙ্গে কথা বলার জন্যই আসা। আপনি তো জানেন যে আমাদের গ্রামটা কত ছোট। সবাই তাই সবার ব্যাপারে সবকিছু জানে। আপনার সম্পর্কে কিছু অদ্ভুত গল্প এসেছে আমার কানে, মি. প্যাট্রিস। লোকে বলছে, আপনি নাকি আপনার মাকে খুন করেছেন...টাকার লোভে।’

‘অসম্ভব! কী সব হাস্যকর কথা শোনাচ্ছেন!’

‘হয়তো...সে ক্ষেত্রে আশা করি কয়েকটা প্রশ্ন করলে কিছু মনে করবেন না। আপনার আম্মু মারা গেলেন কবে?’

‘১০ দিন আগে, ১১ তারিখে।’

‘আপনি নিশ্চিত? ১১ তারিখে কিন্তু আগুন লেগেছিল আপনার রান্নাঘরে।’

‘ওহ, তাই তো? আম্মু মারা গিয়েছেন তারও দিন দুয়েক আগে। আসলে এত নাড়া খেয়েছি যে...’

‘তা তো অবশ্যই। শেষকৃত্যানুষ্ঠান কবে হলো? ১০ তারিখে?’

‘হুম, সে রকমই হবে।’

‘গ্রামের কোনো মুর্দাফরাশ কিন্তু আপনার মায়ের ব্যাপারে কিছু জানে না।’

‘জা-জানার কথাও না। আমি...আমি শহর থেকে মানুষ এনেছিলাম।’

‘তাহলে তো কোনো সমস্যাই নেই। ভালো কথা, ডাক্তারের সই-সাবুদসহ সনদ নিয়েছিলেন তো, যাতে লেখা আছে, আপনার মা মারা গিয়েছেন?’

‘হ্যাঁ।’

‘কাগজের কোনো কপি আছে?’

অসন্তুষ্ট দেখাল প্যাট্রিসকে। ‘নেই।’

‘সবকিছু শুনে মনে হচ্ছে,’ বললেন সার্জেন্ট, ‘আপনার আম্মুর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি। তা যদি কোনো ধরনের অপরাধের কারণে—’

‘দুই দিন আগে মারা গেছেন,’ লাল হয়ে গিয়েছে ওর চেহারা। ‘কিছু মনে করবেন না, আমি ঠান্ডা মাথায় ভাবতে পারছি না। তার মৃত্যু...নাড়া দিয়ে গিয়েছে আমাকে।’

‘কিসের অপরাধ!’ চিৎকার করে উঠল প্যাট্রিস। ‘আমার কোনো মা নেই, জীবনে কোনো দিন চোখে দেখিনি তাকে। ছয় মাস বয়সে আমাকে সে পরিত্যাগ করে। বড় হয়েছি এতিমখানায়।’

‘তাহলে আপনার সঙ্গে যিনি বাস করছিলেন, তিনি কে?’

‘কেউ না...আমার সঙ্গে কেউ থাকে না। আমি একাই থাকি এখানে...সব সময় তা–ই ছিলাম। মানুষের সঙ্গ আমার পছন্দ নয়। ওরা খালি প্রশ্ন করতে থাকে, বাড়িতে আসে...বাইরে যেতে বলে। আমার এসব একদম সহ্য হয় না। আমি শুধু একা থাকতে চাই!’

ওকে থামাতে চাইলেন সার্জেন্ট ওয়ালেস। কিন্তু প্যাট্রিসকে থামায় সাধ্য কার? ‘কিন্তু মানুষের নাক গলানোর কোনো সীমা থাকলে তো! তাদের কোনো-না-কোনো কারণ দিতে হবে। তাই আম্মু পয়দা করলাম একটা। আমি কোথাও যেতে পারি না, কারও সঙ্গে মিশতে পারি না...কেন? কারণ, আমার অসুস্থ আম্মু আছে বাসায়। এমনকি মানুষের সামনে তার সঙ্গে কথাও বলতে লাগলাম। আমার আম্মু খুব ভালো, সুন্দরী...আমাকে ভালোবাসে। অথচ আপনারা এখন তাকে মেরে ফেলেছেন!’

