তুমি কেডায়?
চটাশ! আমরা খালি আওয়াজটা শুনলাম। বিকট আওয়াজ। তারপর দেখলাম ক্লাসরুমের মাঝখানে ধইঞ্চা শওকত ঘুরছে। মুখ দিয়ে একটা আওয়াজ বেরোচ্ছে। গোঁ গোঁ ধরনের মৃদু আওয়াজ। পাকা কাঁঠাল ভাঙার পর তার ওপর মাছি চক্কর মারলে এ রকম আওয়াজ হয়।
আমাদের সহপাঠী শওকত এতটাই রোগা-পটকা যে মনে হয় জোরে ফুঁ দিলেই উড়ে যাবে। শুকনা ধঞ্চেগাছের মতো। তাই আমরা তাকে ‘ধইঞ্চা শওকত’ বলে ডাকি। সেই ছেলে আমাদের চোখের সামনেই দম ফুরানো লাটিমের মতো এদিক-ওদিক দুলছে আর ঘুরছে। ধীর লয়ে কয়েকটা পাক খেয়ে একসময় লাটিমটা মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। মানে শওকতই পড়ে গেল। একদম ধপাস করে উপুড় হয়ে পড়ল ক্লাস টিচারের টেবিলের সামনেই। থেমে গেল গোঁ গোঁ আওয়াজটাও। শওকত স্থির হয়ে পড়ে আছে। একদম নট নড়নচড়ন। পুরো ক্লাস হতভম্ব! ততোধিক হতভম্ব আমাদের সিরাজ মোল্যা স্যার। ঘটনার আকস্মিকতায় তিনি ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেছেন।
পূর্ব ঘটনা হচ্ছে—ওই দিন আমাদের ক্লাস নাইনের বিজ্ঞান ও কলা বিভাগের মোটামুটি অর্ধেকই অনুপস্থিত। বাছাই করা কিছু ছাত্রছাত্রীকে নেওয়া হয়েছে জেলা সদরের সরকারি স্কুলে। আন্তস্কুল বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে। বক্তা চারজন, একমাত্র নারী সদস্যই দলনেত্রী—শাহনাজ। অবশ্য এই পদটা ওরই প্রাপ্য ছিল। বিতর্ক প্রতিযোগিতা বলে কথা! ঝগড়ায় দারুণ দক্ষতার কারণে আমরা তাকে ‘ঘসেটি বেগম’ বলে ডাকতাম। অবশ্য নিরাপত্তার খাতিরে আড়ালেই এই নামে ডাকতাম। তো সেই বিতর্ক দলের সঙ্গে দুই বাস ভরে ছাত্রছাত্রী নেওয়া হয়েছে। এরা হাততালি দিয়ে, টেবিল চাপড়ে উৎসাহ জোগাবে। পুরো টিমের নেতৃত্বে আছেন আমাদের ভূগোলের শিক্ষক মল্লিক স্যার এবং বাংলার শিক্ষক বারী স্যার।
রওনা হওয়ার আগে আমাকে স্কুলের বারান্দায় দেখে মল্লিক স্যার জিজ্ঞেস করলেন, ‘কিরে, তুই যাবি না?’
: না স্যার। এত দূরে যাব না। বাসায় মেহমান আসবে।
মনে মনে বলি, শাহনাজের ঝগড়া তো আমরা সারা বছরই তো দেখি! এত দূরে যাওয়ার দরকার কী?
: রেজাল্ট কেমন হবে বলে তোদের মনে হয়? স্যার আবার প্রশ্ন করেন।
: আমরা স্যার ব্যাপক আশাবাদী। আমাদের দলনেত্রী সেরা বক্তা হবে এটা নিশ্চিত।
স্যার মুচকি হেসে চলে যান। কী বুঝলেন কে জানে! দুটি বাস ভরে হইহই করতে করতে ছাত্রছাত্রীরা চলে গেল। ওদের দুটি আনন্দ—এক. জেলা শহরে যাচ্ছে, আর দুই. আজ ওদের ক্লাস করতে হবে না। আমরা যারা রয়ে গেলাম, তাদের একটা আনন্দ আরেকটা দুঃখ। আনন্দটা হচ্ছে, আজ শাহনাজের সঙ্গে ঝগড়া করতে হবে না। দুঃখটা হচ্ছে, আজকের দিনেও ক্লাস করতে হবে!
দপ্তরি আলী ভাই ঘণ্টা পিটিয়ে জানান দিলেন ক্লাস শুরু হচ্ছে। আমাদের বিজ্ঞান বিভাগে প্রথম ক্লাসটাই ভূগোলের। মল্লিক স্যার তো নেই। অন্যদিকে পাশেই কলা বিভাগে বাংলা ক্লাস। বারী স্যারও নেই। কী মজা! আমরা দুই বিভাগ মিলে সেলিব্রিটির প্রস্তুতি নিচ্ছি। এমন সময় বাড়া ভাতে ছাই পড়ল। হাজির হলেন আমাদের প্রধান শিক্ষক আবদুল কাদির স্যার। অতিশয় সজ্জন ও শ্রদ্ধাভাজন। চেহারায় চীনের মহান নেতা মাও সে তুংয়ের সঙ্গে তাঁর বেশ মিল আছে। তিনি এসেই একটা চায়নিজ টাইপ বুদ্ধি খাটিয়ে সমাধান বের করে ফেললেন!
‘শোন বাপুরা’ হেড স্যার ঠান্ডা গলায় বলতে লাগলেন, ‘তোমাদের দুই বিভাগের মোটামুটি অর্ধেক ছাত্রছাত্রীই তো আজ নেই। দুজন ক্লাস টিচারও চলে গেছেন। তাই বলে ক্লাস বন্ধ রাখা চলবে?
আমরা কাষ্ঠহাসি মুখে ঝুলিয়ে বলি, ‘না স্যার, তা-ও কি হয় নাকি?’ কিন্তু মনে মনে বলি উল্টা কথা।
হেড স্যার আবার শুরু করলেন, ‘কলা বিভাগের সবাইকে বিজ্ঞান বিভাগের ক্লাসরুমে নিয়ে আসি। আবশ্যিক বিষয়গুলোর ক্লাস চলতে থাকুক। তারপর আলাদা আলাদা ক্লাস হবে। প্রথম ক্লাসটা ভূগোলই হোক। আমি সিরাজ মোল্যা স্যারকে গিয়ে বলছি ক্লাসটা নিতে।’ ঘোষণাটা দিয়েই চলে গেলেন হেড স্যার।
সিরাজ মোল্যা স্যারের নাম শুনেই আমাদের বুকের ভেতর ফুলে ওঠা খুশির বেলুনটা হঠাৎ চুপসে গেল। পৌনে তিন শ বছর আগে এক সিরাজউদ্দৌলাকে ইংরেজরা যেমন ভয় পেত, এই আমলে সিরাজ মোল্যা স্যারও সেই রূপে আবির্ভূত হয়েছেন। আমরা তাঁকে সে রকমই ভয় পাই। অথচ তিনি ক্লাসে কখনো বেত আনেন না। পড়া পারলে ‘সোনার চান’ বলে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করেন। আর উল্টোটা হলে কানে-গালে অ্যায়সা থাপ্পড় লাগান যে ভূতও ভেগে যাবে। ভূতদের যদি মরার সুযোগ থাকত, তাহলে হয়তো মরেই যেত। তা-ও আবার একটা নয়, তিন থাপ্পড়ের নিচে কোনো ডোজ নেই।
আমাদের স্কুলে আগে যেসব ছাত্র সিরাজ মোল্যা স্যারের থাপ্পড় খেয়েছে, তারা তাত্ক্ষণিক কোনো প্রতিক্রিয়া জানাতে পারেনি। কী করে জানাবে? অন্তত ১২ ঘণ্টা তারা কানে শুনত না, খালি মনে হতো কান দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে। ছুটির পর বাসায় ফিরলে দু-একজনের চোয়াল ফুলে ওঠারও রেকর্ড আছে। তখন গার্জিয়ানকে বুঝ দিতে হতো—আক্কেলদাঁত উঠেছে বলে। সেই সিরাজ স্যার আমাদের ক্লাস নিতে আসবেন শুনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মতোই ফাঁপরে পড়লাম আমরা। লেখাপড়ায় তো একেকজন বিদ্যাসাগর, এখন উপায় হবে কী?