নতুন এই তথ্যগুলো মাথায় সাজিয়ে নিতে সময় লাগল সার্জেন্ট ওয়ালেসের। ‘আপনি বলতে চাইছেন, আপনার আম্মু কোনো দিন এখানে ছিল না? তাই তাকে খুন করার প্রশ্নই ওঠে না? তাহলে কানাডা যাওয়ার, ওখানে বাড়ি কেনার টাকা পেলেন কই?’

‘একটা প্রতিযোগিতায় নাম লিখিয়েছিলাম। ওটার পুরস্কার পেয়েছি। চিঠি এসেছিল আগুনের দিন সকালে। সে জন্যই ভুলে গিয়েছিলাম কুকার বন্ধ করতে, উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম বলে সে কথা মনেই ছিল না!’

‘তাই নাকি!’ জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন সার্জেন্ট ওয়ালেস। ‘বাগানে নতুন চারা লাগিয়েছেন দেখি।’

‘হ্যাঁ, গোলাপের চারা!’

‘বেশ বেশ! লাগালেন গোলাপের চারা, অথচ এখন যাচ্ছেন চলে? হুম!’

কয়েক দিন পর নতুন একটা খবর রটে গেল গ্রামে। প্যাট্রিসকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পুলিশ এসে ওর পুরো বাগান খুঁড়ে দেখেছে, বাসার মেঝেও বাদ দেয়নি। কিন্তু লাশ মেলেনি কোনো। আরও কিছুদিন পর জানা গেল, বেকসুর খালাস দেওয়া হয়েছে ওকে।

সার্জেন্ট ওয়ালেসকে বলা গল্পটা অদ্ভুত হলেও, সত্যি। আর কেউ আসলেই বাস করত না ওই বাড়িতে। পুরস্কারের গল্পও সত্যি। প্যাট্রিসের আসল মা বাস করেন লিভারপুলে। পুলিশের খাতায় ছিঁচকে আসামি হিসেবে নাম আছে।

বাড়ি ফিরে কানাডা গমনের প্রস্তুতি নতুন উদ্যমে নিতে শুরু করল প্যাট্রিস।

বিদায় নেওয়ার দিন দুয়েক আগে এক সন্ধেয় বেজে উঠল দরজার ঘণ্টি। ডিসেম্বর মাস, যেমন অন্ধকার তেমন ঠান্ডা। গ্রামবাসী সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে যার যার বাড়িতে আশ্রয় নেয়।

দরজা খুলে সামনে দাঁড়ানো মেয়েটিকে চিনতে পারল না হামফ্রে। পরনে যুবতীর পোশাক, কিন্তু চেহারায় বয়সের ছাপ স্পষ্ট।

‘কেমন আছ, হামফ্রে?’ জিজ্ঞেস করল সে।

‘কে আপনি?’ জিজ্ঞেস করল প্যাট্রিস, তবে দরজা বন্ধ করে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত।

হাসল মহিলা। ‘আমাকে চিনবে, এই আশা করিনি। শেষবার যখন দেখা হয়েছে, তখন তুমি শিশু!

‘আপনি...আপনি...নাহ, অসম্ভব!’

‘সম্ভব এবং ঠিক ধরেছ। আমি তোমার আম্মু...কী হলো, শুধু দাঁড়িয়েই থাকবে? আম্মুকে চুমু দেবে না?’

রংমাখা চেহারাটা হামফ্রের দিকে এগিয়ে দিল মহিলা। চমকে গিয়ে পিছিয়ে এল প্যাট্রিস। মহিলাও সেই সুযোগে ঢুকে পড়ল ভেতরে।

বাক্স-পেটরার দিকে নজর গেল প্রথমেই। বলল, ‘কানাডা যাচ্ছ, তা–ই না? খবরের কাগজে পড়েছি। টাকার কথাও জানি।’

‘কী চাই আপনার?’ জিজ্ঞেস করল প্যাট্রিস।

‘কিচ্ছু না, আমার বাবুকে দেখতে এসেছি। আর যদি সেই বাবু তার বেচারি, অভাগী মাকে সাহায্য করতে চায় তো সোনায় সোহাগা।’

‘কেন চাইব? আপনি আমার জন্য কী করেছেন? কিচ্ছু না, পরিত্যাগ করেছেন।’

‘সে অনেক দিন আগের কথা। এখন আমার অবস্থা দেখো, বয়স দেখো। এই বৃদ্ধ মাকে সঙ্গে করে কানাডা নিয়ে যেতে মন চাইছে না?’

‘আপনি আমার মা নন।’

‘আমি না হলে তোমার আম্মু কে, হামফ্রে?’

‘আমার আম্মু সুন্দরী, দয়ালু। তোমার মতো না একদম। তুমি...তুমি আমার মা হতে পারো না।’ উন্মাদ হয়ে গিয়েছে যেন যুবক, মহিলার কাঁধ ধরে ঝাঁকাচ্ছে দুই হাতে।

‘আমিই তোমার এক ও অদ্বিতীয় আম্মু, হামফ্রে!’ হাসছে মহিলা, বিদ্রূপের হাসি।

কাঁধ থেকে কীভাবে যেন গলার দিকে এগিয়ে গেল যুবকের হাত। আস্তে আস্তে শক্ত হয়ে এঁটে বসল।

যখন হামফ্রে খুলল ওর হাতের বাঁধন, লাশটা আছড়ে পড়ল মেঝেতে। হাঁ হয়ে গেল মহিলার মুখ, ভেতর থেকে খসে পড়ল নকল দাঁত!

পরের দিন সকালে, হামফ্রে প্যাট্রিস এল পুলিশ স্টেশনে...সার্জেন্ট ওয়ালেসের সঙ্গে দেখা করতে চায়।

‘শুভসকাল, মি. প্যাট্রিস। কীভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি?’

‘আসলে, সার্জেন্ট। আমার মা...মানে আমার আম্মু...তাকে আমি খুন করেছি!’

‘তারপর কী করলেন? লাশ পুঁতে রেখেছেন বাগানে?’

‘হ্যাঁ।’

‘তাহলে তো ঝামেলা চুকেই গেল।’

‘সার্জেন্ট, আমি খুন করেছি একজন মানুষকে।’ জোর দিল প্যাট্রিস।

‘দেখুন, মি. প্যাট্রিস।’ বললেন সার্জেন্ট। ‘আপনাকে আগেরবার ঝামেলার মধ্যে ফেলার জন্য দুঃখিত। আপনি সেটা নিয়ে ঠাট্টা করতে চাইলে করতে পারেন। কিন্তু আপাতত আমি ব্যস্ত। তাই দয়া করে চলে যান...’

‘চলে যাব?’

‘খুব খুশি হব তাহলে।’

‘চলে যাব কানাডায়?’

‘যে চুলোয় ইচ্ছে যান।’

‘বেশ তাহলে, গেলাম আমি।’ বলে বেরিয়ে এল ও পুলিশ স্টেশন থেকে।

বাইরে বেরিয়ে তাজা বাতাস টেনে নিল হামফ্রে প্যাট্রিস বুক ভরে। হেসে বলল, ‘আম্মু, আমরা কানাডা যাচ্ছি!’

ব্রিটিশ লেখক সাইমন ব্রেটের জন্ম ১৯৪৫ সালে। অসংখ্য রহস্য গল্প ও উপন্যাস লিখেছেন তিনি। তাঁর সর্বশেষ বই দ্য ডেডলি হ্যাবিট বেরিয়েছে ২০১৮ সালে।