মল্লিক স্যার আজকের ভূগোল ক্লাসের পড়া দিয়েছিলেন—উত্তর আমেরিকার খনিজ সম্পদের বর্ণনা মুখস্থ করে আসতে। সারা ক্লাসে চারজনকে পাওয়া গেল পড়া শিখেছে। বাদবাকি আমরা ৩০ জন শিখিনি। আমরাই সংখ্যাগুরু। সুতরাং আমাদের পক্ষ থেকে পাপ্পু ওদের ধাতানি দিল, ‘খায়া আর কাজকাম নাই, এই জিনিস মুখস্থ করছ! ওই ব্যাটারা, তোরা নিজের দেশ ফালায়া উত্তর আমেরিকার খনিজ সম্পদ নিয়া মাথা ঘামাস ক্যান?’ পাপ্পুর সঙ্গে সঙ্গে আমিও চুলায় দুটো লাকড়ি গুঁজে দিলাম, ‘আচ্ছা বল তো, এই ফালতু বিষয় কেন পড়তে গেলি? তোদের জীবনের লক্ষ্য কি উত্তর আমেরিকায় খনিশ্রমিক হওয়া? খনিতে কাজ করা বড় কষ্টের রে!’ মুহুর্মুহু আক্রমণে চারজন সুবোধ ছাত্র কোণঠাসা হয়ে পড়ে। তখন মামুন সমাধান দিয়ে দিল—সিরাজ স্যার ক্লাসে আসার পর আমরা সবাই বলব মল্লিক স্যার কোনো পড়া দিয়ে যাননি। আজ নতুন চ্যাপ্টার পড়ানো হবে। ব্যস, মনে থাকে যেন।
দু-তিন মিনিট পরেই ধীর পায়ে ক্লাসে এসে ঢুকলেন সিরাজ মোল্যা স্যার। তাঁর পেছনে কলা বিভাগের ছেলেমেয়েরাও এসে ঢুকল। আমরা ওদের খ্যাপাতে শিক্ষকদের আড়ালে কলাব্যাপারী বলে ডাকি। ওদেরও চেহারায় দুশ্চিন্তার ছাপ। তারা অবশ্য আমাদের বিজ্ঞান বিভাগের তুলনায় সেফসাইডে আছে। কারণ, ভূগোলের ক্লাসে বাংলা না পড়ে এলেও সমস্যা নেই। গাদাগাদি করে এক রুমেই জায়গা হয়ে গেল আমাদের।
ক্লাস শুরু হয়ে গেল। স্যার দুটি হাজিরা খাতা নিয়ে এসেছেন। একটা বিজ্ঞান বিভাগের, আরেকটা কলা বিভাগের। রোল কল শুরু হলো কলা বিভাগ দিয়েই। তখন একটা বাড়তি সুবিধার সন্ধান পাওয়া গেল। ওদের যে ছাত্র এসেছে, সে বলছে প্রেজেন্ট স্যার। আর যে আসেনি, তার বেলায় অন্য বন্ধুরা সাক্ষ্য দিচ্ছে, ‘স্যার ওর প্রেজেন্ট দিয়ে দিন। ও বিতর্ক দলের সঙ্গে গেছে।’ স্যারও দিয়ে দিচ্ছেন। আমরা তো আর্টসের ছাত্রদের এই সায়েন্টিফিক ফাঁকিবাজি দেখে মুগ্ধ! চার-পাঁচজনের প্রক্সি দেওয়ার পর স্যার বিষয়টা আঁচ করতে পারলেন। খাতার ওপর কলমটা রেখে পাঞ্জাবির হাতা গোটাতে গোটাতে ঠান্ডা গলায় বললেন, ‘সোনার চানেরা, বুইঝা কথা কইয়ো কিন্তু। যে বাস দুইটা জেলা স্কুলে গেছে, সেইখানেও আলগা কাগজে হাজিরা রাখা হইব। পরে যদি হিসাবে গরমিল পাই, তাইলে কিন্তু দিশা পাইবা না!’
স্যারের এই কথায় মন্ত্রের মতো কাজ হলো। পরে দেখি অনেকেই অনুপস্থিত! বুঝলাম, সিরাজ মোল্যা স্যার বিএসসি, তিনিও সায়েন্টিফিক চাল দিয়েছেন।
একপর্যায়ে কলা বিভাগের নাম ডাকা শেষ হলো। স্যার এবার বিজ্ঞান বিভাগের খাতা খুললেন। রোল কল শুরু করতেই কলা বিভাগের দু-তিনজন ছাত্র উঠে দাঁড়াল। একজন বলল, ‘স্যার, আমাদের কয়েকজনের নাম ডাকেননি। আরেকটা পৃষ্ঠা ওল্টালে দেখবেন কয়েকজনের নাম আছে।’
: ‘তাই নাকি?’ স্যার বললেন, ‘তাইলে বিজ্ঞানের সোনার চানেরা বসো, আগে কলা বিভাগের রোল কল শেষ করি।’
এই সময়েই ঘটল অঘটনটা। আর তা ঘটাল আমাদের বিজ্ঞান বিভাগের শরাফত আলী শওকত, ওরফে ধইঞ্চা শওকত। যমে টানলে যা হয় আরকি! ফোর্থ বেঞ্চ থেকে ও সটান দাঁড়িয়ে পড়ল।
: স্যার, একটা কথা।
: তোর আবার কী হইল? খাতা থেকে মুখ তুলে স্যার জানতে চান।
: স্যার, কিছু কলা যেহেতু বাকি আছে, আগে সবগুলি কলা দিয়া লন।
আমরা জোরে হেসে উঠি। ধইঞ্চা এই কাজটা করেছে মূলত আর্টসের ছাত্রদের খ্যাপাতে। কিন্তু এই বেয়াদবি মার্কা রসিকতায় স্যারই খেপে গেলেন। পাঞ্জাবির হাতা আবার গোটাতে গোটাতে তিনি বললেন, ‘সোনার চান শওকত জং, এদিকে আসো। তোমারে কলাবাগান চিনায়া দেই।’ আমি পাশে বসা দিদারের কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললাম, পৌনে তিন শ বছর আগেই সিরাজউদ্দৌলা আর শওকত জঙের মতবিরোধ ছিল। আজ তার একটা রেশ টের পাবি। শওকত তার বেঞ্চ থেকে উঠে স্যারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। চোখেমুখে আতঙ্ক। দেখে মনে হলো, ফাঁসির আসামি এগিয়ে যাচ্ছে মঞ্চের দিকে! স্যারের সামনে গিয়ে ও দাঁড়াতেই আমরা একটা বিজলি চমকানোর মতো ঝলক টের পেলাম। স্যারের হাতটা খুব দ্রুত নড়ে উঠল। তারপরই সেই বিকট আওয়াজটা—চটাশ!
ধইঞ্চা শওকত স্থির হয়ে পড়ে আছে ক্লাসরুমের মেঝেতে। সম্ভবত এক থাপ্পড়েই অজ্ঞান হয়ে গেছে। আমার ঠিক পেছনে বসা আলিনূরের কল্পনাশক্তি একটু বেশি। স্পষ্ট শুনলাম, ও বিড়িবিড় করে পড়ছে ‘ইন্না লিল্লাহি...’। আমাদের হতভম্ব ভাবটা কাটিয়ে উঠতে কয়েক মিনিট লাগল। দু-তিনজন দৌড়ে গিয়ে শওকতকে উল্টিয়ে দেখি, চোখ বন্ধ করে পড়ে আছে। সিপু বলল, ‘জ্ঞান ফিরাইতে হইব। দুই গালে চটকনা দে।’ আলিনূর আঁতকে উঠে বলে, ‘না, না। এক চড়েই যে অবস্থা, আরও চড়াইলে হেষে ক্ষতি হইতে পারে।’ আমি আলিনূরকে বলি, ‘তুই তো ইন্না লিল্লাহ পইড়াই ফালাইছস, আর কি ক্ষতি বাকি থাকে?’ এতক্ষণে মুখ খোলেন সিরাজ স্যার, ‘এক জগ পানি নিয়া আয়, মাথায় ঢাল, আর চোখেমুখে ছিটিয়ে দে। জ্ঞান ফিরবে।’ দুজন দৌড় লাগাল টিচার্সরুমের দিকে। সেখান থেকে জগে ভরে পানি আনবে।
পানি আনা হলো। মাথায় ঢালা, চোখেমুখে ছিটানো হলো। কিন্তু সব চেষ্টা বিফল। শওকত আগের মতোই। আশপাশের ক্লাস থেকেও শিক্ষক-ছাত্ররা ছুটে এসেছে। বায়োলজি শিক্ষক আবদুল্লাহ স্যার বললেন, ‘আর সময় নষ্ট করার দরকার নেই। তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে যাও।’ দুজন চ্যাংদোলা করে শওকতকে ক্লাসরুম থেকে বের করছি, চেরাগ আলী মার্কেটের ক্লিনিকে নিয়ে যাব। এই সময় হাজির হলেন নূরুদ্দীন স্যার। তিনি ইংরেজি পড়ালেও প্রাথমিক চিকিৎসার ট্রেনিংও আছে। খবর পেয়ে তিনি ফার্স্টএইড বক্সসহ হাজির। শওকতকে আবার মেঝেতে শোয়ানো হলো। নূরুদ্দীন স্যার ওর চোখের পাতা টেনে পরীক্ষা করলেন, নাড়ি টিপে দেখলেন, স্টেথেস্কোপ লাগিয়ে গম্ভীরভাবে বুক পরীক্ষা করলেন। তারপর একটা নিশ্বাস ফেলে মুচকি হেসে বলেন, ‘বেশি টেনশনের দরকার নেই। অবস্থা মোটামুটি ভালো। এইখানেই দুইটা ইনজেকশন দিয়ে দেই। পাঁচ মিনিটেই জ্ঞান ফিরবে।’
আমরা চারপাশে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে। রোগীকে বাতাস পাওয়ার জন্য এই শীতকালেও ওর মাথার ওপরের ফ্যানটা চালু করে দেওয়া হয়েছে। নূরুদ্দীন স্যার সিরিঞ্জে ওষুধ ভরছেন। এই সময় শওকত একটু নড়ে উঠল। আলিনূর চিৎকার করে বলল, ‘আছে, আছে, দম আছে।’ শওকত চোখ মেলে পিটপিট করে এদিক-ওদিক তাকায়। আমরা দু-তিনজনে ধরে ওকে বসাই। নূরুদ্দীন স্যার ভরা ইনজেকশন নিয়ে এগিয়ে আসতেই শওকত বলে ওঠে, ‘তুমি আবার কেডায়? হাতে ওইডা কী? খেলনা নাকি!’ ওর কথা শুনে তো আমরা হতবাক! আবদুল্লাহ স্যার বললেন, ‘সর্বনাশ! স্মৃতিভ্রম!’
আমরা পারলে কেঁদে দিই এমন অবস্থা। হেড স্যার আমাদের বললেন, ‘অ্যাই, তোমরা সবাই সরে যাও। অযথা ভিড় কোরো না। ওকে একটু একা থাকতে দাও।’ তারপর পিতৃসুলভ গলায় শওকতকে বললেন, ‘এক গ্লাস গরম দুধ খাবে বাবা, সঙ্গে দুটো সেদ্ধ ডিম?’ শওকত নির্বিকারভাবে হেড স্যারকে জবাব দিল, ‘হ মামা, দুইটা ডিম খাইতে পারি। একটা হাফ বয়েল, আরেকটা পোঁচ। কুসুম যেন না ভাঙে। আর দুধ খামু না, একটা সেভেনআপ আনান।’
হেড স্যারকে অবলীলায় ও মামা ডাকছে দেখে আমরা আরও হতাশ হই। মাথাটা বোধ হয় পুরাই গেছে। এতক্ষণে সিরাজ মোল্যা স্যার এগিয়ে এলেন। এতক্ষণ তিনি ক্লাসরুমের এক কোণে বিমর্ষ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এবার শওকতের সামনে এসে বললেন, ‘ডিম, সেভেনআপ সবই খাইবা সোনার চান। তবে তোমার হারানো স্মৃতি ফিরাইয়া আনতে আগে আমি দুইটা থাপ্পড় দিয়া লই।’ এ কথা শুনেই তড়াক করে উঠে দাঁড়াল ধইঞ্চা শওকত। ক্ষমাপ্রার্থনাসূচক হাসি দিয়ে বলল, ‘কী যে কন স্যার, আপনের আরও দুইটা থাপ্পড় খাইলে আমার পুরা কঙ্কালটাতেই ফাটল ধরব। তার চেয়ে আজ আমারে ছুটি দিয়া দেন। ক্যামুন জানি জ্বর জ্বর লাগতাছে।’
মূল ঘটনা বুঝতে পেরে এবার আমরা সবাই হেসে উঠি। হেড স্যার হেসে এক ছাত্রকে বলেন, ‘দপ্তরি আলীকে বল ছুটির ঘণ্টা বাজিয়ে দিতে। আজ স্কুল ছুটি।’